ছবির নাম ‘সূর্যমুখী’। পরিচালক বিকাশ রায়। শ্যুটিংয়ে একদিন ছবি বিশ্বাসকে আসতে বলা হল বিকেল তিনটেয়। সূর্যের আলোয় খানকতক শট আছে। তার পর ঘরের ভেতরে।
এ দিকে সন্ধে নেমে এল প্রায়। ছবি বিশ্বাসের দেখা নেই। প্রোডাকশন ম্যানেজারকে পাঠানো হল। তারও ফেরার নাম নেই। বিকাশ রায় রেগে কাঁই। ম্যানেজারের ডেপুটি গেল। সে’ও ফেরে না।
ব্যাপার কী?
অনেক দেরি করে এলেন ছবি বিশ্বাস। তাড়াহুড়ো করে শটও দিলেন। পারফেক্ট শট! আর শেষে দেরির কারণটি যা বললেন, শুনে তাজ্জব বিকাশ।
পরদিন ছিল দোল। বেরোবার সময় ছবি বিশ্বাস দেখেন মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে দোলের তত্ত্ব পাঠাচ্ছেন স্ত্রী। থালায় আবির চুড়ো করে দেওয়া। কিন্তু তাতেও যেন ন্যাড়া-ন্যাড়া লাগছে। তখনই সেই প্রোডাকশন ম্যানেজারমশাই হাজির। তাঁকে দিয়েই অ্যালুমিনিয়ামের রঙিন ফয়েল কিনতে পাঠালেন ছবি বিশ্বাস। একটু বাদে এসে পড়লেন ম্যানেজারের ডেপুটিও। ফয়েল এলে সবাই মিলে কাঁচি দিয়ে তারার মতো কেটে কেটে বসিয়ে তবে রওনা দিয়েছেন কাজে। মেয়ের তত্ত্ব বলে কথা, এটুকু না করলে চলে!
ছবি বিশ্বাসের মতো অমন মাপের এক জন শিল্পী, কিছুতেই স্পিরিট গাম দিয়ে দাড়ি লাগাতে দিতেন না। ফলে কাবুলিওয়ালার দাড়িটি হয়েছিল প্রায় কদাকার।
বার্লিন ফেস্টিভ্যালে ছবিটি দেখে এক বিদেশি সাংবাদিক পরিচালকের উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন, ‘‘অভিনয়টি এতই ভাল যে, আপনাকে উনি ওঁর দাড়ির ব্যাপারটা ভুলিয়ে ছেড়েছেন।’’
কিন্তু ছবি বিশ্বাসকে বোঝায় কার সাধ্যি!
এমন এমন সব বিশ্বাস ছিল ওঁর, খুব কড়া ধাঁচের মানুষ না হলে, তা থেকে তাঁকে বের করে আনা রীতিমতো ঝকমারি।
‘কাবুলিওয়ালা’-তে আরও দু’বারের কাণ্ড যেমন।
কাকে করবেন ‘কাবুলিওয়ালা’, তখনও ভেবে পাচ্ছেন না তপন সিংহ।
ছবি বিশ্বাস শুনে বললেন, ‘‘কাবলেদের সম্বন্ধে আমাকে একজন অথরিটি ভেবে নিতে পারো। ওদের সঙ্গে অনেক মেলামেশা করেছি।’’
- তা’হলে তো ওদের পুশতু ভাষাও একটুআধটু জানেন। কিছু সংলাপ পুশতুতে দিতে চাইছি।
এ বার যেন একটু ঘাবড়ে গেলেন ছবি বিশ্বাস। বললেন, ‘‘শুধু শুধু পুশতু-মুশতু আনতে গেলে কেন? বুঝবে কে?’’
- না বুঝলেও চলবে। এতে অভিনয়ের একটা ডায়মেনশন আসতে পারে।
ভেবে বললেন, ‘‘তা ঠিক। একটা কাবলেকে ধরে শিখে নিলেই চলবে। বাদবাকিটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। কেমন পোশাক-পরিচ্ছদ, মেকআপ, চলাবলা …।’’
- প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে একটা বাড়িতে অনেক কাবুলিওয়ালা থাকে। তাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে কথা বলেছি। সে মাঝে মাঝে আপনার কাছে যাবে।
এর পরের কাহিনি শোনা যাক তপন সিংহর কাছেই।
এক জায়গায় লিখেছেন, ‘‘সেটটি ছিল মেটিয়াবুরুজের একটা মুসলমান হোটেলের অংশবিশেষ। … আমরা যখন সেট লাইট প্রভৃতি নিয়ে ব্যস্ত, হঠাৎ ছবি বিশ্বাস কাবুলিওয়ালার বেশে প্রবেশ করলেন। চমকে উঠলাম। এ কাকে দেখছি? অতি দরিদ্র মলিন বেশধারী হিং বিক্রেতা কোনও কাবুলিওয়ালা, না সদ্য কবর থেকে বেরিয়ে আসা স্বয়ং মহম্মদ বিন তুঘলক? মাথায় জরির পাগড়ি। গায়ে সিল্কের আচকানের ওপর জরির কাজ করা হাতকাটা জ্যাকেট। পায়ে সোনার জরির কাজ করা নাগরা। তখন আমি তিনশো টাকা মাইনের এক জুনিয়র পরিচালক। আর ছবি বিশ্বাস হলেন সে যুগের অজেয় দুর্দান্ত অভিনেতা। সুতরাং ইগনোর্যান্স ইজ্ ব্লিস কথাটি ভেবে কাজ শুরু করে দিলাম।’’
বিকেল বেলা প্রযোজক অসিত চৌধুরী হাজির। দেখে শুনে গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ বাদেই তাঁর প্রস্থান। তিন চার দিন বাদে অসিতবাবু মুখ খুললেন, ‘‘দেখুন মশায়, ছবিদাকে ওই ঔরঙ্গজেবের পোশাক ছেড়ে গরিব কাবুলিওয়ালা সাজতে হবে। যতটা কাজ হয়েছে ফেলে দিন।’’
ঠিক হল দু’জনে মিলে গিয়ে বলা হবে। বেশ ভয়ে ভয়েই ছবি বিশ্বাসের কাছে কথাটা পাড়লেন ওঁরা।
শুনে প্রথমে চমকে উঠলেও পরে অবশ্য যুক্তিটা মেনে নেন তিনি। তখন আবার নতুন করে পোশাক তৈরি। নতুন করে শ্যুটিং।
তপন সিংহের অভিজ্ঞতায় ছবি বিশ্বাসের পরের কাণ্ডটি আরও মারাত্মক।
ছবি বিশ্বাসকে নিয়ে তপন সিংহ বলেছেন, ‘‘যেমন সুদক্ষ অভিনেতা তেমনি আবার ফাঁকিবাজও ছিলেন।’’
ঘটনাটি অনেকটা সেই ধাঁচেরই বটে।
সে বার শ্যুটিং কাশ্মীরে। শ্রীনগর থেকে পহেলগাঁওয়ের পথে বেশ কিছু ভেতরে সুন্দর একটা উপত্যকায়। অনেকটাই কাবুলের সঙ্গে মিলে যায় তার গড়ন। নানা জায়গা ঘুরে ঘুরে শ্যুটিং করে তপন সিংহর শরীর তখন বেশ কাহিল। রোজ রাতে জ্বর আসছে।
শ্যুটিঙের দিন ভোরবেলা ছবি বিশ্বাসকে তিনি বললেন, ‘‘শরীরটা আর দিচ্ছে না। আপনি তাড়াতাড়ি চলে আসুন। আজকেই কাজ শেষ করে নেব।’’
- দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।
তপন সিংহ লিখছেন, ‘‘শ’খানেক ভেড়া ও লোকজন জড়ো করে অপেক্ষা করছি। এমন সময় ওঁরা এলেন। দূর থেকে দেখছি জিপ থেকে কাবুলিওয়ালা নামলেন, কিন্তু তার পর যিনি নামছেন, তিনি কে? স্যুট পরা লম্বা চওড়া এক ভদ্রলোক! কাছে আসতে চমকে উঠলাম, উনি তো ছবি বিশ্বাস! তা’হলে কাবুলিওয়ালা কে? এসেই বললেন, দারুণ জায়গা বেছে নিয়েছ তো! এত সুন্দর জায়গায় কি আর আমার ক্লোজ-আপ নেবে? তাই তোমার সহকারী বলাইকে কাবুলিওয়ালার মেকআপ করালাম। একটু লং-এ ট্রিট করলে কেউ ধরতে পারবে না।’’
তপন সিংহ নির্বাক! বলেন কি ভদ্রলোক! কিন্তু আর তো উপায়ান্তরও নেই।
অতএব?
শ্যুটিং হল। ওই বলাইকে দিয়েই!
বলাই বাহুল্য, ছবিতে কাবুলের দৃশ্যে আজও কাবুলিওয়ালা বেশে যাঁকে দেখা যায়, তিনি ছবি বিশ্বাস নন। বলাই সেন।
মানুষ যে কত বিচিত্র হয়! কত বৈপরীত্যে ভরা তার যে আচার-আচরণ!
এই ছবি বিশ্বাসই আবার দেখুন, সম্পূর্ণ অন্য চিত্র তখন।
সময়টা ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর। আউটডোরে যেতে তখন অল্প ক’দিন বাকি। পোস্টমাস্টারের চরিত্রটি তখনও কে করবেন, ঠিক নেই পরিচালক তপন সিংহর।
ছবি বিশ্বাসের কাছে গিয়ে কথায় কথায় বললেন, ‘‘কাকে নিই বলুন তো?’’
উত্তর এল, ‘‘একজনই আছে।’’
- কে?
- তার নাম ছবি বিশ্বাস।
নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না তখন।
তপনবাবু বললেন, ‘‘মাত্র দু-তিন দিনের কাজ। রাত বারোটায় ফ্লাইট। সেখান থেকে গাড়ি। আপনার শরীর অত ধকল নিতে পারবে?”
- খুব পারবে। ঘাবড়াচ্ছ কেন?
তখন উনি স্টার থিয়েটার-এ। নিয়মিত স্টেজ করছেন। প্রাণান্তকর পরিশ্রম। তার মধ্যেই তিন দিন ‘ম্যানেজ’ করে কাজ করতে ছুটলেন ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর।
অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছবি বিশ্বাসের সম্পর্কটা ছিল সম্পূর্ণ অন্য ধরনের। ‘‘ছবি জ্যাঠামশাই-এর শেষ দশ-বারো বছরে ফিল্ম লাইনে একমাত্র নৃপতি চট্টোপাধ্যায় ছাড়া বাবার মতো আপনার কেউ ছিল না। অথচ ওঁর সঙ্গে বাবার আলাপটা কিন্তু অত সহজে হয়নি,’’ এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন ভানুপুত্র গৌতমবাবু।
কী রকম? গৌতম জানিয়েছিলেন, ‘‘সে ’৪৭ সাল-টাল হবে। ‘অভিযোগ’ ছবির কাজ চলছে। বাবার খুব ইচ্ছে, ওঁর সঙ্গে আলাপ করার। জেঠু পাত্তা দিতেন না। ভেবেছিলেন, ফিল্মে চান্স পাওয়ার জন্য বাবা বুঝি তোষামোদি করেছে। আসলে তখন জহরকাকা-বাবা-প্রদীপকুমারদের মতো নতুনদের একটা দল ছিল, যাঁরা সত্যিই কাজের জন্য স্টুডিয়ো পাড়ায় ঘুরঘুর করতেন। শেষে ‘নতুন ইহুদী’ নাটকে বাবার অভিনয় দেখে উনি নিজেই ডেকে পাঠান।’’
‘‘এর পর থেকে ছবি বিশ্বাস বলতে গেলে ওঁর অভিভাবকের মতো হয়ে যান। বাবা মারা যাওয়ার পর অর্থ সাহায্য করা থেকে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ‘কাঞ্চনমূল্য’ ছবি প্রযোজনা করলেন, তখন নামমাত্র টাকায় কাজ করে দেওয়া। আর কী উৎসাহ সে কাজে! দুপুর দুটোয় শ্যুট। উনি এসে বসে থাকতেন ঘণ্টা দুই আগে। প্যাকআপের পরেও আড্ডা দিতেন। কাজ না থাকলেও সেটে ঘুরে যেতেন।’’
এমন এক শ্রদ্ধার সম্পর্কে দুষ্টুমি-খুনসুটি যে ছিল না, তা নয়। একবারের ঘটনা যেমন।
‘ডাকবাংলো’ নাটক। ছবি বিশ্বাসের বরাবরের অভ্যেস, মঞ্চে সংলাপ বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে অন্যকে জেরবার করা। সে দিন ভানু ঠিক করলেন, আজ উনি ওঁকে বেকায়দায় ফেলবেন! সে কথা ফাঁস করে দিয়েছিলেন সুখেন দাস। এর পর মঞ্চে ওঠার পর প্রায় পালাতে পথ পাননি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
তাঁর শ্রী নীলিমাদেবীর বক্তব্যে, ‘‘নাটকে ওঁর নাম ছিল কৃতান্ত বিশ্বাস। ছবিদা নাম জিজ্ঞেস করলে, উনি বললেন। এ বার ছবিদা শুরু করলেন। ‘কী বললেন, বিশ্বাস?’ ‘আজ্ঞে।’ ‘কাউকে বিশ্বাস করবেন না।’ ‘আজ্ঞে।’ ‘আবার অবিশ্বাসও করবেন না।’ ‘আজ্ঞে।’ বলেই চলে যেতে চাইছিলেন। উনি বুঝে গিয়েছিলেন, আজ ছবিদা সহজে ছাড়বেন না। ছবিদা ততক্ষণে বলতে শুরু করেছেন, ‘আরে মশাই, চলে যাচ্ছেন কেন? বিশ্বাসও করবেন না, আবার অবিশ্বাসও করবেন না, তবে করবেনটা কী? বলুন,’ তখন উনি ওঁর কাছে এসে প্রায় হাত জড়ো করে বিড় বিড় করতে লাগলেন, ‘খুব অন্যায় হয়ে গেছে। আর কোনও দিন করব না।’ ছবিদা বললেন, ‘ব্যাটা চালাকি আমার সঙ্গে! বল্, ‘বাড়ি গিয়ে ভাবব।’ শেষ কালে তা-ই বলে সে দিনের মতো উদ্ধার।’’
ছবি বিশ্বাস যে দিন জাগুলিয়ার পথে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেলেন, সে দিন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়েরও যাওয়ার কথা ছিল।
হঠাৎ রেডিয়ো নাটক পড়ে যাওয়াতে শেষপর্যন্ত যেতে পারেননি। তাতে আজীবন আপশোস বয়ে বেড়িয়েছেন। কেবলই তাঁর মনে হত, যদি সঙ্গে থাকতেন, কিছুতেই অমন হত না।
‘নায়ক’ তৈরির সময় সত্যজিৎ রায় নাকি শুরুতে বলেছিলেন, ‘‘ওহে উত্তমকুমার, প্রথম সিনটা একটু ছবিবিক ঢঙে অভিনয় করতে হবে।’’ মানে, ছবি বিশ্বাসের মতো।
মনে ধরেনি। লিখেছেন, ‘‘ছবিবিক ঢঙে আমি কী অভিনয় করব? ছবিদা ছবিদার মতো অভিনয় করতেন, আমি আমার মতো করব।’’
ইগো? না, তা হয়তো নয়।
এক জায়গায় ছবি বিশ্বাসকে নিয়ে তিনি লিখছেন, ‘‘ওই একটা মাত্র লোক স্ক্রিনে থাকলে যেন তাঁর পর্বতপ্রমাণ গাম্ভীর্য আর ব্যক্তিত্বের কাছে আশেপাশের আর সমস্ত কিছু নস্যাৎ হয়ে যেত। … অমনটি ছিল না, আর হবেও না কোনও দিন।’’
ছবি বিশ্বাসের মৃত্যুর পরে মহানায়ক উত্তমকুমার বলেছিলেন,
… ‘‘আমার আর ব্যারিস্টারের ছেলের অভিনয় করা হবে না।’’ …
ছবি বিশ্বাসের মৃত্যুর পর বিশ্ববরেণ্য পরিচালক শ্রী সত্যজিৎ রায় একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন,
… ‘‘১৯৫৮ সনে যখন ‘জলসাঘর’ ছবি করব বলে মনস্থ করি, তখন বিশ্বম্ভর রায়ের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য ছবি বিশ্বাসের চেয়ে যোগ্যতর অভিনেতা কেউ ছিলেন না। কিঞ্চিৎ দ্বিধা সত্ত্বেও তাই তাঁর শরণাপন্ন হতে হয়েছিল আমাকে। দ্বিধা বলছি এই কারণে যে ব্যক্তিটিকে মানুষ হিসেবে তখনও চিনিনি; জানতাম legend হিসাবে এবং এই legend টি সম্পর্কে অল্পবিস্তর অপবাদও আমার কর্ণগোচর হয়েছিল— পরিচালক হিসাবে যা আমাকে উদ্বিগ্ন করেছিল।… ছবিবাবুর মতো অভিনেতা না থাকলে ‘জলসাঘর’-এর চিত্ররূপ দেওয়া সম্ভব হত কিনা জানি না। বোধ হয় না।’’ …
১৯৩৬ থেকে ৪১ সাল পর্যন্ত টানা নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করে হঠাৎই ‘নর্তকী’ ছবির রোম্যান্টিক চরিত্র ছেড়ে তিনি স্বামীজীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। সে ছবি মুক্তি পাওয়ার পর ঘোষণা করলেন— এ বার থেকে তিনি চরিত্রাভিনেতা। এ কথা শুনে উত্তমকুমার বলেছিলেন এমন সিদ্ধান্ত শুধু ওই অভিনেতার পক্ষেই নেওয়া সম্ভব। পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁকে ভারতবর্ষের ‘বেস্ট স্ক্রিন অ্যাক্টর’ শিরোপা দিয়ে বলেছিলেন, অভিনয় জগতে তিনি একটা যুগ। চলচ্চিত্রে অভিনয়ে একটা থিয়েটারি ঢঙ ছিল। প্রথমে সেটি ভাঙেন প্রমথেশ বড়ুয়া। পরে যিনি অভিনয় শিল্পকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের ‘ব্লু-ব্লাডেড অভিনেতা’ শ্রী ছবি বিশ্বাস।
… “মে আই স্পিক টু মিসেস রিনা ব্রাউন?” …
… “লেকিন খোঁকি তুমি শ্বশুরবাড়ি যাবে না, হামাকে ছেড়ে কোত্থাও যাবে না।” …
… “দাও, ফিরিয়ে দাও, ফিরিয়ে দাও আমার সেই বারোটা বচ্ছর।” …
… “সুদখোরের টাকায় আমার একমাত্র ছেলের উপনয়ন হতে পারে না তারাপ্রসন্ন।” …
… “মনে রাখব? কেন মনে রাখব? ওর বিশেষত্বটা কী?” …
‘সপ্তপদী’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘সবার উপরে’, ‘জলসাঘর’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ – বাঙালির মনে এমন আরও ছবির সংলাপ স্পষ্ট হয়ে রয়েছে শুধু ছবি বিশ্বাসের অভিনয়ের গুণে। গিরিশ-যুগের অভিনয়ের ধারাটি শিশির ভাদুড়ি বা অহীন্দ্র চৌধুরী সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। একই মঞ্চে, একই ধারায় তাঁদের সঙ্গে অভিনয় করেছেন ছবি বিশ্বাস। কিন্তু সর্বত্রই বজায় ছিল তাঁর স্বকীয়তা। মন্মথ রায়ের ‘মীরকাশিম’ নাটকে ছবি বিশ্বাস নাম ভূমিকায় অভিনয় করে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন। এ তো গেল মঞ্চের কথা। চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় প্রসঙ্গে স্বয়ং সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন,
… “ছবিবাবু না থাকলে ‘জলসাঘর’-এর মতো চিত্ররূপ দেওয়া সম্ভব হত কিনা জানি না। বোধ হয় না। এক দিকে বিশ্বম্ভর রায়ের দম্ভ ও অবিমৃষ্যকারিতা, অন্য দিকে তাঁর পুত্রবাৎসল্য ও সঙ্গীতপ্রিয়তা এবং সব শেষে তাঁর পতনের ট্র্যাজেডি – একাধারে সবগুলির অভিব্যক্তি একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল।” …
মঞ্চ থেকে ছবি, ছবি থেকে আবার মঞ্চ – দাপটে চালিয়ে গিয়েছেন ছবি বিশ্বাস নিজের অভিনয় জীবন। আর তাই ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ নাটকটির উৎসর্গ পত্রে তাঁকে ‘নট সম্রাট’ নামে অভিহিত করেছিলেন মন্মথ রায়।
রাজা শশাঙ্ক দেবের উত্তর পুরুষ, শ্রী শচীন্দ্রনাথ দে বিশ্বাস কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন ১৯০২ সালের ১২ জুলাই। কাত্যায়নীদেবী ও ভূপতিনাথের এই পুত্র সন্তানটিকে সুন্দর দেখতে ছিল বলে মা তাঁকে ‘ছবি’ বলে ডাকতেন। আর সেই ছবি নামটিই চলচ্চিত্র জগতে পরে সুপরিচিত হয়ে উঠেছিল।
১৬০০ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে দিল্লির সম্রাট আকবরের কাছ থেকে ‘বিশ্বাস’ উপাধি পেয়েছিলেন তিতুরাম দে। তাঁর উত্তরপুরুষ রামকান্তের পুত্র চণ্ডীচরণ দে বিশ্বাস ১৭০০ সালে বড় জাগুলিয়া থেকে ২৪ পরগনার বারাসতের ছোট জাগুলিয়ায় এসে বসবাস শুরু করেন। বসতবাড়িটির নাম ‘কালীনিকেতন’। এর পর সামন্ততান্ত্রিক পরিচয়কে পিছনে ফেলে শিক্ষা ও ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য নিয়ে সম্ভ্রান্ত পরিবারটি কলকাতায় চলে এল। জাগুলিয়ায় যাতায়াত রইল, তবে সে কেবল পুজো-পার্বণে।
কলকাতায় বিশ্বাস পরিবারের উত্তর প্রজন্ম কালীপ্রসন্ন বিশ্বাস থাকতেন বিডন স্ট্রিটে। অর্থে, প্রতিপত্তিতে, ঐতিহ্যে, অনুষ্ঠানে, দান-ধ্যানে, দয়া-দাক্ষিণ্যে বনেদি পরিবার হিসেবে বিডন স্ট্রিটের বিশ্বাস পরিবারের পরিচিতি ছিল। কালীপ্রসন্নের ছোট পুত্র ভূপতিনাথ ছিলেন প্রতিষ্ঠিত পাট ব্যবসায়ী। বিডন স্ট্রিটেরই প্রতাপচাঁদ মিত্রের কন্যা কাত্যায়নীদেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ভূপতি-কাত্যায়নী দম্পতির ছোট ছেলের নাম শচীন্দ্রনাথ দে বিশ্বাস। চিত্রজগতে তিনি নাম হিসেবে ‘ছবি’ ও ‘বিশ্বাস’ পদবি ব্যবহার করতেন।
ছবি’র দশ মাস বয়সে মা কাত্যায়নীর মৃত্যু হয়। অসময়ে মা চলে যাওয়ায় মেজ জ্যাঠাইমার কাছে মানুষ হয়েছিলেন তিনি। ছবি বিশ্বাসের অভিনয় স্পৃহা ছিল ছোট থেকেই। যৌথ পরিবারে ভাই-বোন সবাই মিলে আবৃতি, গান, নাটক— এসব চলত। পাশাপাশি পড়াশোনাও চলত। মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি। নয়ানচাঁদ স্ট্রিটের একটি কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষাজীবন শুরু। পরে ক্ষুদিরাম বসু লেনের সেন্ট্রাল কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চমশ্রেণি পর্যন্ত পড়ে হিন্দু স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন ছবি বিশ্বাস। তবে বন্ধুদের সঙ্গলাভের আশায় প্রেসিডেন্সি ছেড়ে পরে বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন।
বালক ছবিকে সকলে ভালবাসতেন। তাঁর বাবা ভূপতিনাথের পাটের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল ‘মরান অ্যান্ড কোম্পানি’। সেই সূত্রে প্রতিষ্ঠানের এক বিভাগীয় কর্তা জি এস আলেকজান্ডার প্রায়ই বিশ্বাস-বাড়ি আসতেন। নিঃসন্তান এই দম্পতি ছবিকে দত্তক নিতে চাইলেন। কিন্তু তাতে বাধ সেধেছিলেন মাতামহী। কাজেই আলেকজান্ডার পরিবারে আর যাওয়া হয়নি ‘ছবি’র।
৩৪ নম্বর বিডন স্ট্রিটের যে বাড়িতে ছবি বিশ্বাসের জন্ম হয় তার সামনের দিকের বেশির ভাগটাই জনৈক ভোলানাথ দত্তকে বিক্রি করা হয়। যেটি বর্তমানে ‘ভোলানাথ ধাম’ নামে পরিচিত।
গোপীমোহন লেনের বাসিন্দা শচীন্দ্রনাথ বসুর কন্যা নীহারবালাদেবী ওরফে সমীরাদেবীর সঙ্গে ছবি বিশ্বাসের বিয়ে হয়। তাঁদের দুই পুত্র – মলয় ও দিলীপ এবং একটিই কন্যা, মঞ্জুলা।
মদন মিত্র লেনে নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের বাড়ির বৈঠকখানায় ছিল ‘বারবেলা বৈঠক ক্লাব’। এখানে হত শখের অভিনয়। করেছিলেন নাটক ‘ভীষ্ম’। সম্ভবত এই ক্লাবে যোগদানের মাধ্যমেই ছবি বিশ্বাসের অভিনয় জীবনের হাতেখড়ি। ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউ হলে নানা সুধীজন আসতেন। সেখানেই ছবি বিশ্বাস পরিচিত হলেন শিশিরকুমার ভাদুড়ির সঙ্গে। নিয়মিত না শিখলেও নিজেকে মনে করতেন শিশিরকুমারের শিষ্য। এই ভালবাসা থেকেই জড়িয়ে পড়লেন ললিতচন্দ্র বসু পরিচালিত শিকদারবাগান বান্ধব সমাজের সঙ্গে। বান্ধবসমাজের ‘নদীয়া বিনোদ’ কীর্তনাভিনয় প্রথম অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৩-এর ২৬ ফেব্রুয়ারি। সেখানে ছবি বিশ্বাস নিমাই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। মোট ১৭৫ রজনী অভিনীত হয় ‘নদীয়া বিনোদ’। পরে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন রমেশচন্দ্র দত্তের সহযোগিতায় গঠিত কাঁকুড়গাছি নাট্য সমাজ ও হাওড়া নাট্য সমাজের সঙ্গে। ছোট জাগুলিয়ার ‘বান্ধব সমিতি’ ছবি বিশ্বাসের পৈতৃক বাড়ির সামনে ম্যারাপ বেঁধে মঞ্চস্থ করল ‘বিল্বমঙ্গল’ নাটক। সে নাটকে ছবি ‘চিন্তামণি’র ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ১৯৩৮-এ নাট্যনিকেতন মঞ্চে পেশাদারি শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ। নাটক – ‘সমাজ’।
শৈশবে কিছু দিন সঙ্গীতচর্চা করেছিলেন তিনি। জমিরুদ্দীন খান সাহেবের কাছে নাড়াও বেঁধেছিলেন।
নানা রাজনৈতিক ঘটনায় কলকাতা উত্তাল হল। ব্যবসায় ধাক্কা খেল বিশ্বাস পরিবার। ভূপতিবাবু বিডন স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে উঠে এলেন মোহনবাগান লেনে। এই সময় নাট্য পরিচালক সতু সেন ছবিবাবুকে মিনার্ভা থিয়েটারে ডেকে পাঠালেন। কিছু দিনের মধ্যে নাট্য নিকেতন মঞ্চে জ্যোতি বাচস্পতি রচিত ‘সমাজ’ নাটকে পেশাদার শিল্পী হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ। সালটা ছিল ১৯৩৮। নাট্যকার মন্মথ রায়ের ‘মীরকাশেম’ ওই বছরেরই ১৭ ডিসেম্বর মঞ্চস্থ হয়। তার পর ‘পথের দাবী’, ‘পরিণীতা’ ও ‘ভারতবর্ষ’ করে নাট্যমন্দির ছেড়ে নাট্য ভারতীতে চলে এলেন ছবিবাবু। মঞ্চায়িত হল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দুই পুরুষ’। নুটুবিহারীর চরিত্রে অসামান্য অভিনয় করলেন ছবি বিশ্বাস। এটি পরে চিত্রায়িতও হয়েছিল। ‘দেবদাস’, ‘ধাত্রীপান্না’, ‘কাশীনাথ’, ‘চাঁদ সদাগর’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘গৈরিক পতাকা’, ‘বিজয়া’, ‘পরমারাধ্য শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘ডাকবাংলো’-সহ ৩৯টি নাটকে অভিনয় করেছিলেন তিনি। অভিনয় করেছেন মিনার্ভা, স্টার, শ্রীরঙ্গম ও সুন্দরম-এ। ‘স্বামী’ নাটকটি সুন্দরমকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল আর সে সঙ্গেই নাট্যশিক্ষক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন ছবি বিশ্বাস। এমন নাট্যশিক্ষক, যিনি বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন নাটকে প্রম্পটারের কোনও স্থান নেই।
ছবি বিশ্বাস খুব ভাল আবৃত্তিকারও ছিলেন। রেডিওতে তিনি আবৃত্তির অনুষ্ঠান করতেন সে আমলে। বেতারে তাঁর নাটক সম্প্রচারিত হত – ‘চাণক্য’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’।
সে কালের বিখ্যাত পরিবেশক রিতেন অ্যান্ড কোম্পানির খগেন্দ্রলাল চট্টোপাধ্যায় ছবি বিশ্বাসকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন অভিনেতা ও পরিচালক তিনকড়ি চক্রবর্তীর সঙ্গে। ১৯৩৫ সালের শেষ দিকে নিরুপমাদেবীর লেখা ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ নিয়ে ছবি করার জন্য তিনি নায়কের মুখ খুঁজছিলেন। লম্বা, সুদর্শন ছবি বিশ্বাস চলচ্চিত্র জগতে প্রথম পা রাখলেন ১৯৩৬-এ বিশু চরিত্রে।
সিনেমায় অভিনয় করাটা হঠাৎই। একদিন ছবি বিশ্বাস কর্নওয়ালিস ক্রাউন (উত্তরা সিনেমার সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছিলেন। সেইসময় বুকিংয়ে বসেছিলেন প্রিয়নাথ গাঙ্গুলি। তিনি ছিলেন ম্যাডন কোম্পানির মাইনে করা পরিচালক। তিনি ডাকলেন ছবি বিশ্বাসকে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘সিনেমা করবেন’।
ছবি বিশ্বাস একপায়ে খাঁড়া। সম্মতি জানালেন। পরিচালক তিনকড়ি চক্রবর্তী তখন করছিলেন ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’। ছবি বিশ্বাসকে তাঁর কাছে নিয়ে গেলেন প্রিয়নাথ গাঙ্গুলি। পরিচালকের পছন্দ হল ছবি বিশ্বাসকে। কালী ফিল্মসের ব্যানারে ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ (১৯৩৬) ই হল ছবি বিশ্বাসের প্রথম ছবি। সকলেই ছবি বিশ্বাসের অভিনয়ের প্রশংসা করলেন।
‘অন্নপূর্ণার মন্দির’-এ ছবি বিশ্বাসের নাম হলেও নতুন কোনও ছবির অফার তাঁর কাছে আর আসে না। তিনি এ স্টুডিয়ো ও স্টুডিয়ো ঘুরে বেড়ান। একদিন একজন বললেন, ‘আপনি যতই ঘোরাঘুরি করুন কাজ আপনি পাবেন না। আপনার বদনাম করে বেড়াচ্ছেন কমেডিয়ান নৃপতি চাটুয্যে।’
নৃপতিকে চেনেন না ছবি বিশ্বাস।
একদিন স্টুডিয়োরই একজন চিনিয়ে দিলেন। বললেন, ‘ওই যে ঢাঙা মতো রোগা লোকটি যাচ্ছেন, উনিই নৃপতি।’
ছবি বিশ্বাস ডাকলেন, ‘ও মশাই শুনছেন।’
পিছন ফিরে নৃপতি বললেন, ‘আমাকে ডাকছেন?’
‘আপনাকে ছাড়া আর কাকে ডাকবো শুনি। আছেটা কে এখানে!’ ছবি বিশ্বাস তখন খেপে আছেন নৃপতির ওপর।
নৃপতি সামনে এসে বললেন, ‘বলুন। কি বলতে চান?’
ছবি বিশ্বাস অভিযোগের সুরে বললেন, ‘আপনি আমার বদনাম করছেন কেন? আমি আপনার পাকাধানে কী মইটা দিয়েছি বলুন তো!’
নৃপতি ততোধিক শান্ত। বললেন, ‘আপনি খারাপ অভিনয় করেছেন বলব না! আপনার এমন আভিজাত্যপূর্ণ চেহারা। যে-চরিত্র করছেন তার চলনবলন, হাঁটাচলা শিখতে হবে তো! আপনি হাঁটাচলা, কথা বলা নিয়মিত প্র্যাকটিস করুন। শিখুন। দেখবেন একদিন আপনি অনেকদূর যাবেন।’
ছবি বিশ্বাস বুঝলেন ঠিকই বলছেন তিনি। পুরোপুরি নৃপতির কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমাকে কী করতে হবে প্রভু?’
নৃপতির সঙ্গে সারা জীবনের সম্পর্ক তৈরি হল ছবি বিশ্বাসের। নৃপতি তাঁর বাড়ির একটা ঘরে ছবি বিশ্বাসের জন্য আলাদা একটা বিছানা করে রেখেছিলেন। ছবি বিশ্বাস এলে সেখানেই বিশ্রাম নিতেন। এমনকী ছবি বিশ্বাস মারা যাওয়ার পর ওই বিছানা পাতাই থাকত। কাউকে বসতে দিতেন না, নিজেও কোনওদিন বসেননি। এমনটাই শ্রদ্ধা ছিল ছবি বিশ্বাসের ওপর।
এরপর থেকে ছবি বিশ্বাসের কাছে ছবির অফার আসতে শুরু করল। ছবি বিশ্বাস নিজেকে বদলালেন।
অভিনয়েও এল আমূল পরিবর্তন। প্রতিবছরই ছবির সংখ্যাও বাড়তে লাগল।
‘নদের নিমাই’, ‘হাত বাড়ালেই বন্ধু’, ‘সখের চোর’, ‘শিউলিবাড়ি’, ‘রাজা সাজা’, ‘আম্রপালী’, ‘বিচারক’, ‘সপ্তপদী’, ‘নীলাচলে মহাপ্রভু’-সহ প্রায় ২৫৬টি বাংলা চলচ্চিত্র ও তিনটি হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
১৯৪২ থেকে প্রতিবছর ১৩-১৪টি ছবি করতে লাগলেন ছবি বিশ্বাস। পরবর্তী কালে ‘দেবী’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ করেছিলেন তিনি। কীসব করে গেছেন তিনি। কতরকম চরিত্র তিনি যে করেছেন, ভাবনার বাইরে! তবে শম্ভু মিত্র এবং অমিত মৈত্র পরিচালিত ‘মানিক’ বোধহয় একেবারে ভিন্ন ছবি ছিল তাঁর অভিনয়জীবনে। এই ছবিতে ছবি বিশ্বাসের সংলাপ ছিল না। পুরো ছবিটাই ছিল শুয়ে শুয়ে। আজও বাংলা ছবির দর্শক মনে রেখেছেন ‘সপ্তপদী’র উত্তমকুমারের বাবার ভূমিকা, ‘দেবী’র চরিত্র। এমনভাবে বলতে গেলে বিশাল এক তালিকা তৈরি হবে। তবে ‘একদিন রাত্রে’র ছবি বিশ্বাসের কণ্ঠে মান্না দে’র গাওয়া ‘এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়, সব সত্যি’ গানের দৃশ্য আজও বর্ষীয়ান দর্শকের চোখে ভাসে। একেবারে ভিন্ন ধরনের চরিত্র করেছিলেন ‘ওরা থাকে ওধারে’ ছবিতে।
‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘জলসাঘর’ ও ‘দেবী’ – সত্যজিৎ রায়ের এই তিনটি ছবিতে অভিনয় করেছেন ছবি বিশ্বাস। ‘জলসাঘর’-এর জন্য ৫৫ বছরের প্রৌঢ়কে ঘোড়ায় চড়া রপ্ত করতে দিন সাতেক রাইডিং স্কুলে এক ঘণ্টা করে যেতে হয়েছিল। নিখুঁত অভিনেতা ছিলেন বলেই তা রপ্ত করতে পেরেছিলেন ছবিবাবু। ‘দেবী’ ছবির শ্যুটিঙে বেশি আঠা দিয়ে কিছুতেই গোঁফ লাগাতে চাননি তিনি। তাঁর স্কিন বড় ডেলিকেট যে! শোনা যায়, বেশি সাঁটাসাঁটি করলে ঠিক অভিনয়টি হবে না— এমন মন্তব্যও করতে ছাড়েননি স্পষ্টভাষী ছবিবাবু। আর ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় মূর্তিমান কাঞ্চনজঙ্ঘার মতোই যে শেষ দিনটি পর্যন্ত অবিচল রইল, সে কথা বাঙালি মাত্রেই জানে!
বাংলা ছবিতে ছবি বিশ্বাসের আভিজাত্যপূর্ণ চেহারার অভিনেতা বিশেষ আসেননি। আসেননি এমন বড় মাপের অভিনেতা। তিনি ছিলেন একটা যুগ। বাংলা ছবিতে চলনবলন, পোশাকে এনেছিলেন পরিবর্তন। তাঁর অভিনয় ছিল ভীষণই সিনেম্যাটিক। থিয়েটারি প্রভাবকে একেবারে ভেঙেচুরে দিয়েছিলেন। অথচ তিনি ছিলেন মঞ্চসফল অভিনেতা।
নাটক নিয়ে ছবি বিশ্বাস আর নৃপতির একটা মজার গল্প খুব চালু। স্টারে সেই নাটকের শো। ছবি বিশ্বাস এসেছেন নৃপতি তাঁর কাছে ১০ টাকা চাইলেন। ছবি বিশ্বাস বললেন, ‘পাবে না।’ নৃপতি বললেন, ‘দিবি না।’ ছবি বিশ্বাস কিছুতেই টাকা দিলেন না। নৃপতি বললেন, ‘দিলি না তো। আজ তোর কী অবস্থা করি দেখ!’ কলকাতায় প্রচণ্ড গরম পড়েছে সেদিন। নাটকে একটা দৃশ্যে আছে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকবেন ছবি বিশ্বাস। আর কম্বলটা খুলবেন নৃপতি এসে। নাটক শুরু হয়েছে। সেই দৃশ্যটিও চলছে মঞ্চে। নৃপতি কিছুতেই আর কম্বল খুলছেন না। কম্বলের ঘেমে নেয়ে উঠেছেন ছবি বিশ্বাস। আর নৃপতি দর্শকের দিকে পিছন ফিরে ছবি বিশ্বাসকে বলে যাচ্ছেন, ‘দশ টাকা দিবি কিনা বল।’ ছবি বিশ্বাস শেষপর্যন্ত না-পেরে উঠে বললেন, ‘দেব। এখন কম্বলটা তো খোল।’ ১০ টাকা পাওয়ার আশ্বাস পেয়ে কম্বল খুলে দিলেন নৃপতি।
ছবি বিশ্বাসের মদ্যপানের গল্পও আছে বহু। তার মধ্যে একটা হল – একদিন তাঁর মদ্যপানের মাত্রা একটু বেশি হয়ে গেছিল। সেদিন প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়েছিল কলকাতায়। বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নেমে দেখেন পাহারারত একটি পুলিশ কাঁপছে। তিনি বললেন, আপনি ওপরে গিয়ে আমার বিছানায় শুয়ে পড়ুন আর আমি আপনার হয়ে ডিউটি করে দিচ্ছি। পুলিশ যত বলে, এ আবার হয় নাকি! ছবি ততই নাছোড়বান্দা। শেষে গোলমাল শুনে ছবি বিশ্বাসের স্ত্রী ওপর থেকে নেমে তাঁকে বাড়ি নিয়ে যান।
শেষের দিকে তাঁর পারিশ্রমিক ছিল দিনে এক হাজার টাকা। তবে অনেক প্রযোজক ও পরিচালকের অনুরোধে তিনি দিনে ২৫০ টাকাতে কাজ করেছেন, এমন উদাহরণও আছে। অনেক ছবিতে তাঁর অভিনয় নায়ক-নায়িকাকেও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল। হাঁপানিকে অদ্ভুত ভাবে কাজে লাগিয়ে তিনি অসামান্য এক বাচনভঙ্গি তৈরি করেছিলেন। চলচ্চিত্র মাধ্যমে পোশাকে-চলনে-বলনে একটা পরিবর্তন এনেছিলেন ছবিবাবু। রহমতের আলখাল্লা থেকে বিশ্বম্ভরের বেনিয়ান, সাহেবি হ্যাট-কোট-স্যুট বা জরির জোব্বা – সবই যেন তাঁর শরীরে অন্য মাত্রা পেত। উত্তমকুমারের ধাক্কাপাড় ধুতির ডিজাইন নিজেই কারিগরকে দিয়ে করিয়েছিলেন ছবি বিশ্বাস। উত্তমের গ্ল্যামারের সঙ্গে মানানসই সেই ধুতি পরে ‘উত্তমকুমারের ধুতি’ নামে পরিচিত হয়েছিল।
‘প্রতিকার’ (১৯৪৪) ও ‘যার যেথা ঘর’ (১৯৪৯) নামের দু’টি ছবি পরিচালনা করেছিলেন তিনি। এ ছাড়া দু’টি ছবিতে নির্বাক অভিনয় করেন ছবিবাবু— বিজলীবরণ সেনের ‘মানিক’ ও সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশপাথর’-এ। তিনটি ছবিতে গানে লিপ দিয়েছেন তিনি – ‘প্রতিকার’, ‘একদিন রাত্রে’ ও ‘দাদাঠাকুর’-এ।
ছোট জাগুলিয়ায় সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের জন্য ছবি বিশ্বাস প্রায় ১০ বিঘা জমি দান করেছিলেন। ১৯৪২-৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় জাগুলিয়া গ্রামের ঘরে ঘরে চাল-ডাল-জামা-কাপড় পৌঁছে গিয়েছিল তাঁরই বদান্যতায়।
১৯৫৯ সালে বসুশ্রীর একটি ঘরে ‘অভিনেতৃ সঙ্ঘ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সঙ্ঘের সভাপতি অহীন্দ্র চৌধুরী আর সহ-সভাপতি ছিলেন ছবি বিশ্বাস। তিনি মনে করতেন অভিনয় শিল্পে কলাকুশলীদের ভূমিকাই মুখ্য। নিজে অভিনেতা হয়েও মনে করতেন সিনেমার আয়ের অংশ কলাকুশলীদের মধ্যে আগে ভাগ করে দেওয়া উচিত, অভিনেতারা নেবেন সকলের শেষে। যে কোনও আন্দোলনে তিনি থাকতেন সকলের আগে। রঙ্গসভা নামে একটি নাটকের দলও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ছবি বিশ্বাস।
খুব ভাল টেবল টেনিস খেলতেন ছবি বিশ্বাস। ক্রিকেট খেলাতেও আগ্রহী ছিলেন। অন্য দিকে ছিলেন গানের খুব ভাল সমঝদার, বিশেষ করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের। গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে-র সঙ্গে ছবি বিশ্বাস জমিরুদ্দীন খান সাহেবের কাছে তালিম নিয়েছিলেন। তবে এ সবের পাশে অবসর সময় শুধুই বাগান নিয়ে পড়ে থাকতেন। সেখানকার ফুল কখনও ছিঁড়তেন না, কাটিং করতেন। তোড়া সাজিয়ে উপহার দিতেন অতিথিকে। তাঁর বাঁশদ্রোণীর বাড়ির বাগানে ৬০ রকমের জবা ও ৩০ রকমের গোলাপের গাছ ছিল। নানা ধরনের হাতের কাজেও পারদর্শী ছিলেন তিনি। মাটির বা প্লাস্টিকের নানা পাত্রে রং দিয়ে আঁকতেন। বাটিকের কাজ করার পাশাপাশি শাড়িতে এমব্রয়ডারির কাজও করতেন। নিজের হাতে সাজাতেন ছেলেমেয়ের বিয়ের ও দোলের তত্ত্ব। অতিথিপরায়ণ ছবি বিশ্বাস জাগুলিয়ার বাড়িতে একটি গেস্ট হাউস করেছিলেন।
‘প্রতিশ্রুতি’ ও ‘দিকশূল’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য পেয়েছিলেন বিএফজেএ পুরস্কার। বার্লিন ও জাকার্তা চলচ্চিত্র উৎসবেও গিয়েছিলেন ছবি বিশ্বাস। সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি অভিজ্ঞান ও রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত এই শিল্পী ১৯৬২ সালের ১১ই জুন জাগুলিয়া যাওয়ার পথে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের অনুরোধে ছবি বিশ্বাসের দেহ ময়নাতদন্ত হয়নি। তিনি বলেছিলেন, সবাই জানে এটা দুর্ঘটনা, আর শিল্পীর দেহে কাটাছেঁড়া চলে না। ছবিবাবুর মৃতদেহ কলকাতার সমস্ত নাট্যাঙ্গনগুলি ঘুরিয়ে টালিগঞ্জের বাড়ি হয়ে কেওড়াতলা শ্মশানে দাহ করা হয়েছিল। শ্রী ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর মৃত্যুর পর মন্তব্য করেছিলেন,
‘‘ছবিদা চলে গেলেন। এ বার থেকে ব্যারিস্টারের চরিত্রগুলো কেটে মোক্তারের চরিত্র করতে হবে।’’
(তথ্যসূত্র:
১- সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান (প্রথম খণ্ড), সাহিত্য সংসদ।
২- বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান, দ্বিতীয় সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত