ঘণ্টায় চার আনা৷ চব্বিশ ঘণ্টায় ছ’টাকা৷ তিনশো পঁয়ষট্টি দিনে দু’হাজার একশো নব্বই টাকা৷ একশো নব্বই টাকা ছাড়, একুনে বছরে দু’হাজার টাকা৷ না, এটা সুকুমার রায়ের ‘কাক্বেশ্বর কুচকুচের হিসেব’ নয়৷ এটি একটি কবিতা-পত্রিকার ‘গ্রাহক চাঁদার হিসেব’৷ চুয়ান্ন বছর আগে এই হিসেব কষেই প্রকাশিত হয়েছিল ‘কবিতা-ঘন্টিকী’, ‘প্রতি ঘণ্টার কবিতা-পত্রিকা’৷ বাংলা কবিতায় তো বটেই, ভূ-ভারতেই এমন উদ্যোগ ছিল সেই প্রথম৷ ২৩শে বৈশাখ ১৩৭৩ বঙ্গাব্দে, ৭ই মে ১৯৬৬ সালে সকাল দশটায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘কবিতা-ঘন্টিকী’, ‘প্রতি ঘণ্টার কাব্যপত্র’৷ সেটির প্রথম সংখ্যাতেই ছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা, ‘অধৈর্য’৷ সুনীল তখন বেশ ‘রাগী সুনীল’, সেই কবিতায় লিখেছিলেন,
‘‘আমি সেই ফুল নাম্নী মেয়েদের পাতা ছিঁড়ি দাঁতে৷
এবার তোমার মুখ আনো, আমি ঘ্রাণ নেবো একান্ত বিরলে৷’’
কবিতা ছিল, কবি ছিলেন না৷ ‘সম্পাদকমণ্ডলীতে’ নাম ছিল না সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের৷ প্রথম সংখ্যায় ছিল চারটি কবিতা৷ দুটি ‘রবীন্দ্রনাথ’ ও ‘ভারতচন্দ্র রায়ের’৷ বাকি দুটি কবিতা ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়’ ও ‘সমরেন্দ্র সেনগুপ্তের’৷ সুনীল ছিলেন, কিন্তু আত্মপ্রকাশ করেননি৷ ‘সেই মাতামাতির দিনগুলি’ নামে একটি লেখায় সুনীল স্বীকার করে গিয়েছেন তাঁর গোপনে থাকার কথা, ‘‘বিমলের (রায়চৌধুরী) দৈনিক কবিতার কার্যালয় ছিল একটি প্রেসে, আর কবিতা-ঘন্টিকী-র কার্যালয় সুশীল রায়ের কাঁকুলিয়ার বাড়িতে৷ কবিদের মধ্যে প্রায় দুটি দল ভাগ হয়ে গিয়েছিল৷ দৈনিক কবিতা-র হয়ে খাটাখাটনি করেছে শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং তারাপদ রায় প্রমুখ৷ আর কবিতা-ঘন্টিকীর সম্পাদকমণ্ডলীতে ছিলেন সুশীল রায় ছাড়াও সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, আনন্দ বাগচী, প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় ও শান্তনু দাস৷ আমি দু-দলেই ছিলাম, কিন্তু কোনও দলেই সম্পাদকমণ্ডলীতে নাম দিতে রাজি হইনি৷ কারণ, আমি তখন কৃত্তিবাস পত্রিকার সম্পাদক, আমার পক্ষে আর অন্য কোনও কবিতা পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত থাকা শোভনীয় নয়৷’’
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চরিত্রের মাধুর্যই হল একটা আলগা ছন্দ, সরল মেজাজ, নিজেকে সারাক্ষণ একটা কেউকেটা, গুরুত্বপূর্ণ মনে না-করা প্রকৃতি। তা বলে তাঁর কি ইগো ছিল না? ভয়ঙ্কর ছিল। প্রায় সত্যজিৎ রায়ের মতোই, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়র মতো। যে-অহং নিজেকে দেখানো বা অন্যকে দাবানোর জন্য নয়, বুকপকেটের সোনার ঘড়ির মতো ঘন ঘন বার করে লোক দেখানোর জন্য নয়। সে-অহং ছিল নিজের মতো রীতি ও স্বভাবকে অটুট রাখার জন্য, নিজের স্তর ও ক্ষমতাকে বেঁধে রাখার জন্য এবং স্ববিরোধ শোনালেও খুবই সত্যি, নিজের নির্জনতা, লাজুকতা ও দুর্বলতার প্রতিরক্ষার জন্য।
‘নীললোহিত’ যে রকম মানুষ ছিলেন, তাতে তাঁর কোনও স্ত্রী থাকা সম্ভব ছিল না। বোধ হয় উচিতও ছিল না। ‘নীললোহিত’ এক ‘বাউণ্ডুলে’, ঘর থেকে ঘর, পথ থেকে পথে ঘুরে বেড়ায়। সেই যে সুনীল লিখেছিলেন –
‘‘ঐ ছেলেটা মানুষ দেখলে ধুলো কাদায় ছবি আঁকবে
ধুলো কাদাই ছিটিয়ে বলবে ভালোবাসতে চেয়েছিলাম।’’
কিন্তু সেই নীললোহিতই ছিলেন সংসারী। কেমন ছিল তাঁর প্রেম-বিবাহ-সংসার? ১৪ই মার্চ ২০১৫ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘সুনীল-জায়া স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়’ জানিয়েছিলেন সেই অজানা সুনীল-নীললোহিতের কথা। তাঁর চোখ দিয়ে পাওয়া যায় অন্য এক সুনীলকে। তিনি লিখেছিলেন –
‘‘… তো, নীললোহিত হল সেই ছেলেটা। তাঁকে বিয়ে করে ঘর করতে পারবে না কোনও মেয়ে। আর দুঃসাহস করে কেউ যদি সে-কাজ করেও তাঁকে ঠকতে হবে। আমি কি ঠকেছি? উত্তরে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ দুই-ই বলতে হয় আমায়। আসলে আমি তো ঠকতেই চেয়েছিলাম (যদি অবশ্য তাকে ঠকা বলে)। নইলে কী দায় পড়েছিল দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত বাড়ির এক মেয়ের দমদমের কলোনি অবধি গিয়ে ‘কৃত্তিবাস’ সংগ্রহ করার? কী দরকার ছিল বিলেত-ফেরত সব পাণিপ্রার্থীদের বাতিল করে, একদম জিদ ধরে থাকার যে, বিয়ে করলে ওকেই আমি করব। সুনীল অবশ্য আমায় নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিল – ‘আমরা উদ্বাস্তু, আমরা খুব সাধারণ, তোমার খুব কষ্ট হবে …।’ আমি তখন ওর কোনও কথা শুনতে পেতাম না। ওর কথার ভিতরে যে না-বলা কথাগুলো কবিতা হয়ে বেরিয়ে আসত, সেগুলোই তখন আমার অন্ধকারের টর্চ।
‘ভ্রূ-পল্লবে ডাক দিলে দেখা হবে চন্দনের বনে
সুগন্ধের সঙ্গ পাবো দ্বিপ্রহরের বিজন ছায়ায়
আহা কী শীতল স্পর্শ হৃদয় ললাটে, আহা চন্দন, চন্দন
দৃষ্টিতে কি শান্তি দিলে, চন্দন, চন্দন
… ক্ষণিক ললাট ছুঁয়ে উপহার দাও সেই অলৌকিক ক্ষণ
তুমি কি অমল-তরু, স্নিগ্ধজ্যোতি, চন্দন, চন্দন …।’
পড়ে আমার তো তখন পাগল-পাগল অবস্থা। মনে হয়েছিল এ আমার জন্যই লেখা, গভীর গভীরতম বনে আমাকেই সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চাইছে লোকটা। সেই লোকটাই আমার কাছে নীললোহিত, যার সঙ্গে আমি চাইলে গাছতলাতেও থাকতে পারতাম। তবে সুনীলের জায়গায় যদি নীললোহিত থাকত, তা হলে হয়তো আমার বিয়েটাই হত না। আমি আর ফিরে আসার জায়গায় নেই, এটা বুঝতে পেরে সুনীল একটু এগিয়ে এসেছিল। আমার আর ওর বিয়ে হবে এটা মেনে নিতে পারছিলেন না, আমার যে আত্মীয়রা, তাঁদের কারও কারও সঙ্গে কথা বলেছিল। নীললোহিত হলে আদৌ সে রকম কিছু করত কি? ‘আপনাদের মেয়ে যদি অন্য কাউকে বিয়ে করে তাতে আমার কোনও আপত্তি নেই, কিন্তু সে যদি আমাকেই বিয়ে করতে চায়, তা হলে আমিও তাঁকে বিয়ে করবই’ – বলেছিল সুনীল। নীললোহিত এ সবের ধার ধারত না। উল্টে হয়তো ধলভূমগড়ে পাড়ি দিত। তবু বলব, আমি নীললোহিতকেই ভালবেসেছিলাম। আর বিয়ের পর যখন দেখতাম যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নামের লোকটা ডান হাত দিয়ে, বাঁ হাত দিয়ে (কখনও কখনও পা দিয়েও হয়তো) শুধু লেখে আর লিখে যায়, তখন আমার ভীষণ মন কেমন করত। আমি তো ওর সঙ্গে ভিজে ঘাসের ওপর হেঁটে বেড়াতে চেয়েছিলাম, ওকে আর একটু নিজের করে পেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তত দিনে সুনীল বাংলা সাহিত্যের সম্রাট হওয়ার পথে অনেকটা এগিয়ে গেছে। ওর তো চতুর্দিকে তখন ভিড় জমতে শুরু করেছে। আর যেহেতু ও চট করে ‘না’ বলতে পারত না কাউকে, তাই ওর মৌনতাকে সম্মতি ভেবে নিয়ে অনেকেই অনেক কিছু করতে শুরু করেছে। আমি ক্রমশ বুঝতে পারছিলাম যে এই রাজার ভিতরে আমি যে রাখালকে ভালবেসেছিলাম, তাঁকে খুঁজে পাওয়া দিনে দিনে কঠিন হয়ে পড়বে। আর সেই রকম একটা সময়েই ও নীললোহিতের লেখাগুলো লিখতে শুরু করল। ওই একেকটা লেখার মধ্যে দিয়ে আমি আবার প্রথম প্রেমের দিনগুলোকে ফিরে পেতে শুরু করলাম। ‘সুদূর ঝর্ণার জলে’র মারগারিটকে ভালবাসা নীললোহিত বা ‘ভালবাসা নাও হারিয়ে যেও না’র সেই ছেলেটা যে এক বৃদ্ধা ডিম-বিক্রেতা রমণীর সঙ্গে আত্মীয়তা অনুভব করে কাঁচা খেয়ে নেয় উপহার পাওয়া ডিম, আমার খুব কাছের হয়ে উঠেছিল। একটাই কথা বলতে ইচ্ছে করত নীললোহিতের একেকটা উপন্যাস পড়ে, ‘তোমার তুলনা তুমি’।
‘আমার কেউ নাম রাখেনি, তিনটে চারটে ছদ্মনামে
আমার ভ্রমণ মর্ত্যধামে,
… কেউ আমাকে শিরোপা দেয়, কেউ দু’চোখে হাজার ছি ছি
তবু আমার জন্ম-কবচ, ভালোবাসাকে ভালোবেসেছি।’
এই পঙক্তিগুলো তো আসলে নীললোহিতেরই, যদিও সে কখনও কবিতা লেখেনি। আমার একেক সময়, মনে হয় সুনীল, ‘নীললোহিত’ হয়েছিল আমারই জন্য কারণ ও বুঝতে পেরেছিল, যাঁকে ভালবেসে আমি ওর জীবনে এসেছি, তাঁর সঙ্গে খ্যাতির শিখরে উঠতে থাকা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মিল খুব কম। একটা ব্যাপারে অবশ্য খুব মিল ছিল দু’জনের মধ্যে। পকেটে দশ টাকা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো নীললোহিত যেমন উদাসীন ছিল টাকার ব্যাপারে, সুনীলও তাই। অনেক-অনেক রোজগার করলেও সুনীলকে কোনও দিন পয়সার ব্যাপারে মাথা ঘামাতে দেখিনি। বন্ধুবান্ধবদের মদ খাওয়াতে ও যত খরচ করেছে, তাই দিয়ে কলকাতায় একটা বড় বাড়ি হয়ে যায়। এ ছাড়া যে যখন বিপদে পড়ে ধার চেয়েছে, সুনীল তাঁকে ফেরায়নি। এই যে নীললোহিতের দরকারে অদ্ভুত সব সিচুয়েশনে কেউ না কেউ হাজির হয়ে যায়, আমার মনে হয়, ওরা সবাই বোধ হয়, ছদ্মবেশী সুনীল। সুনীল নিজের জীবনে যে সাহায্যগুলো পায়নি, সেগুলো অন্যদের জন্য করতে ভালবাসত। আর নীললোহিতের জন্য করবে না? সে তো ওরই আয়না। না কি আমার? মাঝে মাঝে গুলিয়ে যায়। তবে একটা কথা স্পষ্ট বুঝতে পারি যে ওর প্রেমিকারা সবাই খ্যাতিমান, জনপ্রিয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কেই পেতে চাইত। আর যাঁর আস্তানার নাম দিকশূন্যপুর, তেমন এক ভবঘুরেকে ভালবেসেছিলাম আমিই। একা আমি। আজও একা থাকলেই নীললোহিতের সঙ্গে অনেক কথা বলি। মান-অভিমানের কথা সুনীলের সঙ্গেই হয়, তবে ভালবাসার কথা বলতে গেলেই নীললোহিত সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি এক-এক সময় ভাবি যে এখন বয়স হয়েছে, এতটা উতলা হওয়া মানায় না, বিশেষ করে নীললোহিতও যখন একটা অদৃশ্য দরজার ও পারে। তখনই আমাকে চমকে দিয়ে কে যেন বলে ওঠে –
‘তোমার রূপালি অসহায় মুখ আমাকে করেছে আরও উৎসুক –
ধাক্কা মারো না! আপনি হয়তো দরজা খুলবে পলকা ও তালা …।’
সুনীলের সঙ্গে যদি নাও হয়, তো নীললোহিতের সঙ্গে এ জীবনে মুখোমুখি দেখা হবে না আর?’’
এক সময় সুনীল শুরু করেছিলেন শেক্সপিয়রের ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ অনুবাদের কাজ। কিন্তু শেষ করার আগেই থেমে গিয়েছিলেন। ঠিক এভাবেই তিনি শেষ করেননি মহাভারত লেখার কাজও। যদিও এটা সত্যি যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মহাভারত না-ধরা আর রোমিও-জুলিয়েট’ শেষ না-করা বলতে গেলে ব্যতিক্রম, কারণ তিনি নিজেই বলেছিলেন একবার, ‘‘যে কোনও লেখা শুরু হয়ে গেলে বড় একটা বাতিল করেন না। বাতিল যা হয় তা কবিতা লিখতে গিয়ে।’’ তা হলে শেক্সপিয়রের লাইন উদ্ধৃতি করে আত্মজীবনীর নাম দিয়েছিলেন কেন ‘অর্ধেক জীবন’? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের যুক্তি ছিল, শেক্সপিয়রের পঙ্ক্তির যুক্তি মেনে নিয়েই জীবনের বাজে অভিজ্ঞতাগুলো বাদ দিয়ে মনে রাখার মতো কথাগুলো লিখতে চেয়েছেন। কিন্তু যেটা তাঁর বলার অপেক্ষায় ছিল না, তা হল তাঁর বিপুল সংখ্যক উপন্যাস ও অধিকাংশ কবিতা এবং অজস্র রম্যরচনায় তাঁর তাঁর জীবনটাই ধরে রেখেছিলেন। ‘অর্ধেক জীবন’ তাঁর জীবনের কথা কতটা বলতে পেরেছে সেটা বলা দুষ্কর, তবে উপন্যাস-গল্পে নিজের জীবনের কথা চেলে চেলে আত্মজীবনীর এক বিকল্প তিনি অনেক আগেই রচনা করে ফেলেছিলেন। কিন্তু সেখানেও কি জীবনের সব ‘রটন’ (শেক্সপিয়রের ভাষায়) বা ‘বাজে’ (সুনীলদার ভাষায়) বৃত্তান্ত ছুঁয়ে যেতে পেরেছিলেন? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লেখক শ্রীপান্থর কাছে কবুল করেছিলেন, না পারেননি। বলেছিলেন, ‘‘এত প্রেমের দৃশ্য এঁকেছি, কিন্তু শরীরের সম্পর্ক দেখাতে গেলে কলম আটকে যায়। কেন? না, নিজের শরীরটাই কীরকম অস্থির হয়ে ওঠে। ওটা সাহেবরাই পারে।’’ এ প্রসঙ্গে একবার তিনি বলেছিলেন, “ভাবি, যেটা আড়ালের দিক সেটা আড়ালে রাখাটাই তো ভাল।” তাঁর খুবই প্রিয় ছিল বার্ট্রান্ড রাসেলের ‘অটোবায়োগ্রফি’, কিন্তু স্বীকার করতেন, ‘‘জীবনের সব ভাললাগা, মন্দলাগা, জয়-পরাজয়, প্রেম-ঘৃণা, উচ্চতা-নীচতা, দোষগুণ, মহত্ত্ব-ক্ষুদ্রতা, ওভাবে বলা অসম্ভব কঠিন, প্রায় অসম্ভব।’’ তাছাড়া একবার জানিয়েছিলেন, ‘‘কখনও কি ভেবেছিলাম নিজের কথা এ ভাবে কখনও ঢেলে বলতে হবে? আমার স্মৃতি খারাপ না, তা বলে সাল, তারিখ, চিঠিপত্র, দলিল দস্তাবেজ দিয়ে নিজেকে নিয়ে লেখার কথা মাথাতেই আনতে পারি না।’’ আসলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্বাভাবিক জীবনটাই একটা সময় থেকে অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছিল। দুনিয়ার সবাইকে নিজের সময় বেটে দেওয়াটা কর্ণের দান হয়নি – যা নিয়ে ‘কর্ণকুন্তী সম্বাদ’ লেখা যায় – গৌরী সেনের দান হয়েছিল। একে অক্লান্ত লেখা, সন্ধেকালে মাথা ছড়ানোর পান-আড্ডা, তার ওপর যে-চায় তাঁকেই সময় নয়তো লেখা দেওয়া। একটা সময় তাঁর আগের নিকট-বন্ধুরা অনেকটাই দূরে চলে গিয়েছিলেন, সে নিঃসঙ্গতা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ভরিয়েছিলেন তাঁর জীবনে নতুন, নতুন বন্ধু সমাগমে। যাঁদের কাছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন এক প্রতিষ্ঠান বিশেষ, সব ত্রুটির উর্ধ্বে, কোনও স্তুতিই যাঁর পক্ষে যথেষ্ট নয়। যাঁরা তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন, তাঁরা জানতেন খুব ন্যায্য প্রশংসাতেও তিনি বিব্রত হতেন, তখন তিনি এসব সহ্য করে নিয়েছিলেন। সময়ের দাসত্ব করবেন না বলে যিনি কোনও দিন ঘড়িই হাতে দেন নি (জানা যায়, তাঁর বিয়ের সময়ের ঘড়িটা এক মদের আসরে খোয়া গিয়েছিল, পরে পুলিশে রিপোর্ট করতে গিয়ে নেশার ঘোরে ঘড়ির নাম বলেছিলেন কখনও পার্কার, কখনও শেফার্স, কখনও পাইলট!), তিনিই ডাক পেলে বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতির যে-কোনও সমিতির সভাপতি, কমিটির চেয়ারম্যান বা আসরের মধ্যমণি হওয়া শুরু করেছিলেন। শেষে সাহিত্য একাদেমির সভাপতি হয়ে অজস্র সময় নষ্ট করেছিলেন হিল্লিদিল্লি করায়। যখন তিনি এসব করেছিলেন, তখনও তাঁর ভেতরে কালান্তক রোগটা বাসা বেঁধে ছিল, কিন্তু সুনীল তাতে ভয় পান নি, কাউকে জানতেও দেননি, এতটাই বীরত্ব ও সহ্যশক্তি ধারণ করতেন। তা বলে সময়টা যে বাঁধা পড়ছে, তাঁর মধ্যে এই ভয়ভাবনা থাকাটা কি ভাল ছিল না?
একবার কোন একটা উৎসব উপলক্ষ্যে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন। দুটি অপরিচিত ছেলেমেয়ে এসে তাঁকে বলেছিল, লীলা মজুমদার একবার আপনাকে দেখা করতে বলেছেন। শুনে তিনি বেশ অবাক হয়েছিলেন। লীলা মজুমদার কেন ডাকবেন তাঁকে? সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তখন তিনি ‘সন্দেশ’ পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক। সত্যজিৎ রায়ের চিঠি নিয়ে মাঝে মধ্যে সে পত্রিকায় দু’একবার লিখেছেন – কোন লেখায় কি কিছু ভুল হয়েছে? শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে একটা চেয়ারে লীলা মজুমদার বসেছিলেন। তাঁর লেখায় যত মজা ও রঙ্গরস থাকত মুখের ভাবে কিন্তু তার কিছুই দেখতে পাননি সুনীল। বরং একটু কঠোর ভাব, ভ্রু কোঁচকানো মুখ তাঁর নজরে পড়েছিল। সুনীল তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার পর তিনি বলেছিলেন, ‘‘শোন, তুমি গল্প উপন্যাস কবিতা লেখোটেখো, তা আমি কিছুই পড়িনি। তবে তুমি ছোটদের জন্য কিছু লেখালেখি করছে দেখে খুশী হয়েছি। সব লেখকদেরই শিশু সাহিত্যের সেবার জন্য খানিকটা সময় দেওয়া উচিৎ। আর শোন, এইসব লেখার মধ্যে যেন খুনোখুনি, রক্তারক্তি বেশী এনোনা।’’ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সারা জীবন তাঁর নির্দেশ মেনে চলার চেষ্টা করেছিলেন।
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় একটা কথা প্রায়ই বলতেন, ‘‘তা’ও রক্ষে, সুনীল মোটে একবেলা লেখে, দু’বেলা লিখলে সে যে কী দাঁড়াত!’’ আর কখনও কেউ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সামনে কথাটা বললে সুনীল তাঁর ট্রেডমার্ক মার্কা হাসিটা হাসতেন হুঁ হুঁ করে। এক-একবার মৃদু প্রতিবাদও করতেন, বলতেন – ‘‘তা হলে মদটা খাওয়া হত কখন?’’ দিনে একবেলা করে লিখে এবং বেড়ানোর দিনগুলোয় কোনও বেলা না লিখেও সুনীল যে সম্ভার রেখে গেছেন, তা আয়তনে ছাপিয়ে গিয়েছে রবীন্দ্র রচনাবলীকেও। শেষ দিকে এ নিয়ে কেউ কিছু বললে একটু হাসি-হাসি লজ্জা-লজ্জা ভাব আসত তাঁর মুখে।
‘‘দেখো দেখো, দেশ পত্রিকায় কবিতা বেরিয়েছে এক জনের। তাঁর নামও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়!’’ – ১৯৫০ সালে এক কিশোরী কথাগুলো বলেছিলেন, তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে। সেই কিশোরী জানতেন না তাঁর সামনে দাঁড়ানো ষোলো বছরের ছেলেটিই সুনীল। আর সেই কবিতা, ‘একটি চিঠি’ লেখা হয়েছিল সেই কিশোরীর কথা ভেবেই। তিনি জানতে পারেনি। পরে ‘কৃত্তিবাস’ নিয়ে মেতে ওঠার পর্বে তাঁর সঙ্গে সুনীলের সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়েছিল।
ছাপার অক্ষরে প্রথম কবিতা আর দ্বিতীয় কবিতার মধ্যে তিন বছরের ব্যবধান। লেখা বন্ধ ছিল না, কিন্তু ছাপতে দেননি কিছু। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্য জীবনে ওই তিনটে বছরই নীরবতার বছর। ওই প্রথম, ওই শেষ। ১৯৫৩ সালেই দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ কবিতা বেরিয়েছিল। চতুর্থটি বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় বেরিয়েছিল আর অচিরেই আবু সয়ীদ আইয়ুবের সম্পাদনায় ‘পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা’ সংকলনে নির্বাচিত হয়েছিল। ওই বছরই ছাপা হয়েছিল তাঁর প্রথম ছোট গল্প, ‘বাঘ’। এবং আত্মপ্রকাশ করেছিল ‘কৃত্তিবাস’। যার সম্পাদক ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তাঁর সঙ্গে ছিলেন দীপক মজুমদার এবং আনন্দ বাগচী। নিজেকে যে কত ভাবে ছড়িয়ে দেবেন সুনীল, ওই ঊনিশ বছর বয়স থেকেই তার দিকচিহ্নটি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
ঊনিশ থেকে আটাত্তর – এর মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শুধু বইয়ের সংখ্যাই আড়াইশোর বেশি। সম্পাদিত গ্রন্থ পঞ্চাশের অধিক। কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণসাহিত্য, নাটক, চিত্রনাট্য, শিশুসাহিত্য এতগুলি শাখায় সাবলীল বিচরণের রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকারটি তাঁর জন্যই তোলা ছিল। যৌবনে ‘রবীন্দ্র-বিরোধী’ বলে তকমা জুটেছিল যদিও। সুনীল কিন্তু পরে বলেছিলেন, তাঁর বিদ্রোহ রবীন্দ্রনাথের প্রতি ছিল না। ছিল, ‘রাবীন্দ্রিকতা’র নামে বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে।
আরও দু’টি দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরি ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বাঙালি ‘মধ্যবিত্তসুলভ কূপমণ্ডূকতা’ তাঁর স্বভাবে কোনও দিন ছিল না। সুনীল মানেই পায়ের তলায় সর্ষে। আর, সুনীল মানেই দরজা-জানলা খোলা একটা তরতাজা মন। অজস্র বিষয়ে আগ্রহ, পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে সদা সচেতন। স্পষ্টবাক, প্রায় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে নিজস্ব মতামত তা সে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়েই হোক বা রাজ্যে পরিবর্তনের হাওয়া নিয়েই হোক। ‘নীরা কে’, এই প্রশ্নটি ছাড়া আর কোনও ব্যাপারে কোনও প্রশ্নকর্তাকে কখনও নিরাশ করেননি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
ছাত্র বয়স থেকেই হুটহাট বেরিয়ে পড়তেন। জীবনের শেষ পর্যন্ত সেই বাউন্ডুলেপনা কোনও দিন থামেনি। সাঁওতাল পরগনা থেকে প্যারিস, নিউ ইয়র্ক থেকে শান্তিনিকেতন, সবেতেই ছিল সুনীলের পরম উৎসাহ। নিজেই বলতেন, লেখক হওয়ার কোনও দুরাকাঙ্ক্ষা তাঁর ছিল না। কলেজজীবনে সুনীলের স্বপ্ন বলতে ছিল একটাই, জাহাজের খালাসি হয়ে সাত সমুদ্র পাড়ি দেওয়া। খালাসির চাকরি সুনীলকে করতে হয়নি, কিন্তু বাংলা সাহিত্য ‘নীললোহিত’কে পেয়েছে। বাঙালির অভিধানে দিকশূন্যপুর শব্দটা চিরকালের মতো ঢুকে গিয়েছে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম হয়েছিল ১৯৩৪ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর। সাবেক পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলায় মাইজপাড়া গ্রামে ছিল তাঁর পৈতৃক বাড়ি। বাবা ‘কালীপদ গঙ্গোপাধ্যায়’ ছিলেন কলকাতার টাউন স্কুলের শিক্ষক। সেই সূত্রে ১৯৩৮ সাল থেকেই উত্তর কলকাতায় বসবাস শুরু করেছিলেন সুনীল। চার ভাইবোনের মধ্যে সুনীলই ছিলেন বড়। সংসারে অনটন ছিলই। সেটা আরও বেড়েছিল দেশভাগের পর। বিশাল পরিবারে কালীপদর রোজগারই ভরসা ছিল তখন। তিনি উপার্জনের চেষ্টাতেই ব্যস্ত থাকতেন। ফলে বাবার সঙ্গে সুনীলের তেমন যোগাযোগ গড়ে ওঠার সুযোগ হয়নি। সুনীলকে বই পড়ার নেশাটি তাঁর ধরিয়েছিলেন মা, ‘মীরা দেবী’।
তবে তাঁর কবিতা লেখার ক্ষেত্রে কিন্তু অনুঘটকের ভূমিকাটা বাবারই ছিল। সুনীল তখন টাউন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক দিয়েছিলেন। ছুটির ক’মাসে ছেলে যাতে বখে না যায়, সেজন্য বাবা হুকুম দিয়েছিলেন সময়টা ইংরেজি চর্চার কাজে লাগাতে হবে। টেনিসনের কবিতা অনুবাদ করে দেখাতে হবে। কিছু দিন সেটাই চলেছিল। সুনীল লক্ষ করেছিলেন, পরে তাঁর বাবা আর অনুবাদ আক্ষরিক কি না, মিলিয়ে দেখছেন না। সুতরাং নিজের ঈশ্বরীকে উদ্দেশ করে নিজেই লিখতে শুরু করেছিলেন কিছু লাইন আর সেগুলোই দেখতে দিতেন বাবাকে। এই ভাবেই তাঁর কবিতায় হাত মকসো করা শুরু হয়েছিল। সুনীল পরে লিখেছিলেন, “আমার সৌভাগ্য এই, আমার প্রথম বয়েস থেকেই আমি কোনও সাহিত্যিক গোষ্ঠীর পাল্লায় পড়িনি। আমি পূর্ববঙ্গের গণ্ডগ্রাম থেকে আগত কিশোর, কলকাতার ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম। কোনও লেখককে চোখে দেখিনি, কোনও সম্পাদককে চিনতাম না …।” ডাকযোগে লেখা পাঠানো ছাড়া অন্য উপায় তাঁর জানা ছিল না।
সিটি কলেজে অর্থনীতির ছাত্র সুনীলের তখন বন্ধু ছিলেন দীপক মজুমদার। কফি হাউস, দেশবন্ধু পার্কে আড্ডা জমে উঠত। ওদিকে কমলকুমার মজুমদারের নেতৃত্বে হরবোলা ক্লাবে নাট্যচর্চাও চলছিল। তারই মধ্যে সিগনেট প্রেস তথা দিলীপকুমার গুপ্তের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল তাঁর। ডি কে-র পরামর্শ এবং সহায়তা নিয়েই ‘কৃত্তিবাসে’র পথ চলা শুরু (শ্রাবণ, ১৩৬০ বঙ্গাব্দ) হয়েছিল। কলকাতার রাজনৈতিক আবহ তখন উত্তাল। প্রথম সম্পাদকীয়তে সুনীল লিখেছিলেন, ‘‘বিভিন্ন তরুণদের বিক্ষিপ্ত কাব্য-প্রচেষ্টাকে সংহত করলে বাংলা কবিতায় প্রাণছন্দের উত্তাপ নতুন আবেগে এবং বলিষ্ঠতায় লাগতে পারে এবং সকলের মধ্যে প্রত্যেকের কণ্ঠস্বরকেই আলাদা করে চেনা যেতে পারে।”
সম্পাদকের স্বপ্ন সত্য হয়েছিল। এক মলাটে সুনীলদের সঙ্গে লিখতে শুরু করেছিলেন সমর সেন, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তরা। পত্রিকার সপ্তম ও অষ্টম সংখ্যা উপহার দিয়েছিল আরও কয়েকটি নাম – শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, তারাপদ রায়, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় …। দ্বাদশ সংখ্যায় এসেছিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। এই তরুণ ব্রিগেড শুধু মধ্যরাতের কলকাতাই শাসন করেননি, বাংলা সাহিত্যের মোড় ঘুরে গিয়েছিল এঁদেরই লেখনীতেই। সুনীল-শক্তির এক একটা পংক্তি বাঙালির কাছে প্রবাদে পরিণত হয়েছে।
সুনীলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েক জন’ প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৫৮ সালে। ১৯৬২ সালে কলকাতায় এসেছিলেন মার্কিন কবি অ্যালেন গিনসবার্গ। সুনীলের সঙ্গে গভীর সখ্য গড়ে উঠেছিল তাঁর। পরের বছরই আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পল এঙ্গেলের আমন্ত্রণে আন্তর্জাতিক লেখক কর্মশালায় যোগ দিয়েছিলেন সুনীল। নিউ ইয়র্কে সালভাদর দালির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল তখনই। দেশে ফেরার পথে ব্রিটিশ সরকারের আমন্ত্রণে বিলেত গিয়ে স্টিফেন স্পেন্ডার এবং টি এস এলিয়টের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল সুনীলের। ফরাসি বান্ধবী মার্গারিটের সঙ্গে প্যারিস ভ্রমণ করেছিলেন তিনি। তারপর একা একাই সুইৎজারল্যান্ড, রোম, কায়রো হয়ে দমদম বিমানবন্দরে যখন পদার্পণ করেছিলেন সুনীল, তখন দেখেছিলেন তাঁর পকেটে দশ টাকা পড়ে আছে; এবং তিনি বেকার!
বেশ কয়েক বারই ছোটখাটো চাকরি করেছিলেন, আবার ছেড়েওছিলেন সুনীল। ’৭০ সাল থেকে পাকাপাকি ভাবে আনন্দবাজার পত্রিকার বার্তা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান। তার পরে দেশ-আনন্দবাজার মিলিয়ে একাধিক বিভাগের দায়িত্ব সামলেছিলেন। আনন্দবাজার পত্রিকার হয়ে চাসনালা খনি দুর্ঘটনা, ইন্দিরা গাঁধী হত্যা, বার্লিন প্রাচীরের পতনের মতো ঘটনা কভারও করেছিলেন। দু’-দু’বার আনন্দ পুরস্কার পেয়েছিলেন। চুনী গোস্বামী যেমন মোহনবাগানের, সুনীল তেমনই আনন্দবাজার সংস্থার ঘরের মানুষ। তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল ‘দেশ’-এ, প্রথম উপন্যাসও তাই। ‘আত্মপ্রকাশ’ বেরিয়েছিল ১৯৬৬ সালে। তার পর একে একে প্রকাশিত হয়েছিল ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘অর্জুন’, ‘জীবন যে রকম’, ‘যুবক-যুবতীরা’ …। তাঁর হাতে সন্তু-কাকাবাবু সিরিজ শুরু হয়ে গিয়েছিল একাত্তরে, প্রথম গল্প ছিল ‘ভয়ংকর সুন্দর’। আশির দশকে তিনি হাত দিয়েছিলেন বৃহৎ উপন্যাসে। জন্ম নিয়েছিল ‘সেই সময়’। ক্রমান্বয়ে তাঁর কলম থেকে জন্ম নিয়েছে ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘প্রথম আলো’ …।
কী পদ্য, কী গদ্য ঝরঝরে সুখপাঠ্য ভাষা, ঘরোয়া কথনভঙ্গি আর অব্যর্থ জনপ্রিয়তা, সুনীলের অভিজ্ঞান চিনে নেওয়া যায় সহজেই। দেশি-বিদেশি অজস্র ভাষায় অনুবাদ হয়েছে তাঁর লেখা। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তপন সিংহ, গৌতম ঘোষের মতো পরিচালকরা সুনীলের কাহিনি অবলম্বনে ছবি করেছেন। তাঁর গল্প থেকে একাধিক টেলি-ধারাবাহিক হয়েছে। সুনীলের নিজের চিত্রনাট্যে তৈরি ছবি ‘শোধ’ জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল। ‘সিটি অফ জয়’ ছবির মুখ্য পরামর্শদাতাও ছিলেন সুনীলই। ভালবাসতেন কবিতা পড়তে, গান গাইতে। এমনকি মঞ্চেও অভিনয় করেছিলেন। কলকাতার শেরিফ হয়েছিলেন এক বার। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপকও ছিলেন। একেবারে শেষ জীবনে সাহিত্য অকাদেমির সভাপতির দায়িত্ব সামলেছিলেন।
তাঁর মতো মজলিসি মানুষ কম দেখা যেত। তিনি অকাতরে লিখতেন। বেশি লেখা ভাল কি না, এ নিয়ে খুব একটা ভাবতেন না। নিজেকে বেশি গুরুত্ব দিতেও চাইতেন না। প্রিয় বই কী, জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ‘মহাভারত’। সেই মহাভারত লেখাতেই হাত দিয়েছিলেন। শেষ হয়নি। সুনীলও কথা রাখেননি। জীবনটা অর্ধেকই রয়ে গিয়েছিল। ২০১২ সালের ২৩শে অক্টোবর তাঁর লেখা থেমে গিয়েছিল।
অনেক তরুণ লেখক-কবিকেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আবিষ্কার করেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ পুরস্কৃতও হয়েছিলেন। অনেক লেখক-কবিই তাঁর দ্বারা আবিষ্কৃত হওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিলেন, অবজ্ঞাত হয়ে তাঁর প্রতি বিরূপও হয়েছিলেন। এহেন বিবিধ কারণে শেষজীবনে তাঁর মতো উদার এবং ভাল মানুষেরও খ্যাতির অপচয় ঘটে গিয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর এক বছর আগে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “মরে যাওয়ার আগে আমার একটাই আকাঙ্ক্ষা। এই হানাহানি, রক্তপাত, কুৎসিত ধ্বংসলীলা বন্ধ হোক।” তাঁর বিরুদ্ধে একটা বড় অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধ শিবিরের যে, তিনি সারাজীবন তাঁর খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠাকে হিসেব কষে, মেপেজোপে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন। না বলে উপায় নেই যে, এ হল হেরোদের যুক্তি। ক্লাসের ফার্স্টবয়কে কেউ বেশি পড়াশুনো ও বেশি বুদ্ধিমত্তার দায়ে অভিযুক্ত করতে পারে না। লিওনেল মেসিকে বেশি গোল বা সচিন তেন্ডুলকরকে বেশি রান করার জন্যও না। আফশোসটা হওয়ার কথা সুনীলের অনুরাগীদের। তাঁর কি একটা পদ্মভূষণ অন্তত প্রাপ্য ছিল না? কিংবা একটা জ্ঞানপীঠ? একদা এক সাক্ষাৎকারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন – “কী মনে হয় জানো, মানিকবাবুর ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র মতো একটা উপন্যাস লিখে ফেলতে পারলে সব লেখা বন্ধ করে দেব।’’ না! তিনি ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র মতো কিছু লেখেননি। পদ্মভূষণ বা জ্ঞানপীঠও পাননি। এই সব খেতাব, পুরস্কার, পদে কী এসেছিল-গিয়েছিল সুনীলের মতো লেখকের? যাঁকে রবিশঙ্করেরর মতো মানুষ ‘সেই সময়’ পড়ে ফোন করে বলেছিলেন, ‘‘অভিভূত! আপনার গালে চুমো দিতে ইচ্ছে করছে,” তাঁর আবার কী সংশাপত্র চাই কোনও সংসদ বা সমিতির?
(তথ্যসূত্র:
১- সুনীল স্মরণে, হাসান হাফিজ, মাটিগন্ধা।
২- কথায় কথায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, উজ্জ্বল কুমার দাস, প্রিটোনিয়া পাবলিশার্স।
৩- মুহূর্তকথা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, পারুল প্রকাশনী প্রাইভেট লিমিটেড।
৪- ১৪ই মার্চ ২০১৫ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় সুনীল-জায়া স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় প্রদত্ত সাক্ষাৎকার।
৫- অর্ধেক জীবন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
৬- জীবন যে রকম, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত