দীপক অধিকারী শাহরুখ খান নন। দীপক অধিকারী সোনু সুদ ও নন। তাই একে নিয়ে আমাদের ‘দেব’রুপে মাতামাতি করতে শহুরে বোধে আটকায়। সাথে আমাদের প্রাচীন প্রবাদে তো আছেই ‘গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না’। দেব তো ‘গেঁয়োই’। ওকে আবার মাথায় তুলে নাচার কী হলো?
লালজুতো পায়ে খোকাবাবু সেজে একের পর এক হিট দিয়েছে৷ ঘাটাল হোক বা নামখানা, কোন অষ্টাদশী শরীরে উল্কি করেছে তার নাম, কোন ছেলে ‘দেবদা আইলাব ইউ’ বলে ফেসবুক প্রোফাইল বানিয়েছে। প্রযোজক, ডিস্ট্রিবিউটার, হল মালিক লাভের টাকা ঘরে তুলতে পেরেছে, কতো স্পটবয় থেকে টেকনিশিয়ানের সংসার চলেছে ওই লালজুতোর জন্য। কেউ নিজের কষ্টার্জিত টাকার মধ্যে থেকে বাঁচিয়ে খুচরো নোট নিয়ে হলে ঢুকেছে, প্রথম সিনে নায়ক ঢুকলেই উড়াবে বলে। কেউ অনেক আশা নিয়ে জুলফিকার দেখতে গিয়ে খুব রেগে গেছে দেবদাকে ‘সিজিতদা’ মেরে দিলো বলে। সত্যি তো, গেঁয়ো যোগী আর তার ফ্যানেদের গাঁইয়া আবেগ!

দেবকে নিয়ে নাচার সত্যি কিছু আছে? বাবা সিনেমার সেটে ক্যাটারিং সার্ভিস চালাতো। কেশপুরের ছেলে। মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী পরিবারে দেবকে ও দরকারে বাসন মাজতে হয়েছে, খাবার ডেলিভারি করতে হয়েছে সেটে সেটে। বাংলা আধো আধো করে বলে, উচ্চারণ স্পষ্ট না বলে অভিযোগ আসে কিন্তু সেই ছেলেই সংসদে প্রবেশ করে প্রথম বক্তব্য পেশ করে বাংলাতে। কিছু লোকের বাংলা-জাতীয়তাবাদের হাওয়া তোলার অনেক আগে।
মেদিনীপুরে গ্রামের বাড়িতে কাকার পরিবার লকডাউনের দরুন খাবার পাচ্ছিলেন না। দেব মেদিনীপুরে রেশন পৌঁছে দেওয়ার খবর টুইটারে লিখতেই কিছু লোকে বলে আপনার কাকা খাবার পাচ্ছে না খবর রাখেন? সিপিএম খাবার পৌঁছে দিয়েছে জানেন? দেব তক্ষুণি লেখে, “ক্ষমাপ্রার্থী, আমি জানতাম না। আমাকে বলা ও হয়নি। খাবার আজ পৌঁছে যাচ্ছে একটা বাড়ি না, ওই গোটা এলাকায়। আপনাদের অভিনন্দন সাহায্য করার জন্যে”। ক’জন সংসদের দম আছে এই ভুলটা স্বীকার করে, প্রতিদ্বন্দ্বীকে অভিনন্দন জানিয়ে রাজনীতির উর্ধ্বে উঠতে পারার?
দেব তো অনেকের চক্ষুশূল হয়ে এটা ও বলেছেন এটা রাজনীতি করার সময় না। সব দলের এক হয়ে কাজ করার সময় এখন বাংলার জন্য। নতুন বাংলা তো এটাই চায়! রাজনীতি থাক কিন্তু তা যেন বাংলার অগ্রগতি, উন্নতির অন্তরায় না হয়ে যায়।
৩৬জন পরিযায়ী শ্রমিককে নেপাল থেকে ঘাটাল ফিরিয়েছেন, ত্রানের কাজ করেছেন আবার প্রকাশ্যে কানেকশন বা ফ্যানডমের তোয়াক্কা না করে এটা ও বলেছেন, ‘কৃষ্ণাঙ্গ বা হাতি হত্যার সেলেব-প্রতিবাদ, পরিযায়ীদের বুঝি জীবন নেই?
ঠিকই তো। ওনার হিসেব পরিস্কার। ওই রক্ত-ঘাম, ওই দিনের পর দিন হেঁটে চলা, রাতে ক্লান্ত হয়ে ট্রেনলাইনে শুয়ে পরা, ঘরে ফেরার কাতর আবেদন করা মুখগুলোই তো ওর ছবি দেখে, ওদের মধ্যে থেকেই তো কেউ বলে ওঠে ” আই লাবইউ দেবদা”, ওদেরই তো কলারটিউনে শোনা যায় দেবের সিনেমার গান, ওরাই তো বাংলা। ওরাই তো হিন্দুস্তান।
অনেকে আলিশান প্রাসাদে বসে ওকে নিয়ে মস্করা করে, অভিধান অনুসারে একে বোধহয় বলা হয় উন্নাসিকতা, অনেকে খিল্লি করে পাগলুকে নিয়ে, গুনীজনরা একেই বলে বোধহয় এলিটিজম কিন্তু সেই ক্লাসটা ঠিক যেখানে শেষ হয় তারপর থেকে শুরু হয় ডলবি ডিজিটালে সংলাপ- চ্যালেঞ্জ নিবি না শালা!
একজন সংস্কৃতিমনস্ক, রুচিশীল বাঙালি একবার বলেছিল, দেব হচ্ছে poor man’s শাহরুখ খান বুঝলে, পাতে দেওয়া যায় না। আমি জানতে চেয়েছিলাম সেভাবে দেখলে কী কলকাতা poor man’s মুম্বাই না? আর অমুক বাবু poor man’s জাঁ পল সার্ত্রে নয়? অশিক্ষিত, ঐতিহ্যে সম্বন্ধে অবগত নই ইত্যাদি বলে উনি মুখ গোমড়া করেছিলেন।
আমাদের সময় লাগে শিব আরাধনা ছেড়ে মনসাদের গ্রহণ করতে। কলকাতা ছেড়ে জেলার দিকে তাকাতে। শহুরে আইকনদেরই দেবতুল্য ভাবি, বাকিটা চ্যাংমুরিকানি। তারা যতোই দেবত্বের অধিকারী হোক, আমাদের সময় লাগে এদের স্তম্ভমূলে বসাতে। বনেদি নয় যে! পেডিগ্রি নেই যে!
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত