তিনি ল্যাবরেটরিতে বারুদের আগুনে দগ্ধ হয়েছিলেন, ডিগরি পাহাড়ে বোমা বিস্ফোরণে মুমূর্ষু হয়েছিলেন, আলিপুর আদালত থেকে মৃত্যুদণ্ড পেয়েছিলেন, কলকাতা হাইকোর্ট থেকে দ্বীপান্তরের সাজা পেয়েছিলেন, আন্দামানের সেলুলার জেলে অত্যাচারে তাঁর সদা-উল্লাসিত মনের মৃত্যু হয়েছিল, ফাঁসির দড়ি এড়িয়ে প্রেমের ফাঁসে তাঁর মরণ হয়েছিল। দীর্ঘ জীবন বেঁচে থেকেও তিনি মৃত মানুষের মতন ছিলেন। তিনি ছিলেন দেশপ্রেমে পাগল, পত্নীপ্রেমে পাগল, অত্যাচারে পাগল, দুর্বার প্রাণশক্তিতে পাগল – প্রলয়-নাচন নাচা পাগলা ভোলার চ্যালা ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন অজস্র মৃত্যু পার হয়ে আসা এক আশ্চর্য মানুষ – অদ্ভুত ছিল তাঁর জীবন, অদ্ভুত ছিল তাঁর কাজকর্ম, অদ্ভুত ছিল তাঁর কথাবার্তা। তিনি উল্লাসকর দত্ত। ‘জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন’ উল্লাসকরের মৃত্যুর সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে হাস্য-পরিহাস, রঙ্গরসিকতার কাহিনী সর্বজনবিদিত। মৃত্যুকে তিনি বন্ধুর মতন হেসে বারবার অভ্যর্থনা করেছিলেন।
আলিপুর বোমা মামলার রায় বেরোনোর শেষ দিন। সারা দেশ নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ করে রায়ের প্রতীক্ষা করছে। বিপ্লবীদের বন্ধুবান্ধব-স্বজনদের রাতের ঘুম ঘুচে গিয়েছে। প্রশ্ন ঘুরছে বাতাসে, সকলের মনে – কি আছে বিপ্লবীদের ভাগ্যে? দ্বীপান্তর? ফাঁসি? কারাবাস? যাঁদের ভাগ্য সম্পর্কে সকলের অধীর আগ্রহ, তাঁরা কিন্তু নির্বিকার! আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সেদিন উল্লাসকর আরেকটি বিচার শুরু করেছিলেন এক সহ-বন্দীর সঙ্গে – কোর্ট ইন্সপেক্টরের ভুঁড়িটা কত ফুট আর কত ইঞ্চি আকৃতির, তার চুলচেরা বিচার! নিজের সম্বন্ধে বিচারকের রায়ের তোয়াক্কা না করে তিনি পুলিশের পেটের পরিধি সম্বন্ধে রায় দেন। তারপরে মামলার রায় বের হল। আইনের বিভিন্ন ধারার অপরাধ অনুসারে বিচারক উল্লাসকরকে সাত বছরের করাদণ্ড ও মৃত্যুদণ্ডের সাজা দিলেন। রায় শুনে হো হো করে হেসে উঠে উল্লাসকর সরকার পক্ষের ব্যারিস্টার নর্টন কে বলেছিলেন, ‘সাত বছরের জেল ফাঁকি দিলাম। নথিপত্তর ঘেঁটে অনেক আইনের ধারায় আমাকে বাঁধার চেষ্টায় ছিলে, সব পরিশ্রম পণ্ড হল। দুর্গা বলে ঝুলে পড়লে আর জেলে পুরবে কাকে?’ এমনই পরিহাসপ্রিয় ছিলেন উল্লাসকর।
মৃত্যুদণ্ডের সাজার বিরুদ্ধে ব্যারিস্টার ‘দেশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন দাস হাইকোর্টে আপিল করেন। আপিলের রায় যেদিন বের হয় সেদিন উল্লাসকর আদালত মুখরিত করে তুলেছিলেন গানে – ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’। হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির এজলাসে গান গাওয়া যে রীতিমতো ঔদ্ধত্য, আদালত অবমাননা – একথা সেদিন কারও মনে আসে নি। ইংরেজ জজ-ব্যারিস্টাররাও সেদিন শ্রদ্ধাভরে উল্লাসকরের গান শুনেছিলেন। গান শুনে ব্যারিস্টার দেশবন্ধুর চোখে ছিল জল।
শিবপুর থেকে শিলচর – তাঁর বিপ্লবী জীবনের শুরু ও শেষ। এই প্রাণোচ্ছল পাগল প্রেমিক পুরুষ বহু দীর্ঘপথ অতিক্রম করেছেন। তাঁর প্রতিটা পদক্ষেপ ছিল আশ্চর্যকর, অদ্ভুত। সেই যুগের রূপকথার রোম্যান্টিক নায়ক ছিলেন তিনি – অত্যাচারী দৈত্যের সঙ্গে আধুনিক অস্ত্র নিয়ে তিনি লড়াই করেছিলেন, পাষাণপুরীতে বন্দী হয়ে দিন কাটিয়েছিলেন, যৌবন-স্বপ্নের রাজকন্যাকে বৈধব্যের বন্দীত্ব থেকে উদ্ধার করে বিবাহ করেছিলেন, পঙ্গু প্রিয়াকে নবজীবনের সঞ্জীবনী সিঞ্চনের আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন আর শেষে, রাজ্যহারা রাজকুমারের মতন দূরদেশের বিজন কুটিরে চিরনিদ্রায় মগ্ন হয়েছিলেন।
উল্লাসকর যৌবনে বাস করতেন শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের কাছে। পিতা দ্বিজদাস দত্ত ছিলেন শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক। উল্লাসকর পড়তেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র আর উল্লাসকরের ছাত্রজীবনে একই ধরনের একটি ঘটনা ঘটে। সুভাষচন্দ্র সেই কলেজ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন প্রফেসর ওটেনকে প্রচারের অভিযোগে। উল্লাসকরও ওই একই ধরণের অপরাধের অভিযোগে কলেজ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। বঙ্গভঙ্গের ফলে তখন দেশে স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ার এসেছিল। সেই সময় ইংরেজ অধ্যাপক রেটেল বাঙালি ছাত্রদের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেন। উল্লাসকর গুরু-মারা শিষ্য হন। কয়েকজন সহপাঠীকে সঙ্গে নিয়ে রেটেলকে উত্তম-মধ্যম দিয়ে তাঁর অধম আচরণ ও বক্তব্যের জন্য উচিত শিক্ষা দেন। তারপরে বন্দেমাতরম ধ্বনি দিতে দিতে উত্তেজিত ছাত্রদলের সঙ্গে কলেজ ত্যাগ করেন। সরকারি গোলাম তৈরির কারখানায় উল্লাসকর আর কোনদিন ফিরে যাননি। এরপরে একদিন প্রেসিডেন্সি কলেজের গায়ে একটা বড় পোস্টার দেখা গিয়েছিল, ‘House to let … Apply to Lord Curzon’ – সকলেই সন্দেহ করেছিলেন, প্রেসিডেন্সি কলেজ ভাড়া দেবার এই বিজ্ঞপ্তি পরিহাসপ্রিয় উল্লাসকরেরই কীর্তি ছিল।
এরপরে বিপ্লবীদলের সংস্পর্শে এসে তিনি শিবপুরের বাড়িতে গোপনে একটা ল্যাবরেটরি তৈরি করে বোমা নির্মাণ শুরু করেন। তাঁর পরীক্ষাগারে তিনি নাইট্রো-গ্লিসারিন ও ফ্যালমিনেট অব মার্কারি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। জেলিগনাইট ও পিক্রিক এসিডের বোমা তৈরি করে তিনি সহযোদ্ধাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তাঁরই তৈরি বোমা চন্দননগরের মেয়র তার্ডিডেলের বাড়িতে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। তাঁর নিজের হাতে তৈরি করা মাইন, নারায়ণগড়ে ছোটলাট স্যার এন্ড্রু ফ্রেজারের স্পেশাল ট্রেন ওড়াবার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। তিনি এমন শক্তিশালী পাবকাসন পাউডার তৈরি করেছিলেন, যা বাতাসের সঙ্গে সামান্য সংঘর্ষে বিস্ফোরিত হত, সামান্য ফুঁ দিলে জ্বলে উঠত। জিসিডির ডিগরি পাহাড়ে তাঁরই তৈরি বোমা পরীক্ষার সময়ে বিপ্লবী প্রফুল্ল চক্রবর্তীর দেহ বিস্ফোরণে খণ্ড খণ্ড হয়ে যায়। উল্লাসকর নিজেও মারাত্মক আহত হন। মুমূর্ষু অবস্থায় তাঁকে গোপনে জিসিডি থেকে কলকাতায় এনে ডাক্তার সুন্দরীমোহন দাসের দ্বারা চিকিৎসা করানো হয়েছিল। মৃত্যুরমুখ থেকে তিনি সেবারে ফিরে আসেন।
এরপরে বিপ্লবীরা প্রস্তাব করেন, হেমচন্দ্র দাসের মতন তাঁকেও বিদেশে পাঠানো হোক, বিস্ফোরক প্রস্তুত প্রণালী শিক্ষার জন্য। কিন্তু উল্লাসকর আপত্তি জানান। তিনি জানান যে তিনি দেশে থেকেই নিজেকে আরও প্রস্তুত করে নিতে চান। বিপ্লবীদলের কয়েকজনের ধারণা হয়েছিল যে, দেশপ্রেম ও নারীপ্রেমের দোটানার মাঝে পড়েই তিনি বিদেশে যেতে দ্বিধা করছেন। সেই সময় বিপিনচন্দ্র পালের কন্যার সাথে তাঁর বিবাহ আসন্ন। অভিভাবকরা সেই বিবাহ স্থির করেছিলেন এবং পাত্র-পাত্রী উভয়ের পরিচিত ছিলেন। উল্লাসকর ও লীলাদেবীর মধ্যে তখন চলছিল পূর্বরাগের পালা। তখন উল্লাসকরের জীবনের পথ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে দু’দিকে চলে গিয়েছে। একদিকে হত্যা-বোমা-বিপ্লব-মৃত্যু। অন্যদিকে সংসার-সঙ্গিনী-সঙ্গীত-শান্তি। ঘর ছাড়বেন না ঘর বাঁধবেন? দেশপ্রেম না পত্নীপ্রেম? আরেক ভাবুক শিল্পী বিপ্লবী হেমচন্দ্র সম্ভবতঃ উল্লাসকরের এই মানসিক দ্বন্দ্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। উল্লাসকরের প্রতি সহানুভূতি ভরা মনে তিনি বলেছিলেন, ‘এমন সরল স্বভাবের যুবককে বিপ্লবীদলে গ্রহণ করা নিষ্ঠুরতার কাজ হয়েছে’।
উল্লাসকর বলতেন, প্রকৃত বিপ্লবী হতে গেলে মৃত্যুভয় জয় করতে হবে এবং সাধন-ভজন না করলে দেহের নশ্বরতা ও আত্মার অবিনশ্বরতা উপলব্ধি করা যায় না। সাধন-ভজন করার যে কথা তিনি বলেছিলেন, জীবনে সেটা সত্যিই করেছিলেন। ব্রাহ্ম হয়েও তিনি অন্যান্য বিপ্লবীদের সাথে মূর্তিপূজা করেছিলেন, গৈরিক ধারণ করেছিলেন। নিরামিষ ভোজন করতেন। নিজেকে তিনি সর্বতোভাবে বৈপ্লবিক কাজের উপযুক্ত করেছিলেন। মুরারীপুকুরের কেন্দ্রে পুলিশ যখন হানা দেয়, সকলকে গ্রেপ্তার করতে শুরু করে, তখন তিনি অনেকগুলো বোমা নিয়ে হ্যারিসন রোডের ‘স্বাস্থ্য সহায় ঔষধালয়ে’ কবিরাজ ভাতৃদ্বয়ের কাছে রেখে আসেন। পুলিশ উল্লাসকরের কার্যকলাপ সম্বন্ধে অবগত হয়। বিচারে তিনি নির্বাসন দণ্ড লাভ করেন। তখনকার বিপ্লবীরা রাজবন্দীর মর্যাদা পেতেন না, সাধারণ চোর-খুনি-ডাকাতদের মতই তাঁদের সঙ্গে ব্যবহার করা হত। আন্দামানের জেলে তাঁর উপরে অমানুষিক অত্যাচার চলে। দৈহিক নির্যাতনের ফলে তাঁর মস্তিষ্কের বিকৃতি দেখা দেয়। নির্বাসনের মেয়াদ শেষে অন্যান্যদের সঙ্গে তাঁকেও দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। অন্য বিপ্লবীরা মুক্তি পেলেও সরকার তাঁকে সহজে ছাড়তে চায়নি। সেই সাত বছর জেল খাটাবার চেষ্টা করে। শেষে স্যার সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় তিনি মুক্তি পান। এরপরে কিছুকাল তিনি কুমিল্লায় অন্তরীণ থাকেন। ইতিমধ্যে তাঁর মনোনীত পাত্রী পাঞ্জাবের এক যুবককে বিবাহ করে ঘর-সংসার পেতেছিলেন। নির্বাসন দণ্ড কাটিয়ে উল্লাসকর যখন ফিরলেন, তখন লীলাদেবী বিধবা। উল্লাসকর কিন্তু ভুলতে পারেননি তাঁর প্রথম যৌবনের প্রিয়াকে, ভুলতে পারেননি যে তাঁরা একদিন পরস্পরকে ভালোবেসেছিলেন, ভুলতে পারেননি যে তাঁর নির্বাসন দণ্ডের কথা জানতে পেরে লীলাদেবী জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন। যদিও তারপরে গঙ্গা দিয়ে বহু জল বয়ে গিয়েছে। ধাবমান কাল উল্লাসকরকেও নিজের জালে জড়িয়ে পরিবর্তনের স্রোতে ভাসিয়ে দিলেও তিনি নিশ্চয়ই মনে মনে বলেছিলেন, ‘আমার প্রেম, তারে আমি রাখিয়া এলেম অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশ্যে …’। তাই তিনি সেই মানসীকে আবার বিবাহের প্রস্তাব দেন। কিন্তু পরাধীন দেশে প্রেম যে চির-অভিশপ্ত। দু’জনের মধ্যে প্রথমে ব্যবধান রচেছিল স্বাধীনতার সংগ্রাম, এরপরে বাধা হয়ে দাঁড়াল সামাজিক প্রথা। সেদিন ছিল দ্বীপান্তর, পরে হল বৈধব্যের অভিশাপ। ব্যর্থপ্রেমিক উল্লাসকর, উন্মাদ উল্লাসকর।
দ্বিপান্তর থেকে দেশে ফিরেও উল্লাসকর নতুন করে ঘর বাঁধতে পারলেন না। এদিকে যাঁর জন্য ঘর ছেড়েছিলেন, তাঁকেও পাশে পেলেন না, কারণ অরবিন্দ তখন চলে গেছেন পণ্ডিচারীতে। উল্লাসকর কলকাতা থেকে সাইকেল চালিয়ে উপস্থিত হলেন সেখানে, লক্ষ্য অরবিন্দকে আবার সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। আশ্রমে উপস্থিত হয়ে অরবিন্দের সাথে সাক্ষাৎ করার যে বিধিনিষেধ ছিল তার কোনটাই তিনি মানলেন না। সকলের আপত্তি অগ্রাহ্য করে প্রশ্ন তুললেন, অরবিন্দ কেন সেখানে থাকবেন? সবকিছু এড়িয়ে, সবাইকে এড়িয়ে সটান হাজির হলেন অরবিন্দের সামনে। তারপরেই করলেন এক আশ্চর্য আচরণ। যে লোক যুক্তি-তর্কের জালে জড়িয়ে অরবিন্দকে বাংলায় টেনে আনবেন বলে মনস্থির করে গিয়েছিলেন, তিনি অরবিন্দের মুখোমুখি হয়ে কোন কথা না বলে ফিরে চলে এলেন। উল্লাসকর এবারে ঘরের হলেন, না পরের। সংসারেও নয়, সংগ্রামেও নয়। তিনি হয়ে গেলেন ছন্নছাড়া বাজপড়া তালগাছের মতন। উল্লাসকর তাই উন্মাদ না হয়ে আর কি হবেন?
এরপরে অত্যন্ত দুঃখের জীবন শুরু হল তাঁর। সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের সিঁড়ির নীচে মাথা গোঁজার একটু জায়গা পেয়েছিলেন। কখনও খাবার জুটত, কখনও জুটত না। মরার খাটিয়ায় শুয়ে রাত কাটাতেন, টিনের কৌটায় জল খেতেন। তাঁর জীবন নদী যখন প্রায় শুকিয়ে উঠেছে, তখন বিধাতা তাতে সামান্য করুণাধারা ঢাললেন অমঙ্গলের মধ্য দিয়ে। লীলাদেবী বাতে পঙ্গু হয়ে শয্যাশায়ী হলেন, তাঁর সেবা করার সুযোগ পেলেন উল্লাসকর। দুটো নিঃসহায়, নিঃসম্বল, নিঃসঙ্গ জীবন বহুদিন পরে আবার কাছাকাছি এল। যৌবনে যাঁদের মিলন হয়নি, প্রৌঢ়ত্বের শেষপ্রান্তে প্রজাপতি তাঁদের মিলিয়ে দিলেন। ব্রাহ্মসমাজে উল্লাসকর ও লীলাদেবীর বিবাহ হল। উল্লাসকরের কাছে এই বিয়ের অর্থ ছিল সেবা। যেভাবে তিনি অসুস্থ স্ত্রীর সেবা করেছিলেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। কবিতায়-উপন্যাসে, কল্পজগতে প্রেমিকার জন্য প্রেমিকের যে ত্যাগ-দুঃখবরণের বর্ণনা পাওয়া যায়, তাকে বাস্তব জীবনে উল্লাসকর হার মনিয়েছিলেন। যেখানে যা কিছু সামান্য সাহায্য বা সামগ্রী – এমনকি দু-একটি ফলমূল পেলেই নিজের রুগ্ন স্ত্রীকে তা দিয়ে আসতেন। এরজন্য কতদিন যে তাঁকে পায়ে হেঁটে, কর্নওয়ালিশ স্ট্রীটের ব্রাহ্মসমাজ থেকে ভবানীপুরের হাসপাতালে যেতে হয়েছিল, তার ঠিক নেই। অনেকেই এটাকে ‘পাগলের কাণ্ড’ বলে উপহাস করেছিলেন। কিন্তু এটা কোন পাগলামি ছিল না, ছিল নিঃস্বার্থ প্রেম। হাসপাতাল লীলাদেবীর আরোগ্যের কোন সম্ভাবনা না দেখে তাঁকে ডিসচার্জ করে দেয়। তারপরে পঙ্গু স্ত্রীকে নিয়ে উল্লাসকর অকুল সংসার-সমুদ্রে ভাসলেন। এতদিন ব্রাহ্মসমাজে কোন রকমে দিন কাটাতেন, কিন্তু দুজনের সেখানে স্থান হল না। উপাসনার স্থানে যে সংসার পাতা চলে না। স্রোতের শ্যাওলার মতন এখানে-ওখানে ভেসে বেড়িয়ে কোথাও স্থায়ীভাবে জায়গা না পেয়ে শেষে তাঁরা শ্রীহট্টে চলে যান। কয়েকজন বন্ধু চেষ্টা করেছিলেন যাতে তিনি সরকারি সাহায্য পান। কিন্তু উল্লাসকর তখন জীবন্মৃত হলেও সম্পূর্ণ মৃত ছিলেন না। স্বাধীনচেতা উল্লাসকর সমস্ত সরকারি সাহায্যের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি কঠোরভাবে বলেছিলেন, ‘এমনকি আমার স্ত্রীও সাহায্য নিলে তাঁকে আমি ডিভোর্স দেব’। শেষে উল্লাসকরের অজ্ঞাতে বারীন্দ্র রায়চৌধুরী ও ডা. নীলোদকুমার রায়চৌধুরী সরকারি সাহায্যের ব্যবস্থা করেন। তাঁরা সই করে, অর্থ আগমনের উৎস গ্রহণ করে তাঁকে টাকা দিতেন। শেষে একদিন চিরবিদায় নিলেন লীলাদেবী। স্ত্রীর মৃত্যুর পরেও উল্লাসকর বিশ্বাস করতে চাননি যে তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে। তাঁর বিশ্বাস ছিল, তাঁর স্ত্রী অন্য কোথাও গিয়েছেন, আবার ফিরে আসবেন। নিজের ঘরের দরজা সেই আশায় কখনো বন্ধ করতেন না তিনি। রোজই নিজের খাবারের ভাগ স্ত্রীর জন্য রেখে দিতেন। শেষে এল সেই দিন। জীবনের চরম মুহূর্তেও উল্লাসকরের উল্লাসভরা কন্ঠ থেকে নির্ঝরিত স্রোতে জীবনের সর্বোত্তম বাণী ঝরে পড়ত। বিধাতা তাঁর রক্তে রুদ্রবীণা বাজাতেন। মৃত্যুর সঙ্গে করমর্দন করা মানুষ যেদিন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন, সেদিনও তাঁর শয্যার পাশে ভিড় করা শোকাচ্ছন্ন শুভানুধ্যায়ীদের বলেছিলেন, “তোমরা ভিড় করছ কেন? আমার কি হয়েছে? আমাকে ঘুমোতে দাও।” – রণক্লান্ত বিদ্রোহীর কাছে মৃত্যু মানে যে বিশ্রাম।
আমরা জানি না, নিজের স্ত্রীর জন্য উল্লাসকর যেগুলো করেছিলেন, সেগুলো মোহ না প্রেম। আমাদের জানা নেই, তিনি দেশকে বেশি ভালোবেসেছিলেন নাকি নিজের স্ত্রীকে। তবে এটা আমারা সকলেই জানি, শত্রুকে ঘৃণা না করলে সৈনিক হওয়া যায় না আর মানুষকে ভালো না বাসলে বিপ্লবী হওয়া যায় না। বুকভরা ভালোবাসা নিয়েই উল্লাসকর বিপ্লবের পথে এসেছিলেন। তাই তিনি আদর্শ বিপ্লবী। তীক্ষ্ণ মেধা, দুরন্ত সাহস, নিবিড় প্রেম, গভীর রসজ্ঞান এই সবের অপূর্ব মিলন হয়েছিল ভাঙা বাংলার রাঙা যুগের এই বিপ্লবীর মধ্যে।
(তথ্যসূত্র:
১- অগ্নিযুগ, শৈলেশ দে।
২- Bengali people: Indian independence movement, Bhavabhushan Mitra, Alphascript Publishing (২০১০)।
৩- মুক্তির মন্দির সোপান তোলে, দীপক কুমার রায় ও অরুণা চৌধুরী।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত