‘এরা জানে না কোথায় গেলে মানুষের, সমাজের পারিশ্রমিকের মতন নির্দিষ্ট কোনো শ্রমের বিধান পাওয়া যাবে। জানে না কোথায় গেলে জল তেল খাদ্য পাওয়া যাবে/ অথবা কোথায় মুক্ত পরিচ্ছন্ন বাতাসের সিন্ধুতীর আছে।’ — জীবনানন্দ দাশ
বিগত ২১ দিন পাগলের মতো দেশের প্রায় ছয় লাখ পরিযায়ী শ্রমিক যা নয় তাই করছে। এ মাথা থেকে ও মাথা ছুটে যাচ্ছে। এক কাপড়ে বেরিয়ে আসছে বাস ধরতে, লাঠির ঘা খেয়ে কেঁদে ফেলছে বা লাঠিটা কেড়ে নিয়ে দু ঘা বসিয়ে জেলে যাচ্ছে।কখনো ২০০ কিলোমিটার হাঁটার পণ করে মাঝরাস্তায় অসুস্থ হয়ে মারা যাচ্ছে বা রাতের পর রাত হাইওয়ে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ট্রাকের তলায় পিশে যাচ্ছে।
কখনো ভয়ংকর মারামারি করেছেন পচা কলার খোসার স্তুপে আগে পৌঁছোবেন বলে? তন্নতন্ন করে খুঁজে আধখাওয়া কলা খাবেন বলে? কখনো এরকম মারামারিতে হেরে গিয়ে সবার শেষে পৌঁছে পচা কলার খোসা চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়েছেন? লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকের মতো জীবনযাপন করার সাহস দেখিয়েছেন কখনো? ওরা ঠিক এভাবেই দিন কাটাচ্ছে। কাজ নেই, শোবার জায়গা নেই, গ্রামে টাকা না পাঠানোর গ্লানি আর এক আকাশ রাগ নিয়ে ওরা আপনার চারপাশে ঘুরছে। আপনি বারুদের গন্ধ পাচ্ছেন না?
চারদিকে নর্দমার জল, মাছি ভন ভন করছে, খালের পাশে গামছা পেতে শ’য়ে শ’য়ে শ্রমিক শুয়ে। কোথায় সোশ্যাল ডিস্টানসিং? ওসব তো বিলাসিতা এই ভারতে যেখানে দুবেলা খাবার পেতে লড়তে হয়, কাজ পেতে লড়তে হয়, রাতে শোবার দু ফিট জায়গার জন্য লড়তে হয়। এ বড় কথা কঠিন সময়। পাল্টা মারলে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেওয়া হচ্ছে অশান্তিকারী বলে। ‘বড়লোকের গাড়ির টায়ার/ ফুটো করে লাগাও ফায়ার/ নজরটুকু রাখবে যেন/ আঁচটুকু না লাগে আয়ার’- র মতো কবিতা মারালে বলা হচ্ছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষরযন্ত্র করছে।
সব ইয়াদ রকখা জায়েগা। এই অপমানগুলো, এই অবহেলা গুলো, কৃষকের আত্মহত্যার মতো শ্রমিকের দুর্দশার দাস্তাঁ গুলো ভুলিয়ে দেওয়ার ফন্দিগুলো।
‘যতই তাকাও আড়ে আড়ে, হঠাৎ এসে ঢুকবে গাঁড়ে/ বাম্বু-ভিলার রেকটোকিলার গাঁটপাকানো বাঁশ/ আজ্ঞাবহ দাসবাবাজি আজ্ঞাবহ দাস’। কবির ভাষাতেই ফের সতর্ক করলাম। এই যে অশ্লীলতাটা হচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে, এই যে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবছেন আপনি তো সুরক্ষিত আপনার উঁচু ফ্ল্যাটবাড়িতে, মাথায় রাখবেন এই শ্রমিক, ওই কৃষকেরা একবার হুলুস্থুল শুরু করলে কিন্তু আপনার সাধের সাম্রাজ্যের গোটাটা উপরে খাবে নর্দমার পাশে শুচ্ছে যে নেংটো মজুরেরা।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত