১৮ই এপ্রিল ১৯৩০ সাল, রাত্রি আটটা। লালমোহন সেন, সুবোধ মিত্র, সুকুমার ভৌমিক ও হারান দত্ত – এই চারজন চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ষাট মাইল দূরে ধূম রেলস্টেশনের কাছে এক নির্জন জায়গায় এসেছেন। তাঁদের লক্ষ্য রেললাইন উপড়ে ফেলা ও টেলিগ্রাফের তার কেটে দেওয়া। রেললাইন তুলে ফেলা মোটেও সহজ কাজ নয়, খুব শক্তি দরকার। তখন শালকাঠের স্লিপারের উপরে ফিসপ্লেট আর খুব বড় বড় গজাল দিয়ে রেললাইন আটকানো থাকত। দুজন খুব শক্তিশালী ছেলে উপড়ে ফেলল গজাল, সরিয়ে ফেলল ফিসপ্লেট। কিন্তু লাইনটি একেবারে সরিয়ে দিলে যদি দূর থেকে ইঞ্জিন চালক দেখতে পেয়ে যায়, এই ভেবে খোলা লাইনটি যেমন-তেমন করে আলগা অবস্থায় রেখে দেওয়া হল। এখন সামান্য ঝাঁকুনিতেই লাইন একেবারে কাত হয়ে যাবে। হঠাৎ দেখা গেল দূর থেকে রেলের আলো এগিয়ে আসছে। এখন তো চট্টগ্রাম মেল আসার সময় নয়, তাহলে? হয়ত কোন মালগাড়ি। চারজনই দ্রুত কাছের পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়লেন। একটু পরেই শোনা গেল কানফাটানো বিকট আওয়াজ। দেখা গেল একটা মালগাড়ি উল্টেছে। ইঞ্জিনের সার্চলাইটটা একদিকে হেলে পড়েছে। আর কোন চিন্তা নেই, এবার ছেলেরা সবাই মিলে কেটে ফেললেন রেললাইনের পাশ দিয়ে যাওয়া টেলিগ্রাফের তার।
রেললাইন ভাঙার অন্য একটা দলে ছিলেন উপেন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য, বিজয় আইচ, শংকর সরকার ও সুশীল দে। তাঁরা চট্টগ্রাম থেকে বাহাত্তর মাইল দূরে লাঙ্গলকোট স্টেশনের কাছে একটি জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিলেন, সময় ছিল একই, রাত আটটা। এতদিন ধরে রেললাইন তুলে ফেলা, টেলিগ্রাফের তার কাটার নানা শিক্ষা তাঁরা পেয়েছিলেন – সেদিন তাঁদের ছিল হাতে-কলমে পরীক্ষার দিন। তাঁরা জানতেন, তাঁদের এই সাফল্যের উপরে চট্টগ্রামের মুক্তিসংগ্রামের অন্যান্য সাফল্য নির্ভর করছে। তাঁরা খুবই দ্রুত রেললাইন খুলে ফেললেন। তারপরে লাইনের পাশে টেলিগ্রাফের তারের খুঁটি বেয়ে ওপরে উঠে শুরু করলেন তার কাটা। শনশন, ঝনঝন প্রচণ্ড আওয়াজ হচ্ছিল – কিন্তু তখন আর ভাববার সময় নেই। ঝপাঝপ তার কেটে উধাও হয়ে গেল ছেলের দল। রেলে চেপে আসার পথ নেই, টেলিগ্রাফে যোগাযোগের উপায় নেই, চট্টগ্রাম বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন। কাজ শেষ করে দু’দলই হেঁটে ফিরে চলল চট্টগ্রামের দিকে।
চট্টগ্রাম শহরের মাঝখানে একটা ছোট্ট পাহাড় – তার উপরে টেলিফোন ভবন। টেলিগ্রাফ অফিসও সেই একই বাড়িতে। সামনের খাড়া সিঁড়ি দিয়ে জনসাধারণ টেলিফোন ভবনে যাতায়াত করেন। পেছনের রাস্তাটা নির্জন। ওই পথে মোটরে চেপে সোজা একেবারে টেলিফোন ভবনের দরজায় পৌঁছানো যায়। দ্বিজেন দস্তিদার, কালীপদ চক্রবর্তী, মনীন্দ্র গুহ, বীরেন দে ও নিরঞ্জন রায় – এই পাঁচজনকে মাস্টারদা এক দুর্দান্ত কাজের আদেশ দিয়েছেন। ১৮ই এপ্রিল রাত দশটা বাজতে পাঁচ মিনিট নাগাদ টেলিফোন আর টেলিগ্রাফ অফিস ধ্বংস করে দিতে হবে। একটা ম্যাপ খুলে পাঁচজনকে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছিল টেলিফোন-টেলিগ্রাফ অফিসের ভেতরে কোথায় কি যন্ত্র আছে, কজন কর্মচারী আর কয়টা টেলিগ্রাফ তারের লাইন। সেদিন ছেলের দল ছিল প্রবল উত্তেজিত। এতদিনে তাঁরা কাজের মতন একটা কাজ পেয়েছে। তাঁরা এটুকু বুঝেছিল – চট্টগ্রামে একটা বড় কিছু ঘটতে চলেছে। তার আগে টেলিফোন ভবন ধ্বংস করে ফেলাটা জরুরি। তাঁদের আক্রমণের নেতৃত্বে থাকবেন অম্বিকা চক্রবর্তী।
১৮ই এপ্রিল রাত পৌনে দশটা নাগাদ আনন্দ গুপ্ত নতুন শোভ্রোলে গাড়ি নিয়ে কংগ্রেস অফিসে উপস্থিত হলেন। বড়ো হাতুড়ি, কুড়ুল, কাঁচি, রবারের দস্তানা, পেট্রোলের টিন – সব তাড়াতাড়ি তুলে ফেলা হল গাড়িতে। তারপরে সবাই গাড়িতে উঠে বসতেই আনন্দ গুপ্ত গাড়ি ছোটালেন। টেলিগ্রাফের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট মি. স্কটের কোয়ার্টারের পাশ দিয়ে পিছনের রাস্তা ধরে গাড়ি সোজা এসে থামল টেলিফোন এক্সচেঞ্জের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে এল পাঁচজন। তাঁদের সকলের পরণে মিলিটারি খাকি পোষাক। গাড়ি থেকে চটপট নামিয়ে ফেলা হল ভাঙচুর করার যন্ত্রপাতি। পরিকল্পনা অনুযায়ী অম্বিকা চক্রবর্তী টেলিফোন এক্সচেঞ্জে ঢুকে অতর্কিতে অপারেটরের নাকে ক্লোরোফর্ম মাখানো তুলো চেপে ধরলেন। সে গোঁ গোঁ করতে করতে জ্ঞান হারাল। তাঁকে ঘর থেকে বের করে আনা হল। কালীপদ চক্রবর্তী ও অম্বিকা চক্রবর্তী রিভলভার হাতে পাহারায় রইলেন। বাকি ছেলেরা কাঁচি দিয়ে টেলিফোনের তার কাটতে লেগে পড়ল। এরপরে সুইচ বোর্ডের উপরে পড়তে লাগল হাতুড়ির বাড়ি। আওয়াজ পেয়ে মিস্টার স্কট টেলিফোন ভবন লক্ষ্য করে গুলি চালালে অম্বিকা চক্রবর্তী পাল্টা গুলি ছুঁড়লেন স্কটের কোয়ার্টার লক্ষ্য করে। ব্যাস! এরপরে ওদিক থেকে আর কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। এরই মধ্যে ছেলেরা টেলিফোনের তার কেটে, বোর্ড ভেঙে একেবারে তছনছ করে দিয়েছিল। অম্বিকা চক্রবর্তী আদেশ দিলেন – ‘পেট্রোল ঢালো, আগুন লাগাও’। মুহূর্তের মধ্যে টেলিফোন ঘরে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল।
একই বাড়িতে, পাশেই টেলিগ্রাফ অফিস। অম্বিকা চক্রবর্তীর পরবর্তী নির্দেশ পেয়ে ছেলেরা ছুটলো টেলিগ্রাফ অফিস ধ্বংস করতে। ঘর ততক্ষণে ভেতর থেকে বন্ধ। ভেতরে কর্মীরা ভয়ে ফিসফিস করে কথা বলছে। হাতুড়ি, কুড়ুল দিয়ে দরজা ভেঙে ফেলা হল। অম্বিকা চক্রবর্তী রিভলভার হাতে সবার আগে দৌঁড়ে ভিতরে ঢুকলেন। চিৎকার করে বললেন – হাত তুলুন। সাবধান। কেউ নড়বেন না, চিৎকার করবেন না। ভয় নেই, কিন্তু পালাতে চেষ্টা করলে গুলি করব। কর্মীরা দু’হাত তুলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সেই সুযোগে ছেলেরা টেলিগ্রাফের যন্ত্রগুলো একেবারে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিল। তারপরে সবাইকে বাইরে আসতে বলা হল। পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল টেলিগ্রাফ অফিসেও। তারপরে সবাই বাইরের খোলা জমিতে এসে দেখলেন টেলিফোন-টেলিগ্রাফ অফিস দাউদাউ করে জ্বলছে। চট্টগ্রামের মূল টেলিফোন ভবন আক্রমণ করে বিনা রক্তপাতে জ্বালিয়ে দেওয়া হল। এরপরে অম্বিকা চক্রবর্তী দলের সবাইকে গাড়িতে উঠতে আদেশ করলেন। সবাই গাড়িতে উঠতেই গাড়ি চলতে শুরু করল।
চট্টগ্রাম শহরের একেবারে সীমানার কাছে একটা ছোট পাহাড়ের উপরে পুলিশের অস্ত্রাগার। অস্ত্রাগারের পাশে দুটো ব্যারাক। প্রায় পাঁচশো সেপাই সেখানে থাকে। ১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল, সেপাইদের কাছে অন্যান্য দিনের মতোই একটা দিন। অস্ত্রাগারের গার্ডরুমের প্রহরীদের কাছেও রাত দশটার পাহারা দেবার কাজটা অন্যান্য দিনের কাজের মতন। টিলার উপরে, গার্ডরুমের বাইরে এই রাইফেলধারী প্রহরী নিঃশব্দে পায়চারি করছে। কোমরে সঙ্গিনের খাপ, বুকের উপরে আড়াআড়ি ভাবে কার্তুজের বেল্ট বাঁধা। গার্ডরুমে বাকি রাইফেলধারী পুলিশরা বিশ্রাম করছে। হঠাৎ টিলার সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নামল দু’জন মিলিটারি লোক। দশ-বারো ফুট উঁচু টিলাটা তাঁরা পাঁচ-ছয় সেকেন্ডের মধ্যে লাফিয়ে উঠে এল। প্রহরী তাঁদের সেলাম করার জন্য তৈরি হচ্ছে, হঠাৎ সামনের দুজন মিলিটারি গুলি করল সেপাইটিকে। সেপাইটি ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেল। তারপরেই পিস্তল চালাতে চালাতে তাঁরা আক্রমণ করল গার্ডরুম। একজন সেপাইয়ের গায়ে গুলি লাগল। গার্ডরুমের অন্যান্য সেপাইরা পাশে রাখা বন্দুক তুলে নেবার সময় পর্যন্ত পেল না – তাঁরা নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে যে যেদিকে পারল দৌঁড়ে পালিয়ে গেল।
সাত সেকেন্ডের মধ্যে গার্ডরুম দখল করে সেই মিলিটারি পোষাক পড়া লোকগুলো চিৎকার করে উঠল – ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ! সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক! বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক! বন্দেমাতরম!’ এই শ্লোগানের পরেই পুলিশ লাইনের আশেপাশের ঝোপঝাড় জঙ্গল থেকেও অনেক কণ্ঠের সমবেত স্বরে একই আওয়াজ উঠল। রাতে হঠাৎ আক্রমণ, পিস্তলের গুলি, প্রহরী নিহত, গার্ডরুমের দিকে গুলির শব্দ এবং চারিদিকে হৈ-হৈ স্লোগান শুনে ব্যারক থেকে পাঁচশো সেপাই নিজেদের জান বাঁচাতে যে যেদিকে পারল দৌঁড়ে পালিয়ে গেল। এত সাংঘাতিক কাণ্ড! সূর্য সেনের দল মিলিটারির ছদ্মবেশে পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে! প্রথম যে দুজন গাড়ি থেকে লাফিয়ে বের হয়ে এসে প্রহরীকে আক্রমণ করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন অনন্ত সিংহ আর গণেশ ঘোষ। ঠিক তাঁদের পিছন পিছন উঠে এসেছিলেন আরো চারজন – দেবপ্রসাদ গুপ্ত, হিমাংশু সেন, হরিপদ মহাজন আর সরোজ গুহ।
গার্ডরুম দখলের পরেই স্লোগানের সংকেত শুনে মাস্টারদা চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আরও সাতটা দল নিয়ে এসে পুলিশ লাইনে যোগ দিলেন। পাঁচ-ছয়জন মিলে শত্রুর গতিবিধি লক্ষ্য রাখতে টর্চ হাতে পাহারায় রইল। মাস্টারদা পড়ে রয়েছেন সাদা পোষাক। বাকিরা পরে রয়েছেন মিলিটারি বেশ। হয়ত সেই বিশেষ দিনটির কথা মনে রেখেই তিনি পড়েছিলেন, মালকোঁচা দিয়ে ইস্তিরি করা ধুতি, পরণে ধপধপে সাদা পাঞ্জাবি। এখন অস্ত্রাগারের দরজা ভাঙতে হবে, সবার হাতে তুলে দিতে হবে পুলিশের অস্ত্র। আর দেরি নয়। অস্ত্রাগারের দরজার তলার উপরে মস্ত বড় একটা হাতুড়ির ক্রমাগত ঘা পড়তে থাকল। শেষে একসময় ভেঙে গেল তালা। দরজা খুলতেই দেখা গেল, ঘরে থরে থরে সাজানো রয়েছে পুলিশের মাস্কেট্রি রাইফেল আর রিভলবার। পাশের ঘরে পাওয়া গেল কার্তুজ। চট্টগ্রামের বিপ্লবী দলটির অনেক দিনের পরিকল্পনা আজ সফল হল। পুলিশের অস্ত্রাগারের সব অস্ত্রের মালিক হয়ে গেল চট্টগ্রামের বীর বাঙালি ছেলের দল।
অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে ফেলার পরে আদেশ শোনা গেল – ‘কোম্পানি ফল ইন!’ আদেশ দিলেন গণেশ ঘোষ। দু’লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ল সবাই। দু’জন যুবক সবার হাতে তুলে দিতে থাকল মাস্কেট্রি বন্দুক আর রিভলবার। আরও চারজন তুলে দিল কার্তুজ। রিভলভার, বন্দুক আর টোটা দেবার পরে চট্টগ্রামের ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির জেনারেল গণেশ ঘোষ সবার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বন্দুক ব্যবহার করার পদ্ধতি ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন। তারপরে আবার আদেশ এল – ‘লোড’! সবাই নিজের বন্দুকে গুলি ভরল। এবারে আদেশ এল – ‘এল এম’! সবাই বন্দুক আকাশের দিকে তাক করল। শেষ আদেশ – ‘ফায়ার’! একসঙ্গে পঞ্চাশটি বন্দুক গর্জন করে উঠল। এইভাবে তিনবার চলল বন্দুকের গর্জন।
এবারে মাস্টারদা আদেশ করলেন, পুলিশ লাইনে উড়তে থাকা ব্রিটিশ পতাকা ইউনিয়ন জ্যাক পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আদেশের সঙ্গে সঙ্গে ছেলেরা টেনে নামলো পতাকা, আগুন ধরানো হল তাতে, পতাকা পুড়ে ছাই। এবারে মাস্টারদা আদেশ দিলেন জাতীয় পতাকা তোলার। চট্টগ্রামের পুলিশ অস্ত্রাগারের মাথায় উঠল জাতীয় পতাকা। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ইতিহাসে চিরকাল মনে রাখার মতন ঘটনা। জাতীয় পতাকার সম্মানে আবার তিন-তিনবার পঞ্চাশটা বন্দুক গর্জে উঠল। আবার সমবেত কণ্ঠে স্লোগান উঠল – ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ! সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক! বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক! বন্দেমাতরম!’
পুলিশ লাইন দখল করার পরে ওটাই হবে ভারতীয় প্রহতন্ত্রী বাহিনীর হেড কোয়ার্টার – এমনটাই ঠিক ছিল। অন্যান্য সবাইকে বলা হয়েছিল যাঁর যাঁর কাজ শেষ করে পুলিশ লাইনে চলে আসতে। ঠিক ছিল সেখান থেকেই পরিকল্পনা অনুযায়ী শহর দখল করার অভিযান চলবে। দখল করতে হবে ইম্পেরিয়াল ব্যাঙ্ক। জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হবে বন্দীদের। তারপরে দখল নিতে হবে বিচারশালার। আর যদি ইংরেজরা লড়তে আসে, ঐ বিচারশালা থেকেই লড়াই করতে হবে। লড়াই করে মরতে হবে।
কথামতন গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে নিজের দল নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পড়লেন অম্বিকা চক্রবর্তী। তুমুল জয়ধ্বনি করে সবাই অম্বিকা চক্রবর্তীর দলকে জড়িয়ে ধরল। মাস্টারদা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন – ‘টেলিফোন ভবন নিশ্চিহ্ন হয়েছে তো?’ অম্বিকা চক্রবর্তী জানালেন, বিনা রক্তপাতে টেলিফোন ভবন এতক্ষণে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। টেলিফোন ভবন আক্রমণকারী ছয়জনকেও বন্দুক আর গুলি দেওয়া হল, শিখিয়ে দেওয়া হল চালানোর কায়দা। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে গেলেন নরেশ রায় ও তাঁর পাঁচ সঙ্গী। তাঁরা গিয়েছিলেন ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করতে। কিন্তু গিয়ে দেখেছিলেন, সাহেব-মেমরা সকলে আটটা-নয়টার মধ্যে বাড়ি চলে গিয়েছেন। নরেশ রায় হতাশ, ব্রিটিশদের অত্যাচারের প্রতিশোধ তিনি নিতে পারলেন না। মাস্টারদা তাঁকে সান্তনা দিলেন, বললেন, হতাশ হবার কারণ নেই, চট্টগ্রাম শহর আমাদের দখলে, প্রতিশোধ আমরা নেবই। তিনি বুঝলেন খবর সংগ্রহ ঠিক মতন হয়নি, কারণ দিনটা ছিল গুড ফ্রাইডে, সাহেবদের আমোদ করার দিন। ওদিকে তখন অক্সিলারি ফোর্সের অস্ত্রাগারে চলছে ধুন্ধুমার কাণ্ড, নেতৃত্বে – লোকনাথ বল, নির্মল সেন ও আরও সাতজন। কথামতন অনন্ত সিংহ তিন সঙ্গীকে নিয়ে সেই দিকে চললেন।
চট্টগ্রামের পশ্চিমদিকে পাহাড়তলি যাবার বড় রাস্তার পাশে সমতল ভূমির উপরে অক্সিলারি ফোর্সের অস্ত্রাগার। এই মিলিটারি ঘাঁটির কাছেই কয়েকটা ছোটখাটো পাহাড়। পাহাড়ে বড় বড় সব সাহেবদের বাংলো। রেলের কোয়ার্টারও আছে। সাধারণ লোকের বাস এখান থেকে অনেক দূরে।
১৮ই এপ্রিল ১৯৩০ সালে রাত ঠিক দশটার সময় একটা ডজ-গাড়ি অস্ত্রাগার চত্বরে ঢুকল। মাখন ঘোষালের হাতে সেই গাড়ির স্টিয়ারিং। গাড়ির ভিতরে রয়েছেন আরও পাঁচজন – লোকনাথ বল, নির্মল সেন, রজত সেন, সুবোধ চৌধুরী ও ফণীন্দ্র নন্দী। গাড়ির পেছনে হেঁটে আসছিলেন আরও চারজন – শান্তি নাগ, নিতাই ঘোষ, ক্ষীরোদ ব্যানার্জি ও প্রভাস বল, তাঁরা অস্ত্রাগারের পূর্বদিকের কোণে, অধিকর্তা মেজর ফ্যারেলের আসা-যাওয়ার রাস্তার পাশে লুকিয়ে পড়লেন। অস্ত্রাগার চত্বরে ঢুকে, মাখন ঘোষাল গাড়িতে ব্রেক কষার সঙ্গে সঙ্গে একজন গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে দরজা খুলে বেশ কায়দা করে দাঁড়ালেন – যেন কোন বড় মিলিটারি অফিসার গাড়ি থেকে নামছেন। মিলিটারির খুব বড় সাহেবরা যেমন পোষাক পড়তেন, লোকনাথ বল ও নির্মল সেন সেদিন তেমনই পোষাক পড়েছিলেন। বাকিদের পরণে ছিল খাকি ফৌজি পোষাক। বারান্দার উপরে সন্ত্রী বেয়নেট লাগানো রাইফেল ঘাড়ে পাহারা দিচ্ছিল। লোকনাথ বল গাড়ি থেকে নেমে তাঁর দিকে এগিয়ে গেলেন। প্রায় ছয় ফুট উঁচু বারান্দার উপরে সন্ত্রী অস্ত্রাগারের দরজা আড়াল করে দাঁড়িয়েছিল। লোকনাথ বল ও সন্ত্রীর মধ্যে ব্যবধান ছিল মাত্র দশ-বারো ফুট। লোকনাথ বলের ডান হাতে ছিল রিভলভার – ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে রিভলবারটি পিছনে লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি। সন্ত্রী ভাবল মিলিটারির বড় সাহেব ক্যাপ্টেন টেট এসেছেন বোধহয়। তাই তাঁর পেছনে দুজন বডিগার্ডও আসছে। সন্ত্রীর চোখে চোখ রেখে লোকনাথ বল বারান্দার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকলেন – এক, দুই, তিন, চার …। সিঁড়ির শেষ ধাপে যখন লোকনাথ বল পা রেখেছেন, সন্ত্রী খটাশ করে জুতোর শব্দ করে এটেনশন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে সেলাম করল। বুটের শব্দ মিলিয়ে যাবার আগেই সন্ত্রীকে লক্ষ্য করে লোকনাথ বলের রিভলভার থেকে গুলি ছুটল। একই সাথে গুলি ছুঁড়ল তাঁর দুই বডিগার্ড – নির্মল সেন আর রজত সেন। সন্ত্রী খতম! গার্ডরুমের প্রহরীরা ভয় পেয়ে দৌঁড়ে পালালো। শুধু একজন প্রহরী বন্দুক তুলে নেবার জন্য দৌঁড়াচ্ছিল, গুলি খেয়ে সে মাটিতে পড়ে গেল। কয়েক মুহুর্তের মধ্যে মিলিটারি অস্ত্রাগার দখলে চলে এল। সবাই আনন্দে হৈ হৈ করে উঠলেন। স্লোগান উঠল – ‘বন্দেমাতরম! ইনকিলাব জিন্দাবাদ!’ ওদিকে রিভলভারের আওয়াজ, বন্দেমাতরম স্লোগান, সন্ত্রীর মরণ চিৎকার শুনে মেজর ফ্যারেল নিজের কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে এসে হাঁক পাড়লেন, কৌন হ্যায় তুম, ক্যায়া মাংতা? ফ্যারেল ভাবতেই পারেননি বিপ্লবীরা অস্ত্রাগার দখল করে নিয়েছে। বিপ্লবী জেনারেলের হুকুম শোনা গেল – চালাও গুলি! আদেশের সঙ্গে সঙ্গে গুলি ছুটল। মেজর ফ্যারেল লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। দু-তিন মিনিটের মধ্যে শত্রুপক্ষের দুজন মৃত আর একজন আহত হল।
প্রহরীদের কাছে যে চার-পাঁচটি রাইফেল ছিল তা ইতিমধ্যেই নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তখনও অস্ত্রাগারের দরজা ভাঙা বাকি। জাহাজ বাঁধার দড়ি সঙ্গে আনা হয়েছিল। অস্ত্রাগারের দরজার হাতলের সঙ্গে বাঁধা হল সেই দড়ি। দড়ির অন্যপ্রান্ত বাঁধা হল গাড়ির সঙ্গে। গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে একটু এগোতেই সেই বিশাল ভারী দরজা ফ্রেম সমেত একেবারে উপড়ে খুলে এল। ভেতরে আরও একটা দরজা – সেটা আবার ভেতর থেকে খোলে। লোকনাথ বল ডাকলেন রজত সেনকে। স্কুল-কলেজের ব্যায়ামের প্রদর্শনীতে লোকনাথ দু’হাতে দুখানা চলন্ত মোটর গাড়ি থামিয়ে, লোহার শিকল ছিঁড়ে সবাইকে অবাক করে দিতেন। রজত সেনও চট্টগ্রামের সদরঘাট ক্লাবের সভ্য ছিলেন। তাঁরও ব্যায়ামে খুব নামডাক ছিল। সেদিন দরকারের সময়ে তাঁরা দুজনেই ভেল্কি দেখিয়েছিলেন। দুজনে দৌঁড়ে এসে লোহার দরজার উপরে পড়তেই ঝনঝন শব্দ হল – পাল্লা ঠাস করে ছিটকে পড়ল পিছনের দেওয়ালে – দরজা খুলে গেল।
ভেতরে থরে থরে সাজানো সৈন্যদের রাইফেল। যতদূর চোখ যায় সব রাইফেলে ভর্তি – অন্তঃত চারশো হবে। এই রাইফেলের পাল্লা প্রায় এক হাজার ফুট – পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগারের বন্দুকের চেয়ে অনেক বেশি পাল্লা। এগুলোর এক একটাতে দশটা করে গুলি ধরে। রাইফেলের নীচে সারি সারি বাক্স। নিশ্চয়ই গুলিভর্তি। ঘরের অন্যদিকে সারি সারি পিস্তল আর রিভলভার। সাতটা মেশিনগানও আছে। বাক্স খুলে গুলি বের করতে গিয়ে দেখা গেল – ভেতরে গুলির বেল্ট আছে, আছে চামড়ার অন্যান্য সব সরঞ্জাম, কিন্তু একটাও গুলি নেই! বিপ্লবীরা লড়াইয়ের যে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল, সেটা এই প্রথম ধাক্কা খেল। সারা অস্ত্রাগারের কোথাও একটাও গুলি নেই!
ইতিমধ্যে অনন্ত সিংহ পৌঁছে গিয়েছিলেন অক্সিলারি ফোর্সের অস্ত্রাগারে। পৌঁছেই তিনি শুনলেন, প্রচুর অস্ত্র পাওয়া গেছে, কিন্তু একটাও গুলি পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি তো যায়নি! ঘাবড়ে গিয়ে তো কিছু লাভ হবেনা। এসব তাঁরা মাস্টারদাকে দেখেই শিখেছেন। ঠিক হল, সব কয়টা পিস্তল-রিভলভার, যে কয়টা সম্ভব সেই কয়টি রাইফেল আর দুটো মেশিনগান গাড়িতে তুলে নেওয়া হবে। বাকি সব অস্ত্র হাতুড়ি মেরে ভেঙে ফেলতে হবে। সেইমত কাজ চলতে থাকল। ফেলে যাওয়া রাইফেল আর মেশিনগানগুলিকে হাতুড়ির বাড়ি মেরে ভেঙে ফেলা হল – নিশ্চিত হওয়া গেল, শত্রুপক্ষও এগুলো আর ব্যবহার করতে পারবে না। এবারে অস্ত্রাগার জ্বালিয়ে দিতে হবে। পাঁচ-ছয়টা পেট্রোলের টিন খুলে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরানো হল। দেখতে দেখতে আগুন ধরে গেল পুরো অস্ত্রাগারে। অস্ত্রাগার থেকে একটু এগোতেই পথের মাঝে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ির সঙ্গে বিপ্লবীদের ছোটখাটো একটা লড়াই হল। ম্যাজিস্ট্রেট প্রাণ বাঁচাতে দৌঁড়ে লুকালেন রাস্তার ধারে। মারা পড়ল তাঁর দেহরক্ষী আর গাড়ির চালক। অস্ত্রাগার আক্রমণকারীদের সবাই গাড়িতে চেপে রওনা হলেন পুলিশ লাইনের দিকে, মাস্টারদার উদ্দেশ্যে।
পুলিশ লাইনের টিলার উপরে উঠতেই, মাস্টারদা এগিয়ে এসে সবার খবর জানতে চাইলেন। নির্মল সেন তাঁকে অক্সিলারি ফোর্সের অস্ত্রাগারের দখলের খবর জানালেন। বললেন লড়াইয়ের কথা। তারপরে খারাপ খবরটাও দিলেন – একটাও গুলি পাওয়া যায়নি। মাস্টারদা একটু চুপ করে গেলেন, বোধহয় মনে মনে যুক্তি দিয়ে নিজের অবস্থাটা বিচার করেছিলেন। ভুল যে একটা হয়েছিল, তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। সৈন্যবাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী রাইফেল আর গুলি কখনই এক জায়গায় রাখা হয়না। ঐ চারশো রাইফেল আর সাতটা মেশিনগান দিয়ে ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে সমানে পাল্লা দেওয়া যেত। শান্তি একটাই – ওগুলো বিপ্লবীরাও পায়নি আর ইংরেজরাও ওগুলো আর ব্যবহার করতে পারবে না। পুলিশ লাইনে সবাই জড়ো হয়ে যখন আনন্দ করছে – হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটল। পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার লক্ষ্য করে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে এল মেশিনগানের গুলি। সবাই তাড়াতাড়ি মাটিতে শুয়ে পড়ে বন্দুকে আঙ্গুল রাখল। বোঝা গেল, গুলি ছুটে আসছে দক্ষিণ-পূর্বের জল-কলের ছাদ থেকে। জল-কলের ছাদ লক্ষ্য করে বিপ্লবীদের ৬১টা বন্দুক গর্জন করে উঠল। সাথে উঠল স্লোগান – ‘বন্দেমাতরম! ইনকিলাব জিন্দাবাদ!’ চার-পাঁচ মিনিট পরেই শত্রুর মেশিনগানের গুলি ফুরিয়ে গেল। বিপ্লবীদের একজনের গায়েও গুলি লাগেনি। শত্রুরা রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে গেল।
চট্টগ্রামের ইংরেজদের মধ্যে ততক্ষণে ভালোভাবে বিদ্রোহের কথা রটে গিয়েছে। তাঁরা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে। বন্দরের জেটিতে ছিল একটা মালবাহী জাহাজ। ইংরেজরা সবাই কোন রকমে সেখানে গিয়ে উঠল। নোঙ্গর তুলে জাহাজটাকে নিয়ে যাওয়া হল পাড় থেকে বেশ জুড়ে। ঐ জাহাজ থেকেই কোন রকমে বেতারে খবর পাঠানো হল কলকাতায়। শেষে সারা ভারতে খবর ছড়িয়ে পড়ল – মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা ব্রিটিশ সরকারের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে চট্টগ্রাম।
(তথ্যসূত্র:
১- সূর্য সেন, অশোক কুমার মুখোপাধ্যায়, নালন্দা (২০০৮)।
২- সূর্য সেন, চট্টগ্রাম সশস্র বিপ্লব ও স্বাধীনতা সংগ্রাম, অমলেন্দু দে, প্রতিভাস।
৩- ভারতের স্বধীনতা সংগ্রাম, চট্টগ্রাম বিদ্রোহ ও বিপ্লবী মহানায়ক সূর্য সেন, শরীফ শমশির, অনিন্দ্য প্রকাশ।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত