তাঁর অভিনয়-জীবনটা পুরোটাই গল্প আর গল্প। তার মধ্যে একটি-দুটি না বললে বোধ হয় অভিনেতা-মানুষটির অভিনয়ে বিলীন হয়ে যাওয়া ধাঁচাটা যেন অধরাই থেকে যায়।
পুজোর ছুটিতে দেওঘরে গিয়ে যখন প্রথম প্রেমে পড়েন, তখন সবে কলেজে। সে অবশ্য বেশি দিনের নয়, কিন্তু একেবারে শেষ বেলাতে এসেও যে তার উত্তাপ ছিল, টের পাওয়া যায় লেখায় – ‘‘এক দিন সন্ধ্যার অন্ধকারে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম, পরস্পর পরস্পরের বুকের শব্দ শুনেছিলাম। মনে পড়ে সারা দিন রাত কী এক অনির্বচনীয় আনন্দে ভরপুর হয়ে থাকতাম।’’ এতে অবশ্য রসিকতা নেই। রসিকতা যত, সব বড় বয়সের প্রেম নিয়ে। নিজেই বলেছেন, ‘‘ফিল্মে নামার আগে দু’চার বার, পরে যে কত বার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু ব্যাপারটি সব সময় ছিল বোধ হয় একপক্ষীয়। অর্থাৎ আমিই প্রেমে পড়তাম, হাবুডুবু খেতাম আবার ভেসে উঠতাম, অন্য পক্ষকে বলা হয়ে উঠত না, আর বলবই বা কী করে? বলবার উয্যুগ করলেই তো বিপদ ঘটে যেত।’’
তেমনই এক জবরদস্ত ‘বিপদ’-এর গল্প আছে অনুভা গুপ্ত আর মঞ্জু দে-কে নিয়ে। দু’জনেরই রীতিমতো প্রেমে পড়েছিলেন বিকাশ।
তখন ‘রত্নদীপ’ সবে হিট করেছে। পরিচালক দেবকী বসু তাই রাধা ফিল্মস্-এ এলাহি খাওয়ানোর ব্যবস্থা করলেন। স্টুডিয়োয় গিয়ে ইতিউতি ঘুরছেন বিকাশ। তখনই কাণ্ড ঘটালেন দুই নায়িকা। হঠাৎ দু’জনেই বলে বসলেন, ‘‘আসুন বিকাশবাবু, চু কিৎকিৎ খেলি।’’ বিকাশ লিখেছেন, ‘‘বাহাদুরি দেখাতেই রাজি হয়ে গেলাম। …প্রসঙ্গত বলে রাখি, অনুভা ছেলেবেলায় মেয়েদের ব্যান্ড লিডার ছিলেন। ইয়া ঢাউস ড্রাম বুকের ওপর রেখে দড়াম দড়াম করে বাজিয়ে মার্চ করে যেতেন, আর মঞ্জু তাঁর ছেলেবেলায় ঘোড়ায় চড়ে কোন মহিলা সেবাদলের অগ্রণী হয়ে মার্চ পাস্ট-এ যোগ দিতেন। … প্রথম খেপেই চু-উ-উ বলে দৌড়ে এসে মায়াকে ‘মোর’ করে অনুভা তাঁদের কোর্টে ফিরে গেলেন। তার পর আমি গেলাম ওঁদের কোর্টে। অনুভাকে ‘মোর’ করে ফিরে আসছি, পিছন থেকে উনি মারলেন ল্যাং। আমি তো ছিটকে পড়লাম, মঞ্জু দৌড়ে এসে বসলেন আমার বুকের ওপর, অনুভা বসলেন পা দুটোর ওপর। আর তার পর হি হি করে দু’জনের কী বিজয়িনীর হাসি! আমি তো গেলুম, মলুম বলে চেঁচাচ্ছি – শেষে মিলিদি এসে মহিলা দুটিকে ধমক দিয়ে আমার সর্বাঙ্গ থেকে নামালেন – আমার প্রেমও ঘুচে গেল।’’
প্রেমজীবনে বিব্রত হয়েছেন। বিয়ে করতে গিয়েও ঝঞ্ঝাট কম হয়নি! প্রথম বার বিয়ের ঠিক হল। বিয়ের দিন পনেরো আগে পাত্রীর বাবা বললেন, ‘‘টাকাকড়ি কিছু নেই। বিয়ে এক বছর পিছিয়ে দাও।’’ বিকাশের বাবা বললেন, ‘‘টাকাকড়ির তো কোনও প্রয়োজন নেই। আমার তো কোনও চাহিদা নেই। আপনিই বলেছিলেন মেয়ে জামাইকে দেবেন। নাইবা দিলেন। আর বরযাত্রী ইত্যাদি যদি না নিয়ে যাই, তা’হলে তো কোনও খরচ নেই।’ ভদ্রলোকের তাতেও এক কথা। বিয়ে ভাঙল। আবার নতুন পাত্রীর খোঁজ। পাত্রী পাওয়াও গেল। দিনক্ষণ ঠিক হল। চিঠি বিলি শুরু হল। তখনই এল ভাঙচি। দু’পক্ষেই। ফলে আবার ভাঙন। এ বার খেপেটেপে বিকাশ তাঁর দিদিকে বললেন, ‘‘২০ জানুয়ারি বিয়ে। দেবে তো ভাল। নইলে চলে যাব বাড়ি ছেড়ে।’’ সাত দিন মাত্র বাকি বিয়ের তারিখের। এ দিকে একমাত্র ছেলে যদি বাড়িছাড়া হয়, বাবা সইবেন কী করে! এক পারিবারিক বন্ধু বেরোলেন পাত্রীর খোঁজে। পাত্রী পাওয়া গেল এক অদ্ভুত উপায়ে। মেয়েটির বিয়ের ঠিক হয়ে গিয়েছিল এক বিপত্নীক ভদ্রলোকের সঙ্গে। অনেক টাকাকড়ির মালিক। নিঃসন্তান। ভাবী স্ত্রীর জন্য এক কাঁড়ি গয়নাও কিনে ফেলেছিলেন তিনি। হঠাৎ কী খেয়াল হল, ভাবী স্ত্রীকে নিয়ে গেলেন সিনেমা দেখতে। শান্তারামের ছবি, ‘দুনিয়া না মানে’। এক বিপত্নীক ভদ্রলোক অল্পবয়সি মেয়েকে বিয়ে করে কী দুর্ভোগে পড়েছিলেন, তাই নিয়েই কাহিনি। ব্যস, দেখে ভদ্রলোকের বুক শুকিয়ে গেল। ভাবী বৌয়ের গয়নাগাঁটি, কাপড়চোপড় রেখে বলা নেই কওয়া নেই, সোজা ধাঁ। তখনই হঠাৎ যোগাযোগ দুই পক্ষের। এই বিয়ে-ভাঙা পাত্রীই ঘটনাচক্রে হয়ে গেলেন বিকাশ-ঘরণি।
‘আমি তো তোমারে চাহিনি জীবনে, তুমি অভাগারে চেয়েছ’। নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া একের পর এক নাটক দেখে এ কথাগুলোই বলতেন বিকাশ।
কী না করেছেন! জজকোর্টে আইনি, এরোড্রোমে ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসে হেডক্লার্ক, বিজ্ঞাপনে চাকরি, সেখান থেকে আকাশবাণী! সে’ও এক সময় পোষাচ্ছিল না, তখন সিনিয়র সহকর্মী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পরামর্শে গিয়েছিলেন সে কালের মস্ত বড় প্রযোজক পরিবেশক সংস্থা ডিল্যুক্স-এর ঘরে। সেখান থেকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এমপি প্রোডাকশনের এক চিত্র পরিচালকের কাছে। ভদ্রলোকের ট্যারাব্যাঁকা প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে মুখের ওপর জবাব দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। সেটাই ছিল প্রথম আর শেষ বারের মতো সুপারিশ নিয়ে ফিল্মে নামার চেষ্টা। সে বারের মতো ফিল্ম-এ নামা হল না, উপরন্তু রেডিয়োর বড় কর্তার সঙ্গে মতবিরোধে চাকরিটাও ছাড়তে হল। এ দিকে তত দিনে সংসারের চাপ বাড়ছে। বাড়িতে ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী, বুড়ো বাবা। এমনই সময় হঠাৎই এক দিন ট্রামে দেখা রেডিয়ো-বন্ধু জ্যোতির্ময় রায়ের সঙ্গে। পরে যাঁর ‘উদয়ের পথে’র কাহিনি নিয়ে ছবি করবেন বিমল রায়। সে দিন জ্যোতির্ময়ই খবর দিলেন উনি একটি ছবি প্রযোজনা করছেন। নায়কের পার্ট বিকাশকে করতে হবে। এক হাজার টাকা দিয়ে চুক্তিও হয়ে গেল। ছবিতে শেষমেশ নায়ক হওয়া আর হয়নি। চার নম্বর গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বিকাশ।
তাঁর নিজের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘কিছু স্মৃতি কিছু কথা’তে তাঁর সহ-অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের সম্বন্ধে কিছু অকপট স্বীকারোক্তি দিয়ে গিয়েছেন তিনি। যেমন, শ্রীমতী সুচিত্রা সেন সম্বন্ধে লিখেছেন – ‘‘ওকে আমি ভালোবেসে পাগল! দেবকী বসুর ‘ভালোবাসা’ ছবিতে উনি আমার স্ত্রী। তখন ডায়লগ বলব কি? ঘাড় গুঁজে প্রেমে পড়লাম। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতাম। সুচিত্রাও বুঝেছিলেন সেটা। অসীম ভদ্রতাবোধে আমায় চড়-থাপ্পড় মারেননি।’’; নৃপতি চট্টোপাধ্যায় সম্বন্ধে জানিয়েছেন – ‘‘মদ খাওয়া মানেই প্রভু। প্রভুর নিজের ভাষায় ‘প্রভৃতির আগে নৃপতি’। পরিচালকদের বলতে হত না কোথায় কি অভিনয় করতে হবে। ও যে এত ভাল অভিনয় করত, সেটা বললে একটুও মানতে চাইত না। ছবিদাও ওর অভিনয়ের জন্য ওকে ‘প্রভু’ বলে ডাকতেন।’’; ছায়াদেবী সম্বন্ধে তাঁর বক্তব্য – ‘‘ফ্লোরে থাকলে ভয় পেতাম কখন কি করে বসেন। ওঁর অভিনয়ের জন্যই ‘হারমোনিয়াম’ বহুবার দেখেছিলাম। মজাও করতাম। মানুষের নাম ভুলে যেতেন ছায়াদেবী। দেখা হলেই বলতাম, নমস্কার, আমার নাম বিকাশ রায়।’’; অভিনেত্রী মঞ্জু দে সম্বন্ধে জানিয়েছেন – ‘‘একে আমি পেল্লায় ভালোবাসতাম, সে কথা ওকে বলাই হয়নি কোনও দিন।’’; পাহাড়ী সান্যাল সম্বন্ধে তাঁর মতামত – ‘‘আদর করে গালি দিতেন আমায়। বহু অকৃতজ্ঞ প্রযোজক, পরিচালকের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেও যোগ্য সন্মান পাননি পাহাড়ীদা। অসম্ভব ভাল গানের গলা ছিল।’’; চন্দ্রাবতী দেবী সম্বন্ধে জানিয়েছেন – ‘‘সাজের জন্য পাগল অপরূপ সুন্দর দেখতে। আর মেক আপে নিজেকে আরও মোহময়ী করে তুলতেন। হাসিও ভারী মিষ্টি ছিল।’’
চিত্র পরিচালক হিসেবে বিকাশ রায়ের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাজ ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’। আনুমানিক শ’আড়াই ছবিতে কাজ করেছেন তিনি। পরিচালনা করেছেন আটটি ছবি। এর মধ্যে পাঁচটি আবার নিজেরই প্রযোজনা। ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ তার একটি। ছবির নায়ক থিরুমলের চরিত্রে উত্তমকুমার। নায়িকা সাবিত্রী ছিলেন কুন্তীর ভূমিকায়। দিঘার কাছে সমুদ্র সৈকতের বালিয়াড়িতে মরুভূমি বানানো হয়েছিল। ছবিতে ব্যবহারের জন্য দু’টি উট এনে রেখেছিলেন। এক চরম নাটকীয় মুহূর্তে মানসিক বিকারগ্রস্ত থিরুমল আচমকা কুন্তীর গলা টিপে ধরবে। সেই দৃশ্য গ্রহণের কয়েক দিন আগে থেকে উত্তমকুমার চুপচাপ। বিশেষ কথা বলছেন না কারও সঙ্গে। কেমন যেন আত্মভোলা ভাব। শুটিং শুরু হল। উত্তমকুমারের দৃষ্টি বেশ অস্বাভাবিক লাগছে। গলা টিপলেন যখন, তখন যেন তিনি আর নিজের মধ্যে নেই। সাবিত্রীদেবীর তখন দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শট শেষ করেই ছুটে এসেছিলেন পরিচালক বিকাশ রায়। সাবিত্রীদেবীর তখন হুঁশ নেই, তিনি বমি করে অজ্ঞান। জলটল দিয়ে তাঁকে সুস্থ করে তুলে বিকাশ রায় উত্তম কুমার কে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘তুই তো ন্যাচারাল অ্যাকটিং করতে গিয়ে মেয়েটাকেই মেরে ফেলছিলি!’’ উত্তম ক্ষমা চেয়েছিলেন সাবিত্রীদেবীর কাছে, ‘‘সাবু, প্লিজ ক্ষমা করে দে।’’ আরেকবার তো মাঝপথে ভেস্তেই যেতে বসেছিল ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’। শেষে ছবির পরিচালক বিকাশ রায়কে কিনা বাঁচিয়ে দিয়েছিল চারটে বাংলা মদের বোতল! চাকুলিয়ায় শ্যুটিং সেরে, ঘাটশিলায় দু’দিন। তার পর দিঘায়। গোল বাঁধল ওই দিঘাতেই। শহর থেকে অনেক দূরে লোকেশন। সেখানেই বালিয়াড়ির ওপর ক্যামেরা ধরবে ‘বালুচিস্তানের হিংলাজের মরুভূমি’। এক জোড়া উট উঠিয়ে আনা হয়েছে বেনারস থেকে হাঁটা পথে। উট নাকি ট্রাক বা মালগাড়িতে উঠলে ছটফটিয়ে কেলেঙ্কারি বাধায়, তাই। লোকেশনের ধারেই বালিয়াড়িতে উটের ডেরা বাঁধা হল। তাদের দুই কিপার কুল্লন খান আর আব্বাস ওদের সঙ্গেই থাকে দিনরাত। শুধু আর্টিস্টরা যাতায়াত করে দূরের হোটেল থেকে। দু’চার দিন ভালই গেল। হঠাৎ এক সন্ধেয় কালো মেঘ করে প্রবল বৃষ্টি। সঙ্গে তুমুল ঝড়। হোটেল থেকে যে গাড়ি করে কুল্লনদের খাবার যেত, ঝড়ের তোড়ে তা’ও ভেসে যেত আর কী! হোটেলে বসে পরিচালক খবর পেলেন, তেরপলের ছাউনি উড়ে গেছে। ফেব্রুয়ারি মাসের অসময়ের ঝড়জলে হি হি ঠান্ডায় ভিজে চুপসে যাচ্ছে দুই কিপার আর তাঁদের জোড়া উট। রাতটা ঘর-বার করে কাটল। সাতসকালে স্পটে গিয়ে দেখা গেল, উটের দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। ভাল করে শ্বাস নিতেও পারছে না। শোঁ শোঁ করে আওয়াজ শুধু। চোখ দিয়ে জল ঝরছে। নাক দিয়ে গাঢ় শ্লেষ্মা। তার মধ্যেই ওদের দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে কুল্লন। তাতে আরও কাহিল হয়ে পড়ছে ওরা। আর বেশি কিছু করতে গেলে না মারাই যায়! চুল-দাড়ি লাগিয়ে খালি গায়ে অবধূতের মেকআপ নিয়ে একেবারে ভাঙা মনে এক পাশে গিয়ে ধপাস করে বসে পড়লেন বিকাশ। এত অর্থ, এত শ্রম, সময়, সব জলে গেল! দ্বিতীয় বার এমন ঝক্কি পোওয়ানোর কোনও উপায়ই নেই। দূরে মাথায় হাত দিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আর্টিস্টরা – পাহাড়ী সান্যাল, উত্তমকুমার, চন্দ্রাবতী দেবী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, অনিল চট্টোপাধ্যায় …। শ্যুটিংয়ের কোনও আশা নেই। পুরো হাল ছেড়ে দিয়ে সবাইকে হোটেলে ফিরে যেতে বললেন বিকাশ। ঠিক তখনই শুরু হল কুল্লনের ভেল্কি! – ‘‘আমি দাওয়াই দিচ্ছি, সব ভাল হয়ে যাবে। ক’টা টাকা দিন তো!’’ টাকা পেয়ে স্যাঙাত আব্বাসকে কী যেন বলল কুল্লন! আব্বাস হাঁটা দিল গ্রামের দিকে। বসে বসে ঝিমিয়ে পড়েছিলেন বিকাশ। হঠাৎ হইহই চিৎকারে চটকা ভাঙতে দেখেন দুটো বাংলা মদের বোতল গড়াগড়ি খাচ্ছে। আরও দুটো বোতল উটের মুখে ধরে আছে আব্বাস আর কুল্লন! একটু বাদেই টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল সেই জোড়া উট। বেঁচে গেল ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’! চন্দ্রাবতী দেবী। খুব সাজতে ভালবাসতেন। এ নিয়েই একবার গোল বাধল ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’-এই। চাই তাঁর নো-মেকআপ লুক। এ দিকে একবার বিকাশের নজর এড়াতে পারলেই হল, হাল্কা বেসের ওপর ঠিক পাউডার বুলিয়ে চলে আসবেন। প্রতিবার সেটে মেকআপ তুলে প্যারাফিন লাগাতে হতো। তাতে উৎপটাং সময় বেরিয়ে যেত। একদিন বিরক্ত হয়ে বিকাশ বললেন, ‘‘রোজ রোজ সবার সামনে কচি মেয়ের মতো ধমক দিয়ে মেকআপ তুলিয়ে দিতে হয়, আপনার মনে হয় না যে, আর কখনও করবেন না?’’ বালিকার সারল্যমাখা মুখে হেসে চন্দ্রাবতী বলেছিলেন, ‘‘বারে, মেকআপ না করলে যে শ্যুটিং করছি মনেই হবে না। কত দিনকার অভ্যেস বলুন তো! আমি রোজ একটুআধটু মেকআপ করেই আসব, আপনিও রোজ সেগুলো তুলে দেবেন।’’
ছবির নাম ‘সূর্যমুখী’। পরিচালক বিকাশ রায় নিজে। শ্যুটিংয়ে একদিন ছবি বিশ্বাসকে আসতে বলা হল বিকেল তিনটেয়। সূর্যের আলোয় খানকতক শট আছে। তার পর ঘরের ভেতরে। এ দিকে সন্ধে নেমে এল প্রায়। ছবি বিশ্বাসের দেখা নেই। প্রোডাকশন ম্যানেজারকে পাঠানো হল। তারও ফেরার নাম নেই। বিকাশ রায় রেগে কাঁই। ম্যানেজারের ডেপুটি গেল। সে’ও ফেরে না। ব্যাপার কী? অনেক দেরি করে এলেন ছবি বিশ্বাস। তাড়াহুড়ো করে শটও দিলেন। পারফেক্ট শট! আর শেষে দেরির কারণটি যা বললেন, শুনে তাজ্জব হয়েছিলেন বিকাশ রায়। পরদিন ছিল দোল। বেরোবার সময় ছবি বিশ্বাস দেখেন মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে দোলের তত্ত্ব পাঠাচ্ছেন স্ত্রী। থালায় আবির চুড়ো করে দেওয়া। কিন্তু তাতেও যেন ন্যাড়া-ন্যাড়া লাগছে। তখনই সেই প্রোডাকশন ম্যানেজারমশাই হাজির। তাঁকে দিয়েই অ্যালুমিনিয়ামের রঙিন ফয়েল কিনতে পাঠালেন ছবি বিশ্বাস। একটু বাদে এসে পড়লেন ম্যানেজারের ডেপুটিও। ফয়েল এলে সবাই মিলে কাঁচি দিয়ে তারার মতো কেটে কেটে বসিয়ে তবে রওনা দিয়েছেন কাজে। মেয়ের তত্ত্ব বলে কথা, এটুকু না করলে চলে!
ছায়াদেবী। এক বার শ্যুটিং জোনে তাঁকে কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বহুক্ষণ বাদে যেন আকাশ থেকে কেউ ডেকে উঠলেন, ‘‘এই যে আমি-ই-ই!’’ বিকাশ রায় দেখলেন, ক্রেনে চড়ে বসে আছেন ছায়াদেবী। – ‘‘চড়ে দেখলাম, ওখান থেকে আপনাদের দেখতে কেমন লাগে!’’ যে জন্য ক্যামেরাম্যান অনিল গুপ্তকে পাঁচ টাকা ঘুষ দিয়ে নাকি ম্যানেজ করেছিলেন তিনি!
তাঁর প্রথম ছবি ছিল ‘অভিযাত্রী’। সঙ্গীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। গান রেকর্ড করা হল। ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো’। রেকর্ডে গাইলেন হেমন্তের সঙ্গে বিনতা বসু (রায়)। ছবিতে বিকাশ রায় আর বিনতা লিপ দেবেন। হেমন্ত ধরিয়ে দিলেন, ‘আগুন জ্বালো…’। প্রথমটা বিকাশ রায় ধরবার পর বিনতা ধরবেন। সে ধরা আর হয় কই! উল্টে ঘেমে নেয়ে একশা! বিকাশ রায় লিখছেন – ‘‘… ‘ভয় কি বিকাশবাবু, এই তো দেখুন না, এক… দুই… আগুন জ্বালো…।’ আমি ক্রমশ ক্রমশ লাল নীল বেগ্নে হচ্ছি …কিন্তু আগুন আর জ্বলছে না। কোনও বার এক-এ আগুন জ্বলে, তো কোনও বার দুই-এ। কিন্তু এক দুই-এর ঠিক পরেই কোনও সময় আগুন জ্বলে না। সে যুগে ফিল্মের ভয়ানক দাম, ব্ল্যাক মার্কেটে কিনতে হয়, সেই ফিল্ম হুড়মুড় করে নষ্ট হচ্ছে, সময় নষ্ট, অথচ …।’’ শেষে মিলেছিল বটে, কিন্তু ততক্ষণে ধরিত্রী বোধহয় বিকাশের লজ্জাকে ঢাকা দিতে দু’খান হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর পায়ের কাছে।
এটাও মনে রাখতে হবে যে বিকাশ রায় অভিনয়ের সঙ্গে-সঙ্গে ছবির প্রযোজনা, পরিচালনা, কাহিনী-রচনা ও চিত্রনাট্য রচনাও করেছেন। অনেকে এই সূত্রে তাঁকে মনে রাখেন। ‘বিকাশ রায় প্রোডাকশন’ -এর ছবি গুলি বিভিন্ন প্রকারের। অর্ধাঙ্গিনী ও সূর্যমুখী পারিবারিক ছবি, বসন্ত বাহার সংগীতবহুল। মরুতীর্থ হিংলাজ মানুষের মনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত-প্রেম নিয়ে একটি নিটোল ভ্রমণ কাহিনী। এইটি সুপার হিট ছবি। ছবিটির গান গুলি অবিস্মরণীয়। চলচ্চিত্র নির্মাণে তার অদ্বিতীয় নৈপুণ্য। ঐতিহাসিক উপন্যাস কেরিসাহেবের মুন্সী অবলম্বনে তৈরী ছবির চিত্রনাট্য, পরিচালনা ও প্রযোজনা তিনিই করেন। নতুন প্রভাত ও উত্তমকুমার অভিনীত রাজা-সাজা ছবির কাহিনী রচনা করেন বিকাশ রায়। তা ছাড়া বহু ছবির চিত্রনাট্য রচনা করেছেন – যেমন ‘কাজললতা’, ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘দুই পুরুষ’।
পর্দায় অভিনয় ছাড়াও বিকাশ রায় রেডিও ও মঞ্চেও অভিনয় করেন। মঞ্চে চারটি নাটকই খুব জনপ্রিয় হয়েছিলো। এছাড়া তিনি “শেষের কবিতা” উপস্থাপিত করেন ও নিজে ভাষ্যকারের অংশ পাঠ করেন। এধরণের প্রযোজনার তিনিই বোধহয় প্রথম উদ্যোক্তা। এই শ্রুতিনাটক লং-প্লেয়িং রেকর্ড-এ বেরোয়। তাঁর দু-তিনটি গ্রামোফোন রেকর্ডও আছে। এসব সূত্রেও বিকাশ রায়কে বাংলার মানুষ মনে রেখেছে।
বিকাশ রায় সম্বন্ধে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, তিনি অত্যন্ত স্নেহশীল ও family-oriented ছিলেন। তিনি সহজ অনাড়ম্বর জীবন যাপন করেছেন। আহ্নিক দিয়ে তাঁর সকাল শুরু হত। অতি স্বল্পাহারি ছিলেন। শুটিং-এর সময় তাঁর খাবার বাড়ি থেকে যেত। তাঁর মতে “প্রযোজক-এর গলায় পা দিয়ে খাওয়া আমার পোষায় না”। তিনি কোনদিন মদ্যপান করেননি – স্বাদ কেমন তাও জানতেন না। আত্মীয় স্বজন , বন্ধুবান্ধব নিয়ে বাড়িতে দুর্গা পূজাও করেছিলেন। পুজোর সময় সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত মায়ের মূর্তির সামনে বসে তন্ত্রধারক হয়ে তাঁর সুললিত কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ করতেন আর পূজার খুঁটিনাটি ঠিক হচ্ছে কিনা খেয়াল রাখতেন। সেই সঙ্গে অতিথি অভ্যাগতদের ঠিক মত সমাদর হচ্ছে কিনা তাও দেখতেন। পূজার দিন গুলিতে বাড়িতে নিরামিষ রান্নার নিয়ম ছিল। অতিথিরা সবাই পাত পেড়ে প্রসাদ পেয়ে যেতেন। তাঁর একটা সুন্দর মিষ্টি ব্যক্তিত্ব ছিল যা তাঁকে একাধারে রাশভারী ও অন্য দিকে বিশেষ স্নেহশীল করেছিল। বয়স্কদের প্রতি তাঁর ব্যবহার শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমপূর্ণ ছিল। ছোটদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার ছিল বন্ধুর মত।
জানা যায় তাঁর শৈশবে তাঁর মায়ের কাছে তাঁর পিতা বলেছিলেন, ‘‘তোমার এই ছোট ছেলেটির লেখাপড়া কিচ্ছু হবে না। রেসিটেশন শিখছে, নকল-টকল করতে পারে। যাত্রা, থিয়েটারে নোটো সেজেই ওর দিন যাবে।’’ বলতেই হয় কী অমোঘ ছিল সেই পর্যবেক্ষণ! বিকাশ রায় নিজেই পরে বলেছেন, ‘‘বাবার ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলেছে। নোটো হয়েই দিন গেল!’’
যে সময়ের কথা, বিকাশ তখন বালক। জন্ম ১৯১৬ সালে, নদিয়ার রানিনগরে। বিত্তবান জমিদার বংশের ছেলে। তবে পূর্বপুরুষের বাবুয়ানি এবং উড়নচণ্ডিপনায় ভাঁড়ার প্রায় সবটাই তত দিনে উজাড় হয়ে গিয়েছিল। টিকেছিল শুধু জমিদারিসূত্রে পাওয়া ‘রায়’ পদবিটুকু। পিতা যুগলকিশোর কলকাতায় এসে সরকারি চাকরি নিলেন। যে কোনও আদর্শ পিতার মতোই তিনি চাইতেন, ছোট ছেলে ‘বিকু’ ভাল লেখাপড়া শিখে আইসিএস হোক। বিকাশ রায় ভর্তি হলেন ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনে। কিন্তু তাঁর বেশি আগ্রহ ছিল আবৃত্তি (সেই শিক্ষা অবশ্য বাবার কাছেই শুরু), অভিনয়ে। তাই হাত-পা নেড়ে ‘পঞ্চনদীর তীরে’ আবৃত্তি করে প্রশংসা কুড়োলেও বাবা যেই ইংরেজি ট্রান্সলেশন ধরলেন, তাঁর হাল খারাপ হল! ম্যাট্রিকে বাংলায় লেটার ও স্বর্ণপদক নিয়ে পাশ করেছিলেন বিকাশ। পড়তে গেলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেখানেও নাটকের ভূত চেপেছিল তাঁর ঘাড়ে। তখন ঘটল আর এক কাণ্ড! কলেজের থিয়েটারের দলে ঢুকে শরৎচন্দ্রের ‘বৈকুণ্ঠের উইল’-এ পেলেন বিনোদের ভূমিকা। চরিত্রের দাবি অনুযায়ী মদ, সিগারেট সবই দরকার। কলেজের নাটকে মদ খাওয়া দেখানোর প্রশ্নই নেই। তবে সিগারেট রেখেই মহলা হল। কিন্তু গোল বাধল শেষবেলায়। চূড়ান্ত মহলা দেখতে এসে অধ্যক্ষ রেগে আগুন। প্রেসিডেন্সির ছেলেদের নাটকে সিগারেট খাওয়া! অতএব সেটি অভিনয় থেকে ছেঁটে দেওয়া হল। যদিও সিগারেটের নেশা তত দিনে রপ্ত হয়ে গিয়েছিল তাঁর। আর মদ? একের পর এক চলচ্চিত্রের খল চরিত্রে মদ্যপান যাঁর কাছে জলপানের চেয়েও স্বাভাবিক লেগেছে, ব্যক্তিজীবনে সেই বিকাশ রায় নেশা করবেন, এতে আশ্চর্য কী! সত্যিই আশ্চর্য। কারণ কোনও দিন মদের গ্লাসে চুমুকটুকুও দেননি তিনি! ঘনিষ্ঠদের আড্ডায় এ সব নিয়ে মজাও করেছেন। বিকাশ রায়ের বিভিন্ন লেখার সংকলনগ্রন্থ প্রকাশের সূত্রে বইপাড়ার প্রকাশক বামাচরণ মুখোপাধ্যায় তাঁর খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। একবার বিকাশবাবুর কাছে তিনি জানতে চান, নিজে মদ না খেলে মদ্যপের নিখুঁত অনুভূতি বোঝা যায়? বিকাশবাবু হেসে জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘অভিনয় তো মনে। মদ কী করবে!’’ অভিনয়ের এই সাবলীলতাই বিকাশ রায়ের সবচেয়ে বড় সম্পদ। চলচ্চিত্র জগতের মানুষজন তো বটেই, একেবারে সাধারণ দর্শকও তাঁর অভিনয় প্রতিভায় মজে থেকেছেন চিরকাল। তিনি আর নেই। কিন্তু সেই স্বীকৃতি আজ পর্যন্ত একই রকম রয়ে গিয়েছে।
বিকাশ রায়ের পাকাপাকি ভাবে অভিনয়ে আসার আগের পথটি কিন্তু খুব মসৃণ ছিল না। চড়াই-উতরাই ছিল বিস্তর। সংসার প্রতিপালনের জন্য কঠিন লড়াই করতে হয়েছে তাঁকে। বিলেত ফেরত চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট দাদার অকালমৃত্যু, বাবার চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে পরিবারে নিদারুণ অর্থকষ্ট, তারই মধ্যে তাঁর বিয়ে। অন্নসংস্থানের জন্য হাড়ভাঙা খাটুনি ছিল তাঁর। সকালে টিউশন দিয়ে শুরু হত দিন। তার পরে বাসভাড়া বাঁচাতে ভবানীপুর থেকে হেঁটে হাইকোর্ট পাড়া। ভাগ্যান্বেষণে এ দুয়ার, সে দুয়ার। প্রেসিডেন্সি থেকে অনার্স নিয়ে বিএ পাশ করেছেন, আইন পাশ করেছেন। ওকালতি করতে গিয়েও সুবিধে হয়নি। বহু ঘাটে ঘুরতে ঘুরতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাজারে অল্প দিন মোটা বেতনে সিভিল ডিফেন্সে পাবলিসিটির চাকরিও করেছিলেন। কাজ করেছিলেন একটি এরোড্রম তৈরির অফিসেও। কিন্তু কোনওটিই তাঁর জীবনে স্থায়ী হয়নি। শেষে অনেক কম টাকায় যোগ দেন রেডিয়োর চাকরিতে। মাইক্রোফোনের আকর্ষণ তাঁকে টেনেছিল। নানা বাঁক ঘুরে সেখান থেকেই তিনি এক সময় পৌঁছেছিলেন সিনেমার জগতে। দেশ তখনও স্বাধীন হয়নি। সিনেমায় নামার আগে স্ত্রীর ‘অনুমতি’ নিয়েছিলেন বিকাশ রায়। কারণ এমন একটি কাজে পদে পদে নানা হাতছানি থাকে, নিন্দা রটতেও দেরি হয় না। স্ত্রী কিন্তু মুক্তমনে সায় দিয়েছিলেন। তিনি জানতেন, তাঁর স্বামী কত ‘খাঁটি’।
১৯৪৭-এ মুক্তি পায় বিকাশ রায় অভিনীত প্রথম ছবি ‘অভিযাত্রী’। ছবির কাহিনি, চিত্রনাট্য, শিল্পী নির্বাচন ইত্যাদির দায়িত্ব পেয়েছিলেন তাঁর রেডিয়ো-জীবনের বন্ধু জ্যোতির্ময় রায়। তিনিই নিয়ে যান বিকাশবাবুকে। আশ্বাস ছিল, নায়ক হবেন। পেলেন চার নম্বর চরিত্র। পাঁচ হাজার টাকাও। মন না মানলেও অবস্থা তা মেনে নিতে বাধ্য করল। এবং বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ পেয়ে গেল অভিনেতা বিকাশ রায়কে। প্রথম ছবির পরিচালক হেমেন গুপ্তের কাছেই বিকাশবাবুর দ্বিতীয় ছবি ‘ভুলি নাই’। সেই সঙ্গে পরিচালকের সহকারী হয়ে বুঝতে শুরু করলেন চলচ্চিত্র নির্মাণের অন্ধিসন্ধি। যেটা পরবর্তী কালে বিকাশকে নানা ভাবে সাহায্য করেছে। পরিচালনা, চিত্রনাট্য তৈরি, প্রযোজনা— সব ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণে দীর্ঘ সময় জুড়ে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা ছবি। এরপরে ১৯৫১ সাল। একের পর এক ছবি করতে করতে অভিনেতা বিকাশ রায় তখন বেশ পরিচিতি পেয়ে গিয়েছেন। সেই সময় হেমেনবাবু তৈরি করেন ’৪২। ছবিটিতে নৃশংস অত্যাচারী মেজর ত্রিবেদীর ভূমিকায় অবিস্মরণীয় অভিনয় করেন বিকাশ রায়। দেশ তখন স্বাধীন হওয়ার আবেগে উত্তাল। পর্দায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপর মেজরের অত্যাচার দেখতে দেখতে মানুষ এতটাই খেপে উঠেছিল যে, রাস্তাঘাটে বিকাশ রায়কে দেখলে তাড়া করার ঘটনাও ঘটত। ছবির প্রিমিয়ারে তাঁকে দেখতে পেয়ে জুতো তুলে ছুটে এসেছিলেন অনেকে।
ছোট-বড় যে চরিত্রই হোক, নিজেকে সেই অনুযায়ী তৈরি করার কাজে বিকাশ রায় কোনও ঘাটতি রাখতেন না। যখন তিনি রীতিমতো নামডাকওয়ালা, তখনও সেই অভ্যেস তিনি ছাড়েননি। শট দেওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত চরিত্রায়ন নিয়ে নিজের মতো কিছু না কিছু ভেবেই চলতেন। অভিনেত্রী লিলি চক্রবর্তী সংবাদমাধ্যমে শুনিয়েছিলেন তেমনই এক টুকরো অভিজ্ঞতা। তখন টেকনিশিয়ান্স স্টুডিয়োয় কোনও ছবির শুটিং করছিলেন তিনি। পাশের ফ্লোরে অন্য কোনও ছবিতে বিকাশ রায়। এক ফাঁকে বাইরে বেরিয়ে লিলিদেবী দেখেন, পুলিশ অফিসারের পোশাক পরা বিকাশবাবু বাইরের চত্বরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন। ‘‘কী হয়েছে, বিকাশদা? পায়ে লাগল?’’ তাঁর প্রশ্নে বিকাশ রায় জানিয়েছিলেন, এই পুলিশ অফিসারের চরিত্রে একটু পা টেনে হাঁটলে ভাল হবে মনে হয়েছে বলে তিনি শটের আগে সেটা অভ্যেস করছেন। ফ্লোরে অন্য কেউ কিন্তু তা জানেননি, বোঝেননি। তাঁরা শুধু শটটাই দেখেছেন। ‘আমি সিরাজের বেগম’ ছবিতে মিরজাফর হয়েছিলেন বিকাশ রায়। সিরাজের ভূমিকায় ছিলেন অভিনেতা বিশ্বজিৎ। শট দেওয়ার সময় বিশ্বজিতের মনে হত, বিকাশ রায়ের মিরজাফর যেন একটু ভালমানুষ গোছের। চুপচাপ বসে মালা জপছেন, আর ঘাড় হেলিয়ে তাকাচ্ছেন। ক্রূরতার প্রকাশ কি কম হচ্ছে? তখন সংশয় ছিল বিশ্বজিতের। পরে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘‘পরে ছবি দেখে মালুম হল, মিরজাফর চরিত্রকে কী অসীম দক্ষতায় জীবন্ত করে তুলেছিলেন বিকাশদা। ওই ঠান্ডা দৃষ্টিতে কী অসম্ভব কুটিলতা, ভাবা যায় না!’’
প্রমথেশ বড়ুয়া ছিলেন তাঁর প্রিয় শিল্পী। অভিনয়ে আসার আগেই বড়ুয়া সাহেবের স্টাইল তাঁকে টানত। ফিল্মে পরিমিতি বোধের অনুভূতি তিনি বুঝতে শিখেছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়ার ছবি দেখে। বিকাশ রায়ের কাটা কাটা সংলাপ বলার ভঙ্গিতেও অনেকে তাই বড়ুয়া-স্টাইল খুঁজে পান।
আবৃত্তির প্রতি অনুরাগ তো শৈশব থেকেই ছিল। তাই প্রতিটি শব্দ উচ্চারণে যত্ন এবং স্বর প্রক্ষেপণ তাঁর অভিনয় প্রতিভায় যোগ করেছিল বাড়তি মাত্রা। কিন্তু তার বাইরেও আবৃত্তি তাঁকে প্রেরণা দিত। কাজ থেকে ফিরে সময় পেলেই ছেলে সুমিতের সঙ্গে বসে কত কী যে পড়তেন— ‘শেষের কবিতা’, ‘ম্যাকবেথ’, ‘সঞ্চয়িতা’র পাতা উল্টে কোনও কবিতা। বাবা-ছেলের পাঠে ঘর গমগম করে উঠত। তিনি নিজের ছেলেকে ডাকতেন ‘বেণুবাবু’ বলে। তবে ছেলে-মেয়ের মুখে সাদামাঠা ‘বাবা’ শুনতে চাইতেন না। তাঁকে সন্তানেরা বলতেন ‘বাবু’। ধমনীতে জমিদারের রক্ত বলেই হয়তো ‘কর্তা’ ডাকটিও অপছন্দের ছিল না। ছেলেকে নিয়ে এক সান্ধ্য পাঠের আড্ডায় একদিন ঘটল মজার কাণ্ড। সে দিন শেক্সপিয়র-এর লেখা পড়া হবে। বিকাশ রায়ের বাড়ি ছিল বইয়ের গুদাম। পুস্তক অনুরাগী এই অভিনেতার নিজস্ব সংগ্রহে ছিল কয়েক হাজার বই। তাঁর যোধপুর পার্কের ভাড়াবাড়িতে কাজের বাইরে সর্বদা বই নিয়ে মগ্ন থাকতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন শিল্পী। ছেলেকেও বইয়ের নেশা ধরিয়ে দিয়েছিলেন পুরোদস্তুর। কিন্তু সে দিন শেক্সপিয়র পড়তে গিয়ে দেখা গেল, রচনাসমগ্রটি বেপাত্তা! তন্ন তন্ন করে খুঁজে বোঝা গেল, কোনও বহিরাগত অতিথি হয়তো ‘নিজের’ ভেবে সেটি কোনও দিন হস্তগত করেছেন। ‘‘সে হোক। তা-বলে শিক্ষিতের বাড়িতে শেক্সপিয়র থাকবে না! রবীন্দ্রনাথ এবং শেক্সপিয়র যে বাড়িতে নেই, সে বাড়ি বাসের যোগ্যই নয়’’ বলে মেজাজ হারিয়েছিলেন বিকাশ রায়। অতএব সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তখুনি শেক্সপিয়রকে বাড়িতে এনে পুনর্স্থাপন করতে হবে। ছেলেকে আদেশ দিয়েছিলেন, ‘‘বেণুবাবু, গাড়ি বের করো।’’ পুত্র গাড়ি চালিয়ে বাবাকে নিয়ে গিয়েছিলেন চৌরঙ্গির ফারপো হোটেলের কাছে। ফুটপাতের এক পরিচিত বই বিক্রেতা তখন ঝাঁপ ফেলে শোওয়ার আয়োজন করছিলেন। বই পাওয়া গিয়েছিল তাঁর ভাণ্ডারে। স্বস্তি পেয়েছিলেন বিকাশ রায়! আরও একবার একই ভাবে রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’ খুঁজে পাননি। পরদিন বিশ্বভারতীর গ্রন্থন বিভাগে কিনতে গিয়ে শুনেছিলেন, ছাপা নেই। আপাতত বাজেট-বরাদ্দও নেই। জানা যায় বিকাশ রায় তাদের বলেছিলেন, আমি যদি গোপনে ছাপার টাকা দিই, তা হলে নেবেন? কাউকে বলতে হবে না। শুধু ছাপলেই হবে। শুনে বিশ্বভারতীর কর্তারা হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন!
ছবির কাজ যখন কমে এল, তখন বেশি বয়সে মঞ্চে গেলেন বিকাশ রায়। সে-ও অনেক সাধ্যসাধনার পরে। তরুণকুমার এবং সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় এক রকম জোর করে রাজি করালেন তাঁকে। প্রথম নাটক ‘চৌরঙ্গি’। তিনি স্যাটা বোস। চলচ্চিত্রের দৌলতে উত্তমকুমারের স্যাটা বোস তত দিনে বাজার মাত করেছে। সেই চরিত্রকে মঞ্চে ফোটাতে গোড়ায় খুব আপত্তি ছিল বিকাশ রায়ের। বলেছিলেন, ‘‘উত্তমকে পর্দায় দেখার পরে আমাকে দর্শক নেবেই না।’’ উত্তম তা শুনে বলেছিলেন, ‘‘তুমি নিজেকে এত কম ভাবছ কেন? আমি জানি, তুমি নিজের মতো করে চরিত্র ফোটাবে। আমি দেখতে যাব।’’ বিকাশবাবু উত্তরে বলেন, ‘‘দর্শক আসনে তোকে দেখলে আরও নার্ভাস হয়ে যাব রে!’’ উত্তমকুমার গিয়েছিলেন। না জানিয়ে অন্ধকারে হলে ঢুকে বসে পড়েছিলেন। পরে গ্রিনরুমে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলেন তাঁর বিকাশদাকে। এর পরেও আরও কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেন বিকাশ রায়। প্রায় সবই তরুণকুমার, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে।
কাজের জগতের বাইরে বিকাশ রায় ছিলেন একেবারেই পারিবারিক। স্বামী, বাবা, গৃহকর্তা ঠিক যেমনটি হন। তাঁদের বাড়িতে ফিল্ম নিয়ে আলোচনা কার্যত নিষিদ্ধ ছিল। কাজ না থাকলে তাঁর একমাত্র বিনোদন ছিল বই এবং গান শোনা। সিগারেট খেতেন। বিদেশি গাড়ির শৌখিনতা ছিল। আর হয়তো বংশের ধারায় কোঁচানো ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি পরতে পছন্দ করতেন। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনচর্যায় অন্য কোনও উচ্ছ্বলতাকে প্রশ্রয় দেননি। হাঁপানির প্রকোপে গলার স্বর যখন ভেঙে গেল, তখন নিজেই সিদ্ধান্ত নিলেন— আর নয়। এ বার সরে দাঁড়াতে হবে। স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘‘যা দিতে চাই, তা দিতে পারব না। মানুষ যা চাইবে, পাবে না। এই অবস্থায় কাজ করলে দর্শকের সঙ্গে প্রবঞ্চনা করা হবে। সেটা সইবে না।’’ ছেলে চেয়েছিলেন, বাবা-মা তাঁর কাছে আমেরিকায় গিয়ে থাকুন। যাননি। নিজের শহর, চেনা পরিমণ্ডল তাঁকে পিছু টেনে ধরেছে। শেষ জীবনে তাঁর ৪৩১, যোধপুর পার্কের ভাড়াবাড়ির রাস্তার দিকের বারান্দায় আরামকেদারায় বসে চলমান জীবন দেখতেন। বই পড়তেন, অথবা আত্মমগ্ন হয়ে ভাবতেন। কোনও দিন কোনও অভিযোগ ছিল না। চাহিদাও ব্যক্ত করেননি। জীবনের পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে নীরবই থেকেছেন। কারও হয়তো মনে পড়তে পারে ‘বনপলাশীর পদাবলি’ ছবির সেই দৃশ্য। কর্মজীবনের শেষে আপন ঘরে ফিরে জগৎ ও জীবনকে যেন নতুন করে চিনলেন শিক্ষক গিরিজাপ্রসাদ। বড় বেদনার সেই অনুভব। ভাঙা মনে, ক্লান্ত পায়ে হেঁটে আসছেন তিনি। নেপথ্যে ভেসে আসছে সংগীত – ‘সাথীহারার গোপন ব্যথা, বলব যারে সে জন কোথা…’
‘‘আমি চলে যাচ্ছি, আমায় মনে রাখবেন। তাঁর বাঁ হাতে ধরা কালো ছড়িটি কেঁপে উঠল।’’ – এ ভাবেই অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন বিকাশ রায়। অনেকেরই মনে হয়েছিল, বহু স্বপ্নভঙ্গের অভিমান এবং ব্যথা থেকে বিকাশ রায় রেডিয়ো, টিভি, মঞ্চ, মাস মিডিয়ার রাজপথ থেকে সরে দাঁড়ালেন। কারও কারও ধারণা হয়েছিল, বিকাশ রায় বয়সের জন্য সরে গেলেন। জীবনের উপান্তে এসে, তিনি যখন বুঝতে পারছিলেন আর বোধহয় বেশি দিন নেই, তখন একবার বলেছিলেন, “হে আমার ভগবান, আমার দর্শক, অতীতের মতো সামনের দিনও তোমাদের দক্ষিণমুখ আমার দিকে যেন উন্মোচিত করে রেখো।”
১৯৮৭ সালে ৭১ বছর বয়সে জীবনাবসান হয় বিকাশ রায়ের।
(তথ্যসূত্র:
১- কিছু স্মৃতি কিছু কথা: বিকাশ রায়, অনুলিখন – অমিয় সান্যাল, করুণা প্রকাশনী।
২- ‘A gentleman actor’, Article published on ‘The Hindu’ on 26th January by Ranjan Das Gupta.
৩- ‘Looking at a forgotten stalwart’, Article published in ‘The Statesman’ on 29th January 2016 by Swapan Mullick.)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত