উত্তমকুমার ছিলেন মোহনবাগানপ্রেমী। আর সুচিত্রা সেন ইস্টবেঙ্গল সমর্থক। শ্যুটিংয়ের ফাঁকে মোহন-ইস্ট নিয়ে তাঁদের মধ্যে চলত খুনসুটি। ১৯৬০ সালে সপ্তপদীর শ্যুটিংয়ে তাঁরা দুই প্রধানকে নিয়ে জড়িয়ে পড়েছিলেন এক মজার ঘটনায়। ওই ছবিতে ভারতীয় চিকিৎসকদের সঙ্গে বিদেশি চিকিৎসকদের ফুটবল ম্যাচের দৃশ্য ছিল। মহানায়িকা ছিলেন গোরাদের সমর্থক। চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মণিকোঠায় সেই ঘটনা আজও নিশ্চয়ই অক্ষয় হয়ে রয়েছে। মোহন বাগান-ইস্ট বেঙ্গল এজমালি মাঠে সেই ম্যাচের শ্যুটিং হয়েছিল। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই জানেন না যে, সেই সময় এরিয়ানের দিকটি ছিল সবুজ-মেরুনের। একই মাঠে দুই প্রধানের অনুশীলন চলত। গা ঘামানোর পরে উমাপতি কুমার-আমেদ খানরা একসঙ্গে ঠান্ডা পানীয়ে গলা ভেজাতেন। যাক সে কথা। ফেরা যাক সপ্তপদীর শ্যুটিংয়ে। ১৯৬০ সালে মরশুম শুরুর মুখে মোহনবাগান গিয়েছিল ইস্ট আফ্রিকা সফরে। তাঁবুও বন্ধ। তাই উত্তম কুমার দ্বারস্থ হলেন ইস্ট বেঙ্গল ফুটবল সচিব মন্টু বসুর। মহানায়কের অনুরোধে তিনি খুলে দিয়েছিলেন ইস্টবেঙ্গল তাঁবু। মন্টুবাবুর উদ্যোগেই রেঞ্জার্সের অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ফুটবলারদের নিয়ে আসা হল ব্রিটিশ চিকিৎসক দলের হয়ে অভিনয়ের জন্য। শ্যুটিংয়ের দিন ডাকা হল তুলসীদাস বলরামকে। শ্যুটিংয়ের জন্য আনা সাদা জার্সি ইস্ট বেঙ্গলের তৎকালীন কর্তা সুধাময় দাশগুপ্ত তুলে দিয়েছিলেন রেঞ্জার্সের খেলোয়াড়দের হাতে। আর উত্তমকুমারের দলকে দেওয়া হল লাল-হলুদ জার্সি। কিন্তু মহানায়ক তা পড়তে চাইলেন না। তিনি বিকল্প জার্সি নিয়ে আসার অনুরোধ করলেন। শেষ পর্যন্ত ময়দান মার্কেটে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হল সুধাময়বাবুকে। কিন্তু তিনি এক মতলব আঁটলেন। সাইকেল নিয়ে ময়দান মার্কেটে না গিয়ে ডালহৌসি ঘুরে খালি হাতে ফিরলেন। জানালেন, ময়দান মার্কেটের সব দোকান বন্ধ। ইস্ট বেঙ্গল জার্সিই পরে শ্যুটিং করতে হবে উত্তমকুমারকে। যা শুনে হতাশ হলেন মহানায়ক। তিনি কিছুতেই তা গায়ে তুলতে রাজি নন। ইউনিটের লোকজনদের উত্তমবাবু বললেন, শ্যুটিং প্যাক-আপ করতে। এদিকে, উত্তমের টালবাহানায় তখন ভীষণ চটে গিয়েছেন সুচিত্রা সেন। তাঁর মেক-আপ হয়ে গিয়েছিল। পরিচালকের কাছে জানতে চাইলেন, উত্তমকে ঘিরে জটলা কেন? মহানায়িকার বক্তব্য ছিল, ‘‘জার্সি নিয়ে দড়ি টানাটানি অযৌক্তিক। ২০ মিনিট অপেক্ষা করছি। নইলে শ্যুটিং করব না।’’ কাজ হয়েছিল সেই হুমকিতেই। অনিচ্ছা সত্ত্বেও লাল-হলুদ জার্সি গায়ে চাপিয়েই অভিনয় করেছিলেন উত্তমকুমার। প্রসঙ্গত বলে রাখা প্রয়োজন, সপ্তপদী সিনেমায় মহানায়কের বল কন্ট্রোলের দৃশ্যে ছিলেন তুলসীদাস বলরাম।
একবার উত্তম পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বললেন, ‘‘আমাদের মরশুমি ক্লাবের সঙ্গে টেকনিসিয়ান্স স্টুডিয়ো একটা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলবে। মামা, তোমাকেও খেলতে হবে।’’ কথাটা যেখানে হচ্ছিল সেখানে তখন ছিলেন শ্যামল মিত্র, রতু মুখোপাধ্যায়, ভূপেন হাজরিকারা। সকলে শুনে হইহই করে উঠলেন। ফুটবল খেলার প্রস্তাবে মুখ শুকিয়ে গেল পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের! বললেন, ‘‘আমি!’’ নাছোড় উত্তম! শেষে সাহস দিলেন শ্যামল মিত্র। সেই ম্যাচ হয়েছিল এক রবিবার সকালে মহমেডান স্পোটিং মাঠে। উত্তম হয়েছিলেন ক্যাপ্টেন। পুলক লিখছেন, ‘‘খেলা আরম্ভ হল। শ্যামল, উত্তম, রতু সুনীল বেশ ভালই খেলা জানত। … আমিও ওদের সঙ্গে অহেতুক দৌড়োদৌড়ি করতে লাগলাম। একবার আমার কাছে বল এল। মেরে দিলাম একটা শট। বল কোথায় দেখতে পাচ্ছি না। উত্তম পাশেই ছিল। বুঝতে পেরে হো হো করে হেসে আমায় বললে, ‘মামা ওই যে বল। স্কাইং হয়ে গেছে!’ …’’ সে দিন ‘মরশুমি’ ক্লাব জিতেছিল। উত্তমকুমারের একটি থ্রু শিল্পী শ্যামল মিত্র আলতো করে এগিয়ে দিয়েছিলেন সুরকার রতু মুখোপাধ্যায়ের দিকে। রতু বলটা সোজা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন জালে। সেলিব্রেট করতে সকলে হাজির ময়দান থেকে গঙ্গার ধারে। সেখানে ইলিশ কিনে ভবানীপুর, মরশুমি ক্লাব। মনে মনে সেই তখনই বুঝি পুলক লিখে ফেলেছিলেন উত্তম অভিনীত ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবির সেই বিখ্যাত গান, ‘সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল!’
উত্তম-সুচিত্রা জুটির প্রথম হিট চলচ্চিত্র ছবি কোনটি? এই প্রশ্নের উত্তরে যে কোন চলচ্চিত্রপ্রেমী চোখ বুজে বলে দেবেন ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ – যার পরিচালক ছিলেন নির্মল দে। সেই ছবিতে প্রধান আকর্ষণ ছিলেন কিন্তু তুলসী চক্রবর্তীই। উত্তমকুমার সেখানে কার্যত ব্রাত্য। টাইটেল কার্ডে বড় করে নাম ছিল তুলসী আর মলিনা দেবীর। তাঁদের থেকে একটু ছোট হরফে সুচিত্রা সেন। নিজের কেরিয়ারের শুরুর দিকের যে গল্প বলতে গিয়ে উত্তমকুমার নিজেই লিখেছেন, ‘‘ছবির বিজ্ঞাপনে প্রথম যে কথা ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল প্যারাডাইস চিত্রগৃহে বাংলা ছবি। দ্বিতীয় আকর্ষণ ছিল তুলসী চক্রবর্তী অভিনীত একটি ছবি। নায়ক হিসেবে আমার কোনও হদিসই রইল না বিজ্ঞাপনের কোথাও। আমি নগণ্য, আমি সামান্য।’’ উত্তম-সুচিত্রার উপস্থিতিতেও সেই ছবির প্রাণ ভোমরা ছিল তুলসী-মলিনা জুটিই। উত্তম-সুচিত্রা দু’জনেই পরে স্বীকার করেছেন, ‘‘সাড়ে চুয়াত্তর ছবির আসল নায়ক-নায়িকা তুলসী-মলিনা।’’ ছবির সমালোচনাতে সেই সময়কার একটি পত্রিকা লিখেছিল, ‘‘তুলসী চক্রবর্তী, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, মলিনাদেবী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সুচিত্রা সেন যেটুকু সুযোগ পেয়েছেন তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন।’’ কিন্তু ‘রামপ্রীতি’ উত্তমকুমারকে তৎকালীন সমালোচনায় গ্রাহ্যই করা হয়নি। যদিও সেই ছবি দিয়েই উত্তম-সুচিত্রা জুটির জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল।
‘‘আমার চারপাশে ঘন অন্ধকার। নিকষ কালো অন্ধকার। অথচ আমি দাঁড়িয়ে আছি একটি আলোকিত বৃত্তের মধ্যে। … কিন্তু আমি জানি, এই আলো এই উজ্জ্বলতা কিছুই দীর্ঘস্থায়ী নয়। যে কোনও মুহূর্তে নিভে যেতে পারে। … আমাকে নিক্ষেপ করতে পারে আরও গভীর, গভীরতর অন্ধকারে। … এই … অন্ধকারের ওপারেই আছে আলোর জগৎ। … এক দিন সেই আলোর জগৎ থেকেই আমি এসেছিলাম। এসেছিলাম অনেক অন্ধকার পেরিয়ে। …’’ – কথাগুলো তাঁরই। তত দিনে তিনি শুধুই নায়ক নন, প্রায় মহানায়ক। ১৯৬৮ সাল। ‘শাপমোচন’, ‘সাগরিকা’, ‘পথে হল দেরী’, ‘হারানো সুর’ পেরিয়ে প্রায় সওয়া শো’রও বেশি ছবি করে ফেলেছিলেন। তবু, ফেলে আসা জীবনের জলজ্যান্ত সংলাপ লিখতে বসে এতটাই ভাবাবেগ ছিল তাঁর!
‘‘মনে পড়ছে, আস্তে আস্তে সব মনে পড়েছে। কী দুঃসহ অপমান লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে সে দিন।’’ তখন নরেশ মিত্রর ‘বৌঠাকুরাণীর হাট’-এর কাজ চলছিল। তাঁর হাতে এসেছিল অন্য আর একটি ছবি। জানিয়েছিলেন, ‘‘বাজারে কিছু নাম-ধামও হয়েছে। কনট্র্যাক্ট ফর্মে সইটুকু কেবল বাকি। ছবির মহরতের দিন ঠিক হল। আমাকে দিয়েই মহরত দৃশ্যটি গ্রহণ করা হবে। যথা সময়ে স্টুডিয়োতে গিয়ে দেখলাম আমার জায়গায় মেকআপ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন আর একজন শিল্পী। ক্ষোভে দুঃখে অপমানে চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এসেছিল। লজ্জায় কারও দিকে তাকাতে পারিনি। আস্তে আস্তে বেরিয়ে এসেছিলাম সেখান থেকে।’’
এক লাঞ্ছনার কথা লিখতে বসে আরও এক লাঞ্ছনা মনে পড়ে যেত মহানায়কের। অনেক পরীক্ষার পরে কোনও একটি ছবিতে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সে বারও কনট্র্যাক্ট ফর্মে সই করার মুহূর্তে খবর পেয়েছিলেন, ‘‘আমার সইয়ের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। আমার থেকেও অনেক বড় একজন শিল্পীকে তাঁরা রাজি করিয়েছেন। এত দিন তাঁর সঙ্গে বনছিল না বলেই এঁরা দয়া করে আমায় সুযোগ দিয়েছিলেন।’’
অপমান! এ ভাবেই। বারবার। তবু থেমে যাননি। এক দরজা থেকে ধাক্কা খেয়ে অন্য কারও কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন – ‘‘দয়া করে সুযোগ দিন। আমায় প্রমাণ করতে দিন আমি অযোগ্য নই।’’
লিখতে লিখতে এক-এক সময় উঠে এসেছিল অভিমান, অনুযোগও। সহশিল্পীদের জন্য। শুধু প্রযোজকদের দোষ দিয়ে কী লাভ! অন্যের সঙ্গে কথা পাকা হয়ে গেছে জেনেও এক জন শিল্পী কী করে সেই একই ছবির অফার ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো প্রসন্নচিত্তে নিয়ে ফেলেন – অবিশ্বাস্য লেগেছিল তাঁর! ভদ্রতা হিসেবেও তো জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল, কেন বাদ পড়লেন তিনি! লিখছেন, ‘‘এখানে যে যার নিজের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু এ ভাবে কত দিন চলবে? সৌমিত্র, অনুপ, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে এগজিবিটররা বয়কট করতে চাইছে, তাতে উত্তমকুমারের কী ক্ষতি! তাকে তো আর বয়কট করেনি কেউ। তবে কী দরকার তার ও সব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে? এই সহজ সরল কথাটা তো একটা শিশুতেও বুঝতে পারে। কিন্তু উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায় বুঝতে পারছে না কেন? তাঁকে যে দিন দরজা থেকে দরজায় মাথা কুটে, অপমান আর লাঞ্ছনা সর্বাঙ্গে মেখে ফিরে আসতে হয়েছে, সে দিন তো কেউ তার জন্য মাথা ঘামায়নি।’’
নিজের লেখায় তিনি কখনও ফিরে গিয়েছিলেন প্রথম দিনে – ‘‘তুমি বিয়ে করতে এসেছ। তোমাকে মেরে ভাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভাল করে বুঝে নাও, কেমন?’’ – প্রথম বার ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর আগে পরিচালকের মুখে এমন কথা শুনে বেজায় ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন – ‘‘ওরা আমাকে খুব জোরে মারবে না তো?’’ শুনে ফ্লোরের সকলের কী হাসি! পরিচালক বলেছিলেন – ‘‘না, না, এটা বাস্তব না। একে বলে সিনেমার মার।’’
যে ছবি নিয়ে এই কথাগুলো সেটা হিন্দি ছবি ‘মায়াডোর’। কোনদিন মুক্তি পায়নি। কিন্তু সে-ছবিতেই প্রথম বার সুযোগ এসেছিল। একস্ট্রা-র পার্ট। দিনে পারিশ্রমিক পাঁচ সিকে। তখনও তিনি পোর্ট কমিশনার্সের চাকুরে ছিলেন অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। লিখেছিলেন, ‘‘পর পর পাঁচ দিন শ্যুটিংয়ে আসতে হল। আর ওই ক’টা দিন আমার মাস-মাইনের অফিসটা নির্দ্বিধায় কামাই করে ফেললাম।’’
তখন তাঁর বাড়ির নীচের তলায় থাকতেন ‘গণেশদা’। গণেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। বেতার নাটকের নিয়মিত অভিনেতা। তাঁর জন্যই ‘মায়াডোর’-এ সুযোগ পেয়েছিলেন উত্তমকুমার। ‘গণেশদা’ সিনেমায় নামছেন শুনে আব্দার করে বসেছিলেন, ‘‘আমার একটা চান্স হবে না? একটু চেষ্টা করে দেখো না, গণেশদা।’’ আবদার শুনে উত্তমের গণেশদা বলেছিলেন – ‘‘তুই পার্ট করবি? … এক কাজ কর, কালই ভারতলক্ষ্মী স্টুডিয়োতে চলে আয়। আমি থাকব, দেখি কী করা যায়।’’ এর পরেই ‘যায় যাবে যাক প্রাণ না কেন যদি হরি পাই’ বলে ট্রামে চেপে, উত্তমকুমার সোজা ভারতলক্ষ্মীতে চলে যান। ছেলে সিনেমা করবে শুনে, মা প্রাণ ভ’রে আশীর্বাদ করেছিলেন। আর গৌরী? তখন তিনি ‘গৌরীরানি গঙ্গোপাধ্যায়’। ল্যান্সডাউনের বিখ্যাত ধনী চণ্ডীচরণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে। রমেশ মিত্র গার্লস স্কুলের ছাত্রী। সবে প্রেমের মুকুল ফুটেছে। তবুও উত্তমের মনে হয়েছিল, গৌরীরও তো অনুমতি নেওয়া দরকার। স্কুলের সামনে দেখা করতেই চুপি চুপি গৌরী তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘তুমি বাড়ি যাও, আজ আমি তোমাদের বাড়ি যাব।’’ এর পর তাঁরই লেখা থেকে জানা যায় – ‘‘আমি ভারাক্রান্ত মনে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। অপেক্ষায় রইলাম গৌরী আসবে, আমার দীর্ঘ প্রতীক্ষা। গৌরী সে দিন কথা রেখেছিল। সোজা চলে এসেছিল আমার কাছে। কাছে এসে লজ্জাবনত মুখে দাঁড়াল। … বললাম, ‘আমি সিনেমায় নামছি। তোমার মত কী গৌরী?’ বড় বড় দু’টো চোখ আমার ওপর রেখে বলল, ‘বেশ তো, এতে আবার আমার মতামত কী?’ সেই মুহূর্তে কোনও লজ্জা আমাকে ভর করেনি। কোনও সঙ্কোচ বোধ করেনি। আবার বললাম, ‘গৌরী বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে ভালবাসি, আর ভালবাসি বলেই তোমার মতামত আমার একান্ত দরকার।’ গৌরী হাসল। প্রাণখোলা মিষ্টি হাসি। সে হাসি উচ্ছ্বাসের হাসি নয়। হাসতে হাসতে বলল, ‘তুমি সিনেমায় নামলে আমি খুশি হব বেশি।’ …’’
এরপরে সময় গড়িয়েছে। এক সময় দিনে ছবি, তো রাতে থিয়েটার। পরের পর অভিনয়। আকাশ ছোঁওয়ার নেশা ধীরে ধীরে এতটাই! এক দিকে পর্দায় ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘পথে হল দেরী’, ‘সবার উপরে’, ‘সাগরিকা’, ‘শিল্পী’, ‘চন্দ্রনাথ’ … সাফল্যের পর সাফল্য। অন্য দিকে মঞ্চে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে জুটি বেঁধে তৈরি ‘শ্যামলী’ মৃতপ্রায় বাংলা থিয়েটারে ‘ফেনোমেনন’ হয়ে উঠল। এর পরও আকাঙ্ক্ষা থামার নয়। একের পর এক ধাপ পেরিয়ে উঁচু, আরও উঁচুতে উঠতে চাওয়াতে ছাড় নেই কোনও! তিনি লিখেছিলেন, ‘‘কেন জানেন? ছোট হয়ে ঢুকেছিলাম, কিন্তু সমালোচনা পেয়েছিলাম বিরাট। যে দেখে সেই গালাগাল দেয়। বলে, ‘এ আবার কোথা থেকে এল? হটাও ঝুটঝামেলা!’ … আজকাল এই ধরনের একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়, ‘দ্য মোমেন্ট আই স হিম, আই নিউ আ গ্রেট অ্যাক্টর হ্যাজ অ্যারাইভড!’ আসলে কিন্তু ‘আই ডিড নট অ্যারাইভ। আই পুশড মাইসেলভ ইন!’ … আমি, আমিই নিজেকে তুলে ধরেছি, কেউ না। আমি একাই।’’
পেরিয়ে আসা অমসৃণ সড়কের দিকে ফিরে তাকিয়ে নিজের আহত, ক্ষতবিক্ষত শরীরটা দেখে পাহাড়-ফাটা হুঙ্কার যেন! জিতে আসা মহাসৈনিকের মতো। নায়কোচিত। আবার এই নায়কেরই শক্তপোক্ত মনটা কোথায় যেন চুর চুর করে ভেঙে পড়ে, যখন তিনি লেখেন, ‘‘শ্যামলী নাটককে সফল করে তুললাম। অনেক রেকর্ড হল। কিন্তু আমি কী পেলাম? একটা বিশ্রী গুজব যে আমি নাকি গোপনে কোনও নায়িকাকে বিয়ে করেছি! বাইরে অশান্তি – সবাই জিজ্ঞেস করে, এ কী করেছ তুমি? ঘরে অশান্তি!’’ শেষ নয় এখানেই! রটে গিয়েছিল উত্তমকুমার একা কিছু নয়। সুচিত্রা আছে বলেই তাঁর এত কিছু। লিখছেন, ‘‘শুনে শুনে ভুল বোঝাবুঝির উপক্রম হত। ভাবতাম জুটি ভেঙে দেব, একলাই অভিনয় করব। এখানেও আকাঙ্ক্ষার তাড়না। সুচিত্রা ছা়ড়া অনেক অভিনয় হল। … রটনার মৃত্যু হল।’’
শুধুই আকাঙ্ক্ষা? তারই কারণে বারে বারে চড়াই টপকে টপকে যাওয়া? নিজেই স্বীকার করেছিলেন, হয়তো শুধুই তা নয়। তার চেয়েও আরও কিছু। বৈচিত্র খোঁজাটা আসলে জীবনে শেষ কথা হয়ে উঠেছিল তাঁর প্রত্যেকটি ধাপে। তার মধ্যেই বোধ হয় বেঁচে থাকার রসদ কুড়িয়ে নিতে নিতে এগিয়েছেন। লিখেছিলেন, ‘‘বৈচিত্র না থাকলে মানুষ বাঁচে না। বৈচিত্র ছিল না বলেই মেরিলিন মনরো আত্মহত্যা করেছে। গ্ল্যামারের একঘেয়েমি থেকে উদ্ধার করে কেউ যদি ওকে বৈচিত্রের সন্ধান দিতে পারত, ও আত্মহত্যা করত না। বেঁচে থাকত। একঘেয়েমি ওর জীবনের আকাঙ্ক্ষাকে নষ্ট করে দিয়েছিল। তাই ও কোনও দিন বিচার করেনি আকাশ কত উঁচু।’’
বৈচিত্রকে হারিয়ে ফেলার ছটফটানি কতটা যে তাঁকে গলা টিপে ধরত, নিজেই বলেছিলেন তা’ও! – ‘‘একই টাইপের ছবিতে অভিনয় করতে বাধ্য হচ্ছি আমি আজও। আমার দেবার ক্ষমতারও তো একটা সীমা আছে। আজ বারবার মনে হচ্ছে – তথাকথিত রোমান্টিক শিল্পী হিসেবে আমি নিঃশেষ হয়ে গেছি। ইচ্ছে হয়, ভাল ছবিতে ভিন্ন ধরনের চরিত্রে প্রাণ দিয়ে অভিনয় করার, কিন্তু সে পরিচালক কই? গল্প কই? সুযোগ কই?’’
১৯৬০ সালে সাদা কালো অক্ষরে ক্লান্ত, বীতশ্রদ্ধ মহানায়কের এমনই স্বর শোনা গিয়েছিল। মনে মনে ‘মুক্তি’ খুঁজতে চাইছিলেন তখন। এর বছর পাঁচ-ছয় বাদেই সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’। প্রাণ ফিরে পেয়েছিলেন যেন মহানায়ক! বলেছিলেন – ‘‘আমি আমাকে এক নতুন ভূমিকায় খুঁজে পেলাম। মুক্তি হল আমার।’’
‘নায়ক’ অরিন্দমের ‘পাল্স’-এ নিজেকে দেখতে পেয়েছিলেন কি? তাই কি মহাকাঙিক্ষত সেই মুক্তি? উত্তম লিখেছিলেন, ‘‘মনে হয়েছে অরিন্দমের সুখ আমার সুখ, অরিন্দমের দুঃখ আমার দুঃখ, অরিন্দমের জটিলতায় আমিও ভাবিত। অরিন্দমের সরলতায় কখনও আমিও মুগ্ধ।’’
‘নায়ক’ তৈরির সময় সত্যজিৎ রায় নাকি শুরুতে বলেছিলেন, ‘‘ওহে উত্তমকুমার, প্রথম সিনটা একটু ছবিবিক ঢঙে অভিনয় করতে হবে।’’ মানে, ছবি বিশ্বাসের মতো। সেটা তাঁর মনে ধরেনি। লিখেছিলেন, ‘‘ছবিবিক ঢঙে আমি কী অভিনয় করব? ছবিদা ছবিদার মতো অভিনয় করতেন, আমি আমার মতো করব।’’ এটা কি তাঁর ইগো? না, তা হয়তো নয়। কারণ এক জায়গায় ছবি বিশ্বাসকে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘ওই একটা মাত্র লোক স্ক্রিনে থাকলে যেন তাঁর পর্বতপ্রমাণ গাম্ভীর্য আর ব্যক্তিত্বের কাছে আশেপাশের আর সমস্ত কিছু নস্যাৎ হয়ে যেত। … অমনটি ছিল না, আর হবেও না কোনও দিন।’’ তবু ‘নায়ক’-এ ‘ছবিবিক’ হতে চাননি। হোক না একটি মাত্র দৃশ্য, তা’ও না। ‘অরিন্দম’-এর মধ্যে এতটাই নিজের শরীর-মন দেখতে পেয়েছিলেন তিনি!
একবার লস এঞ্জেলস-এ ভাষণ দিতে গিয়েছিলেন। পরে সেই ভাষণের বাংলা তর্জমা প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে দেখা গিয়েছিল, তাবড় সাহেব-সুবোদের সামনে দাঁড়িয়ে বাংলা সিনেমা নিয়ে প্রায় বোমা ফাটিয়েছিলেন মহানায়ক। বলেছিলেন, ‘‘এক এক সময় মনে হয় কী জানেন – আমরা তো অনেক বড় আর্টিস্ট, নয় কেন? কেন নয়? আমরা যদি রবার্ট রেডফোর্ডকে বলি – আমরা যদি বার্টন সাহেবকে বলি – আমরা যদি পিটার ওটুলকে বলি – আমরা যদি টোপল সাহেবকে বলি যে আমাদের ওই জায়গায় টালিগঞ্জে গিয়ে এক ঘণ্টা শ্যুটিং করে আসুন না। পালিয়ে আসবেন। পরের দিনই টিকিট কেটে পালিয়ে আসেবেন।’’
সে কালের স্টুডিয়োর অবস্থা যে কতটা কুৎসিত ছিল, তা নিয়ে বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়েও কোনও লুকোচুরি ছিলনা তাঁর। দুটোর বেশি লেন্স নেই। ভাঙা ক্যামেরা। তা’ও বলতে গেলে ক্লাইভের আমলের। উত্তম বলেছিলেন, ‘‘সে এখনও চলছে ভাল রোমান্টিক সিনে – বেশ গদগদ নায়ক-নায়িকা। বেশ সুন্দর। পার্টটাও ভাল হচ্ছে। হঠাৎ কাট কাট। … কী ব্যাপার ফিল্ম জ্যামড্ হয়ে গেছে। আবার সেই নায়ক নায়িকা চোখ কুঁচকে মুখের ওপর বরফ লাগিয়ে ঠান্ডা জলটল লাগিয়ে আবার রেডি হচ্ছে … হয়তো ঠিক আগের মতো হল না।’’
অপর্ণা সেনের সঙ্গে অভিনয়। এক গাল দাড়ি, গোঁফ। হঠাৎ লোডশেডিং। গোটা বাংলায় যখন তখন সে ছিল এক নতুন উৎপাত। ছবির পরিচালক ছিলেন অজয় কর। উত্তম জানিয়েছিলেন, ‘‘বললাম, অজয়বাবু আর হবে? উনি বললেন, একটু অপেক্ষা করো – দেখি। বসে আছি – কামড়। কীসের বলুন তো – মশার। প্রচণ্ড মশা। … এরই মধ্যে আমরা কাজ করছি।’’
কথায় বিদ্রুপ ছিল। ঠাট্টাও। কিন্তু যন্ত্রণাও কি ছিল না? আর বেপাড়ায় গিয়ে, তার ঔজ্জ্বল্যতে কুঁকড়ে না গিয়ে নায়কের মতোই চ্যালেঞ্জ দেওয়া? চ্যালেঞ্জটা তিনি দিয়েছিলেন এভাবে – ‘‘এক বার খেলে যান না এ মাঠে, দেখি কেমন পারেন!’’
প্রেম নিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘প্রেম যেন অনেকটা নতুন শাড়ির গন্ধের মতো, দু’দিন পরলেই আর গন্ধটা থাকে না। না পরে বাক্সে তুলে রাখলেও গন্ধটা নষ্ট হয়ে যায়। আর প্রথম প্রেম? সম্ভবত কর্পূরের মতো উবে যায়।’’ আশ্চর্যের বিষয় হল বছরের পর বছর ধরে তিনি নিজেই কি’না ছিলেন লক্ষ লক্ষ কিশোরী-তরুণীর হার্টথ্রব! মহানায়ক প্রথম প্রেমে পড়েছিলেন স্কুলবেলায়। ধূমকেতুর মতো দেখা দিয়ে তা উধাও-ও হয়ে গিয়েছিল, ধূমকেতুর মতোই। সেই ঘটনা নিয়ে মহানায়ক লিখেছিলেন, ‘‘মেয়েটি এক দিন ভরপুরের হাজির হয়েছিল আমার ঘরে। মনে পড়ে, তখন আমি স্কুলের ছাত্র। কী কারণে স্কুলে যাইনি। খাওয়াদাওয়ার পাট চুকে গেছে। মা ওপরের ঘরে শুয়ে ঘুমোচ্ছেন। নীচতলায় আমার পড়বার ঘরে আমি একলা। খাতা কলম নিয়ে হিজিবিজি কী সব আঁকছি। ঠিক সেই সময়ে মেয়েটি এল। আমারই বয়সি, পাশের বাড়ির বাসিন্দা। আমি চোখ তুলে তাকালাম। মুহূর্তে মেয়েটির চোখের তারায় বিদ্যুৎ নেচে উঠতে দেখলাম। সে খিল খিল করে হেসে উঠল। হঠাৎ উপলব্ধি করলাম, এ হাসির যেন অনেক অর্থ। সেই প্রথম ওই নিঃশব্দ নিরালা মুহূর্তে পরম বিস্ময়ে অনুভব করলাম, এক অপরূপের আবির্ভাব ঘটেছে আমার চোখের সামনে। … ওরা ছিল দুই বোন। এক দিন দেখি, বড় বোনও আমায় প্রেম নিবেদন করতে চাইছে। সেই আমার প্রথম প্রেমের মৃত্যু হল।’’
মহানায়ক ফ্যানদের বিচিত্র সব কাণ্ড কারখানা দেখেছিলেন জীবনভর। একটা ঘটনার উল্লেখ করে লিখেছিলেন, ‘‘ছেলেটি বাড়িসুদ্ধ লোকের সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো।’’ ঘটনাটি ঘটেছিল মেদিনীপুরের চাতরায়। আরেকবার এক অভিজাত কুলবধূ মফস্বল থেকে শহরে এসে তাঁর সাথে দেখা করে বলেছিলেন, ‘‘আমি আর ফিরব না।’’ ওদিকে সদ্য বিবাহিতা একজন সব লাজলজ্জা ধুয়ে সটান হাজির হয়েছিলেন শুধু তাঁকে দেখবেন বলে। তাঁর ফ্যানলেটারের রকম বললে তো আড়েবহরে সেটা মহাকাব্যকে হার মানাবে। তবু চাতরার সেই যুবকটির ঘটনা যেন সবার থেকে আলাদা ছিল। উত্তম কুমার লিখেছিলেন, ‘‘আমার পুরনো দিনের বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম নেমন্তন্ন খেতে। খাওয়া আর হল কই!’’ তার মাঝেই অমন কাণ্ড! তারপরের বর্ণনা দিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘দৃশ্যটা সবাই এনজয় করল বেশ। আমি এক্কেবারে বোকা বনে গেছি। ফিরে আসবার সময় ছেলেটির সঙ্গে আমার দেখা হল। রাস্তায়। গাড়ি থামিয়ে ছেলেটিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বহু জায়গায় গিয়েছি, কিন্তু হঠাৎ এরকম একটা ব্যবহার।’ … কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে খুব ক্যাজুয়ালি বলল, ‘দাদা, আপনার ওই বুকে তো অনেক নায়িকা পড়েছে। আমিও একবার পড়ে দেখলাম। বহু দিনের শখ ছিল। বিশ্বাস করুন, ওই জায়গাটার প্রতি আমার একটা দুর্বলতা ছিল এত দিন।’ …’’
এত মানুষ, এত আলো, এত রকমের চাওয়ার মাঝে ওঁর ছোট্ট ছোট্ট চাওয়াগুলো কেমন বুদবুদ কেটে ভেসে ওঠার আগেই মিলিয়ে যেত। যেন একরাশ ক্লান্তি চেপে লিখেছিলেন – ‘‘এত লোকের আগ্রহ আমি, উত্তমকুমার, আমারও ইচ্ছেপূরণ হয় না, অনেক ছোট আকাঙ্ক্ষা মেটে না।’’ একবার জগুবাবুর বাজারের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। রাস্তায় এক ফুলওয়ালা গোলাপ নিয়ে বসেছিল। মহানায়কের নজর পড়েছিল বিশেষ একটি গোলাপের ওপর। নিজেই নামতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সবদিক বিবেচনা করে ড্রাইভারকেই পাঠিয়েছিলেন। ড্রাইভার ফিরেছিল অন্য একটি গোলাপ নিয়ে। পাল্টাতে বলবেন যে, সে উপায় তখন ছিলনা। কারণ ততক্ষণে তাঁর গাড়ির সামনে, পিছনে শুধু সার সার লোক। বাধ্য হয়ে ‘‘গাড়ি চলতে শুরু করল, ফুলটা নিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি আমি।’’ লিখেছিলেন, ‘‘ছোট ছোট এই ইচ্ছে, আকাঙ্ক্ষাগুলো আমাকে দংশন করে, যখন আমি একা, আমার চারপাশ গাঢ় অন্ধকার।’’
আসলে ছবির জগৎটাই তো এমনি। চারপাশের অন্ধকারেই ছবির জগৎ রোশনাইয়ের মতো জ্বলে। ছবির জগতের যাঁরা বাসিন্দা তাঁদের জীবনটাও এই রকম। যতই চারপাশ অন্ধকার হবে ততই তাঁরা স্পষ্ট হবেন। নিজেদের জীবনের চারপাশের অন্ধকার নিয়ে তবেই তাঁরা জ্বলতে পারেন। কিন্তু নায়কের স্বরও এত ম্রিয়মাণ, এত শুষ্ক, রিক্ত, প্রাণহীন হয়!
উত্তম কুমারকে হিন্দি ছবিতে অভিনয় করার জন্য প্রথম প্রস্তাব দিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ১৯৬২ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রযোজিত প্রথম হিন্দি ছবি ‘বিস সাল বাদ’ সুপারহিট হয়েছিল। এর পর উত্তমকে নায়ক করে ‘শর্মিলি’ বলে একটি হিন্দি ছবির পরিকল্পনা করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও পরিচালক বীরেন নাগ। নায়িকা ওয়াহিদা রেহমান। উত্তমের সঙ্গে কথা বলে ‘শর্মিলি’ তৈরির প্রস্তুতি নেওয়া হয়। একটি সর্বভারতীয় পত্রিকায় পাতা জুড়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। কথা ছিল, প্রথম শুটিং হবে উত্তমকে নিয়ে, আসানসোলে কয়লাখনিতে। সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু চূড়ান্ত মুহূর্তে উত্তম অভিনয় করবেন না বলে বেঁকে বসেন। কী কারণে এই সিদ্ধান্ত তা কোনদিন তিনি স্পষ্ট করে জানাননি। তাঁর এ হেন আচরণে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় খুবই আঘাত পেয়েছিলেন। দু’জনের মধ্যে সম্পর্কে সামান্য হলেও চিড় ধরে। যার ফলে অবিস্মরণীয় ‘উত্তম-হেমন্ত’ জুটির সাময়িক বিচ্ছেদ ঘটেছিল। এ দিকে ‘শর্মিলি’ না হওয়ার জন্য হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে বিপুল আর্থিক মাসুল গুনতে হয়েছিল। তখন তিনি ওই ছবির কাজ বন্ধ রেখে, বিশ্বজিৎ ও ওয়াহিদাকে নিয়ে তৈরি করেছিলেন ‘কোহরা’ (১৯৬৪)। বীরেন নাগই পরিচালনা করেছিলেন। চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের মতে, উত্তমকুমার হিন্দি ছবিতে সফল না হওয়ার জন্য প্রথম ভুলটি করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে। কারণ, ‘শর্মিলি’ ছবিতে উত্তম ছিলেন একক নায়কের চরিত্রে। আর ‘সঙ্গম’ ছবিতে অফার ছিল দ্বিতীয় চরিত্রের জন্য।
মহানায়ক চলে গিয়েছেন ২৪শে জুলাই ১৯৮০ সালে। আর এই চল্লিশটি বছর ধরে, একটু একটু করে মৃত্যু ঘটে চলেছে তাঁর অভিনয়ের ইতিহাসের। প্রতিভা, এমনকি, তার চেয়েও বড় কোনও শব্দ দিয়ে যদি ব্যাখ্যা করা যায় তবে উত্তমকুমার তা-ই। কিন্তু এ কথা আবেগের। যুক্তি দিয়ে, বিশ্লেষণ করে এর প্রমাণ করতে গেলে যে সংগ্রহটি প্রথম জরুরি, তা-ই অনেকাংশে হারিয়ে ফেলেছি আমরা, এই আত্মবিস্মৃত বাঙালি জাতি। আগাগোড়া, পূর্বাপর উত্তমকুমার-অভিনীত সব ছবি আজ আর দেখার উপায় নেই। অনেক ছবিরই ‘নেগেটিভ’ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। উত্তম-পাগলামির স্রোতে সে সব খড়কুটোর কথা বাঙালি মনেই রাখেনি।
‘‘হিন্দুস্তান মে কেয়া হ্যায় তুমারা,
ও বৃটিশ বেচারা!
আভি চলি যাও ইংল্যাণ্ড বাজা কর ব্যাণ্ড।
মন্দির মসজিদ মে পূজা আরতি,
মসজিদ মে শুননা আজান পূকারতি,
দিলকে দিলাও মিল হিন্দু মুসলমান।
সারি হিন্দুস্তানমে আয়ি তুফান,
গরিবাে কে দুখো কি হােগি আসান।।’’
১৯৪৬ সালে যখন দাঙ্গা হয়েছিল তখন তিনি নিজে এই গান লিখে-সুর দিয়ে অনেক জায়গায় গাইতেন। উত্তমকুমার তখনও উত্তমকুমার হননি। ইন্ডাস্ট্রির কাছে তিনি তখন ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’! সে সময়, ’৪৯-এ পূর্ণশ্রী, প্রাচী, আলেয়াতে মুক্তি পেল উত্তমকুমারের তৃতীয় ছবি ‘কামনা’। নায়িকা ছবি রায়। সে ছবি ফ্লপ! সুরকার ও গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে উত্তমের সম্পর্ক ছিল মামা-ভাগ্নের। তাই চিন্তায় পড়লেন তিনি। কোথাও নতুন ছবির ডাক পাচ্ছেন না শুনে, চিন্তায় পড়েছিলেন পুলক। কলেজের থার্ড-ইয়ারের ক্লাস কেটে একদিন তিনি তাঁর জামাইবাবু সরোজ মুখোপাধ্যায়ের কাছে হাজির হয়েছিলেন। তার আগে, সরোজবাবু উত্তমকে নিয়ে দিয়ে ‘কামনা’ করেছিলেন। তবু খানিকটা জোর করেই জামাইবাবুকে রাজি করিয়েছিলেন পুলক। স্মৃতিরেখা বিশ্বাসের বিপরীতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন উত্তম। ছবির নাম ‘মর্যাদা’। যেহেতু উত্তম অভিনীত তাঁর আগের ছবিগুলি ফ্লপ করেছিল, তাই প্রযোজকের শর্ত মতো নাম বদলে অভিনয় করেছিলেন নায়ক। ‘অপয়া’ নাম বদলে মহানায়কের নতুন তখন নামকরণ হয়েছিল ‘অরূপকুমার’। সেই ছবিতে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা গান, নায়কের লিপে প্রথম প্লে-ব্যাক করেছিলেন কেউ। তিনি তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
উত্তমকুমার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো করে সিনেমায় আসেননি। সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালকের হাত ধরে চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশের সুযোগ তাঁর হয়নি। যে উত্তমকুমার ১৯৪৮ সালে ‘দৃষ্টিদান’ ছবিতে প্রথম দেখা দিয়েছিলেন তাঁর মধ্যে উত্তমকুমার হয়ে ওঠার নিহিত সম্ভাবনার প্রকাশ কতটা দেখা গিয়েছিল, সেটা বলা কঠিন। ২৪শে এপ্রিল ১৯৪৮ সাল, স্বাধীনতার বছরও গড়ায়নি তখনও, কলকাতার চিত্রা সিনেমাহলে মুক্তি পেয়েছিল সে ছবি। রবীন্দ্রনাথের গল্প, চিত্রনাট্য লিখেছিলেন সজনীকান্ত দাস। পরিচালনা নীতিন বসুর। ছবির নায়ক উত্তমকুমার ছিলেন না। তাঁর নাম তখন অরুণকুমার। অভিনয়ের একটা নতুন যুগ, নতুন ধারার সম্ভাবনা যদিও বা থেকে থাকে সে ছবিতে তবু তা চাপা পড়ে গিয়েছিল সে কালের দুর্দান্ত সব অভিনেতার অভিনয়ে। অসিতবরণ, ছবি বিশ্বাস, কেতকী দত্তের পাশে নবাগত অরুণকুমার পাত্তা পাবেন কেন!
তার পরের পাঁচ বছরে উত্তমকুমার অভিনয় করেছিলেন মোট ১৯টি ছবিতে – ‘কামনা’, ‘মর্যাদা’, ‘ওরে যাত্রী’, ‘সহযাত্রী’, ‘নষ্টনীড়’, ‘সঞ্জীবনী’, ‘বসু পরিবার’, ‘কার পাপে’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘লাখ টাকা’, ‘নবীন যাত্রা’, ‘বউঠাকুরানির হাট’, ‘মনের ময়ূর’, ‘ওরা থাকে ওধারে’, ‘চাঁপাডাঙার বউ’, ‘কল্যাণী’, ‘মরণের পরে’, ‘সদানন্দের মেলা’, ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’। পর পর এই ছবিগুলিতে কী ভাবে বদলে যাচ্ছিল উত্তমকুমারের অভিনয়, তার পিছনে ছিল কী অসীম অধ্যবসায় তার ধারাবাহিক বিচারভিত্তিক সমালোচনা করা সম্ভব নয়। কারণ, এর বেশ কয়েকটি ছবির ‘নেগেটিভ’ নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
তবে আশার কথা, একক ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে উত্তমকুমারের অভিনয়-জীবনের ইতিহাসের নানা উপাদান সংরক্ষিত হয়েছে। যেমন সংরক্ষিত আছে তাঁর অভিনীত ২০২টি ছবিরই পুস্তিকা।
সেই পুস্তিকাগুলিই এখন উত্তম চলচ্চিত্রের ইতিহাস রচনায় চলচ্চিত্র গবেষকদের প্রধান উৎস। সেখান থেকেই দেখা যায়, ১৯৫৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবি থেকেই সেই অর্থে বলতে গেলে উত্তমকুমারের জয়যাত্রার শুরু। সে ছবিতে অবশ্য শুধু উত্তমকুমার নয়, ছিলেন সুচিত্রা সেনও। সুচিত্রা সেন অবশ্য তার আগেও উত্তমকুমারের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন। সেই অভিনয় দেখা যায় ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে। কিন্তু সে ছবিতে তখনও সুচিত্রা সেন ও উত্তমকুমার ঠিক জুটি হয়ে ওঠেননি। একটি তরুণদল যেখানে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ সকলেই ছিলেন তার মধ্যে উত্তমকুমার ছিলেন নেতৃস্থানীয়। আর সুচিত্রা সেন ছিলেন সেই তরুণ দলের কিছুটা স্বপ্নের পরির মতো। ফলে, উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেনের সিনেমায় প্রেমটা সেখানে ছবির মুখ্য বিষয় নয়, ওই নব তরুণদলের হুল্লোড় তথা কীর্তিকলাপটাই ছিল মুখ্য। কিন্তু ‘অগ্নিপরীক্ষা’য় এসে সুচিত্রা সেনকে আর উত্তমকুমারের সঙ্গে ছিলেন বললে অবশ্য কিছুটা কমিয়ে বলা হয়, সেই প্রথম উত্তম-সুচিত্রা জুটি সাড়া ফেলে দিয়েছিল বাঙালি দর্শকের মনে। সেই সাড়া ফেলে দেওয়াটা যে পরবর্তী কালে কী গভীর অভিঘাত তৈরি করেছিল সেটা বোঝা যায় ইতিহাসের পরবর্তী পাতাগুলোর দিকে তাকালে। উত্তমকুমার বলতেই আজও অনেকের মনে ভেসে ওঠে উত্তম-সুচিত্রা জুটির কথা, যদিও আরও অনেক নায়িকার সঙ্গেই অত্যন্ত সফল ভাবে অভিনয় করেছেন উত্তমকুমার।
১৯৫৪ সালে সাড়া ফেলে দেওয়া সেই ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে আশাপূর্ণা দেবীর কাহিনী অবলম্বনে চিত্রনাট্য লিখেছিলেন নিতাই বন্দ্যোপাধ্যায়, পরিচালনায় ছিলেন অগ্রদূত, অর্থাৎ, বিভূতি লাহা। ৩রা সেপ্টেম্বর ১৯৫৪ সালে, উত্তরা-পূরবী-উজ্জলায় মুক্তি পাওয়া সে ছবিতে অভিনয় করেছিলেন চন্দ্রাবতী, কমল মিত্র, সুপ্রভা মুখোপাধ্যায়, যমুনা সিংহ, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, জহর রায়, অপর্ণা দেবী, অনুপকুমার, শিখারানি বাগ প্রমুখ। এত জন অভিনেতার নাম এক সঙ্গে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিছক উত্তম-অভিনীত ছবিগুলির সম্পূর্ণ তথ্যচিত্রণ নয়, সেই সময়টা অর্থাৎ, বাংলা ছবির কোন পর্যায়ে উত্তমকুমার অভিনয় করতে এসেছিলেন সেই পর্যায়টাকে কিছুটা পরিচিত করা।
মনে রাখতে হবে উত্তমকুমার যে সময়ে অভিনয় করতে এসেছিলেন সেই সময়ে বা তার আগে বাংলা ছবিতে ভাল অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভাব ছিল না। উত্তমকুমারের সময়ে যাঁরা প্রধানত পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তাঁরাও তাঁর আগে যথেষ্ট ভাল অভিনেতা হিসেবে বাংলা সিনেমার দুনিয়া দাপিয়ে বেড়িয়েছিলেন। কিন্তু উত্তমকুমারের অভিনয় জীবনের শুরুর কালটা বাংলা সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে একটা সন্ধিকাল বলা যেতে পারে। দীর্ঘ সময়ের ব্রিটিশ শাসন শেষে সবে স্বাধীন হয়েছিল ভারত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী কালে ভেঙেচুরে যাচ্ছিল পুরনো মূল্যবোধ, অর্থনৈতিক জীবনেও নেমে এসেছিল একটা বড় পরিবর্তন। আর সেই পরিবর্তনের সময়ে উত্তমকুমারের আবির্ভাব ঘটেছিল। মধ্যবিত্ত বাঙালি যৌবনের চিন্তাধারা, সমাজচেতনা তখন পাল্টে পাল্টে যাচ্ছিল, তৈরি হচ্ছিল এক নতুন আশার ভিত্তিভূমি। এই সব কিছুর সঙ্গেই, সমাজ ও অর্থনৈতিক জীবনের সঙ্গেই বদলে যাচ্ছিল প্রেমের ধারণাটাও। আর সেই পরিবর্তমান প্রেমের ধারণা খুঁজে বেড়াচ্ছিল এক নতুন ‘রোম্যান্টিক আইডল’কে। বাঙালি যৌবনের সেই ‘রোম্যান্টিক আইডল’ খুঁজে বেড়ানোটা যেন খানিকটা দিশা পেয়েছিল উত্তমকুমারে এসে। কিন্তু সেই দিশা পাওয়ার বিষয়টাও খুব গভীর সমাজতাত্ত্বিক আলোচনায় ধরার প্রধান বাধা উপাদানের অভাব। উত্তমকুমার-অভিনীত সব কটি ছবি যথাযথ ভাবে ফিরে ফিরে দেখার সুযোগ নেই। নেই তেমন ‘নির্ভরযোগ্য’ জীবনীও।
অতএব, উত্তমকুমার আজও বাঙালির স্মৃতিবিলাসের ‘ম্যাটিনি আইডল’, পূজার ছলে আমরা যাঁকে ভুলেই থাকি।
(তথ্যসূত্র:
১- কথায় কথায় রাত হয়ে যায়, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স (১৯৯৯)।
২- স্মৃতিসুধা, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, ভারতী বুকস্ (২০০৯)।
৩- আমার আমি, উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং (২০১৬)।
৪- ম্যাটিনি আইডল উত্তম কুমার, জয়ন্ত কুমার ঘোষ, দে’জ পাবলিশিং।
৫- Mahanayak Revisited: The World of Uttam Kumar, Swapan Mullick, Westland (২০১৩)।
৬- ২৪শে জুলাই ২০১৯ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় মহানায়ক স্মরণে শ্রী আশিস পাঠক লিখিত প্রবন্ধ।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত