পানিপথের প্রথম যুদ্ধে জিতে দিল্লীর মসনদের দখল নিয়েছেন জহিরুদ্দিন মহম্মদ বাবর। তবে আর্যাবর্তে বিস্তীর্ণ অংশ তখনও তাঁর নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বস্ত সেনাপতি মির বাকিকে অওধ আর রোহিলাখণ্ডে সেনা অভিযানের দায়িত্ব দিলেন প্রথম মুঘল সম্রাট। ১৫২৭ সালে অওধ দখল করলেন বাকি। পরের বছর তাঁর মনিবের নামে সরযূ নদী পাড়ে বানালেন তিন গম্বুজওয়ালা এক মসজিদ। বাবরি মসজিদ যা ঘুরিয়ে দিল রাজনীতির মোড়।
বলা হয় বাবরির জমিটি বিতর্কিত। উনবিংশ শতকের ব্রিটিশ নথিতে অবশ্য অযোধ্যায় ওই বিতর্কিত জমিতে দুই সম্প্রদায়ের ধর্মাচরণ সম্পর্কে তথ্য রয়েছে। ১৮৫৭ সালের শেষ পর্বে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের পরে বিতর্কিত জমিকে দু’টি অংশে ভাগ করে লোহার বেড়া দিয়ে ঘিরে দেয় ব্রিটিশ সরকার। ভিতরের অংশ মুসলিমদের এবং বাইরের অংশ হিন্দুদের ধর্মাচরণের জন্য নির্ধারিত হয়। ১৮৭৭-এ বিতর্কিত জমির অন্দরে অবস্থিত ‘রাম চবুতরা’-য় হিন্দু পুণ্যার্থীদের প্রবেশের জন্য তৈরি হয় পৃথক পথ। উত্তর দিকে সীতা কি রসুই হয়ে।
বিতর্কিত জমি ও মসজিদের মালিকানা নিয়ে শিয়া এবং সুন্নিদের মতবিরোধ গড়ায় আদালতে। ১৯৪৬ সালে ফৈজাবাদ জেলা আদালতের বিচারক এস এ এহসান রায় দেন, ‘সম্রাট বাবর সুন্নি ছিলেন। তাই জমি সুন্নিদের প্রাপ্য’। যদিও মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা মির বাকি ছিলেন শিয়া।
স্বাধীনতার পরে নতুন মাত্রা পায় বাবরি সঙ্ঘাত। ১৯৪৯ সালের ২২ ডিসেম্বরের গভীর রাতে মসজিদের মূল গম্বুজের নীচে রামলালার মূর্তি স্থাপন করা হয়। মন্দির-পন্থীদের দাবি, রামলালা প্রকট হয়েছেন। পরের দিন ফৈজাবাদ জেলার অযোধ্যা পুলিশ স্টেশনের অফিসার ইন-চার্জ পণ্ডিত রামদেও দুবে ওই ঘটনায় একটি এফআইআর দায়ের করেন অভিরাম দাস, রামসকল দাস, সুদর্শন দাস-সহ প্রায় ৬০ জনের বিরুদ্ধে। ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৪৭ (দাঙ্গা), ৪৪৮ (অবৈধ প্রবেশ), ২৯৫ (উপাসনাস্থলের অসম্মান) ধারায় অভিযোগ আনা হয়।
রামমন্দির নিয়ে নতুন করে অশান্তির সূচনা প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীর জমানায়। ১৯৮৬-র ২৫ জানুয়ারি ভক্তদের রামলালার দর্শনের অনুমতি দেওয়ার জন্য ফৈজাবাদ আদালতে আর্জি জানান আইনজীবী উমেশচন্দ পাণ্ডে। ১ ফেব্রুয়ারি ফৈজাবাদের জেলা বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট কে এন পাণ্ডে রামলালা দর্শনের জন্য ভক্তদের সুযোগ দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। হিন্দু পুণ্যার্থীদের জন্য খোলা হয় বিতর্কিত জমির প্রবেশপথের তালা।
এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া হয় মুসলিম সমাজে। ১৯৮৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি, দিল্লির জামা মসজিদের ইমাম বুখারি এবং সৈয়দ সাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত হয় বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি। বিতর্কিত জমিতে মসজিদের দাবিতে আন্দোলনের প্রস্তুতিও শুরু হয়।
১৯৮৯-সালের নভেম্বরে বিতর্কিত এলাকার বাইরে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের শিলান্যাস অনুষ্ঠান হয়। সেখান থেকেই রামমন্দির আন্দোলনের ‘মুখ’ হিসেবে আবির্ভাব লালকৃষ্ণ আডবাণীর। ১৯৯০-এর ২৫ সেপ্টেম্বর গুজরাতের সোমনাথ মন্দির থেকে অযোধ্যার উদ্দেশে রামরথ যাত্রা শুরু করেন আডবাণী। তাঁর ঘোষণা, ৩০ অক্টোবর অযোধ্যা পৌঁছে করসেবার মাধ্যমে রামমন্দির নির্মাণের সূচনা করবেন। কিন্তু ২৩ অক্টোবর বিহারের মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ সমস্তিপুরে রথ আটকে আডবাণীকে গ্রেফতার করেন।
অযোধ্যায় জমায়েত রামভক্তেরা অবশ্য ৩০ অক্টোবর বিতর্কিত জমিতে করসেবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিংহ যাদবের নির্দেশে সেই চেষ্টা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। সরকারের হিসেবে পুলিশের গুলিতে ১৬ জন করসেবকের মৃত্যু হয়।
লখনউয়ে বিজেপি সরকার গঠনের পরেই অযোধ্যায় করসেবার জন্য নতুন করে তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। ১৯৯২ সালের ২৭ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা জমা দিয়ে করসেবার অনুমতি দেওয়ার আবেদন জানায় কল্যাণ সরকার। বাবরি মসজিদের নিরাপত্তার আশ্বাসও দেওয়া হয়। বিতর্কিত এলাকার বাইরে করসেবার অনুমতি দেয় শীর্ষ আদালত। ৬ ডিসেম্বরের করসেবার উপর নজরদারির জন্য পর্যবেক্ষক নিয়োগ করে সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু প্রশাসনের আশ্বাসে ফল মেলেনি। করসেবক ও রামভক্তেরা ঢুকে গুঁড়িয়ে দেন বাবরি মসজিদ। উত্তরপ্রদেশ প্রশাসন ও পুলিশ মসজিদ রক্ষায় কোনও তৎপরতা দেখায়নি বলে অভিযোগ ওঠে।