চওড়া ফ্রেমে আঁটা মোটা লেন্সের আড়ালে চকচকে দুটো চোখ, ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। তিনি মৃণাল সেন। বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই চলচ্চিত্রকার পাল্টে দিয়েছিলেন বাংলা সিনেমার ধারা। প্রতিনিয়ত নিয়ম ভেঙ্গে নতুন নিয়ম সৃষ্টিতে যাঁর ছিল অদম্য নেশা। সমাজ বাস্তবতাকে তিনি সব সময়ই গুরুত্ব দিয়েছেন। আর তাই তাঁর ছবিতে নকশাল আন্দোলন যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে শ্রেণীদ্বন্দ্ব, এসেছে দরিদ্র আদিবাসীদের কথা, এসেছে মানুষের গভীর সম্পর্কের কথাও। মৃণাল সেন মানেই এক প্রতিবাদী মুখ। যে মুখ তরুণের। তাই তারুণ্যের ভাষা তাঁর সৃষ্টিজুড়ে। তিনি সমাজমনস্কতায় বা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলেন এক অ্যাংরি ইমেজ। চলচ্চিত্রকে তিনি দিয়েছেন এক নতুন ভাষা। ক্যামেরাই ছিল তাঁর প্রতিবাদের অস্ত্র।

‘‘কলকাতা শহরে কত উনুন?’’ ছবির প্রধান চরিত্রের মনে এই প্রশ্ন উস্কে দিত মৃণাল সেনের ‘চালচিত্র’। মধ্যবিত্ত সংসারে রান্নার গ্যাসের যুগ নয় সেটা। উনুনের ধোঁয়া, লোডশেডিংয়ের অন্ধকার ঘেরা বারো-ঘর-এক-উঠোন আর পাঁজরের হাড় বার করা সত্তর-আশির কলকাতা সবচেয়ে বেশি যাঁর ছবিতে ধরা দিয়েছে, তিনি মৃণাল সেন।
চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, বাংলার চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে কলকাতার সবচেয়ে নিবিড় এবং স্থায়ী প্রণয়ী মৃণাল সেন। যে প্রেম এসেছিল তাঁর মধ্যবিত্ত শ্রেণিগত অবস্থান থেকেই। লং শট-এ একটু লো অ্যাঙ্গলে কে কে মহাজনের ক্যামেরায় শহরের গলিঘুঁজি, ছাদ দেখলেই চেনা যায় মৃণালের স্বাক্ষর।
চলচ্চিত্রবিদ্যার অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, কী ভাবে উনি ফুটপাতে হাতে ‘ফ্রন্টিয়ার’ নিয়ে তর্ক করতে ভালবাসতেন। সেই ভালবাসাই তাঁকে কলকাতার গলি-উপগলি নিয়ে যত্নশীল করেছিল। তাঁর মতে, ‘‘ষাটের দশকের গোড়াতেই ‘নীল আকাশের নীচে’ ছবিতে চিনা চরিত্রটি যখন সিনেমার পোস্টারে এক অ-বাক নারীর দিকে তাকায়, বোঝা যায়, মৃণাল সেন কলকাতার এক অন্য রূপকল্প ভাবছেন। সেই রূপকল্পই আরও গভীর হয় সত্তরের দশকে।’’ কোরাস বা কলকাতা’৭১-এর যে কলকাতা, সেটা পরিচালকের নিজের ভাষায়, ‘ইনটেস্টিন্স অব দ্য সিটি’। শহরের অন্তঃপ্রণালী। ‘ভুবন সোম’, যেখানে শহর নেই, সেখানেও মৃণাল গ্রামকে পরীক্ষা করেছিলেন শহরের চোখ দিয়েই। সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের মতে, সত্যজিৎ বা ঋত্বিকের সঙ্গে মৃণালের প্রধান তফাৎই হল রোজকার জীবনের গল্প বলায়। মৃণাল প্রায়ই তাঁর প্রিয় চিত্রনাট্যকার, ইটালির জাভাতিনিকে উদ্ধৃত করে বলতেন, ‘টুডে টুডে অ্যান্ড টুডে’। সেই আজ-এর গল্পে কলকাতাই ছিল তাঁর নায়িকা।
মৃণাল সেনের অন্যতম প্রিয় অভিনেতা ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়ও পরিচালকের কলকাতা-প্রেমের ঘনিষ্ঠ সাক্ষী ছিলেন। তাঁর বক্তব্যে, ‘‘ছাত্রজীবন, আইপিটিএ-র সঙ্গে যোগ এবং পরে কিছুদিন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি – জীবনের বিভিন্ন স্তরে কলকাতাকে চষে খেয়েছেন মৃণালদা।’’ শহরের যে ছবিটা ওঁর মগজে রয়েছে, সেটা বুঝে নেওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ধৃতিমানের কথায়, ‘‘পদাতিক’-এর সময়ে ক্যামাক স্ট্রিটের একটি বহুতলে শুটিং হত। কাজ শেষে সেখানেই আমরা থাকতাম। যাতে যে কোনও সময়ে সকলের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়।’’ কলকাতা’৭১-এর জন্য ভবানীপুর, কালীঘাট আদিগঙ্গার ধার থেকে একেবারে ময়দান পর্যন্ত ক্যামেরা ধাওয়া করত অভিনেতা দেবরাজ রায়কে। নিজের স্মৃতিচারণে তিনি বলছিলেন, ‘‘প্রচুর দৌড় করিয়েছিলেন মৃণালদা!’’
মৃণাল সেনের স্মৃতিচারণে আধুনিক যুগের বাংলা গানের অন্যতম গায়ক ও অভিনেতা অঞ্জন দত্ত ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৮ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় জানিয়েছিলেন – ‘‘প্রথমেই আমার নায়ক হওয়ার সব আশা জলাঞ্জলি দিয়ে দিলেন মৃণাল সেন। লম্বা চুল কেটে দিলেন। তার পর তেল মাখিয়ে, রোগা চেহারায় স্যান্ডো গেঞ্জি পরিয়ে দৌড় করালেন। দৌড়তে দৌড়তে মাঝে মাঝে পরিচালকের কথা শুনতে পারছি না। সে কথা বলতেই উনি রেগে বলে উঠলেন, ‘যা মনে হয়, সে রকম করো। ন্যাচারাল রিঅ্যাকশন।’ …’’ – ছবিটার নাম ‘চালচিত্র’।
মৃণাল সেন কোনও কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার ছিলেন না। কিন্তু মানুষের ভিড় ও মিছিল তাঁকে উদ্দীপ্ত করেছে। তিন তর্ককে প্রশ্রয় দিতেন, কিন্তু স্তাবকতাকে নয়। নন্দীগ্রাম নিয়ে প্রতিবাদ মিছিলে তিনিএসপ্ল্যানেড থেকে একটু হেঁটেছিলেন। পরদিন তাঁকে ক্ষমতাসীন নেতারা ফোন করেন। তিনি সেই মিছিলেও গিয়েছিলেন। লোকে বলতে শুরু করল, তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন। মৃণাল নীরব ছিলেন, কারণ ‘মানুষের সঙ্গে আছি, সেটাই আমার জায়গা’ এই বার্তাই উনি বারংবার দিতে চেয়েছিলেন।
মৃণাল সেনের একটা অদ্ভুত স্বভাব ছিল। খুব সিগারেট খেতেন তিনি। যখনই মুখে একটা সিগারেট ধরাতেন, যে সামনে আছে, তাঁর কাছে দেশলাই চাইতেন। তারপর সেটা নিজের পকেটে রেখে দিতেন। সেও লজ্জায় আর চাইতে পারত না। এই অভ্যাস প্রসঙ্গে অনেককেই বলেছিলেন, ‘যখন বাড়ি ফিরি, পকেটে গোটা দশ-বারো দেশলাই!’
এছাড়াও খুব শীতকাতুরে মানুষ ছিলেন তিনি। শীতকালে একদম স্নান করতে চাইতেন না। স্ত্রী শ্রীমতী গীতা সেন বলতেন, ‘তুমি যদি স্নান না করো, তোমাকে আমি খেতে দেব না।’ এই ঘটনা নিজে প্রত্যক্ষ করেছিলেন অভিনেতা শ্রী রঞ্জিত মল্লিক নিজে। একদিন তিনি মৃণাল সেনের বাড়িতে গিয়েছেন। শুনলেন গীতা সেন বলছেন, ‘শুনছো, তোমার স্নান হয়েছে?’ মৃণাল সেন উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ক-ও-ও-বে…’। এই কবে মানে কিন্তু অনেকক্ষণ আগে নয়! আসলে মানুষটা ছিলেন খুব মজাদার। ‘ফুল অফ লাইফ’ যাকে বলে।
১৯২৩ সালের ১৪ই মে, বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন মৃণাল সেন। মৃণাল সেন জন্মদিন সম্পর্কে তাঁর অটোবায়োগ্রাফিতে লিখেছিলেন, ‘I am one year younger than what I’ll be in next year’! দেশ বিভাগের সময় তাঁরা সপরিবারে কলকাতায় চলে আসেন। প্রথমে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। স্কটিশ চার্চ কলেজে যখন পড়তেন তখন থেকে নিয়মিত জাতীয় গ্রন্থাগারে যেতেন। নানাধরনের বইয়ের পাশাপাশি তাঁর চোখ খুঁজে বেড়াত চলচ্চিত্র বিষয়ক বইপত্র। একদিন হাতে এল বিখ্যাত রাশিয়ান শিল্প সমালোচক ভ্লামিদির নিলসেনের ‘সিনেমা অ্যাজ এ গ্রাফিক আর্ট’ বইটি। সেটা পড়েই মৃণাল সেন আজেনস্টাইনের সমাজ তত্ত্ব সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হলেন। চিন্তার জগতে তুমুল আলোড়ন শুরু হল। এই সময় ফরাসি পরিচালক জাঁ রেনোয়া কলকাতায় ছবি করতে এলেন। মৃণালবাবুর বেশ কয়েকজন বন্ধু রেনোয়ার কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রেনোয়ার কাজ দেখার জন্যে তিনি কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতেন। কারণ, সিনেমার প্রতি তাঁর কমিটমেন্ট ছিল অসাধারণ।
ছাত্রাবস্থায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক শাখার সঙ্গে যুক্ত হন। কিন্তু তিনি কখনও কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয়পদ গ্রহণ করেননি। ১৯৪৩ সালে তিনি আইপিটিএ-র সঙ্গে যুক্ত হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করার পর তিনি সাংবাদিকতা,ওষুধ বিপণনকারী এবং চলচ্চিত্রের শব্দ কলাকুশলী হিসেবে কাজ করেন। তখনকার নামী অভিনেত্রী সুনন্দা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে প্রোডাকশন হাউস খুললেন। তিনি ছবি করবেন। পরিচালনা করবেন কে, সেই নিয়ে তিনি খোঁজখবর করছেন। এমন সময় খবর পেলেন কলকাতারই চলচ্চিত্র বোদ্ধা এবং একটি ছবির সহকারী পরিচালক মৃণাল সেন প্রযোজক খুঁজছেন। সুনন্দা দেবী তাঁকে প্রস্তাব দিলেন ছবির জন্য। মৃণালবাবুও রাজি হলেন। ১৯৫৫ সালে তাঁর প্রথম ছবি ‘রাতভোর’ মুক্তি পেল। যদিও ছবিটি ততটা সাফল্য পায়নি। ১৯৫৮ সালে মুক্তি পায় তাঁর দ্বিতীয় ছবি ‘নীল আকাশের নীচে’। একপ্রকার আচমকাই প্রযোজক রূপে পেলেন সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে। ছবির নায়ক ওয়াং লু-এর চরিত্রে কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ছবির মাধ্যমে বাংলা সিনেমায় রাজনীতির প্রবেশ ঘটল। এই ছবিটি সরকার দুই মাসের জন্য বাজেয়াপ্ত করে রেখেছিল। এই ছবিই তাঁকে স্থানীয় চলচ্চিত্র মহলে পরিচিতি এনে দেয়। তাঁর তৃতীয় ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’ মুক্তি পায় ১৯৬০ সালে। এই ছবির দ্বারা তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি পান। ১৯৬৯ সালে তাঁর পরিচালিত বহুল আলোচিত ছবি ‘ভুবন সোম’ মুক্তি পায়। এই ছবিটি অনেকের মতে মৃণাল সেনের শ্রেষ্ঠ ছবি। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৩ সালের ভিতরে, কলকাতার অস্থির সামাজিক অবস্থার আলোকে তাঁর তিনটি ছবি (ইন্টারভিউ, কলকাতা ৭১, পদাতিক) মুক্তি পায়। এই ছবি তিনটি ‘কলকাতা ট্রিলজি’ নামে খ্যাত।
উল্লেখ্য, ১৯৮৩ সালে তাঁর পরিচালিত ‘খারিজ’ ছবিটি কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ জুরি পুরস্কার পেয়েছিল। ১৯৮৬ সালে তিনি নির্মাণ করেন ‘জেনেসিস’। এই ছবিটি হিন্দি, ফরাসি ও ইংরেজি ভাষায় মুক্তি পেয়েছিল। সবমিলিয়ে তিনি ২৭টি কাহিনীচিত্র, ১৪টি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি, ৪টি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। মৃণাল সেনের আত্মজীবনী বেরিয়েছে ২০০৪ সালের শেষদিকে। দিল্লির স্টেলার পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত ৩১০ পৃষ্ঠার এই বইটির নাম ‘অলওয়েজ বিয়িং বর্ন’।
১৯৮১ সালে তিনি পদ্মভূষণ পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৫ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার। ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সাল অবধি তিনি সংসদের সাম্মানিক সদস্যপদ লাভ করেন। ২০১৭ সালে হয়েছিলেন অস্কার অ্যাকাডেমির সদস্যও। সম্মান পেয়েছেন ফরাসি দেশেরও। ‘কমান্ডার অব আর্টস অ্যান্ড লেটার্স।’ সোভিয়েত রাশিয়া থেকে ‘নেহরু সোভিয়েত ল্যান্ড অ্যাওয়ার্ড’, রাশিয়ান ফেডারেশন থেকে ‘অর্ডার অব ফ্রেন্ডশিপ’। এ রকম কত দেশের কত সম্মান! একদা পশ্চিম জার্মানির প্রতিবাদী পরিচালক রাইনার্ড হফ আশির দশকের মাঝামাঝি বার্লিন থেকে কলকাতা আসেন দশ দিনের জন্য। মৃণালকে নিয়ে দীর্ঘ তথ্যচিত্র তৈরি করলেন—‘টেন ডেজ ইন ক্যালকাটা: আ পোর্ট্রেট অব মৃণাল সেন’। কাগজ পড়তেন নিয়মিত। স্ত্রী গীতা সেনের সঙ্গে ছিল তাঁর অসাধারণ এক দাম্পত্য জীবন। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে একাকীত্বে ডুবেছিলেন যেন। তবুও সমাজের খুঁটিনাটি বিষয়ের খবর রাখতেন। বই ও পত্র-পত্রিকা ছিল তাঁর আজন্ম সঙ্গী। ভালো লাগত বিরাট কোহলিকে। রাজনীতি থেকে খেলা সব কিছু গভীরভাবে পড়া চাই। বার্ধক্য যতই ছোবল বসাবার চেষ্টা করুক, তিনি যেন আড্ডার মাঝে ফুটন্ত তরুণ। তবে সবার সঙ্গে আড্ডা দিতেন না। পছন্দসই মানুষ পেলে বিছানায় শুয়েও জমে যেতেন গল্পে। বলতেন, জীবনটাই যেন নীললোহিতের মতো, সবসময় আটকে থাকে সাতাশে।
পরাধীন ভারতে জন্মেছিলেন মৃণাল সেন, মাথার ওপর ছিল প্রায় দেড়শো বছরের ঔপনিবেশিকতার চাপ। জন্ম থেকে জীবনের প্রথম দিকটা কাটে ফরিদপুরের ছোট মফস্সল শহরে, যা আজ বাংলাদেশের অন্তর্গত। স্বাধীনতা অর্জনের পর বহু বছর ধরেই সিনেমায় আধুনিকতার নিরিখ কী, এক নাগাড়ে খুঁজে বেড়িয়েছেন তিনি।
শেষ ছবি ‘আমার ভুবন’ (২০০২)। প্রথম ছবি করেছিলেন ১৯৫৫-য়, ‘রাতভোর’। ‘পথের পাঁচালী’-র তুমুল সাফল্যের পাশে ‘রাতভোর’-এর ব্যর্থতা তাঁকে দমিয়ে দিতে পারেনি এতটুকু। পরবর্তী ‘নীল আকাশের নীচে’ ছুঁয়ে তৃতীয় ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’ থেকেই খুঁজে নিয়েছেন নিজের জমি। ফিল্ম, এই আর্ট ফর্মটির প্রতি তীব্র আসক্তি বা ভালবাসা না থাকলে বোধহয় এমন ক্রমোন্নতি অসম্ভব।
সত্যজিৎ রায়ের মতো গোড়া থেকেই ধ্রুপদী সাহিত্য বা সাহিত্যিককে নিজের ফিল্মের আশ্রয় করে তোলেননি তিনি। বরং সত্যজিতের সৃজন-ভাবনার বিপরীত বিন্দু থেকেই তাঁর ছবি করা শুরু। সত্যজিৎও স্বীকার করেছেন সে কথা। ‘‘দে স্টার্টেড অ্যাট অ্যাবাউট দ্য সেম টাইম অ্যাজ আই ডিড, ঋত্বিক অ্যান্ড মৃণাল।’’ ‘‘দে ওয়্যার মেকিং ফিল্ম ভেরি ডিফারেন্ট ফ্রম মাইন, ভেরি ডিফারেন্ট, বাট ভেরি পাওয়ারফুল, আই থিংক।’’
মৃণাল সেন বিশ্বাস করতেন কোনও ছবি-করিয়ের ‘সবচেয়ে বড় সঙ্কট হল আদর্শগত’। তার মোকাবিলা করতে পরিচালক হিসেবে সব সময় তিনি দায়বদ্ধ থাকতেন ছবির মূল বিষয়বস্তুর প্রতি, ফিল্ম মাধ্যমটির প্রতি এবং যে সময়ে তিনি ছবি করছেন, সেই সময়ের প্রতি। ফলে ষাটের দশকের মাঝামাঝি বা শেষ থেকে সারা সত্তর দশকের উত্তাল কলকাতা কিংবা তার সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা অনবরত উঠে আসত তাঁর ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর পর প্রায় প্রতি ছবিতেই। ‘আকাশকুসুম’, ‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘পদাতিক’, ‘কোরাস’-এর মতো সাদাকালো ছবিতে বাঙালি মধ্যবিত্তের অসার স্বপ্ন বা স্বপ্নভঙ্গের কাহিনি বুনে দিতেন তিনি। বাঙালি মধ্যবিত্তের দ্বন্দ্বে আকীর্ণ, রুক্ষ, স্ববিরোধী আর অসুন্দর জীবন যেমন ঠাঁই পেত তাঁর ছবিতে, তেমনই নকশাল আন্দোলন থেকে জরুরি অবস্থা অবধি বামপন্থী আন্দোলনের শক্তি ও দুর্বলতার ইতিহাসও ধরা পড়ত তাঁর এই সব ছবিতে। ধরা পড়ত অসম্ভব দারিদ্র আর ভয়ঙ্কর শোষণ। পুলিশ-প্রশাসন-সরকারের সশস্ত্র সন্ত্রাস। গণতন্ত্রের বকলমে রাষ্ট্র বা আইন-আদালতে শাসন নিয়ে প্রায়ই সপ্রশ্ন হয়ে উঠতেন তিনি, সেই সময়কার প্রায় প্রতিটি ছবিতেই। সে দিক থেকে দেখলে মৃণাল সেনকে রাজনৈতিক চলচ্চিত্রকার বললে মোটেও বাড়িয়ে বলা হবে না।
এই রাজনৈতিক সচেতনতার পিছনে ছিল তাঁর ফরিদপুরের জীবন। বাবা ছিলেন পেশায় উকিল, চরমপন্থী কংগ্রেসি, বিপিনচন্দ্র পালের ঘনিষ্ঠ। মৃণাল সেনের জন্ম যে বছর, সেই ১৯২৩-এর রায়ত সম্মেলনের বক্তৃতায় বাবা ১৯১৭-র বলশেভিক বিপ্লবের সশ্রদ্ধ উল্লেখ করেছিলেন। বড় হয়ে জানতে পেরে সে-কথা আজীবন স্মৃতিধার্য করে রেখেছিলেন মৃণাল সেন। বিপ্লবীদের ফাঁসির হুকুম হলে বাবা তাঁদের হয়ে কেস লড়তেন। এক বার গাঁধীজিকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে সারা দেশে হরতাল। বাবা আদালতে তো গেলেনই না, জেলাশাসক কৈফিয়ত চাইলে স্পষ্ট বলে দিলেন কারণটা। সে জন্যে শাস্তি পেতে হয়েছিল তাঁকে। এ সব দেখতে দেখতেই বড় হয়েছেন মৃণাল সেন।
দেখেছেন, সুভাষচন্দ্র বসু আর বিপিনচন্দ্র পালের কী রকম স্নেহধন্য ছিলেন তাঁর মা। ব্রিটিশ-বিরোধী জনসভায় উদ্বোধনী গান গাইতেন মা। এ সব অভিজ্ঞতার কথা বহু বার বলেছেন তিনি: ‘‘তখন দেখেছি কত অসংখ্য লোক আসতেন আমাদের বাড়িতে। আসতেন সে-সব লোক, যাঁরা সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, যাঁদের পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে।… ফলে আমাদের বাড়িতে ক্ষণে ক্ষণে পুলিশের তল্লাশি চলতে লাগল। কী করে মানুষ পালিয়ে বেড়ায় এটা আমি খুব ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি। মানুষ ভয় পেয়ে পালায়, এক জন মানুষ অনেক মানুষের জন্যেই পালায়। ছোটবেলা থেকেই আমি পুলিশ চিনেছি।’’
নিজের নানান ছবিতে এই সব স্মৃতিকে পুনর্নির্মাণ করেছেন মৃণাল সেন। ধরাবাঁধা ছাঁচে আঁটা জীবনের গল্প বলতে চাননি বলেই বোধহয় কখনও ‘ট্র্যাডিশনালিস্ট’ হননি। নতুন কথা কিংবা নতুন বিষয় বিধৃত করার জন্যেই ফিল্মের ফর্ম বা টেকনিক নিয়ে অবিরত ভাঙচুর চালিয়ে গিয়েছেন। তাই কেতাবি কায়দায় ক্যামেরা চালানোটা কখনওই তাঁর ফিল্মের ধরন হয়ে ওঠেনি। অনেক সময় ক্যামেরার ফ্রেম স্লিপ করেছে। ফ্রেমলাইন ক্যামেরার মাঝখানে চলে এসেছে। পুলিশের লাঠি চালানো বা বিভিন্ন মারামারির শট তুলতে গিয়ে এটা ঘটেছে। পরে ওগুলোকে ও-ভাবেই রেখে দিয়েছেন। এ রকম উদাহরণ ছড়ানো আছে তাঁর ‘কলকাতা ৭১’, ‘পদাতিক’, ‘ইন্টারভিউ’-তে। এ ভাবেই তিনি চিত্রায়িত করতেন অসুন্দরকে। জীবনের মসৃণতার অভাব দেখানোর জন্যে সৃষ্টি করতেন টেকনিক্যাল জৌলুসের অভাব। খুব ভাল ভাবে মাধ্যমটাকে জানলে তবেই এটা করা সম্ভব।
ফর্মের এই ভাঙচুর নিয়ে মৃণাল সেনকে ঘিরে আলোচনা হয়েছে বিস্তর, তর্কাতর্কিও কম নয়। যেমন ‘ভুবন সোম’। ১৯৬৯-এ তৈরি এ শুধু মৃণাল সেনেরই প্রথম হিন্দি ছবি নয়, হিন্দি ছবির জগতেও প্রথম তরঙ্গ; আরও স্পষ্ট ভাবে বললে ‘নবতরঙ্গ’। ‘ভুবন সোম’ হিন্দি ছবির ভাবনার জগৎটাকে কিংবা বানানোর রীতিকে উল্টেপাল্টে দিয়েছিল একেবারে। বাণিজ্যিক সিনেমার লোকজন বরাবর বলে এসেছেন, ফিল্ম আদতে খুব ব্যয়বহুল মাধ্যম, মৃণাল সেনের কাছে সেটাই ছিল চ্যালেঞ্জ, কত কম খরচে, কত ভাল ছবি করা যায়। সেটাই করে দেখালেন ‘ভুবন সোম’-এ। মাত্র দেড় ঘণ্টার এই ছবিটি সরকারি ফিল্ম সংস্থা এফএফসি (আজকের এনএফডিসি)-র ইতিহাস বদলে দিয়েছিল। ছবির তুমুল জনপ্রিয়তা সাহস জুগিয়েছিল সংস্থাটিকে, পরে নতুন ধারার ছবিতে অর্থ বিনিয়োগের।
আশি থেকে নব্বইয়ের গোড়া পর্যন্ত যে ধরনের ছবি তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন মৃণাল সেন, সেখানে মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবন যেন আরও বেআব্রু। আত্মরক্ষার আর কোনও অস্ত্র রইল না, প্রায় প্রতিটি ছবির চরিত্রদের তিনি চুল ধরে টেনে এনে দাঁড় করিয়ে দিলেন আয়নার সামনে। ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘আকালের সন্ধানে’, ‘খারিজ’, ‘খণ্ডহর’, ‘জেনেসিস’ বা ‘মহাপৃথিবী’ এ ধরনের ছবিতে আত্মসমালোচনা আর নিজেকে প্রশ্ন করা শুরু করলেন তিনি। কতটা বাস্তবনিষ্ঠ হতে পারছেন বা হওয়ার চেষ্টা করছেন শিল্পকর্মীরা, কিংবা বাস্তবের ধাপ বেয়ে চলতে চলতে কোনও ইচ্ছাপূরণের মোহে আটকে পড়ছেন না তো তাঁরা, এ সব প্রশ্নেরই যেন উত্তর পাওয়ার একটা দুর্মর চেষ্টা ছবিগুলিতে।
‘মহাপৃথিবী’-র পর নিয়মিত ছবি করা ছেড়ে দিয়েছিলেন। দীর্ঘ দশ বছরের ব্যবধানে যে-দু’টি ছবি করেছিলেন ‘অন্তরীণ’ আর ‘আমার ভুবন’, সে-দু’টি শিল্পমানের দিক থেকে গুরুত্বের। যখন নানা ভারতীয় ভাষায় অন্তত গোটা আটেক ছবি করেছেন, ওড়িয়া-য় ‘মাটির মনিষ’, তেলুগুতে ‘ওকা উরি কথা’ কিংবা হিন্দিতে ‘ভুবন সোম’, ‘এক আধুরি কহানি’, ‘মৃগয়া’, ‘খণ্ডহর’, ‘জেনেসিস’, ‘একদিন অচানক’, তখন অবিরত ভারতীয়তা বা আন্তর্জাতিকতার কথা বলে গিয়েছেন। বলেছেন, ‘‘আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেন যে, আপনি কেন এত বিভিন্ন ভাষায় ছবি করেন? আমি বলি, আমি দারিদ্র নিয়ে ছবি করি। আফ্রিকাতে গিয়ে সোয়াহিলি ভাষায় ছবি করতেও আমার কোনও অসুবিধে হবে না, যদি আমি ফিজিক্যাল পিকিউলিয়ারিটিগুলো ধরতে পারি, যেটা সব সময় সারফেস-এ থাকে।’’
টেলিফিল্ম, শর্টফিল্ম এবং ডকুমেন্টারি বাদ দিলে তাঁর পূর্ণদৈর্ঘ্যের ফিচার ফিল্মের সংখ্যা সাতাশ। বিদেশে, বিশেষ করে রাশিয়া ও ফ্রান্সে যেমন সম্মানিত, তেমনই রাজ্যসভার সাংসদ হয়েছেন, পেয়েছেন পদ্মভূষণ, অর্জন করেছেন ভারতীয় সিনেমার সর্বোচ্চ উপাধি ‘দাদাসাহেব ফালকে’।
মৃণাল সেন আজও আমাদের কাছে মীমাংসিত। তাঁর অবস্থান, তাঁর চলচ্চিত্র, তাঁর বক্তব্য অত্যন্ত সুনির্ণীত। ব্রিটিশ অভিনেত্রী ভেনেসা রেডগ্রেভ পরিষ্কার করেই বলেন, ‘আমি বাম-দলের যতোটা সম্ভব ততোটাই।’ মৃণাল সেন ‘যতোটা-ততোটা’, ‘সম্ভব-অসম্ভবের’ ধার ধারেন না। তিনি পুরোটাই শ্রেণী সচেতন। মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র মানেই রাজনৈতিক চলচ্চিত্র। ‘শিল্পের জন্যে সিনেমা’ বা ‘বিনোদনের জন্যে সিনেমা’ যাদের আরাধ্য তাঁরা আর যাই হোক মৃণাল সেনের ছবিতে আরাম পাবেন না, পাওয়ার কথাও না। মৃণাল সেন সচেতন, বিচক্ষণ এবং নিজের কাজটি সম্পর্কে জানতেন।
ভারতীয় বাংলা সিনেমার ত্রয়ী গুরুদের শেষজন মৃণাল সেন। সত্যজিৎ রায়ের (১৯২১- ১৯৯২) সঙ্গে তাঁর চিন্তাগত নৈকট্য কমই ছিলো। বয়সে তাঁর চেয়ে দু’বছরের বড় ছিলেন সত্যজিৎ। ১৯৫৫ সালে মৃণাল সেনের প্রথম ছবি ‘রাত ভোর’ মুক্তি পায়। একই বছর সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালি’ মুক্তি পায়। ‘পথের পাঁচালি’ বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তোলে, অথচ মৃণাল সেনের প্রথম ছবি সে অর্থে কোন আলোড়নই তোলেনি। তৃতীয় ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’ (১৯৬০) তাঁকে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসাবে চিহ্নিত করে। আরো পরে ১৯৬৯ সালে ‘ভুবন সোম’ চলচ্চিত্রের কারণে মৃণাল সেনকে আমরা সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটকের কাতারের চলচ্চিত্রকার মনে করি। ঋত্বিক ঘটক (১৯২৫-১৯৭৬) অবশ্য বয়সে সত্যজিৎ ও মৃণাল সেনের চেয়ে ছোট হলেও চলচ্চিত্রে তাঁর আগমন ও প্রস্থানও তাঁদের আগেই। ‘নাগরিক’ (১৯৫২) চলচ্চিত্র দিয়ে ঋত্বিকের চলচ্চিত্র অভিযান শুরু আর সমাপ্তি ঘটে ‘যুক্তি তক্ক গপ্পো’ (১৯৭৩) দিয়ে। ঋত্বিক ঘটক আর মৃণাল সেনের একটা কমন আইডেন্টিটি ছিলো। দুজনই আইপিটিএ (Indian People’s Theatre Association) এর কর্মী ছিলেন। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক মুখপাত্র ছিলো এই নাট্যদল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪২ সালে এ নাট্যদলের জন্ম। ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষ, উপনিবেশিকতার ভয়াবহবতা এবং সর্বোপরি শ্রেণি শত্রু নিধনই আইপিটিএ-এর অন্যতম কাজ ছিলো। নানা সময়ে পৃথ্বিরাজ কাপুর, বিজন ভট্টাচার্য, বলরাজ সাহানি, ঋত্বিক ঘটক, উৎপল দত্ত, মৃণাল সেন, সলীল চৌধুরী, পণ্ডিত রবি শঙ্কর, সফদর হাসমির মতো ব্যক্তিরা এখানে কাজ করেছেন। এবং অনিবার্যভাবেই তাঁদের কাজে আইপিটিএ-এর প্রভাব পড়েছে। বিশেষত বাংলা চলচ্চিত্রে ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন এবং উৎপল দত্ত শ্রেণী সংগ্রামকে দিয়েছেন নতুন মাত্রা। সত্যজিৎ রায় সরাসরি এই দলে যোগ দেননি। তবে তাঁর একাধিক চলচ্চিত্রে সাধারণ মানুষ, শ্রেণী শোষণ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মৃণাল সেনের ‘আকালের সন্ধানে’র (১৯৮০) আগেই সত্যজিৎ রায় বানিয়েছিলেন ‘অশনি সংকেত’ (১৯৭৩) আবার ১৯৭২-এ মৃণাল সেন বানিয়েছেন ‘কলকাতা ৭১’। উল্লেখ করা দরকার এই তিনটি চলচ্চিত্রেই ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের চিত্রায়ণ হয়েছে বলিষ্ঠভাবে। ‘অশনি সংকেত’ বিভূতিভূষণের উপন্যাস অবলম্বনে করা। অন্যদিকে ‘কলকাতা ৭১’ এর কাহিনী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধ স্যান্নাল, সমরেশ বসু এবং অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চারটি গল্প থেকে নেয়া। এটাই তো স্বাভাবিক যে, লেখক, চলচ্চিত্রকার, শিল্পীরা তাঁদের সময়, সমাজের সংকট তুলে ধরবেন। অতীত আর বর্তমানকে বিশ্লেষণ করবেন ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিয়ে। মৃণাল সেন সময় ও সমাজের দায় পালন করেছিলেন ‘কলকাতা ৭১’, ‘আকালের সন্ধানে’র মতো চলচ্চিত্র বানিয়ে। সোজা করে বললে, মৃণাল সেনের সব চলচ্চিত্রই দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে নির্মিত।
গঠনগত দিক থেকে সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ সরল ভঙ্গির গল্প। মানবিক সংকটের একটি গল্প বলাই তাঁর লক্ষ্য, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি তাই করেছিলেন। অন্যদিকে ‘কলকাতা ৭১’ অনেকটাই জটিল। কারণ, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতির হিসাবটা একরৈখিক নয়। অসহায় মানুষগুলো সদা এক জটিল রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদির আবর্তে পাক খেতে থাকে। সেই বিবিধ পাকের গল্প ‘কলকাতা ৭১’। গ্রিফিতের ‘ইন্সটলারেন্স’ চলচ্চিত্রে যেমন নানা সময় উঠে এসেছে, শোষণের নানা কাল উঠে এসেছে, তেমনি ‘কলকাতা ৭১’ এর চারটি সময় তুলে ধরা হয়েছে। গ্রিফিথের মতো মৃণাল সেনও পুঁজিবাদ, শ্রেণী শোষণ ও সামাজিক অসঙ্গতিকে চারটি ভিন্ন ভিন্ন গল্পে বয়ান করেছেন। এবং এই গল্প বয়ানটিও সরল নয়; প্রায়ই ব্রেখটিয় এলিনিয়েশন দ্বারা তাড়িত। মৃণাল সেনের গণনাট্য চর্চার অভিজ্ঞতা হয়তো এ ক্ষেত্রে কাজে লেগেছে। দর্শককে তিনি আবেগাপ্লুত করেননি, বরং যখনই আবেগের মোহ তৈরি হয়েছে, যখনই মন নরম হয়েছে তখন তিনি সজোরে আঘাত করে জানিয়ে দিয়েছেন, আবেগে ভেসে যাওয়ার কিছু নেই, বিশ্লেষণে মন দিতে হবে। মন নয়, মৃণালের ছবি মগজের খাদ্য। ব্রেখটিয় এলিনিয়েশনের মতো তিনি দর্শককে গল্প বলার মুগ্ধতায় নয়, বরং গল্প থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুহূর্তেই বুদ্ধি জাগিয়ে দিতে চান। ছবিতে জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষের চিত্র ব্যবহার করা মগজ আর মননের দারূণ সমন্বয়।
তাঁর ‘আকালের সন্ধানে’ চলচ্চিত্র বাস্তবতার বিশ্লেষণাত্মক চিত্ররূপ। আঙ্গিকগত দিক থেকে একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক আর মার্সেল প্রুস্তের উপন্যাসের জটিলতা ও নান্দনিকতাকে ধারণ করে। এ চলচ্চিত্র ক্ষুধা, দারিদ্র আর দুর্ভিক্ষের মোক্ষম চিত্রায়ণ। জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষের চিত্রমালার মতো ধ্রুপদী মৃণাল সেনের ‘আকালের সন্ধানে’। নির্মাণের দিক থেকে এটি ফরাসি চলচ্চিত্রকার ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর নিউ ওয়েভ চলচ্চিত্র ‘ডে ফর নাইট’ এবং ইতালীয় নাট্যকার লুইজি পিরানদেল্লার ‘সিক্স ক্যারেক্টার ইন সার্চ অব আ রাইটার’ বা ‘হেনরি দ্য ফোর্থ’ মঞ্চ নাটকের কথা মনে করিয়ে দেয়। চলচ্চিত্রের ভেতরে চলচ্চিত্র, নাটকের ভেতরে নাটক, চলচ্চিত্র নিয়ে চলচ্চিত্র, নাটক নিয়ে নাটক- এই ব্যাপারগুলো আছে মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রে। কথাগুলো আরও পরিষ্কার হবে ‘আকালের সন্ধানে’র কাহিনীর দিকে দৃষ্টি দিলে।
বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক গ্রামে গেছেন শুটিং করতে। সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’-এর মতো তাঁরাও ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষের চিত্রায়ণ করতে চান। একটি বোমাও ফেলা হয়নি, একটি বন্দুকও ছোড়া হয়নি- অথচ মানুষের তৈরি এই দুর্ভিক্ষে ৫০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিলো অনাহারে। ১৯৮০ সালে চলচ্চিত্রের পরিচালক, কুশলী, শিল্পীরা গ্রামে এসে ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের গল্প চিত্রায়ণ করতে গিয়ে মুখোমুখি হন এক ঐতিহাসিক বাস্তবতার। ১৯৪৩ সালের সাথে সংযোগ তৈরি হয় ১৯৮০ সালের মানুষের। গ্রামের দারিদ্র্য, অশিক্ষিত মানুষগুলোর সঙ্গে সিনেমার শৈল্পিক, শিক্ষিত লোকগুলোর মিল আর তফাত বেরিয়ে আসে। সিনেমার বাস্তবতা আর জীবনের বাস্তবতা এক নয়। ফলে ক্ল্যাপস্টিক চালু হওয়ার সাথে সাথেই সিনেমার শিল্পীকুশলীরা ক্রমশ ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি হতে থাকে। গ্রাম্য গৃহবধূর চরিত্র নিজের সমস্ত দরদ দিয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করে স্মিতা পাতিল বুঝাতে পেরেছিলেন এই মানুষগুলোকে চেনার ক্ষেত্রে কতোটা পিছিয়ে আছি আমরা। আরেক নাগরিক অভিনেত্রী তো দুর্ভিক্ষের কালে শরীর বিক্রি করা নারীর চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে গ্ল্যামার বিসর্জন দিতে রাজি হন না। তিনি শুটিং রেখেই চলে যান। গ্রামের একটি নারী কি পারবে এ চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে? এদিকে যে বাড়িতে শুটিং সেখানেই একটি মৃত্যু পুরো ইউনিটকে বিব্রত করে। লোকেশনে শুটিংয়ের নানা কারিগরি সমস্যা তো আছেই, সেই সঙ্গে অভিনেতাদের দ্বৈত সত্তা ক্রমশ জটিল করে তোলে। এদিকে গ্রামের সরল মানুষগুলো এই শুটিং নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে। এর মধ্যে গ্রাম্য জটিলতাও দেখা দেয় কিছু।
‘আকালের সন্ধানে’ করতে এসে কেবল দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর নয়, আরো বাড়তি কিছু অনুভব যোগ হয়। গ্রামীণ সমাজের সারল্য, অজ্ঞতা, নারীর অবমূল্যায়ন, শহর ও গ্রাম জীবনের ফারাক – এমনি সব বিষয় উঠে আসে একটি সিনেমার শুটিংয়ের অজুহাতে। শহর আর গ্রাম যে ‘দুটো আলাদা পৃথিবী’ ছবির শেষে তাই মৃণাল সেন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৪৩ আর ১৯৮০ একাকার হয়ে যায়। ইতিহাস আর বাস্তব একাকার হয়ে যায়। জীবন আর সিনেমার ফারাক বেরিয়ে আসে। ফলে পুরো টিম ফিরে যায়, যেতে হয়। গ্রামে নয়, স্টুডিওতেই শুটিং করতে হবে বাকী চলচ্চিত্রের, কারণ শেষতক চলচ্চিত্রও একটা বুর্জোয়া শিল্পমাধ্যম। চলচ্চিত্র মুনাফা, পূঁজির হিসাবের বাইরের কিছু নয়। প্রসঙ্গত আবার গঁদারের কথা মনে পড়ে যায়। মৃণাল সেন বরাবরই এই নানা প্রসঙ্গ মনে করিয়ে দেন। প্রচুর রেফারেন্স ব্যবহার করেছিলেন তিনি। মাঝে মাঝে প্রবন্ধের নির্লিপ্ততা চলে আসে তাঁর চলচ্চিত্রে। মাঝে মাঝে গল্প হয়ে ওঠে তথ্যচিত্রের মতো একনিষ্ঠ বিশ্লেষণ। বিশ্লেষণ তবে তা বাস্তবসম্মত এবং বোধ জাগানিয়া।
একটি ছবির কথা না বলে আলোচনা শেষ করা যায় না। মৃণাল সেনের ‘মৃগয়া’ এমন এক চলচ্চিত্র যা আমাদের বোধ জাগ্রত করে।
ওড়িয়া গল্পকার ভগবতি চরণ পানিগ্রাহী’র গল্প অবলম্বনে তৈরি হয়েছিল ‘মৃগয়া’। ব্রিটিশ শাসিত ভারতের প্রেক্ষাপটে এক আদিবাসী যুবকের জীবন ও সংগ্রাম কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে কাহিনী। ঘিনুয়া সরল আদিবাসী যুবক, শিকারই তার নেশা-পেশা। ইংরেজ সাহেবও শিকারের নেশায় মত্ত। শিকারকে ঘিরেই দুই অসম শ্রেণীর মানুষের মধ্যে হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। ঘিনুয়া ও আদিবাসীদের সঙ্গে মহাজনের সংঘাত চিরকালই লেগে আছে। এর মাঝে বিপ্লবী হয়ে ওঠে কোনো কোনো আদিবাসী যুবক। তাঁরা জানে বুনো জন্তু আর শোষক-মহাজনে কোনো তফাত নেই। মহাজন একদিন ঘিনুয়ার প্রিয়তম স্ত্রীকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। বউকে লুণ্ঠনের শাস্তি ঘিনুয়া নিজ হাতে তুলে নেয়। ব্রিটিশ আইন তাঁর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত রায় দেয়। কিন্তু ঘিনুয়া আর তাঁর আদিবাসী সঙ্গীরা বুঝতে পারে না, বিশ্বাসঘাতককে হত্যা করলে তাঁর শাস্তি হবে কেন! কারণ তাঁরাই দেখেছিল তাঁদের গ্রামের বিপ্লবী শাপলুকে যে হত্যা করেছিলো তাঁকে সরকার পুরস্কার দিয়েচ। এমনকি সাহেবও এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেননি। বিচারও যেন শ্রেণী ও মানুষ ভেদে ভিন্ন এ গল্প চোখে আঙুল দিয়ে তা-ই দেখিয়ে দেয়। ছবির শেষে এক ভিন্নতর অর্থেই ‘সব চিন্তা- প্রার্থনার সকল সময় শূন্য মনে হয়, শূন্য মনে হয়।’
ঋত্বিক ঘটক ও সত্যজিৎ রায়, দুই পরিচালকের থেকে অনেকটা দূরে থেকেই সিনেমাকে অন্যভাবে দেখেছেন পরিচালক মৃণাল সেন৷ কখনও কঠোর বাস্তব, তো কখনও মানুষের মনের থেকে স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নকে নিংড়ে নিয়ে এসে পর্দায় তৈরি করতেন এক অদ্ভুত ছবি৷ আর তাই হয়তো, সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটকের পাশাপাশি সিনেমার পর্দার নিজের আলাদা ‘অটিয়োর’ তৈরি করেছিলেন মৃণাল সেন৷ মৃণাল সেন আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন – সাহসী মৃণাল, ক্ষুব্ধ মৃণাল, স্পষ্ট মৃণাল ও মহাত্মা মৃণাল হয়ে।
(তথ্যসূত্র:
১- মৃণাল সেন, তৃতীয় ভুবন, আনন্দ পাবলিশার্স (২০১১), কলকাতা।
২- মৃণাল সেন, আমি ও আমার সিনেমা, বাণীশিল্প (২০১৫), কলকাতা।
৩- মৃণাল সেন, অনেক মুখ অনেক মুহূর্ত, পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ ও থীমা (২০১৫), কলকাতা।
৪- Mrinal Sen: Sixty Years in Search of Cinema, Dipankar Mukhopadhyay, HarperCollins India.
৫- অনেক মুখ অনেক মুহূর্ত, মৃণাল সেন, থীমা।
৬- Always Being Born: Recipient Of Dadasaheb Phalke Award Mrinal Sen A Memoir, Mrinal Sen, Stellar (২০১৬)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত