‘বাঙলা’, ‘আসাম’ ও ‘উড়িষ্যা’য় মনসাদেবীর পূজা সুপ্রচলিত। এই পূজা এখন যে-ভাবে সাধারণতঃ অনুষ্ঠিত হয় সেটা ঠিক প্রতিমাপূজা নয়, ‘ঘট-মনসা’ বা ‘পট-মনসা’র পূজা এবং মধ্যযুগীয় বাঙলার মনসামঙ্গলের সঙ্গে এই ‘ঘট-মনসা’ ও ‘পট-মনসা’র সম্বন্ধই ঘনিষ্ঠ। ‘ধান্যপূর্ণ’ মাটির ঘটের উপর ‘সর্পধারিণী’ বা ‘সর্পােলংকারা মনসার ছবি’ এঁকে তাঁর পূজা অথবা শোলা বা কাপড়ের পটের উপর ‘সর্পময়ী’ বা ‘সর্পধারিণী’ বা ‘সর্পালংকারা মনসার কাহিনী’ এঁকে টাঙানো পটের সম্মুখে পূজাই সাধারণ রীতি। কিন্তু একাদশ-দ্বাদশ-ত্ৰয়োদশ শতক-পূর্বে বঙ্গদেশে মনসার ‘প্রতিমাপূজা’ হত; তার কয়েকটি ‘মূর্তি-প্রমাণ’ও বিদ্যমান। মনসাদেবী যে কি করে উচ্চতর সামাজিক স্তরে উন্নীত হলেন তার বিস্তৃত ‘পুরাণ-কাহিনী’ বঙ্গদেশে সুবিদিত। সাপ ‘প্রজনন শক্তির প্রতীক’ এবং মূলত কৌম সমাজের ‘প্রজনন শক্তির পূজা’ থেকেই মনসা-পূজার উদ্ভব, এ-তথ্য নিঃসন্দেহ। পৃথিবী জুড়ে আদিবাসী সমাজে কোনও না কোনও রূপে সর্পপূজার প্রচলন ছিলই। বঙ্গদেশে যে-সব মনসাদেবীর প্রতিমা পাওয়া গিয়াছে তার প্রায় প্রত্যেকটিতেই মনসাদেবীর সঙ্গে ‘একাধিক সর্পের’, ‘ক্রোড়াসীন একটি মানবশিশুর’, ‘একটি ফলের’ এবং কোথাও কোথাও ‘একটি পূর্ণঘটের প্রতিকৃতি’ বিদ্যমান। এদের প্রত্যেকটিই ‘প্ৰজনন শক্তির প্রতীক’। একটি মূর্তির পাদপীঠে ‘ভট্টিনী মট্টুবা লিপি’ উৎকীর্ণ। এই লিপির অর্থ কি ‘রাজমহিষী মট্টুবা’ না আর কিছু বলা কঠিন। ‘মট্টুবা’ কি ‘তদ্ভব’, না ‘দেশজ অস্ট্রিক’ বা ‘দ্রাবিড় ভাষা’র শব্দ, সেটাও নিশ্চয় করে বলা যায় না। তবে, প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণে এ-তথ্য নিঃসংশয় যে, ‘পাল-আমলের প্রথম পর্বে’ই মনসাদেবী ব্ৰাহ্মণ্যধর্মে পূজিতা ও স্বীকৃত হতে আরম্ভ করেছিলেন। ‘মহাভারত’ ও ‘ব্রহ্মবৈবর্ত-পুরাণের কাহিনী’ থেকেই প্রমাণ হয়, মনসাদেবীর ‘প্রাচীন বৈদিক’ বা ‘পৌরাণিক’ কোনও ‘ঐতিহ্য’ই ছিল না; ব্রাহ্মণ্য ধর্মে স্বীকৃত হওয়ার পরও বহুদিন পর্যন্ত তাঁর রূপ সুনির্দিষ্ট হয়নি। কোনও কোনও ধ্যানে তাঁর বাহন হচ্ছেন ‘হংস’ এবং তিনি ‘পুস্তক’ ও ‘অমৃতকুম্ভধারিণী’। বলা বাহুল্য, এই সব উপকরণ ‘সরস্বতী’র এবং আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ‘ব্ৰহ্মবৈবর্ত-পুরাণের একটি ধ্যানে’ মনসাকে ‘সরস্বতীর সঙ্গে অভিন্ন’ বলে কল্পনা করা হয়েছে। ‘তেলেগু’ ও ‘কানাড়ী-ভাষাভাষী’ লোকদের মধ্যে ‘মঞ্চাম্মা’ নামে এক সর্পদেবীর পূজা আজও প্রচলিত এবং আমাদের দেশে মধ্যযুগে মনসাদেবীর যে ধরনের কাহিনী প্রচারিত হয়েছে, সেখানেও ‘অম্বাবরু’ নামীয় এক সর্পদেবী সম্বন্ধে অনুরূপ কাহিনী সুপ্রচলিত। অসম্ভব নয় যে, দক্ষিণী ‘মঞ্চাম্মা’ই আমাদের মনসা এবং ‘অম্বাবারু’র কাহিনীই আমাদের মনসাকে আশ্রয় করেছে। ঐতিহাসিক প্রমাণের উপর নির্ভর করলে বলতে হয়, বঙ্গদেশে মনসা-পূজার বহুল প্রচলন হয় ‘দক্ষিণী সেনা-বর্মণ রাজা’দের আমলেই।

‘ধর্মঠাকুরের সঙ্গিনী কেতকা মনসা’কে নিয়ে বেশ কিছু মত প্রচলিত আছে –
প্রথমতঃ, কেতকা-মনসা ‘ধর্মের অঙ্গজা’, বেদের ‘যমি’ যিনি ভগিনী হয়ে ভ্রাতাকে কামনা করেছিলেন পতিরূপে। ‘কেতকা’ও ধর্মের কামিনী (‘কামিন্যা’)। বেদের কাহিনীতে যম মারা গিয়েছিলেন এবং ধর্মের কাহিনীতেও তাই।
দ্বিতীয়তঃ, কেতকা ‘বারুণী’। তাঁর প্রতীক ‘জলভরা ঘট’ (আদিতে সুরাভরা?), বেদের ‘শ্বেত সোমকলস’। তার থেকে নানান পথ-বাঁক ঘুরে তিনি একদিকে হয়েছেন ‘আরোগ্যের দেবতা’ – ‘বিষহরি’, অপর দিকে শস্যদেবতা ‘ইলা’, ‘শ্রী’।
তৃতীয়তঃ, যম-ভগিনী যমুনারূপে কেতকাও ‘কুর্ম দেবতা’, তাঁর বাহন ‘কুর্ম’। যমুনা ‘কালো’, গঙ্গা ‘গৌরী’। গঙ্গার বাহন ‘মকর’ = গৌরী দুর্গার বাহন ‘গোধা’।
চতুর্থতঃ, তিনি ‘গোরুপিনী বসুন্ধরা’। পুরাণে উল্লেখিত ‘পৃথুর গোদোহন কাহিনী’ এই বিষয়ে স্মরণীয়। আবার এর ইঙ্গিত, আবেস্তার প্রাচীনতম অংশে জরাথ্রুষ্টের গাঁথায় আছে। সেখানে হত্যার সম্মুখীন হয়ে আদিসৃষ্ট গোরু আদিদেবের কাছে অনুনয় করছেন যাতে তাঁকে না মারা হয়। কেতকা যেমন একদিকে ‘চণ্ডী’ হয়ে শিব গৃহিণী হলেন, অপর দিকে ‘ষাঁড়’ হয়ে শিববাহন হলেন। ঋগ্বেদে পাওয়া যায়, রুদ্রের পত্নী হচ্ছেন ‘পৃশ্নি’ অর্থাৎ ‘বাঘাফটকা’ রঙের গাই। এখানে কেতকা-শিব বিবাহের আরেকটি ছবি পাওয়া যায়। বাংলার লৌকিক ধর্মে, ‘গোভাগাড়-বাসিনী গোমুণ্ড-প্রীতিকা ভগবতী দেবী’র উৎপত্তিও এই সূত্রে কল্পনা করতে পারা যায়। মনসা ‘পঞ্চমী দেবী’, তাঁর পূজা তিথি হচ্ছে ‘পঞ্চমী’। ভগবতী ‘ষষ্ঠী দেবী’, তাঁর পূজা তিথি ‘ষষ্ঠী’। এই দুই দেবীই মূলতঃ এক – তার প্রমাণ হল ‘শীতল ষষ্ঠী’। এই দিনে বাস্তুদেবতার পূজা হয়। বাস্তুশিল্পে ‘ছেলেকোলে মনসা ও ষষ্ঠী’ দুইই পাওয়া যায়।
পঞ্চমতঃ, চণ্ডীরূপী কেতকা একজন ‘পক্ষীদেবী’ও। ‘দেবকীগর্ভসম্ভুতা কাত্যায়নী’ শিলাপাটে আছাড় খেয়ে ‘শঙ্খচিল’ হয়ে যান – এ কাহিনী সুবিদিত।
ধর্ম-মনসা (কামিনী) একদা যমজ দেবতারূপে একসঙ্গে একত্রে পূজিত হতেন। যেমন এখন ধর্মের গাজনে হয়। কিন্তু প্রায় শুরু থেকেই মনসার পদ্ধতি অন্য পথ নিয়েছে। সেই জন্য এখন ধর্মঠাকুরের সাথে মনসার যোগাযোগ স্পষ্ট নয়। কেবল একটি ব্যাপারে মিল আছে, সেটা হচ্ছে বাস্তু পূজায়। কিন্তু এখানে ধর্মঠাকুর প্রায় বিলুপ্ত। ধর্ম যিনি ধারণ করেন তিনিই ‘বাস্তুদেব’। নাগ পৃথিবী ধারণ করে আছেন। সুতরাং নাগ হলেন বাস্তুদেব। নাগের থেকে এলেন মনসা। তার থেকে তিনি এখন ‘সিজের’ (মনসা গাছের) ডালে পৌঁছেছেন। ঊনানে মনসা গাছের ডাল রেখে এখন বাস্তুপূজা করা হয়। ঊনান সেদিন বাস্তুর প্রতিনিধি, তাই অরন্ধন পালিত হয় – নাগের অর্ঘ্য শীতলতা, আগুনের উত্তাপ নয়।
মনসার ইতিহাস অতীব বিচিত্র। সভ্যতার উন্মেষের বহু পূর্বেই মানুষের হৃদয়ে ভয়-বিস্ময় প্রভৃতি আদি জন্মলব্ধ প্রবৃত্তিগুলি থেকে সমাজের প্রাচীনতম দেবতাদিগের কল্পনা করা হয়েছিল। সেইজন্য প্রত্যেক সমাজের প্রাচীনতম দেবদেবী প্রত্যক্ষদৃষ্ট প্রকৃতিরই অঙ্গীভূত আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক ভয় বা বিস্ময়ের বস্তু। প্রাচীন মানবজাতি অরণ্যে ও গুহায় বাস করত। ফলে অরণ্যের জীবজন্তুর সাথে তাঁদের সবসময় সংগ্রামে লিপ্ত থাকতে হত। আর অরণ্যচারী জীবজন্তুর মধ্যে সাপ বেশ ভালই ভীতিকর। ভারতে সর্পপূজার উৎপত্তি সম্বন্ধে পণ্ডিত ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে কম বিতর্ক নেই। পাশ্চাত্য পণ্ডিত ‘জে. ফার্গুসন’ তাঁর ‘Tree and Serpent Worship’ নামক গ্রন্থে বলেছেন, সাপের পূজা সর্বপ্রথমে ভারতবর্ষের বাইরে ‘তুরাণীয় জাতি’র মধ্যে উদ্ভূত হয়। তারপরে ‘তুরাণীয় জাতি’ উত্তর-পশ্চিম পথে ভারতে প্রবেশ করে সর্পপূজার প্রবর্তন করে – সর্পপূজার সাথে আর্যজাতির কোন মৌলিক সম্পর্ক ছিল না। আর্যগণ ভারতে এসে এই তুরাণীয় জাতির কাছে সর্পপূজার শিক্ষা লাভ করেছিল। কিন্তু এই সম্পর্কে আরেকজন পাশ্চাত্য পণ্ডিত ‘ডাব্লু.ডি.হ্যাম্বলি’ বলেছেন,
‘‘Fergusson write in 1869, and his use of terms presents difficulties. He employs the word Turaniyan in the sense of non-Aryan; the Turaniyans being a people who were ousted by the Aryans. Persians and settled Iranians gave the name Turanian to nomads of the steppe region of Central Asia … Fargusson, how ever disregards the fundamental fact that culture elements may be borrowed without racial mixture when he claims that, ‘‘eventually the worship of the serpent may become a valuable test of the presence of Turanian blood in the baina of the people among whom it is found to prevail.’’ …’’ (Serpent worship in Africa, W.D.Hambly, Field Museum of Natural History, Chicago, XXI – 1931, page – 18).
কেউ কেউ আবার মনে করেন যে, ভারতীয় ‘নাগগণ’ একটি জাতিবিশেষ, তাঁরা হয়ত সাপকে ‘জাতীয় অভিজ্ঞান’ (‘totem’) রূপে ব্যবহার করত, এছাড়া সাপের সঙ্গে তাঁদের আর কোনও সম্পর্ক ছিল না। ‘সর্প’ ও ‘নাগ’ একার্থবাচক শব্দও নয়।
আবার কেউ মনে করেন, ‘নাগ’ বলতে সর্প-নর নামক একজাতীয় অর্ধনর ও অর্ধনাগ জাতীয় জীবকে বোঝায়। কেউ আবার বলেছেন যে, ভারতে জল-দেবতাকেই ‘সর্প’ বলা হত। বলা বাহুল্য, এই সকল মতবাদ এতই একদেশদর্শী ও অনুমান নির্ভর যে এদের কোনটাই সমগ্রভাবে গ্রহণ করা যায় না। তবে একথা সত্যি যে, প্রাচীন ভারতীয় সংস্কারে ‘নাগ’ এবং ‘সর্প’ একার্থবাচক ছিল না। ‘নাগ’ বলতে সম্ভবতঃ ‘গন্ধর্ব’, ‘কিন্নর’, ‘যক্ষ’ এই শ্রেণীর কোনও উপজাতিকে বোঝাত, আর ‘সর্প’ বলতে প্রকৃত প্রাণীটিকে বোঝানো হত। এই সম্পর্কে হিন্দুদের নিত্যস্নানের তর্পণ মন্ত্রটি উল্লেখযোগ্য। তাতে নাগ এবং সর্পকে যে কেবল পরস্পর স্বতন্ত্র বলেই উল্লেখ করা হয়েছে তা নয়, এতে তাদের প্রকৃতিও যে পরস্পর সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, তারও আভাস পাওয়া যায়। মন্ত্রটি নিম্নরূপ –
‘‘দেবা যক্ষাস্তথা নাগা গন্ধর্বাপ্সরসোহসুরাঃ।
ক্রুরাঃ সর্পা সুপর্ণাশ্চ তরবো জিহ্মগা খগা।।
বিদ্যাধরাজলাধারাস্তথৈবাকাশগামিনঃ।
নিরাহারাশ্চ যে জীবাঃ পাপে ধর্মে রতাশ্চ যে।
তেষামাপ্যায়নজৈতদ্দিয়তে সলিলং ময়া।।’’
দেখা যাচ্ছে যে, নাগকে যক্ষ-গন্ধর্ব-অপ্সরা ইত্যাদির সঙ্গে একসঙ্গে উল্লেখ করে সর্পকে ‘ক্রূর’ বিশেষণ দিয়ে সেটা থেকে স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করা হচ্ছে। ‘ক্রূর’ সর্পকে পুনরায় ‘জিহ্মগ’ অর্থাৎ নির্বিষ সাপ থেকে পৃথক করে উল্লেখ করা হচ্ছে, যেভাবে এদের এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, সেটা দেখে গবেষকরা মনে করেন যে – গোঁড়া হিন্দু সমাজে তখনও তাদের উপরে কোন দেবত্বের আরোপ করা হয়নি।
মহাভারতের মধ্যে ‘নাগ’ একটি জাতি – তাঁরা আর্য বিরোধী – আর্যদের সঙ্গে সর্বদা বিবাদে মত্ত। তারা তখনও সমাজে দেবতা বলে পূজা পেতে শুরু করেন নি। এর পরবর্তী সময়ে আর্যেতর সমাজ থেকে জীবিত সর্পের ধারাটি স্বতন্ত্র – গবেষকরা মনে করেন যে, খুব সম্ভবতঃ ‘নাগ’ ও ‘সর্প’, এই দুটি শব্দের অর্থ-সাদৃশ্যের জন্য নাগজাতির ঐতিহ্যের সঙ্গে এসে মিলত হয় এবং এরই ফল স্বরূপ সমাজে নাগপূজার প্রচলন হয়। তখন থেকেই মহাভারতে উল্লেখিত ‘নাগজাতির অধিপতি বাসুকি’ সর্পরাজরূপে পূজা পেতে থাকেন। মহাভারতের অন্যান্য কোনও কোনও নাগচরিত্রও সর্পরূপ লাভ করেন। এমনকি, নাগরাজ বাসুকির ভগিনী ‘জবৎকারু’ মুনির পত্নী বঙ্গদেশে এসে মনসায় রূপান্তরিত হয়ে যান।
এইভাবে মহাভারতের মধ্যে যা তৎকালীন মানব-সমাজের মধ্যে একটি স্বতন্ত্র শাখামাত্র ছিল, সেটাই সেই যুগে সরীসৃপ রূপ লাভ করে। কিন্তু তথাপি একথা স্বীকার করতেই হয় যে, প্রাচীন হিন্দু ও বৌদ্ধদের সাহিত্য কিংবা ভাস্কর্য বিশেষভাবে অনুধাবন করলে দেখা যায় যে, এই নাগ ও সর্পের মধ্যে ব্যবধান কোনদিনই সুস্পষ্ট ভাবে মিটে যায় নি।
ভারতে প্রচলিত জীবিত সর্পের পূজার একটি আদর্শ পরবর্তীকালে নাগপূজার সঙ্গে মিলিত হয়েছে বলেই আধুনিক কাল পর্যন্ত ভারতীয় ধর্মসংস্কারের মধ্যে নাগপূজা ও সর্পপূজা দুটো স্বতন্ত্র ধারার অস্তিত্বের অনুভব করা যায়। প্রাচীন ভারতীয় হিন্দু ও বৌদ্ধ ভাস্কর্যে একধারে নরনারীরূপ নাগনাগিনীমূর্তি ও অন্য ধারে সরীসৃপরূপ সর্পমূর্তি – এই উভয়ের অস্তিত্বের হয়ত এটাই কারণ।
আবার কিছু গবেষকের মতে, নাগ বলতে সরীসৃপ তো দূরের কথা, কোনও দৈত্য-দানব কিছুই বোঝায় না। নাগ বলতে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের, বিশেষত প্রাচীন তক্ষশীলা অঞ্চলের এক জাতির লোককে বোঝায়। তাঁরা সর্পফনাকে জীবকরূপে (‘totem’) রূপে ব্যবহার করত বলেই তাঁদের নাগ বলে পরিচয় দেওয়া হত। এই অনুমান উপরোক্ত মতকে কিছুটা সমর্থন করে। গবেষকরা মনে করেন যে মহাভারতের নাগজাতি বলতে এঁদের কেও বোঝানো হতে পারে। যাঁরা মনে করেন যে সর্পপূজা ভারতের বাইরে থেকে এসেছে তাঁরা এই বিষয়ের স্বপক্ষে কোন যুক্তি দেখাতে পারেননি। সেই জন্য মনে হয়, ভারতে সর্পপূজা শুরুর মূলে বাইরের কোন প্রভাব নেই, এই পূজার উদ্ভব এই দেশেই হয়েছিল।
ভারতে জীবিত সর্পের পূজা যে খ্রিষ্টপূর্ব শতাব্দীতেও ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে প্রচলিত ছিল তার প্রমাণ বেশ কিছু প্রাচীন গ্রিক গ্রন্থে পাওয়া যায়। গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডার ভারতে আসার সময়ে তাঁর সাথে যে সকল সঙ্গীরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে তাঁদের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে এলিয়েন নামক একজন গ্রিক সেনাপতি লিখেছিলেন, যখন আলেকজান্ডার ভারতবর্ষে প্রবেশ করে একের পর এক নগর ক্রমাগত অধিকার করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি অনেক স্থানেই অন্যান্য পশুর সঙ্গে এক বিরাট জাতীয় সর্প দেখতে পান। সেই সর্পকে ভারতীয়রা পবিত্র বলে মনে করত এবং এক গিরিগুহায় সেটিকে আবদ্ধ রেখে ভক্তি সহকারে পূজা করত।
ভারতের অনেক জায়গায় এখনও জীবিত সর্পের পূজা প্রচলিত আছে। ভারতের বাইরেও কোন নর বা নারীর আকৃতি পরিকল্পনা করে সর্পের পূজা করার পরিবর্তে সাধারণত জীবন্ত সর্পের উদ্দেশ্যেই পূজা করা হয়ে থাকে। কেবলমাত্র মধ্য এশিয়ার মেসোপটেমিয়ার প্রত্নতাত্বিক আবিষ্কার থেকে একটি সর্পদেবীর মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল, যাতে দেখা গিয়েছিল, তার দুই হাতে তাগার মতন দুটো সর্প আর গলায় আরেকটি সর্প হারের ন্যায় বেষ্টন করে ছিল (‘Field Museum of Natural History, Chicago, Vol – XXI, 1931, page-67’)। দক্ষিণাত্যের কোন কোন স্থানে এখনও জীবিত সর্পের পূজা হয়ে থাকে। এমনকি বেশ কিছু মন্দিরও আছে যেখানে জীবিত সর্প পালন করে তাদের প্রত্যেকদিন পূজা দেওয়া হয়। গৃহ্যসূত্রে নাগপঞ্চমী পূজার যে বিধি ও নির্দেশ রয়েছে, সেটা জীবিত সর্পের পূজা ছাড়া আর কিছুই নয় বলে গবেষকরা মনে করেন। ভারতের প্রায় সর্বত্র, বঙ্গদেশেও, বাস্তুসর্প বলে পরিচিত এক জাতীয় গৃহবাসী সর্প গৃহস্থের নিকট পরম শ্রদ্ধা লাভ করে থাকে। অতীতে বঙ্গদেশের অনেক জায়গায় ও ভারতের অন্যত্র, মৃত গোক্ষর সর্পের (গোখরো সাপের) ব্রাহ্মণচিত পূর্ণ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা করা হত। এই সকল নিদর্শনের ভিতর দিয়েই জীবিত সর্পের পূজার ধারাটি আজও ভারতে চলে আসছে।
সর্পপূজা ভারতে প্রথম কোন জাতির মধ্যে শুরু হয়েছিল সেটা বলার কোন উপায় নেই। তবে কতগুলো বিষয় এই সম্পর্কে লক্ষ্য করা যেতে পারে। প্রথমতঃ ‘সাঁওতাল’, ‘ওঁরাও’, ‘মুণ্ডা’, ‘শবর’ প্রভৃতি প্রোটো-অস্ট্রালেয়েড বা আদি অস্ট্রাল বলে পরিচিত ভারতীয় যে আদিম জাতিগুলো মধ্য-পূর্ব ভারতে আজও বাস করছে, তাঁদের মধ্যে সর্প পূজার বিশেষ কোন নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায় না। সর্প তাঁদের অধিকাংশের কাছেই ভক্ষণযোগ্য খাদ্য ও সর্প সম্বন্ধে তাঁদের মধ্যে কোন ধরণের শ্রদ্ধাবোধ নেই। গবেষকরা মনে করেন যে, এই সমস্ত জাতি ভারতের বাইরে থেকে আগত, তাই এদের মধ্যে কোনদিনই সর্প পূজার প্রচলন হয়নি। ভারতীয়-মঙ্গোলীয় জাতিগুলোর মধ্যে ‘খাসি জাতি’র মধ্যে এক সর্পদেবতার বিশেষ প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। অনেকেই বিশ্বাস করেন যে এদের সর্পদেবতার কাছে একদা নরবলির চল ছিল। এছাড়াও আসামের বোড়ো, মিসমি প্রভৃতি জাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে মধ্যযুগের অসমীয় ভাস্কর্যে সর্পপূজার কিছু কিছু নিদর্শন পাওয়া গেছে। মঙ্গোলীয় জাতিও অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালে উত্তর-পূর্ব পথে ভারতে এসে প্রবেশ করেছিল। বিচ্ছিন্নভাবে এদের দু-একটি জাতির মধ্যে সর্পপূজার প্রচলন দেখতে পাওয়া গেলেও, সামগ্রিকভাবে এদের মধ্যে সর্পপূজা কোনদিন বিশেষ প্রাধান্য লাভ করে উঠতে পারেনি। ‘নেগ্রিটো’ বলে পরিচিত, ভারতের প্রাচীনতম জাতির লোকসংখ্যা বর্তমানে এত বিরল হয়ে পড়েছে যে তাঁদের ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে আর কোন প্রাচীন বৈশিষ্ট্যের নিদর্শন অনুসন্ধান করা বেশ কঠিন। বিশেষত বৃহত্তর ভারতীয় কৃষ্টির মধ্যে তাঁদের দান নিতান্তই নগন্য। কিন্তু দ্রাবিড় জাতির যে সকল বংশধর এখনও মধ্য ভারত ও দক্ষিণ ভারত অঞ্চলে বসবাস করছে, তাঁদের মধ্যেই সর্পপূজার অধিক প্রচলন দেখতে পাওয়া যায়। এই সব বিষয় অনুসন্ধান করে গবেষকরা মনে করেন যে, সর্পপূজা ভারতে দ্রাবিড় সংস্কৃতিরই একটি বিশিষ্ট অঙ্গ ছিল। এর ব্যাপক প্রভাব বশতঃ পরবর্তীকালে আর্য সমাজও এটা নিজেদের সভ্যতার মধ্যে বহুলাংশে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। আর্য সভ্যতার প্রাচীনতম যে নিদর্শন পাওয়া যায়, তার মধ্যে সর্পপূজার কোন ইঙ্গিত পাওয়া না গেলেও আর্যদের আগমনের অনতিকালের ব্যবধানে রচিত সাহিত্যিক নিদর্শনের মধ্যেই এই সর্প পূজার ব্যাপক পরিচয় প্রকাশ পেয়েছিল।
মজার বিষয়টি হল, প্রাচীনতম বৈদিক সাহিত্যে অর্থাৎ ঋগ্বেদের মধ্যে সর্পের উল্লেখ আছে, কিন্তু সর্প পূজার কোন উল্লেখ নেই। কঠিন শ্লোকের ব্যবচ্ছেদ না করে বিভিন্ন গবেষকদের প্রদেয় তথ্য থেকে এটা বোঝা যায় যে, আর্যগণ হয়ত যে স্থান থেকে ভারতে এসেছিলেন সেখানে সম্ভবতঃ জীবটি বিশেষ পরিচিত ছিল না। ভারতে এসে এখানকার প্রাচীন জাতিগুলোর সাথে মেলামেশা করার পরেই সর্প নিয়ে তাদের মধ্যে একটা ধারণার সৃষ্টি হয়। এর ফলেই পরবর্তীকালে রচিত বৈদিক সংহিতাগুলোতে এর উল্লেখ অপরিহার্য হয়ে ওঠে।
(তথ্যসূত্র:
১- বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস, শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য, এ. মুখার্জি এন্ড কোং প্রাইভেট লিমিটেড (২০০০)।
২- The Myths and Gods of India: The Classic Work on Hindu Polytheism from the Princeton Bollingen Series, Alain Daniélou, Simon & Schuster (১৯৯১)।
৩- হিন্দুদের দেবদেবী: উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ, ডা. হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য, ফার্মা কে.এল.এম প্রাইভেট লিমিটেড (১৯৬০)।
৪- বাঙালীর ইতিহাস (আদিপর্ব), নীহাররঞ্জন রায়।
৫- বাংলার লোকসংস্কৃতি, ড. আদিত্য মুখোপাধ্যায়, অমর ভারতী।
৬- বাংলার লৌকিক দেবতা, গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু, দে’জ পাবলিশিং।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত