হায়দ্রাবাদ থেকে কলকাতা এসেছিলেন তিনি। চোখে ছিল ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন। বাকিটা ইতিহাস। এই শহরটা তাঁকে দিয়েছে ভালবাসা, সম্মান। তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলা তথা ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম বড় সুপারস্টার। আর সেই যাত্রায় তিনি পাশে পেয়েছিলেন আরও দু’জনকে। একজন প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বা পিকে। অন্যজন সুবিমল গোস্বামী বা চুনী। আর এই চুনী, পিকের সঙ্গে ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম সেরা ত্রয়ী হয়ে উঠেছিলেন দক্ষিণ ভারত থেকে আসা ছেলেটা। কালের নিয়মে মাসখানেক আগে পরলোকে চলে গিয়েছেন পিকে। আজ চলে গেলেন চুনী। রয়ে গেলেন একা তিনি, তুলসীদাস বলরাম।
বলরাম বলছেন, “আমি তখন হায়দ্রাবাদে আর ও বাংলার হয়ে খেলছে, সবাই বলছিল, ও নাকি দারুণ প্রতিশ্রুতিমান ফুটবলার। কলকাতার মোহনবাগানের হয়ে ভাল খেলছে। দুর্দান্ত ড্রিবল করে। অসাধারণ পাস দেয়। গোলের জায়গা করে নিতে পারে মুহূর্তে। এটা শোনার পর থেকেই ওকে দেখার ইচ্ছে ছিল। আর মনের মধ্যে বার বার একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল, চুনীর মধ্যে কী এমন খেলা আছে, যা আমার নেই! যত দূর মনে পড়ছে, ও একটা ম্যাচই খেলেছিল এবং সেটা সেমিফাইনাল। বাংলা হেরে গিয়েছিল মুম্বইয়ের কাছে। আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। বাংলা হারলেও চুনীর খেলা ভালই লেগেছিল। তবে আমি যে ওর চেয়ে খারাপ খেলি, এটা মেনে নিতে পারছিলাম না মন থেকে। পরে বুঝেছিলাম, কম বয়সে এ-রকম হয়, সমবয়সিদের মধ্যে একটা দেখানোর জেদ তৈরি হয়। চুনীই হয়তো উদ্বুদ্ধ করেছিল আমাকে, না হলে দেশের নানা জায়গার এত ক্লাব থেকে প্রস্তাব আসা সত্ত্বেও কেন চলে এসেছিলাম কলকাতায় খেলতে! ওর সঙ্গে আমার সখ্য ছিল। পিকের মতোই ছিল বন্ধুত্ব।
বলরাম আরও বলছেন, “দেশের হয়ে খেলার সময় আমরা চুনী-পিকে-বলরাম হয়ে যেতাম। তখন এক আত্মা, এক প্রাণ। কিন্তু ক্লাবের জার্সি পরলেই মনের মধ্যে একটা তাগিদ চলে আসত নিজের ক্লাবকে জেতানোর। যখন ডার্বি হত, তখন তো আর কথাই নেই। চুনীর মোহনবাগানকে হারানোর জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত থাকতাম। শুধু কলকাতা লিগ নয়, আইএফএ শিল্ড, রোভার্স, ডুরান্ড কাপ যেখানেই দেখা হত, তখন হারানোর চেষ্টা করতাম মোহনবাগানকে। আমি লাল-হলুদ জার্সিতে আর চুনী মোহনবাগান জার্সিতে— এই দ্বৈরথ দেখার জন্য সারা বাংলা উত্তাল হয়ে উঠত তখন। বলতে পারেন, এই লড়াইটা উপভোগ করব বলেই বার বার প্রস্তাব এলেও কখনও মোহনবাগানে যাইনি। ইস্টবেঙ্গলে থেকে গিয়েছি।আমাদের লড়াইটা ছিল নব্বই মিনিটেরই। তবে এটা স্বীকার করছি, চুনীকে আমি ফুটবলার হিসেবে সম্মানই করতাম”।
পুরানে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ কিংবা বলিউডের অমর-আকবর-অ্যান্টনি, যখনই কোনও ত্রয়ীর কথা উঠেছে, বাঙালি ফুটবল পাগল মানুষ এই ত্রয়ীর কথা তুলেছেন বারবার। পিকে-চুনী-বলরাম সেই ৬০’র দশক থেকে আজও বাংলার তথা ভারতের ফুটবল হৃদয়ে থেকে গিয়েছেন। থেকে যাবেনও চিরকাল।