জানা যায় তিনি পড়তেন কিন্তু খুব, যাকে বলে ভোরাশিয়াস রিডার। তাঁর বিপুল পড়াশোনার কথা লিখে গিয়েছেন লীলা মজুমদার থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ১৯৮৮ সালের ৩রা মে, যেদিন তিনি না ফেরার দেশে চলে গেলেন, ঠিক তার এক মাস পরে, ৪ঠা জুনের ‘দেশ’ পত্রিকায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন তাঁর দৃষ্টিক্ষীণতার মধ্যেও ‘অদম্য পাঠতৃষ্ণা’র কথা। ম্যাগনিফায়িং গ্লাস দিয়ে পড়তেন, পরে মাইনে করা লোক রেখেছিলেন, যে তাঁকে বই-পত্রপত্রিকা পড়ে শোনাত। সুনীল লিখেছিলেন প্রেমেন্দ্রের বয়ান: ‘‘না পড়ে যে পারি না! পৃথিবীটাকে এখন আর ভালো করে দেখতে পাই না, এইসব লেখাপত্তরের মধ্য দিয়েই পৃথিবীটাকে দেখি।’’ আলস্য তখন কোথায়, আবার লেখালিখির ইচ্ছে। আন্দাজে কলম ধরে, পরে ডিক্টেশন দিয়ে লিখতেন। আর খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা লিখেছিলেন সুনীলের গঙ্গোপাধ্যায়, ‘‘সাধারণত প্রবীণ লেখকরা পরবর্তী প্রজন্মের রচনা বিশেষ পড়েন না। প্রেমেনদা সব সময়ই সাম্প্রতিক সাহিত্যের খুঁটিনাটি খবর রাখতেন।’’
চিরকালই নিজের শর্তে বেঁচেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। তাঁর সাহিত্যকৃতিও একক, স্বতন্ত্র। বলা যাবে না যে তিনি ‘অমুকের মতো’ লিখতেন। রবীন্দ্রধারার বিপরীতে ‘কল্লোল যুগ’, এ রকমটা সাহিত্যের ইতিহাসে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রেমেন্দ্র মিত্র কিন্তু লিখে গিয়েছেন আসল কল্লোল-কথা –
![এমন মিত্র আর কে আছে!----রানা চক্রবর্তী 2 WhatsApp Image 2020 09 04 at 15.42.04](https://ekhonkhobor.com/wp-content/uploads/2020/09/WhatsApp-Image-2020-09-04-at-15.42.04-875x1024.jpeg)
‘‘বহু বিচিত্র অমিলকে মেলাবার একটি পতাকা’ ছিল ‘কল্লোল’, ‘সেখানে মিল ছিল না শৈলজানন্দ আর অচিন্ত্য সেনগুপ্তের লেখায়। বুদ্ধদেব আর যুবনাশ্ব ছদ্মনামে মণীশ ঘটক সম্পূর্ণ ভিন্ন কলমে লিখত। আমার সঙ্গে অজিত দত্তের কোনো মিল ছিল বলে মনে হয় না। তবুও পটুয়াটোলা লেনের দোতলার ছোট্ট একটি ঘরে আমরা কী এক প্রচণ্ড গভীর আকর্ষণে মিলিত না হয়ে পারতাম না।’’
পরে সাক্ষাৎকারেও বলেছিলেন, ‘‘আমরা কবিতা লিখেছি, কিন্তু আন্দোলন করিনি। কবিতার আন্দোলন বলে কিছু নেই। আসল কথা, কবিতায় যা বলা হয়নি, তা-ই বলব। ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা রাখব। যে-যার ক্ষমতা অনুযায়ী বাহাদুরি নেব; আন্দোলন করে নয়।’’
সাহিত্যে অশ্লীলতা নিয়ে যখন সে যুগে সমাজমন তোলপাড়, তখন প্রেমেন্দ্র মিত্র উচ্চারণ করেছিলেন শুধু একটি অমোঘ বাক্য, ‘আশঙ্কাটা সাহিত্যের অশ্লীল হয়ে ওঠা নিয়ে নয়, অশ্লীলতার সাহিত্য সাজবার চাতুরি ও স্পর্ধা দেখে।’ বলিষ্ঠ কলমের মানুষটা কত কিছু যে লিখেছেন – ছোট গল্প, উপন্যাস, গান, কবিতা, ছড়া, কৌতুক, রম্যরচনা, গোয়েন্দা কাহিনি, বিজ্ঞান-সাহিত্য, প্রবন্ধ, চিত্রনাট্য। বাংলা সাহিত্য তাঁর কাছে গ্রীষ্মে ছায়া, ঝড়বাদলে ত্রাণ, শীতে ওম পেয়েছে।
‘‘আত্মপ্রচারের অহমিকা থেকে নয়, অত্যন্ত অপরাধীর মতো সঙ্কোচভরে আমি স্বীকার করছি যে আমি অত্যন্ত কুঁড়ে … কেজো লোকেরা আমার নামে মুখ বিকৃত করে, বন্ধু-বান্ধবেরা হতাশার নিশ্বাস ফেলে, অনুরাগী যে দু’চারজন আছে তারা বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়ে … সম্পাদকেরা আমার কাছে সময়মতো লেখা পায় না, বন্ধু-বান্ধবেরা পায় না চিঠির জবাব। সদিচ্ছার আমার অভাব নেই – চিঠি পেলেই তার জবাব দেবার জন্য উৎসুক হই, কিন্তু লেখাটা বেশির ভাগ সময়ে মনে মনেই হয়, কলমের মুখে কাগজ পর্যন্ত পৌঁছোয় না।’’ – কথাগুলো লিখেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র।
লেখার ব্যাপারে সত্যি কুঁড়েমি ছিল তাঁর। কালীঘাটের বাড়িতে প্রায়ই দেখা যেত, তিনি লিখতে লিখতে উঠে পায়চারি করছেন, ভাবছেন। আবার গিয়ে বসছেন লেখায়। লিখতে বসলে কিন্তু কিছু খেয়াল থাকত না। চেয়ার-টেবিলে লিখতেন না। যে খাটে শুতেন, তার তলায় একটা তোরঙ্গ থাকত। সেটা টেনে তার উপরে বসতেন। আর একটা ম্যাসোনাইট বোর্ড ছিল, সেটা খাটে রেখে তার উপরে কাগজে লিখতেন। ছোট্ট ছোট্ট, পরিষ্কার অক্ষরে।
প্রেমেন্দ্র মিত্র! ‘কল্লোল’, ‘কালি কলম’-এর ছোট গল্প লেখক, বুদ্ধদেব বসু-সমর সেনের সঙ্গে ‘কবিতা’ পত্রিকা সম্পাদনা করা প্রেমেন্দ্র মিত্র। ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’-এর স্রষ্টা, ‘ফেরারী ফৌজ’, ‘সাগর থেকে ফেরা’র কবি। ‘পথ বেঁধে দিল’, ‘কালো ছায়া’, ‘হানাবাড়ি’র মতো ছবির পরিচালক, ‘ওরা থাকে ওধারে’র গীতিকার-চিত্রনাট্যকার, আনন্দ পুরস্কার থেকে সাহিত্য অকাদেমি, নেহরু অ্যাওয়ার্ড থেকে দেশিকোত্তমে বন্দিত সাহিত্যিক। মামাবাবু, পরাশর বর্মা বা অমর ঘনাদার মতো চরিত্রের, দুর্দান্ত বিজ্ঞান-সাহিত্যের জিয়নকাঠি যাঁর হাতে, সেই প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখতে চাইতেন না?
‘‘লোকে সোনার চামচ-রুপোর চামচ মুখে নিয়ে জন্মানোর কথা বলে, আমি তো ‘প্লাটিনাম টাং’ নিয়ে জন্মেছিলাম,’’ বলতেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। তাঁর দাদামশাই যখন মারা যান, তাঁর দিদিমার কাছে নাকি ষাট হাজার টাকার সোনার গয়না আর আশি হাজার টাকার কোম্পানির শেয়ার ছিল! কিন্তু তাঁর আত্মীয়পরিজনরা সব লুটেপুটে খেয়ে নিল। কালীঘাটে আদি গঙ্গার ধারের বাড়ি, যার পাঁচ হাজারও দাম হয় না, আত্মীয়রা কিনিয়েছিল ২৫ হাজার টাকা দিয়ে! প্রেমেন্দ্র বড় হয়ে দেখলেন, পড়ে আছে মোটে পাঁচ-দশ হাজার টাকা। সেও এক ফুটবলার বন্ধু ধার নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। জীবন শুরু করতে হয়েছিল পেনিলেস অবস্থা থেকে।
জীবনানন্দে ভাটা পড়েনি তাতে। স্মৃতিকথা ‘নানা রঙে বোনা’র পাতায় পাতায় সে জীবন পড়ে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। উত্তরপ্রদেশের রুখুসুখু মির্জাপুরে রেল হাসপাতাল কম্পাউন্ডে তারের বেড়ায় ঘেরা শৈশব, বিংশ শতাব্দী শুরুর দশকে। পেশায় ডাক্তার দাদু ‘রাধারমণ ঘোষ’কে লোকে বলত সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি। বসন্ত রোগে তিনি মারা যাওয়ার পর মির্জাপুরের পাট চুকিয়ে পাড়ি দিতে হয়েছিল, ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের লুপ লাইনের ছোট্ট স্টেশনে, বীরভূমের নলহাটি। রেলের ওয়াগনে বাক্সপ্যাঁটরা পোঁটলাপুঁটলির সঙ্গে তিনি নিয়ে এসেছিলেন বিরাট একটা পাথরের চাঁই! মির্জাপুরের স্মৃতি। সেই পাথর পরে কলকাতার বাড়ির প্রাঙ্গণেও স্থান পেয়েছিল। তারপরে ভবানীপুরে সাউথ সুবার্বান স্কুলে ভর্তি হওয়া, বন্ধু হয়েছিলেন উদ্দাম প্রাণশক্তির এক ছেলে – দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী। ভবিষ্যতের অনন্য ভাস্কর-চিত্রকর দেবীপ্রসাদের সঙ্গেই গড়ের মাঠে বায়োস্কোপ দেখা, বড় আর বেপরোয়া হওয়ার স্বাদ। এরই মধ্যে জীবনে এসেছে বই। জুল ভার্ন, চার্লস ডিকেন্স, এমনকী ইঙ্গারসোলও! ইস্কুলে কিন্তু সেই ছেলেই নীলডাউন হয়ে থাকত। এক দিন পণ্ডিতমশায়ের হঠাৎ চোখে পড়ল, প্রেমেন্দ্র খাতায় কবিতা লিখেছেন। কী আশ্চর্য, বকেননি, বরং নীলডাউন থেকে তুলে বেঞ্চিতে ফেরত পাঠিয়েছিলেন।
এক জীবনে কত কিছু করা যায়? কত কী পড়া যায়? চোদ্দো বছর বয়সে ‘ফার্স্ট ক্লাস’-এ উঠে গিয়েছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। কিন্তু ষোলো না হলে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়া যাবে না। খুব ভাল রেজাল্ট ছিল, হেডমাস্টারমশাই প্রেমেন্দ্রকে বিদেশে পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর ইচ্ছে ছিল, ফুটবল খেলবেন মন দিয়ে। পরে ঠিক করেছিলেন, ডাক্তার হবেন। গোড়ায় স্কটিশে আর্টস নিয়ে, পরে আশুতোষ কলেজে (তখন নাম সাউথ সুবার্বান কলেজ) সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। ১৯২২, স্বাধীনতার আন্দোলন জমাট বাঁধছে তখন। তখন ইচ্ছে পাল্টাল আবারও, এবারে ঠিক করলেন কৃষিবিদ্যা শিখবেন। পোঁটলায় দু’-একটা জামাকাপড় বেঁধে শ্রীনিকেতন চলে গেলেন। বললেন – আমি পড়তে চাই, কিন্তু টাকা দিতে পারব না। ভর্তি হওয়া গেল। ভোর পাঁচটায় উঠে কাজ শুরু হত। প্রতি ছাত্রের জন্য তিন কাঠা জমি বরাদ্দ ছিল, একটা ফসল ফলাতে হবে তাতে। জল বয়ে আনা, মাটি খোঁড়া, সার দেওয়া, বীজ লাগানো। শীতের রাতে ফিতের খাটিয়ায় একটি মাত্র কম্বল জড়িয়ে শোওয়া। তোশক, বালিশ নেই, জানালা খোলা! এক বার ‘আমিষ বনাম নিরামিষ’ নিয়ে বিতর্ক হল। বিশ্বভারতীর নামকরা ছাত্র, রবীন্দ্রস্নেহধন্য ও পরবর্তী কালের প্রখ্যাত লেখক-অধ্যাপক সেখানে নিরামিষ নিয়ে বললেন। প্রেমেন্দ্র বললেন আমিষ নিয়ে। নিজের স্মৃতিকথায় প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছেন – ‘‘নিরামিষ বন্দনাটা যথার্থ আন্তরিক না হওয়ায় মাননীয় অতিথি খুব বেশি সুবিধে করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ক্ষুদে দুর্বাসার মতো বেশ যেন একটু রুষ্ট হয়েই চলে গিয়েছিলেন বলে মনে পড়ছে।’’
তারপরে শ্রীনিকেতন ছেড়ে চলে এলেন। এ বার ডাক্তারি পড়তে চলে গেলেন ঢাকা শহরে। সেখানে ভর্তির ক্ষেত্রে ঢাকার ছেলেদের অগ্রাধিকার ছিল, পরে অন্য ছেলেদের। জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হলেন সায়েন্স নিয়ে। ছুটিতে মাঝে মাঝে কলকাতা আসতেন। তখন প্রেমেন্দ্র থাকতেন কাশীতে, কলকাতার বাড়ির প্রায় পুরোটাই ভাড়া দেওয়া ছিল। তাই কলকাতায় এসে ২৮ নম্বর গোবিন্দ ঘোষাল লেনে এক মেসে উঠতেন। সেখানেই এক শনিবার ছুটির দিনে, ফাঁকা মেসবাড়ির ঘরের কুলুঙ্গিতে বোর্ডারদের ডাঁই মালপত্র আর কাগজের বান্ডিলের মধ্যে আবিষ্কার করলেন একটা পোস্টকার্ড। কোন এক গ্রামের মেয়ে সংসারের সব খবর জানিয়ে চিঠি লিখেছেন। ‘বৌমার আজো জ্বর এসেছে, দেখতে দেখতে দুমাস হয়ে গেল। ঘুষ ঘুষে জ্বর ত’ কিছুতেই সারে না …’ চিঠি পড়ে কী মনে হল, সেই রাতেই দুটো গল্প লিখে ফেললেন প্রেমেন্দ্র। পরদিন সকালে ভবানীপুর পোস্ট অফিসে গিয়ে ‘প্রবাসী’র ঠিকানায় পাঠিয়েও দিলেন। ঢাকায় ফিরে মাসের পর মাস হস্টেলের রিডিং রুমে ধুকপুকুনি সমেত ‘প্রবাসী’র দিকে নজর ছিল। নেই নেই, কিছু নেই! হঠাৎ এক দিন ডাইনিং হলে এক বন্ধু তাঁকে জানালেন, ‘‘এ মাসের ‘প্রবাসী’তে প্রকাশিত একটা গল্পের লেখকের নাম হুবহু তোমার যা, তা-ই!’’
সেই শুরু। ‘প্রবাসী’তে পর পর দু’মাসে দুটো গল্পই বেরিয়েছিল – ‘শুধু কেরাণী’ আর ‘গোপনচারিণী’, লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্র। একবার বড়দিনের ছুটিতে কলকাতায় আসাতে বন্ধু অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত জানালেন, এহ বাহ্য, ‘কল্লোল’ নামে একটা সাহিত্যপত্রিকায় ‘শুধু কেরাণী’ নিয়ে বারো পাতা প্রশংসা-প্রবন্ধ বেরিয়েছে, ‘গোপনচারিণী’ নিয়েও চার পাতা! জানা গেল, সেই পত্রিকার বয়স মোটে দুই। কিন্তু এরই মধ্যে সেখানে কাজী নজরুল ইসলাম, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়-সহ তরুণ সুলেখকদের লেখা জ্বলজ্বলে! আলাপ হল ‘কল্লোল’-সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশ ও গোকুলচন্দ্র নাগের সঙ্গে, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ছেলের জন্মদিনে ‘কল্লোল’-এর সবাইকে ডেকেছিলেন তাঁর হুগলির বাড়িতে। হইহল্লা, খাওয়াদাওয়া। ছাদে আবৃত্তি চলছিল একের পর এক। সেখানে শৈলজানন্দ উসকে দিলেন প্রেমেন্দ্রকে, ‘‘তোমার নিজের কবিতা আবৃত্তি করো!’’ নজরুল অবাক, প্রেমেন কবিতা লেখে? নজরুল কবিতা শুনে দীনেশ দাশকে বলেছিলেন, ‘‘তুমি এদের কবিতা ছাপো না, দীনেশদা?’’
তখন ‘পাঁক’ উপন্যাস লিখেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, এক দিন একটা পোস্টকার্ড এসে হাজির। পত্রলেখক শিবরাম চক্রবর্তী। উপন্যাসের প্রভূত প্রশংসা সেই চিঠিতে। শিবরামের সঙ্গে দেখাও হল অপ্রত্যাশিতভাবে, ম্যাডান সিনেমায় (এখনকার ‘এলিট’) নির্বাক ছবির সবচেয়ে সস্তা টিকিটের সিটে। ‘ওয়রলিট্জার অর্গান’ বাজনা বসানো হয়েছে তখন। হলের ছাদ ফুটো করে মস্ত চোঙা বসাতে হয়েছিল। সেই সঙ্গীত নিয়ে আলাপ শুরু। আলাপ থেকে বন্ধুত্ব। যে বন্ধুত্ব সাহিত্যের কূল ছাপিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছিল দু’জনের জীবনকে। এক বার যখন ঢাকায় আছেন, শিবরাম চক্রবর্তী চিঠি লিখে পাঠালেন, ‘কলকাতা এস, তোমার চাকরি হয়ে গেছে।’ চাকরি! কই, ইন্টারভিউ-টিউ তো দিইনি কিছু! অফিসের ঠিকানায় পৌঁছে প্রেমেন্দ্র শুনলেন আর এক গল্প। অফিসার বলছেন, ‘‘আরে মশাই, পাবলিসিটি অফিসারের পদে বেছেবুছে লোক ডেকে বললাম, কাল থেকে জয়েন করো। তো সে ছেলে বলছে, আমি তো জয়েন করব না! করবে আমার বন্ধু, প্রেমেন! তা হলে তুমি কে?’’ আমি শিবরাম চক্রবর্তী! শিবরাম ইন্টারভিউ দিয়ে গিয়েছেন, কিন্তু চাকরি করবে তাঁর বন্ধু প্রেমেন মিত্তির। প্রেমেন্দ্র মিত্র সেই বিজ্ঞাপন-অফিসে চাকরি করেওছিলেন কিছু দিন। শিবরাম প্রেমেন্দ্রকে বার বার বলতেন সিনেমাপাড়ার জন্য গল্প দিতে। প্রেমেন্দ্র এড়িয়ে যেতেন। এক দিন ঘটনাচক্রে স্টুডিয়োপাড়ার এক জনের কাছে যেতে তিনি বললেন, ‘‘আপনার পাঠানো গল্প পড়লাম। কিন্তু ওই জায়গাটা বুঝতে পারলাম না, ওই যে মেয়েটা দার্জিলিং গিয়ে একটা পার্টিতে সবাইকে চ্যালেঞ্জ করে হঠাৎ বিবস্ত্র হয়ে গেল …’’ প্রেমেন্দ্র তো আকাশ থেকে পড়লেন, ‘‘আমি তো লিখিইনি ছাই কিছু সিনেমার গপ্পো, তার উপরে এ সব কী!’’ পরে শোনা গিয়েছিল, শিবরাম ‘প্রেমেন লিখেছে’ বলে একটা গল্প সেই লোকটির কাছে জমা দিয়ে গিয়েছিলেন! যখন দেখা হল, তখন শিবরামকে প্রেমেন্দ্র চরম বকাঝকা করবেন বলে রাগে ফুঁসছেন। শিবরাম বললেন, ‘‘তুমি নিজে পাঠাবে না, তাই আমি নিজে একটা গল্প লিখে তোমার নামে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। তা ছাড়া সিনেমায় তো সবই হয়। তুমি তো পরে সে সব বদলে দিতে পারতে!’’ প্রেমেন্দ্র লিখে গিয়েছেন, ‘‘খোদ শিব্রামকে আমার মতো কেউ বোধ হয় চেনে না, এ আমার একটা অহঙ্কার।’’
রসরাজ শিবরাম চক্রবর্তীকে বাদ দিয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্রকে বোঝা বা তাঁর জীবনকে বোঝা অসম্ভব। শিবরাম চক্রবর্তী’র সাথে প্রেমেন্দ্র মিত্রের আচমকাই পরিচয় হয়েছিল এক সিনেমা হলে। শিবরামের আবার রোজ একটি করে সিনেমা না দেখলে খাবার হজম হত না। তো, পরিচয়ের একটু পরেই দু’জনের গল্প এমন তুঙ্গে উঠেছিল যে সিনেমা দেখা মাথায় উঠেছিল। শিবরাম তখন ওই সিনেমা হলেরই সিটে বসে প্রেমেন্দ্রকে নিয়ে মানসভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছিলেন। এই দেশ ওই দেশ ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। প্রেমেন্দ্র মিত্রও হাঁ করে শুনেছিলেন। মোটামুটি কোন কোন দেশ ঘুরতে যাওয়া হবে তার খসড়া তৈরি হয়েছিল। তখন প্রেমেন্দ্র জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘কিন্তু এত দেশ যে ঘুরব দু’জনে টাকা কই?’’ শিবরামের উত্তর ছিল, ‘‘আরে লাখ টাকার মামলা ঠুকেছি ভায়া। জিতলাম বলে। ওই টাকা হাতে পেলেই বেরিয়ে পড়ব দুই বন্ধুতে।’’
হ্যাঁ, সত্যিই শিবরাম সেবার এক লাখ টাকার মামলা ঠুকেছিলেন তাঁর পৈতৃক সম্পত্তির দাবিতে। যাকে বলে একেবারে শিব্রামীয় মামলা। শিবরামের পক্ষে উকিল ব্যারিস্টার কেউ ছিলেন না। শিবরাম নিজেই সব ছিলেন। প্রমাণ বলতে ছিলেন একজন সাক্ষী। আর সেই সাক্ষী কে? যাঁর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছিলেন স্বয়ং তাঁকেই নিজের পক্ষের সাক্ষী বানিয়েছিলেন শিবরাম। তাঁর এতই বিশ্বাস যে সাক্ষী মিথ্যে বলবেনই না। এ দিকে যা অবশ্যম্ভাবী, তাই-ই ঘটেছিল। আদালতে দাঁড়িয়ে সেই প্রতিপক্ষ তথা সাক্ষী বলেছিলেন, ‘‘ধর্মাবতার শিবরামবাবুর এই অভিযোগ সবটাই মিথ্যে এবং ভিত্তিহীন।’’ ব্যস, সাক্ষীর একটি কথাতেই পুরো মামলা খারিজ হয়ে গিয়েছিল।
প্রেমেন্দ্র মিত্র আর শিবরাম চক্রবর্তীর বন্ধুত্ব – এই নিয়েই অস্ত একটি বই লিখে ফেলা যায়। শিবরাম তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড ‘ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা’তে লিখেছেন, “পৃথিবীতে বড় বয়সের বন্ধু বলে কিছু হয় না। বন্ধু হয়, সেই ছোটবেলায় স্কুল কলেজে পড়বার সময়। তার পর হয় এনিমি বা নন-এনিমি। এই নন-এনিমি দেরই আমরা বন্ধু বলে ধরি।” তবে, প্রেমেন্দ্রের ব্যাপার আলাদা। শিবরাম প্রায়ই বলতেন, “প্রেমেনের মতো মিত্র হয় না।”
এক বার, এক রেস্তরাঁয় বসে খাওয়াদাওয়া করছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, হেমেন্দ্রকুমার রায়, কাজী নজরুল এবং শিবরাম। স্নেহের আবেগে জাপ্টে ধরে হঠাৎ হেমেন্দ্রকুমার প্রেমেনের গালে একটা চুমু খেয়ে বসেছিলেন। সেটা দেখে শিবরাম লিখেছিলেন,
“গল্প না বৎস, না কল্পনা চিত্র
হেমেন্দ্র চুম্বিত প্রেমেন্দ্র মিত্র।”
প্রেমেন্দ্র তাঁর প্রথম প্রকাশিত ছোটগল্পের বই ‘পুতুল ও প্রতিমা’ উৎসর্গ করেছিলেন শিবরামকে। সেই প্রসঙ্গে শিবরাম লিখেছিলেন, “অনেকদিন পরে ‘পুতুল ও প্রতিমা’র দ্বিতীয় সংস্করণ বেরুল সিগনেট থেকে। তার একখানা কপি হাতে পেতে পাতা উল্টে দেখি, বইটা আমার নামেই উৎসর্গ করা। এ কী! আমি অবাক হয়ে গেলাম দেখে। ‘তোমার প্রথম বইটা আমাকেই দিয়েছ দেখছি’, গদগদ কণ্ঠে তাকে বললাম। ‘সে কি! তুমি জানতে না?’ সে শুধালো। ‘না, এই দ্বিতীয় সংস্করণ বের হবার পর টের পেলাম’, আমি বলি – ‘দ্বিতীয় সংস্করণটাই দিয়েছ বুঝি আমায়? প্রথম সংস্করণটা কাকে দিয়েছিলে?’ ‘কেন? তোমাকেই তো! তুমি জানতে না?’ সে হতবাক। ‘বইয়ের প্রথম সংস্করণ একজনকে, দ্বিতীয় সংস্করণ আরেকজনকে – এরকম দেওয়া যায় নাকি! … আশ্চর্য! বইটা বেরুবার দিনই তো দিয়েছিলাম তোমায়, তোমার বাসায় গিয়ে, মনে নেই? বইয়ের মলাটও উলটে দেখনি নাকি!’ ‘উলটে দেখার কী ছিল? তোমার সব লেখাই তো মাসিকে বেরুনোর সঙ্গে সঙ্গেই পড়া। একবার নয়, বারবার। সেই সব জানা গল্প আবার নতুন করে জানতে যাবার কী আছে – তাই কোন কৌতূহল হয়নি আমার।’ … মনে পড়ল তখন। হাতে পেয়ে বইটার মলাট দেখেই খুশি হয়েছিলাম। মলাটের পাতা উলটে আরও বেশি খুশি হবার সৌভাগ্য আমার ঘটেনি যে, সেটা আমার ললাট। প্রেমেনের বই তখন লোকের হাতে হাতে চলত, তাই মনে হয়েছিল এই দুর্যোগের দিনে এটাকেও হাতে হাতে চালিয়ে দিই এই সুযোগে। সঙ্গে সঙ্গে এম সি সরকারে গিয়ে বেচে দিয়ে এসেছিলাম বইটা।”
প্রেমেন্দ্রের ‘পাতালে পাঁচ বছর’ বইটি প্রকাশিত হওয়ার কিছু পরেই শিবরাম লিখেছিলেন, ‘পাতালে বছর পাঁচেক’ গল্পটি। এতে তিনি লিখেছিলেন – “… তখনই বারণ করেছিলাম গোরাকে সঙ্গে নিতে। ছোট ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে কোনো বড় কাজে যাওয়া আমি পছন্দ করিনে। আর ঐ অপয়া বইখানা। প্রেমেন মিত্তিরের ‘পাতালে পাঁচ বছর’! যখনই ওটা ওর বগলে দেখেছি, তখনই জানি যে, বেশ গোলে পড়তে হবে …” নিবিড় অন্তরঙ্গতা থাকলে, তবেই না প্রেমেন মিত্তিরের মতো সাহিত্যিকের সাহিত্য নিয়ে এমন মশকরা করা যায়!
প্রেমেন্দ্র মিত্র ১৪টা ছবি পরিচালনা করেছিলেন নিজের কোম্পানি ‘মিত্রাণী’র ব্যানারে। অনেক ছবির গল্প, চিত্রনাট্য, গান লিখেছেন। ধীরাজ ভট্টাচার্যকে ডাবল রোলে নিয়েছিলেন ‘কালো ছায়া’ ছবিতে। তখন আজকের মতো ক্যামেরা, প্রযুক্তি কোথায়! লেন্সের অর্ধেকটা ঢেকে শুট করলেন একটা চরিত্রের ধীরাজ ভট্টাচার্যকে, তার পর বাকি অংশ দিয়ে আবার অন্য চরিত্রটার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ‘পথ বেঁধে দিল’ খুব নাম করেছিল। সবিতা বসু, ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ী সান্যাল বাড়িতে আসতেন। প্রেমেন্দ্র কন্যার বিয়েতেও এসেছিলেন চিত্রতারকারা। তিনি উত্তমকুমারকে বলেছিলেন, তুমি এলে তো ভিড়ে সব ভেঙে পড়বে। সারা সপ্তাহ সিনেমা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। বিরাট একটা গাড়ি ছিল, হাম্বার সুপার স্নাইপ। এক জন ড্রাইভার ছিল, তিনশো টাকা মাইনে, সঙ্গে থাকা-খাওয়া। তখন দশ টাকায় এক গ্যালন, মানে সাড়ে চার লিটার পেট্রল পাওয়া যেত। প্রেমেন্দ্রর গাড়ির জন্য রোজ কুড়ি টাকার পেট্রল কেনা হত। সেই তিনিই ছবি করা ছেড়ে আবার লেখালিখিতে ফিরে এসেছিলেন। সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হয়েছিল, সিনেমায় যখন গেলেনই, আবার ফিরে এলেন কেন? প্রেমেন্দ্র মিত্র বলেছিলেন, ‘‘ফিরে এলাম বলেই তো আমাকে আবার সাহিত্যে পেলে!’’
তা বলে টাকাপয়সার প্রতি টান তাঁর কোনও দিনই ছিলনা। একবার তাঁর কন্যার টাইফয়েড হল। এ দিকে টাকা নেই। তখন একটা কবিতা লিখলে পাঁচ টাকা পাওয়া যেত। তার মূল্য তখন অনেক, তবু তাতে চিকিৎসা হয় না। তাঁর দুই বন্ধু – শিবরাম চক্রবর্তী ও বিভাস রায়চৌধুরী – দেখা করতে এসে চুপি চুপি টাকা গুঁজে রেখে যেতেন। প্রেমেন্দ্র ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিক ম্যাগাজিন নিয়মিত রাখতেন। জমে থাকা সেই ম্যাগাজিনের কপি বিক্রি করে তাঁর কন্যার চিকিৎসা হয়েছিল। তাঁর শখ তেমন কিছুই ছিল না। সকালে চা আসত ট্রে-তে করে, পাতলা লিকার। আলাদা করে লেবু, চিনি। রবিবার রেসের মাঠে যেতেন মাঝেসাঝে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখে গিয়েছেন, ‘বুদ্ধদেব বসু তাস খেলা দু’চক্ষে দেখতে পারতেন না, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ব্রিজ খুব প্রিয়।’
রবিবার তাঁর বাড়িতে সাহিত্যের আড্ডা বসত। সেখানে সিনেমার স্থান নেই। এক দিন আড্ডা চলছে, তার মধ্যেই কেউ এলেন, একটা ছবির গান লিখে দিতে হবে। প্রেমেন্দ্র প্রথমে ‘না’ করে দিলেন। পরে আড্ডার মধ্যেই বসে বসে পাঁচ মিনিটে একটা গান লেখা সারা! পাঠিয়েও দিলেন। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত বসে কফি আর চুরুট খেতেন। তিনি ‘পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ’ লিখছেন যখন, তখন ও সব খাওয়াও বন্ধ করেছিলেন। রবিবারের আড্ডায় শ্রীরামকৃষ্ণকে নিয়ে অনর্গল বলে যেতেন অচিন্ত্যকুমার। তিনি চলে যাওয়ার পর কেউ কেউ টিপ্পনী কাটলে প্রেমেন্দ্র মিত্র বলতেন, ‘‘তোমরা কেউ কোনও কথা বলবে না। ও যখন বলছিল, তখন তো বলতে পারোনি! এটা তো ওর প্রতিভা, ও এমন ভাবে বলছে যে, তোমরা সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছ!’’
বাংলা সাহিত্যের আর একটি অতি জনপ্রিয় চরিত্র প্রেমেন্দ্র মিত্রের অনবদ্য সৃষ্টি ‘ঘনাদা’। তিনিও থাকতেন মেসবাড়িতে। তাঁর পুরো নাম ‘ঘনশ্যাম দাশ’। ঘনাদার কথায় ইয়োরোপের লোকে চেনে ‘ডস’ বলে। মেসের সদস্যরা তাঁকে ডাকত ঘনাদা বলে। ঘনাদা জমিয়ে যে গল্প ফাঁদেন তা বাঙ্গালির ট্রেড মার্ক গুল মারা হলেও সে সব গল্পের ভিত্তিতে আছে কল্প-বিজ্ঞান, আছে ভুগোল, আছে ইতিহাস। এ সব গল্প শুধু বাগাড়ম্বর নয়। গল্পের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে ঘনাদার পাণ্ডিত্য, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, আর উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয়। বাংলা সাহিত্যে ঘনাদার আবির্ভাব ঘটে ১৯৪৫ সালে। দেবসাহিত্য কুটির থেকে প্রতি বছর একটি করে ছোটোদের জন্যে পুজাসংখ্যা বেরোতো। প্রতি বছর সে পত্রিকার একটি নতুন নাম দেওয়া হত। সে বছর নাম ছিল ‘আলপনা’। গল্পের নাম ছিল ‘মশা’। প্রথম গল্পেই জানা গিয়েছিল ঘনাদা একটি মেসের চিলেকোঠায় থাকেন। ঘনাদা ধুমপায়ী, ভোজনবিলাসী, স্বভাবে কিঞ্চিৎ আয়েসী, চেহারা লম্বা, গায়ের রঙ কালো। সেই মেসবাড়িতে থাকতেন চার বাসিন্দা ‘শিবু’, ‘শিশির’, ‘গৌর’ আর ঘনাদার গল্পের কথক ‘সুধীর’। প্রথম গল্পে সেই মেসবাড়ির ঠিকানা না জানা যায়নি। তাঁর ষষ্ঠ গল্প ‘টুপি’তে জানা যায় সে মেসবাড়ির ঠিকানা ‘৭২ নং বনমালী লস্কর লেন’।
বনমালী নস্কর লেনের বাসিন্দা ঘনশ্যাম দাস, যে চরিত্রের জন্যই প্রেমেন্দ্র মিত্র অমরত্বের দাবিদার, সেই ঘনাদার গল্পগুলিকে লীলা মজুমদার বলেছেন, ‘বিজ্ঞানের একেকটি সার্থক পাঠ’। তাঁর নিজের চোখে দেখা, প্রেমেন্দ্র মিত্র ‘ঘরের মধ্যে তক্তাপোশে গোটা চারেক এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা খুলে, একটা নিচু মোড়ায় বসে ঘনাদার নবতম অভিযানের গল্প লিখছেন। বৈজ্ঞানিক তথ্যে পাছে কোনো ভুল বা বিচ্যুতি ঢুকে যায়, তাই সতর্কতার আর যত্নের শেষ নেই।’ হাতি ধরার গল্প ‘ঝড়ের কালো মেঘ’ লেখার আগে পড়েছিলেন হস্তায়ুর্বেদ পুঁথি। তাঁর ‘কুহকের দেশে’কে ‘বাংলায় প্রথম সার্থক বিজ্ঞানভিত্তিক কিশোর উপন্যাস’ বলেছিলেন লীলা মজুমদার। স্মৃতিচারণ করেছিলেন আকাশবাণীতে একসঙ্গে অনুষ্ঠান প্রযোজনার দিনগুলির। ‘রঙমশাল’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটা অসমাপ্ত গল্পের কথা তুলে প্রেমেন্দ্র প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ‘‘এটা দু’জনে মিলে শেষ করলে কেমন হয়?’’ তারুণ্যে অচিন্ত্যকুমার-প্রেমেন্দ্র একসঙ্গে বই লিখেছিলেন, ‘বাঁকালেখা’। প্রেমেন্দ্র-লীলার সেই অসমাপ্ত গল্পও পূর্ণ হয়েছিল।
যখন তিনি খুব অসুস্থ, তখনও বিছানায় শুয়ে ‘ঘনার বচন’ লিখেছিলেন। ‘এক যে ছিল রগরগে বাঘ, দগদগে তার সারা গায়ে ঘা।’ মনে হয় যেন তিনি নিজের শরীরের কথাই যেন লিখেছেন। ক্যানসারের যন্ত্রণা তিনি কি বোঝেননি? কিন্তু কাউকেই বলেননি কিছুই। ‘দেশিকোত্তম’ নেবেন বলে বিশ্বভারতী গিয়েছিলেন, ’৮৮ সালের জানুয়ারি মাসে। স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা আসছিল, অটোগ্রাফের খাতা এগিয়ে দিচ্ছিল, প্রেমেন্দ্র মিত্র তৎক্ষণাৎ এক-একটা ছ’আট লাইনের কবিতা লিখে দিচ্ছিলেন এক-এক জনকে! ফিরে আসার পর ডাক্তার দেখানো হল। বেরিয়াম এক্স-রেতে ধরা পড়ল, পেটটা এতটুকু হয়ে গিয়েছে, রোগ এত ছড়িয়ে পড়েছে। শেষে ৩রা মে চলে গেলেন।
‘কুঁড়েমি মানে তো মনের শূন্যতা নয়, অসীম রহস্যে ডগমগ মনের নিথর নিটোল পূর্ণতা’, লিখেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। বাংলা সাহিত্য আশ্রয় পেয়েছিল তাঁর মনের নিথর নিটোল পূর্ণতার কাছে।
(তথ্যসূত্র:
১- শতবার্ষিকী সংকলন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ।
২- বাংলা ছোটগল্পের সূচনা এবং প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুরজিৎ দাশগুপ্ত, দে’জ পাবলিশিং।
৩- বাংলা ছোটগল্পের তিন নক্ষত্র: বনফুল-প্রেমেন্দ্র মিত্র-নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, শীতল চৌধুরী, প্রজ্ঞা বিকাশ।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত