সাংঘাতিক কাণ্ড! চট্টগ্রাম শহরের অল্পবয়সী কিছু ছেলে এক মাস্টারদার বুদ্ধিমতন ইংরেজ পুলিশের সাথে লড়ে তাঁদের গোলাবারুদের ভাণ্ডারটিকে দখল করে নিয়েছে। আগুন লাগিয়ে দিয়েছে সেই অস্ত্রাগারে। আগুন লাগিয়েছে টেলিফোন আর টেলিগ্রাফের অফিসেও। ট্রেনে করে যে শহরে আসবে সেই উপায়ও নেই। দুই জায়গায় রেল লাইন ভেঙে ফেলেছে তাঁরা। সেখানে মালগাড়ি উল্টে ট্রেন চলাচল বন্ধ। চট্টগ্রাম ইংরেজ শাসন থেকে মুক্ত, এমন এক ঘোষণা করেছে সেই ছেলের দল। তাঁরা পুড়িয়ে দিয়েছে ইংরেজ পুলিশঘাঁটিতে উড়তে থাকা ব্রিটিশ পতাকা ইউনিয়ন জ্যাক। সেখানে উড়ছে স্বাধীন ভারতের পতাকা। এক সাহেব, ‘ভারতীয় কুত্তা’ এইসব গালাগালি দিতে দিতে লড়তে এসেছিল, তাঁকে উচিত শিক্ষা দিয়েছে ছেলের দল। এরপরে, ছেলেদের লক্ষ্য করে পুলিশ আড়াল থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি চালিয়েছে। জবাবে পাল্টা গুলি ছুঁড়েছে ছেলেরা। পুলিশ পালিয়েছে। শহরের সাহেব-মেমরা ভয়ে শহর ছেড়ে পালিয়েছে। তাঁরা আশ্রয় নিয়েছে সমুদ্রে ভেসে থাকা এক জাহাজে। ভারত শাসন করতে এসে এমন মার ইংরেজরা বোধহয় আগে কমই খেয়েছে। তাঁরা মনের সুখে রাজ্যপাট চালিয়েছে এতদিন। ভারতবাসী দিনের পর দিন খেটে গেছে আর সেই খাটুনির ফল ভোগ করেছে সাদা চামড়ার ইংরেজ। প্রতিবাদ করতে গেলেই এদেশের মানুষের কপালে জুটেছে অত্যাচার। জেলবন্দি করে বেদম মেরেছে ইংরেজ পুলিশ। শ’য়ে শ’য়ে নিরীহ সাধারণ মানুষ মারা গিয়েছে ইংরেজ পুলিশের গুলিতে। তাছাড়া স্কুল-কলেজ, অফিস-কাছারি এমনকি রাস্তায় ঘোরা ফেরার মধ্যেও ইংরেজরা এদেশের মানুষকে দম্ভভরে বোঝাতে চেয়েছে, তাঁরা নাকি জাতি হিসেবে ভারতবাসীর থেকে অনেক উন্নত আর সভ্য! তাঁরা নাকি বীরের জাত! এদেশে রাজত্ব করতে এসে তাঁদের স্পর্ধা একেবারে আকাশ ছুঁয়েছে। কোন কোন প্রতিষ্ঠানে সাদা চামড়ার লোক ছাড়া অন্য কারও প্রবেশাধিকার নেই। রেস্তোরাঁর গায়ে নোটিশ ঝুলছে – ‘কালো চামড়ার লোক ও কুকুরের প্রবেশ নিষেধ’!
এমন অন্যায় বেশিদিন চলে না। প্রতিবাদ হবেই। প্রতিরোধ গড়ে উঠবেই। বিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী, প্রত্যেক ক্রিয়ার একটা বিপরীত ক্রিয়া হয় – অর্থাৎ যেকোন কাজের, বিশেষত সেই কাজ যদি অন্যায় হয় একটা পাল্টা ধাক্কা আসবেই। ইংরেজদের অন্যায় অবিচারের প্রতিক্রিয়া হিসেবে মানুষের মনে ক্ষোভ জমেছে, প্রতিবাদ শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন। প্রতিবাদের ধরণ মোটামুটি দু’রকম। একদল ইংরেজ-রাজত্বের মধ্যে থেকেই আবেদন অনুরোধ জানিয়ে, দয়া-ভিক্ষা করে ইংরেজ-শাসনের কিছু অন্যায়কে বন্ধ করতে চেয়েছেন। অন্যদলের উদ্দেশ্য, বন্দুক হাতে লড়াই করে দেশ থেকে ইংরেজ তাড়ানো। তাঁদের মনে হয়, এভাবেই স্বাধীন ভারতবাসীর স্বাধীন দেশ গড়ে উঠবে। নিজের হাতে নিজের ভাগ্য গড়ার ক্ষমতা তখনই এদেশের মানুষের আয়ত্বে আসবে। তাঁরা চেয়েছেন মারের বদলে পাল্টা মার দিতে। অত্যাচারী ইংরেজকে পাল্টা অত্যাচার করে ভয় দেখাতে। চট্টগ্রামের ছেলের দল রূপকথার রাজপুত্রদের মতন লড়াই করে দেশ থেকে দানব তাড়াতে চেয়েছে। তাঁদের মনে হয়েছে ভারতের একটা জায়গায় যুদ্ধ করে যদি ইংরেজ তাড়ানো যায়, সারা দেশ তাহলে জেগে উঠবে। অন্যান্য সবার মনে হবে তাহলে তো আমরাও এমনভাবে লড়াই করে ইংরেজদের অত্যাচার বন্ধ করতে পারি, তাঁদের তাড়াতে পারি। দেশ আমাদের মা। সেই মা’কে ইংরেজ দানবের কবল থেকে মুক্ত করতে পারি।
সেই ছেলেদের দলকে দেশের কথা বলে, খেলাধুলো, বন্দুক চালানো শিখিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়ার উপযুক্ত যিনি করে তুলেছেন, সেই গণিতের শিক্ষককে সকলে মাস্টারদা বলে ডাকে। আর ছেলেদের লড়াই করবার ফৌজটির নাম ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’ অর্থাৎ ‘ভারতীয় প্রজাতন্ত্রী বাহিনী’। চট্টগ্রামের পুলিশ ঘাঁটি দখল করে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির ছেলেরা আকাশ তাক করে গুড়ুম গুড়ুম করে গুলি ছুঁড়ে বিজয় ঘোষণা করেছে। জয়ের আনন্দে তাঁরা টগবগ করে ফুটছে। বলে উঠছে বন্দেমাতরম, ইনকিলাব জিন্দাবাদ, মাস্টারদা জিন্দাবাদ। কে এই মাস্টারদা, যাঁর কথায় ছেলের দল ইংরেজদের বিরুদ্ধে মরণপর লড়তে পারে? চট্টগ্রামের মানুষ জানতেন, এই রোগা, সাধারণ চেহারার, ধুতি পড়া মানুষটির নাম সূর্য সেন।
গবেষক ও লেখক শ্রী শৈলেশ দে’র ব্যক্তিগত উদ্যোগে ১৯৬৯ সালের এক শনিবারে কলকাতার লেক গার্ডেন্সের এক বাড়িতে কয়েকজন পদস্থ ব্যক্তির সহযোগিতায় সেখানে এনে হাজির করা হয়েছিল ফাঁসুড়ে শিবলাল ডোমকে। শিবলাল ডোমের বাড়ি ছিল মজঃফরপুর জেলার বেরিচাপরা গ্রামে। তার মামা বাঁকা ডোমের কাছে সে শিখেছিল ফাঁসি-দেওয়ার পদ্ধতি। শিবুর ছেলে নাটা মল্লিক তো ধনঞ্জয় চ্যাটার্জিকে ফাঁসি দিয়ে মিডিয়ার দৌলতে একসময় রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। মাস্টারদা এবং তারকেশ্বর দস্তিদার-সহ বহু বিপ্লবীর ফাঁসির কারিগর ছিল শিবুডোম। একজন মুন্সেফের উপস্থিতিতে টেপ রেকর্ড চালিয়ে শিবুডোমের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল শৈলেশ দে’র সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে।
বিশ্বের ইতিহাসে কেউ কোনওদিন জেলকোড লঙ্ঘন করে রাতদুপুরে ফাঁসি দেওয়ার প্রহসন ঘটানোর কথা শুনেছে কি? বরাবর ফাঁসি দেওয়া হয় ভোররাত্রে। তাজ্জব কাণ্ড! সেদিন ওখানে ফাঁসি দেওয়া হলে রাতদুপুরে। শিবুডোম সেদিন সবকিছু দেখেছিল, কারণ সেদিন হ্যান্ডেলে হ্যাঁচকা টান মেরে ছিল শিবুডোমই। একই দিনে, একই সঙ্গে, একই ফাঁসির মঞ্চে প্রাণহীন যে দুটি মৃতদেহ ঝুলে ছিল, তাঁরা হলেন মাস্টারদা সূর্য সেন ও সহকারী নেতা তারকেশ্বর দস্তিদার। আইনে আছে গলায় দড়ি পরাবার আগে হাত দুটো পিছমোড়া করে বেঁধে দিতে হবে। কিন্তু ইংরেজ সরকারের কোনও আইন মাস্টারদা এবং তারকেশ্বর দস্তিদার মানেন না। তাই তাঁরা হাত বাঁধতেও দেবেন না। সাহেবদের হুকুমে গোর্খা সৈন্যরা তাঁদের দুজনকে মারতে লাগল, কিন্তু তাঁদের হাত বাঁধতে পারল না। তাঁদের মুখে শুধু-বন্দে মাতরম্। সারা রাত ধরে গোটা জেলখানার বন্দি স্বদেশিরা গেয়েছিল— বন্দে মাতরম্। কনডেমড রুমে নিয়ে গিয়ে চলেছিল পাশবিক অত্যাচার, দাঁত ভেঙে, চোখ উপড়ে দুই মৃতদেহকে আনা হয়েছিল আবার সেই ফাঁসির মঞ্চে। বেহুঁশ দুই দেহের হাত বেঁধে, কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে, দড়ির ফাঁস পরিয়ে, হাতল ধরে জোর হ্যাঁচকা টান—ব্যস, শরীর দুটো অদৃশ্য হয়ে নীচে চলে গেল। এরপর এক প্রহসন থেকে আর এক প্রহসনে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। সেদিনের ব্রিটিশ সরকার। গোপনে ব্রিটিশ রণতরী এইচ এম এস এফিংগামে চাপিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়ে গিয়ে সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের শবদেহ দু’টির বুকে পাথর চাপিয়ে ডুবিয়ে দিয়েছিল। বঙ্গোপসাগরের জলে…।
১২ই জানুয়ারি ১৯৩৪ মাস্টারদা সূর্য সেন এবং তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি হয়েছিল। লোকচক্ষুর অন্তরালে কোর্ট বসিয়ে অতি সাবধানে বিচারের প্রহসন শেষ করা হয়েছিল। ভারতীয় দণ্ডবিধি আইনের ১২১নং ধারায় তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হলো, তা কোনও মামুলি খুনের নয়, অভিযোগ আরও গুরুতর; বলা হলো — “Waging, or attempting to wage war, of abetting waging of war, against the government of India.” — আর অভিযুক্ত দু’জনের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এবং কল্পনা দত্ত-র বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রইল। দুই মৃতদেহকে ফাঁসির মঞ্চে এনে ঘটানো হলো ফাঁসির প্রহসন মূলক নাটক।
১৯৩৪ সালের ১২ই জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলে ফাঁসির ৫ ঘন্টা পূর্বে সন্ধ্যা ৭ টায় এ লেখা, শেষ চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন –
‘‘আমার শেষ বাণী- আদর্শ ও একতা। ফাঁসির রজ্জু আমার মাথার উপর ঝুলছে। মৃত্যু আমার দরজায় করাঘাত করছে। মন আমার অসীমের পানে ছুটে চলছে। এই তো সাধনার সময়। বন্ধুরূপে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার এই তো সময়। ফেলে আসা দিনগুলোকে স্মরণ করার এইতো সময়।
কত মধুর তোমাদের সকলের স্মৃতি। তোমরা আমরা ভাই-বোনেরা তোমাদের মধুর স্মৃতি বৈচিত্রহীন আমার এই জীবনের একঘেঁয়েমিকে ভেঙ্গে দেয়। উৎসাহ দেয় আমাকে। এই সুন্দর পরম মুহূর্তে আমি তোমাদের জন্য দিয়ে গেলাম স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। আমার জীবনের এক শুভ মুহূর্তে এই স্বপ্ন আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। জীবনভর উৎসাহভরে ও অক্লান্তভাবে পাগলের মতো সেই স্বপ্নের পেছনে আমি ছুটেছি। জানি না কোথায় আজ আমাকে থেমে যেতে হচ্ছে। লক্ষে পৌঁছানোর আগে মৃত্যুর হিমশীতল হাত আমার মতো তোমাদের স্পর্শ করলে তোমরাও তোমাদের অনুগামীদের হাতে এই ভার তুলে দেবে, আজ যেমন আমি তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছি। আমার বন্ধুরা-এগিয়ে চল, এগিয়ে চল- কখনো পিছিয়ে যেও না। পরাধীনতার অন্ধকার দূরে সরে যাচ্ছে। ওই দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার নরারুণ। কখনো হতাশ হয়ো না। সাফল্য আমাদের হবেই। ভগবান তোমাদের আশীবার্দ করুন।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম ইস্টার বিদ্রোহের কথা কোনও দিনই ভুলে যেও না। জালালাবাদ, জুলখা, চন্দননগর ও ধলঘাটের সংগ্রামের কথা সব সময় মনে রেখো। ভরতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যেসব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরম প্রদেশে লিখে রেখো।
আমাদের সংগঠনের বিভেদ না আসে- এই আমার একান্ত আবেদন। যারা কারাগারের ভেতরে ও বাইরে রয়েছে, তাদের সকলকে জানাই আমার আশীবার্দ। বিদায় নিলাম তোমাদের কাছ থেকে।
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।
বন্দেমাতরম।’’
তাঁর লাশ বস্তাবন্দী করে দূরসমুদ্রে ফেলে দেয় ব্রিটিশ সেনারা। বাংলার মাটিতে কোথাও যেন তাঁর চিহ্ন না থাকে। কিন্তু বিপ্লবী আত্মার যে মৃত্যু নেই। সূর্য সেন এ দেশের নির্যাতিত মানুষের হৃদয়ে তাই আজও অমর। তাঁর দেখানো পথে বছরের পর বছর অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে এ দেশের মানুষ। শিক্ষকতা করার কারণে তিনি ‘মাস্টার দা’ হিসেবে পরিচিত হন।
সূর্য সেন ১৮৯৪ সালের ২২শে মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রাজমনি সেন এবং মাতার নাম শশী বালা সেন। রাজমনি সেনের দুই ছেলে আর চার মেয়ে। সূর্য সেন তাঁদের পরিবারের চতুর্থ সন্তান। দুই ছেলের নাম সূর্য ও কমল। চার মেয়ের নাম বরদাসুন্দরী, সাবিত্রী, ভানুমতী ও প্রমিলা। শৈশবে পিতা মাতাকে হারানো সূর্য সেন কাকা গৌরমনি সেনের কাছে মানুষ হয়েছেন। সূর্য সেন ছেলেবেলা থেকেই খুব মনোযোগী ভাল ছাত্র ছিলেন এবং ধর্মভাবাপন্ন গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন।
তাঁর প্রথম স্কুল ছিল দয়াময়ী উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়। পরে তিনি নোয়াপাড়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর তিনি ন্যাশনাল হাই স্কুলে ভর্তি হন। সূর্য সেন ১৯১২ সালে চট্টগ্রামের নন্দনকাননে অবস্থিত হরিশদত্তের ন্যাশনাল স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে চট্টগ্রাম কলেজে এফ. এ.-তে ভর্তি হন। সে সময় আই.এ বা বর্তমানের এইচএসসি পরীক্ষার পরিবর্তে ফার্স্ট আর্টস বা এফ. এ. পরীক্ষার নিয়ম ছিল। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এফ. এ. পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে পাশ করেন তিনি। ১৯১৮ সালে তিনি বহররমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন এবং চট্টগ্রামে ফিরে এসে ব্রাহ্ম সমাজের প্রধান আচার্য্য হরিশ দত্তের জাতীয় স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে গেলে তিনি দেওয়ানবাজারে বিশিষ্ট উকিল অন্নদা চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত অধুনালুপ্ত ‘উমাতারা উচচ ইংরেজি বিদ্যালয়ে’ অংকের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এসময় বিপ্লবী দলের সাথে তাঁর সম্পর্ক গভীরতর হয়ে ওঠে এবং শিক্ষকতা করার কারণে তিনি ‘মাস্টারদা’ হিসেবে পরিচিত হন।
বিপ্লবী ভাবধারায় দীক্ষিত সূর্য সেন দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগকে একমাত্র তপস্যা হিসেবে নিয়েছিলেন। তাই তিনি বিবাহ-বিরোধী ছিলেন। কিন্তু বিএ পাশ করে চট্টগ্রামে আসার পর থেকেই তাঁর বিবাহের কথাবার্তা অভিভাবকরা তোলেন। অবশেষে তাঁর বড়ভাই শিক্ষক চন্দ্রনাথ সেন (সহোদর নয়) ও অন্যান্য আত্মীয়দের বিশেষ অনুরোধে ১৯১৯ সালে তিনি চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়ার নগেন্দ্রনাথ দত্তের ষোল বছরের কন্যা পুষ্প দত্তকে বিয়ে করেন। আত্মীয়-স্বজনের চাপে বিয়ে করলেও মাস্টারদার মনে এ ধারণা বলবৎ ছিল যে, বিবাহিত জীবন তাকে কর্তব্যভ্রষ্ট করবে, আদর্শচ্যুত করবে। তার ফলে স্ত্রীর সংগে একদিন তিনি কথা পর্যন্ত বলেন নি। বিবাহের তৃতীয় দিনে হিন্দুদের মধ্যে যে ফুলশয্যার প্রথা প্রচলিত আছে, সেদিন তিনি তাঁর বৌদিকে বলেন, তিনি স্বপ্নে দেখেছেন স্ত্রীর সংগে সহবাসে তাঁর মৃত্যু অনিবার্য। তাই তিনি সেদিনই গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শহরে চলে আসেন এবং তারপর স্ত্রীর সাথে আর কোনদিন দেখা করেন নি।
১৯২৬ সালে সূর্য সেন পলাতক অবস্থায় কোলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রীটের এক মেসে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। সেখান থেকে তাঁকে বোম্বাইয়ের (মুম্বাই) রত্নগিরি জেলে পাঠানো হয়। মাস্টারদা যখন রত্নগিরি জেলে আটক, তখন তাঁর স্ত্রীর কঠিন টাইফয়েড রোগ হয়। দেওয়ানবাজারের যে বাসা থেকে মাস্টারদা পালিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর স্ত্রী সেখানে তখন মৃত্যুশয্যায় ছিলেন। বহু দরখাস্তের পর মাস্টারদাকে যখন পুলিশ পাহারায় রত্নগিরি জেল থেকে ছুটিতে চট্টগ্রাম আনা হয় মূমুর্ষু স্ত্রীকে দেখার জন্য, তাঁর স্ত্রীর আয়ু তখন সম্পূর্ণ নিঃশেষিত। সূর্য সেনের স্ত্রী বিপ্লবী কাজ-কর্মে তাঁকে নেয়ার জন্য মাঝে মাঝে বয়োকনিষ্ঠ সহকর্মীদের কাছে অনু্যোগ করতেন। স্বামীর কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা পুষ্প দত্ত এ জীবনে আর এ বিপ্লবী নেতার দেহ-মনের সান্নিধ্যে যেতে পারেন নি।
১৯১৬ সালে বহররমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে সূর্য সেন সরাসরি রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত হন। বিপ্লবীদের গোপন ঘাঁটি এই কলেজ়ে তিনি অধ্যাপক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তীর সান্নিধ্যে আসেন। তিনি যুগান্তর দলের সাথে যুক্ত ছিলেন। সূর্য সেনকে তিনি বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষা দেন। সূর্য সেন ১৯১৮ সালে শিক্ষাজীবন শেষ করে চট্টগ্রামে এসে গোপনে বিপ্লবী দলে যোগ দেন। ৪৯নং বেঙ্গল রেজিমেন্টের নগেন্দ্রনাথ সেন ১৯১৮ সালে চট্টগ্রামে এসে সূর্য সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী ও চারুবিকাশ দত্তের সাথে দেখা করেন। সূর্য সেন এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী অম্বিকা চক্রবর্তী একই থানার পাশাপাশি গ্রামের ছাত্র হিসেবে ছোটবেলা থেকেই পরস্পরের কাছে পরিচিত ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) শেষের দিকে অনুরূপ সেন, চারুবিকাশ দত্ত, অম্বিকা চক্রবর্তী, নগেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখদের সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রামে গোপন বিপ্লবী দল গঠন করা হয়।
এখানে উল্লেখ্য, শুরুতে চট্টগ্রামের বিপ্লবী দল একটিই ছিল। তারা বাংলার প্রধান দু’টি বিপ্লবী দল “যুগান্তর” এবং “অনুশীলন”- কোনটির সাথে একেবারে না মিশে গিয়ে স্বতন্ত্রভাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। বিপ্লবী নেতা সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী তখন চট্টগ্রাম শহরের দেওয়ানবাজার দেওয়ানজী পুকুরপারে ‘সাম্য আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করে ওখানে থাকেন। সেখানে গোপনে বিপ্লবীরা জমায়েত হয়। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের অন্যতম নেতা চারুবিকাশ দত্ত তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে “অনুশীলন” দলের সাথে যুক্ত হয়ে যান। এভাবে চট্টগ্রামেও বাংলার অন্যান্য জেলার মত দু’টি বিপ্লবী দল গড়ে ওঠে। দুই দলে বিভক্ত হওয়ার পর চট্টগ্রামে যে বিপ্লবী দলটি নিজস্ব স্বতন্ত্রতা বজায় রেখে কংগ্রেসের প্রকাশ্য আন্দোলনে কোলকাতার “যুগান্তর” দলের সঙ্গে সহযোগিতা করত, সে দলের সাংগঠনিক কমিটি ছিল নিম্নরূপ- সভাপতি- সূর্য সেন; সহসভাপতি- অম্বিকা চক্রবর্তী; শহর সংগঠনের দায়িত্বে- গণেশ ঘোষ ও অনন্ত সিংহ; গ্রামের সংগঠনের দায়িত্বে- নির্মল সেন। এছাড়া লোকনাথ বলকে ছাত্র আন্দোলন ও ব্যায়ামাগার গঠন প্রভৃতি কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়। অনুরূপ সেন বিপ্লবীদলের সংবিধান লিখলেন এবং তাঁকে ও নগেন্দ্রনাথ সেনকে কলকাতার অন্য দলগুলোর সাথে যোগাযোগ এবং অস্ত্র সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
১৮ই এপ্রিল ১৯৩০, শুক্রবার রাত ৮টা বিদ্রোহের দিন হিসাবে ঠিক হয়। পরে তা দশটায় করা হয়। চারটায় বাড়ি হতে চারটি দল আক্রমণের জন্য বের হয়। সে রাতেই ধুম রেলস্টেশনে একটা মালবহনকারী ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে উল্টে যায়। একদল বিপ্লবী আগে থেকেই রেল লাইনের ফিসপ্লেট খুলে নেয়। এর ফলে চট্টগ্রাম সমগ্র বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অন্য একটি দল চট্টগ্রামের নন্দনকাননে টেলিফোন এবং টেলিগ্রাফ অফিস আক্রমণ করে। হাতুড়ি দিয়ে তারা সব যন্ত্রপাতি ভেঙ্গে দেয় এবং পেট্রোল ঢেলে সেখানে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। আরেকটি দল পাহাড়তলীতে অবস্থিত চট্টগ্রাম রেলওয়ে অস্ত্রাগার দখল করে নেয়। উন্নতমানের রিভলবার ও রাইফেল গাড়ীতে নিয়ে অস্ত্রাগারটি পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগানো হয়। তবে সেখানে কোনো গুলি পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ পরিকল্পনা অনুযায়ী বিপ্লবীরা দামপাড়ায় পুলিশ রিজার্ভ ব্যারাক দখল করে নেয়। এই আক্রমনে অংশ নেয়া বিপ্পবীরা দামপাড়া পুলিশ লাইনে সমবেত হয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। মিলিটারি কায়দায় কুচকাওয়াজ করে সূর্য সেনকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সূর্য সেন অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। তিনি তার ঘোষণায় বলেন:
“The great task of revolution in India has fallen on the Indian Republican Army. We in Chittagong have the honour to achieve this patriotic task of revolution for fulfilling the aspiration and urge of our nation. It is a matter of great glory that today our forces have seized the strongholds of Government in Chittagong…The oppressive foreign Government has closed to exist. The National Flag is flying high. It is our duty to defend it with our life and blood”.
চট্টগ্রাম সম্পূর্ণরুপে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত ছিল চারদিন। কিন্তু এরমধ্যে বিপ্লবীদের খাদ্যসংকট দেখা দিল এবং সূর্য সেন সহ অন্যদের কচি আম, তেঁতুল পাতা, কাঁচা তরমুজ এবং তরমুজের খোসা খেয়ে কাটাতে হয়। সূর্য সেন সহ ছয়জন শীর্ষস্থানীয় বিপ্লবীকে ধরার জন্য ইংরেজ সরকার ৫০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষনা করে। ১৯৩০ সালের ২২শে এপ্রিল বিপ্লবীরা যখন জালালাবাদ পাহাড়ে (চট্টগ্রাম সেনানিবাসের পাহাড়) অবস্থান করছিল সে সময় সশস্ত্র ইংরেজ সৈন্যরা তাঁদের আক্রমণ করে। দুই ঘন্টার প্রচন্ড যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর ৭০ থেকে ১০০ জন এবং বিপ্লবী বাহিনীর ১২ জন নিহত হয়।
জালালাবাদ যুদ্ধের পর বিপ্লবী নেতাদের ধরার জন্য রেলস্টেশন, স্টীমারঘাট হতে শুরু করে সব স্থানে অভিযান চলছিলো। বিপ্লবীরা তখন বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে আত্মগোপন করে ছিলো। সূর্য সেন ১৬ জন বিপ্লবীকে নিয়ে ২৪শে এপ্রিল রাতে নিজ বাড়িতে আসেন। এর মধ্যে অনন্ত সিং পুলিশের কাছে স্বেচ্ছায় ধরা দেন এবং কয়েকজনকে পুলিশ আটক করে এবং এদের বিরুদ্ধে অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলা শুরু হয়। এ মামলা শুরু হওয়ার পর অসুস্থ অম্বিকা চক্রবর্তী পটিয়া থানার চক্রশালা গ্রামে গ্রেপ্তার হন। অম্বিকা চক্রবর্তী এবং সেসময় গ্রেপ্তার হওয়া অন্য বিপ্লবীদের নিয়ে দ্বিতীয় অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলা শুরু হয়। প্রায় ১৯ মাস বিচারের পর ১৯৩২ সালের ১লা মার্চ অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলার রায়ে অনন্ত সিং, লোকনাথ বল এবং গনেশ ঘোষসহ ১২ জনকে দ্বীপান্তর বাসের আদেশ দেয়া হয়। পরবর্তীতে অপর মামলায় অম্বিকা চক্রবর্তীর প্রাণদন্ডের আদেশ হয় পরে হাইকোর্টে আপিলের রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ রায়ের পর সূর্য সেনকে ধরার জন্য পটিয়া এবং গোমদন্ডীতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়। সরকার ৫০০০ টাকার পরিবর্তে ১০,০০০ পুরস্কার ঘোষণা করে। ১৯৩২ সালের ১৩ই জুন রাত ৯টায় পটিয়ার ধলঘাট গ্রামে সাবিত্রী চক্রবর্তীর বাড়িতে তাঁকে ধরার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ক্যামেরনকে গুলি করে সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত পালিয়ে যেতে সক্ষম হন কিন্তু নির্মল সেন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিলের (চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের দিন) অন্যতম একটি পরিকল্পনা ছিল পাহাড়তলী ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ কিন্তু গুড ফ্রাইডে থাকায় সেদিন ঐ ক্লাবে কেউ ছিল না। মাস্টার’দা সূর্য সেন স্থির করেন ২৩শে সেপ্টেম্বর (১৯৩২ সাল) ইউরোপীয় ক্লাবে প্রীতিলতার নেতৃত্বে হামলা করা হবে। এ প্রসজ্ঞে মাস্টার’দা লিখেছেন-
“বাংলায় বীর যুবকের আজ অভাব নাই। বালেশ্বর থেকে জালালাবাদ, কালারপোল পর্যন্ত এদের দৃপ্ত অভিযানে দেশের মাটি বারে বারে বীর যুবকের রক্তে সিক্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে মায়ের জাতিও যে শক্তির খেলায় মেতেছে, ইতিহাসে সে অধ্যায় আজও অলিখিত রয়ে গেছে। মেয়েদের আত্মদানে সে অধ্যায় রচিত হোক এই-ই আমি চাই। ইংরেজ জানুক, বিশ্বজগৎ জানুক, এদেশের মেয়েরাও মুক্তিযুদ্ধে পেছনে নেই”।
২৩শে সেপ্টেম্বর রাতে প্রীতিলতা সূর্য সেন-এর নির্দেশে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করেন। হামলায় ৫৩ জন ইংরেজ হতাহত হয়েছিল। গুলিতে আহত প্রীতিলতা দৈহিকভাবে অত্যাচারিত হওয়ার চাইতে থেকে স্বেচ্ছামৃত্যুকে বেছে নিলেন। তিনি পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
ইংরেজ প্রশাসন সূর্য সেনকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরার জন্য সর্বাত্নক চেষ্টা অব্যাহত রাখে। সূর্য সেন গৈরলা গ্রামে ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে আত্মগোপন করে ছিলেন। ১৯৩৩ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারী রাতে সেখানে এক বৈঠকে ছিলেন কল্পনা দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী, মণি দত্ত, ব্রজেন সেন আর সুশীল দাসগুপ্ত। ব্রজেন সেনের সহোদর নেত্র সেন সূর্য সেনের উপস্থিতির খবর পুলিশকে জানিয়ে দেয়। রাত প্রায় ১০টার দিকে পুলিশ আর সেনাবাহিনী ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িটি ঘিরে ফেলে। রাতের অন্ধকারে গুলি বিনিময় করে কল্পনা দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী, মণি দত্ত আর সুশীল দাসগুপ্ত পালিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু রাত ২টার দিকে অস্ত্রসহ সূর্য সেন এবং ব্রজেন সেন ধরা পড়েন। তারপর ঐ বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ সূর্য সেনের নিজের হাতে লেখা অর্ধসমাপ্ত আত্মজীবনীর খাতা উদ্ধার করে। সেই খাতার উপর লেখা ছিল “বিজয়া”। বিচারের সময় “বিজয়াতে”লেখা তাঁর কথাগুলো বিপ্লব এবং প্রশাসনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রমান হিসাবে অনেকবার ব্যবহার করা হয়। ১৭ই ফেব্রুয়ারী রাতে সূর্য সেন এবং ব্রজেন সেনকে প্রথমে জেলা গোয়েন্দা সদর দপ্তরে, পরে কোর্ট হয়ে চট্টগ্রাম জেলে নেয়া হয়। সূর্য সেন গ্রেপ্তার হবার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছিল “চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন সম্পর্কে ফেরারী সূর্য সেনকে গত রাতে পটিয়া হইতে ৫ মাইল দূরে গৈরলা নামক স্থানে গ্রেপ্তার করা হইয়াছে। সূর্য সেনকে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের মামলায় প্রধান আসামি বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে। গত ১৯৩০ সাল হইতে সূর্য সেন পলাতক ছিলেন এবং তাঁহাকে ধরাইয়া দিবার জন্য গভর্নমেন্ট দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করিয়াছিলেন”। ১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বেঙ্গল চিফ সেক্রেটারী কর্তৃক লন্ডনে ব্রিটিশ প্রশাসনের কাছে কাছে পাঠানো রিপোর্টে লেখা হয়
“The outstanding event of the fortnight is the arrest on 17 February of Surjya Sen of Chittagong Armoury Raid notoriety, who, as the leader and brain of absconders, has been giving constant anxiety over the last three years. It was unfortunate that when Surjya Sen and his companion were arrested, 4 others made good their escape…But luck enters very largely into these night operations and it certainly was a great stroke of luck that Surjya Sen was secured”।
সূর্য সেন গ্রেফতার হবার পর তারকেশ্বর দস্তিদার দলের নেতৃত্ব গ্রহন করেন। কিন্তু ১৯৩০ সালের ১৮ই মে আনোয়ারা থানার গহিরা গ্রামে পুলিশ আর মিলিটারীর সাথে সংঘর্ষের পর তারকেশ্বর দস্তিদার এবং কল্পনা দত্ত গ্রেপ্তার হন। ১৯৩৩ সালের মার্চ মাসে বিপ্লবীরা জেল থেকে সূর্য সেনকে মুক্ত করার জন্য কয়েকবার চেষ্টা চালায়। প্রতিবারই তাঁদের গোপন পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়।
কনডেম্ড সেলে সূর্য সেনকে কড়া পাহারায় নির্জন কুঠুরীতে রাখা হত। একজন কয়েদি মেথর সূর্য সেনের লেখা চিঠি ময়লার টুকরিতে নিয়ে জেলের বিভিন্ন ওয়ার্ডে বন্দী বিপ্লবীদের দিয়ে আসতো। মৃত্যুর আগে জেলে আটক বিপ্লবী কালীকিঙ্কর দে’র কাছে সূর্য সেন পেন্সিলে লেখা একটি বার্তা পাঠান। সে বার্তায় তিনি লেখেন “আমার শেষ বাণী-আদর্শ ও একতা”। তিনি স্মরণ করেন তাঁর স্বপ্নের কথা-স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন যার জন্য জীবনভর উৎসাহ ভরে ও অক্লান্তভাবে পাগলের মত তিনি ছুটেছেন। তাঁর ভাষায় “ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যে সব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো”। তিনি সংগঠনে বিভেদ না আসার জন্য একান্তভাবে আবেদন করেন।
শেষ দিনগুলোতে জেলে থাকার সময় তাঁর একদিন গান শোনার খুব ইচ্ছা হল। সেই সময় জেলের অন্য এক সেলে ছিলেন বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী। রাত ১১টা/১২টার দিকে কল্পনা দত্ত তাঁকে চিৎকার করে বলেন “এই বিনোদ, এই বিনোদ, দরজার কাছে আয়। মাষ্টারদা গান শুনতে চেয়েছেন”। বিনোদ বিহারী গান জানতেন না। তবুও সূর্য সেনের জন্য রবিঠাকুরের “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে” গানটা গেয়ে শোনালেন। ১৯৩৪ সালের ১২ই জানুয়ারি মধ্যরাতে সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসী কার্যকর হবার কথা উল্লেখ করা হয়।
সূর্য সেন কে এবং তারকেশ্বর দস্তিদারকে ব্রিটিশ সেনারা নির্মম ভাবে অত্যাচার করে। ব্রিটিশরা হাতুরী দিয়ে তাঁর দাঁত ভেঙ্গে দেয় এবং তাঁর হাড় ও ভেঙ্গে দেয়। হাতুরী দিয়ে নির্মম ভাবে পিটিয়ে অত্যাচার করা হয়। এরপর তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের লাশ আত্মীয়দের হাতে হস্তান্তর করা হয়নি এবং হিন্দু সংস্কার অনুযায়ী পোড়ানো হয়নি। ফাঁসীর পর লাশদুটো জেলখানা থেকে ট্রাকে করে ৪ নম্বর স্টীমার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর মৃতদেহ দুটোকে ব্রিটিশ ক্রুজার “The Renown” এ তুলে নিয়ে বুকে লোহার টুকরা বেঁধে বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরের সংলগ্ন একটা জায়গায় ফেলে দেওয়া হয়।
মিথ্যা ইতিহাসের সামিয়ানার তলে স্বাধীনতা দিবসের দিন, গণতন্ত্র দিবসের দিন ঘটা করে বাজানো হয় মুক্তির মন্দির সোপান তলে…।
অপেক্ষা … শুধু অপেক্ষা। দেশের তরণদের জেগে ওঠার অপেক্ষা। জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠার অপেক্ষা। রাষ্ট্ররক্ষার দায়িত্ব নেবার অপেক্ষা। অপেক্ষা সত্যের লক্ষ্যে ইতিহাসকে গড়ে তোলার…। নতুন করে শোনার অপেক্ষা—‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে।’
কিন্তু স্বাধীনতার পরের অবস্থাটা ঠিক কি দাঁড়িয়েছে। দেশভাগ করে স্বাধীনতা। দুই দিকে দুই পাকিস্তান, মাঝখানে ভারতবর্ষ। তারপরে আবার এক রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পরে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র। সেই স্বাধীন বাংলাদেশে কেমন আছেন মাস্টারদা সূর্য সেনের বংশধররা? সূর্য সেনদের বংশের শেষজনকেও শেষপর্যন্ত গ্রাম ছেড়ে পাশের দেশে পাড়ি দিতে হয়েছে।
সূর্যবাবুর নিজের ছেলেপিলে বলতে তো কিছুই ছিলো না। তিনি নিজে তো ফাঁসির দড়িতে ঝুলে ইহলীলা সাঙ্গ করলেন। স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা তারপর কোথায় হারিয়ে গেলেন কে জানে? কাজেই, চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ার সেনপাড়ায় নিজের গাঁয়ে তাঁর ভিটেটা আগেই হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিলো। সেখানে কিছু গ্রাম্য টাউট-বাটপার ঘুঘু চরাচ্ছিলো।
এদিকে, সূর্য সেন বিপ্লবটা করেছিলেন ভুল সময়ে, ভুল দেশে। তিনি নিজে শহিদ হয়ে ‘মহাবিপ্লবী’ হয়ে গেলেন, যদিও তাঁর লাশটা পর্যন্ত পাওয়া গেলো না। ওদিকে, তাঁর বিপ্লবের ষোল বছর পর তাঁর স্বদেশ যখন স্বাধীন হলো, তখন তা দ্বিখণ্ডিত। আর তাঁর জন্মগ্রামটি এই দুখণ্ডের যে-খণ্ডে পড়েছে, মাস্টারদা তার কথা তাঁর মহাবিপ্লবের স্বপ্নেও কখনো ভাবেননি। তাই বলা চলে, মহাবিপ্লবীর স্বাধীন স্বদেশের স্বপ্ন পূর্ণ হলো বটে, কিন্তু তা এমনভাবে হলো, যা আসলে এক দুঃস্বপ্ন, যা আদৌ না-হলেই ভালো হতো।
সে-স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ ফলাফল হিসেবে শুরু হয়ে গেলো, পাইকারি হারে সেন বংশীয়দের দেশত্যাগ। অবশ্য শুধু সূর্য সেনের বংশের লোকেরা নয়, সমৃদ্ধ, স্বর্ণপ্রসূ নোয়াপাড়া গ্রামের, মোগল যুগের বিখ্যাত ‘পরগনে নোয়াপাড়া’র মোক্ষদা রায়দের বাড়ি, মহাকবি নবীন সেনদের বাড়ি, রক্ষিতদের বাড়ি, দাসবর্মণদের বাড়ি ইত্যাকার বিশাল বিশাল সব বনেদি বাড়িগুলো জনশূন্য হতে শুরু করলো। বাঘ-সিংহদের সেসব বাড়িঘর, জমিজমা দখল নিতে শুরু করলো শেয়ালরা।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাড়িগুলো দখলে গেলো আগের মালিকদের বর্গাচাষী, লেঠেল প্রভৃতির হাতে। সংখ্যগুরুত্ব বা সরকারি দলের জোরে তারা নামমাত্র মূল্যে কিংবা একেবারে বিনামূল্যেই সেসব বাড়ি-জমির দখল নিয়ে নিলো।
সে-ধারা অক্ষুণ্ণ রইলো পরবর্তী অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে। ইতোমধ্যে সূর্য সেনের স্বদেশ আরো একদফা স্বাধীন হলো। তাতে লাভের মধ্যে এটুকু হলো যে, আগেকার স্বাধীনতার পরেরকার সিকিশতাব্দী ধরে তাঁকে বিপ্লবী বলার চেয়ে ডাকাত বলতেই তৎকালীন সরকার যেখানে বেশি পছন্দ করেছে, দ্বিতীয় দফা স্বাধীনতার পর তাঁর মান-ইজ্জত কিছুটা বাড়লো। যে-শহরে তিনি মহাবিপ্লব করেছিলেন, প্রথম দফা স্বাধীনতার পর তাঁর স্বদেশের অন্য অর্ধাংশে পালিয়ে যাওয়া তাঁর সহবিপ্লবীরা আবার সে-শহরে এসে মহাসমারোহে তাঁর আবক্ষ ব্রোঞ্জ মূর্তি উন্মোচন করলেন লোহার শিকের বেড়ার ভেতরে। সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগলো। তবে দুর্মুখ দুষ্টজনেরা বলাবলি করতে লাগলো, মরে গিয়েও সূর্য সেন রেহাই পেলেন না লোহার শিকের ঘেরাটোপ থেকে। তবে সে-দুঃখটাও কিছুটা ঘুচিয়ে দিলেন তাঁর এলাকা থেকে নির্বাচিত ‘মাটি ও মানুষের দল’-এর একজন সাংসদ। থানা সদরের কেন্দ্রস্থলে তিনি আরো একটা আবক্ষ মূর্তি বসালেন মাস্টারদা’র, এবং এটাকে ঘিরে কোনো লোহার শিকের ঘেরা দেয়া হলো না। কিন্তু তাতেও তো রেহাই নেই! দুনিয়ার যত ভিখারি, বাউণ্ডুলে, নেশাখোররা তখন আড্ডা জমালো ছোট্ট ছাউনির নিচে, মাস্টারদার মূর্তির তলায়। অচিরেই মূর্তিটার কাঁধে, মাথায় শোভা পেতে লাগলো ওদের নোংরা কাপড়, গামছা, থলে ইত্যাদি। ওদের কেউ কেউ আবার মাস্টারদার পরম ভক্ত। তাঁর উদ্দেশ্যে গাঁজার কল্কে বা দোচুয়ানির গ্লাস উৎসর্গ না-করে তারা মুখেই তুলতো না।
এর অল্প ক’বছর আগে অবশ্য আরো একটা ভালো কাজ হয়ে গিয়েছিলো। আরেক দলের আরেক নির্বাচিত সাংসদ টাউট-বাটপারদের কবল থেকে সূর্যবাবুর ভিটেটা উদ্ধার করে সেখানে একটা সরকারি দাতব্য হাসপাতাল খুলে দিলেন। মহাসমারোহে সেটার উদ্বোধন হল। সূর্য সেনের সহযোদ্ধা বয়োবৃদ্ধ বিপ্লবীরা আরো একবার অতিথি হিসেবে এসে বক্তৃতা-টক্তৃতা দিয়ে গেলেন। সেনগুষ্টির সর্বশেষ যেজন তখনো নিজ ভিটের মাটি কামড়ে পড়ে ছিলেন, দাতব্য হাসপাতালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তাঁকেও একটেরে একটা আসন দেয়া হয়েছিলো, যদিও বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি। সেই সাংসদ আরো একটা ভালো কাজ করলেন— সেনপাড়ার নাম পাল্টে তিনি ‘সূর্য সেন পল্লী’ করে দিলেন। তারই বদৌলতে আজ দূর-দূরান্তের একজন সাধারণ রিকশাওয়ালা পর্যন্ত বিপ্লবী সূর্য সেনের নাম জানে। চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের পথের হাট স্টপেজে নতুন কোনো যাত্রী নামলে সাগ্রহে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় যাবেন বাবু? সূর্য সেন পল্লীতে তো?”
কিন্তু এতসবের পরও সূর্য সেনের গুষ্টির শেষজন তাঁর ভিটেয় টিকতে পারলেন না। পুরোনো ইঁদুরগুলো ভেতরে ভেতরে ঠিকই মাটি খুঁড়ে যাচ্ছিলো।
সেনপাড়ার বাকি সবাই দেশ ছাড়লেও, সূর্যবাবুর জ্ঞাতি ভাইপো যতিন সেন কিন্তু ভিটে ছেড়ে না-যাওয়ার জন্যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলারে ফুলে-ফেঁপে ওঠা তাঁদের সাবেক বর্গাচাষী পরিবারের ছেলেরা তাঁকে ভিটেছাড়া করেই ছাড়লো। এ-জন্যে তাঁরা সুদূরপ্রসারী জাল পেতেছিলো। প্রথমে তারা যতিনবাবুর পিতৃহীন ভাইপোটাকে তাঁদের জালে ফাঁসালো। মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছেলেটার হাতে তাঁরা তুলে দিলো ব্রাউন সুগারের পুরিয়া। তার পড়াশোনা সব অচিরেই চুলোয় গেলো। নেশার টাকার জন্যে সারাক্ষণ হন্যে হয়ে ঘুরতে লাগলো সে। এর পর তাঁরা ছেলেটার কানে মন্ত্র ঝাড়তে লাগলো যে, তার বাবা বেঁচে না-থাকায় তাঁর ভাগের সব সম্পত্তি তার খুড়ো-জ্যাঠারা মেরে খাচ্ছে, এবং তাকে তার প্রাপ্য ভাগ দিচ্ছে না। তাঁরা তাঁকে বোঝাতে লাগলো, বাড়িভিটে, জমিজমা সব বেচে দিলে তাঁরা নগদ টাকা দিয়ে কিনে তো নেবেই, উপরন্তু সে যাতে তাঁর ন্যায্য ভাগটা পায়, তার জন্যে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাও নেবে।
হার্ড ড্রাগে আসক্ত একজন অর্বাচীন তরুণের জন্যে এর চেয়ে ভালো প্রস্তাব আর কী হতে পারে! অচিরেই সে বাড়িতে এমন কুরুক্ষেত্র বাধালো যে, যতিনবাবু শেষপর্যন্ত সব বিক্রি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলেন। ভাইপোকে সুপথে ফেরানোর সাধ্য সেই বুড়োবয়সে তাঁর আর ছিলো না। কাজেই তাঁর চাপের কাছেই তিনি নতি স্বীকার করলেন। স্বাভাবিকভাবেই, প্রাক্তন বর্গাচাষীর উঠতি ধনী ছেলেরাই সব কিনে নিলো। সাপও মরলো, লাঠিও ভাঙল না।
তবে শর্ত রইলো যে, অশীতিপর যতিন সেন বাকি যে-কটা বছর বাঁচবেন, ততদিন তিনি ও তাঁর পরিবার ওই ভিটেতেই থেকে যাবেন। কিন্তু মাস-দু’মাস না-কাটতেই ওই বাড়িতে একদিন ডাকাত পড়লো। সেন বংশীয়দের বাড়িতে অতীতে কখনো যা ঘটেনি, এবার তাই ঘটলো। যতিনবাবু আগেই কথাবার্তা কমিয়ে দিয়েছিলেন, এ-ঘটনার পর একেবারে নির্বাক হয়ে গেলেন। পরদিন সকাল না-হতেই যতিন সেনদের বাড়ির দরজায় দুটো অটোরিকশা এসে দাঁড়ালো, এবং ওগুলোতে চেপে সাতপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে তিনি ও তাঁর পরিবার যাত্রা করলেন অজানার উদ্দেশ্যে। যতিনবাবুর বিপথগামী ভাইপোটাকে সে-সময় ধারেকাছে দেখা গেলো না। সম্পত্তি বিক্রির টাকার ভাগ নিয়ে সে যে কোথায় গা ঢাকা দিয়েছে, তা কেউ বলতে পারলো না। পরের কয়েকদিন চট্টগ্রাম শহরে এক আত্মীয়বাড়িতে থেকে, তারপর যতিনবাবুরা চলে গেলেন পাশের দেশে, যেখানে তাঁদের সম্প্রদায় সংখ্যাগুরু।
তাঁদের চলে যাওয়ার পর ব্যাপক গুজব শোনা গেলো যে, যতিন সেনদেরকে দ্রুত উচ্ছেদ করে তাঁদের বাড়িভিটের দ্রুত দখল নেয়ার উদ্দেশ্যে সেখানে ডাকাত লেলিয়ে দিয়েছিলো সেগুলোর নতুন মালিকরাই।
অতঃপর স্থানীয় মানচিত্রে ঠিকই থেকে গেলো সেনপাড়া বা সূর্য সেন পল্লী, কিন্তু সূর্য সেনের জ্ঞাতিগুষ্টির একজনেরও সেখানে ঠাঁই রইলো না।
যতিনবাবুর ভাইপো, একদার মেধাবী ছাত্রটি এখন এক আধবুড়ো আধপাগল। তার বর্তমান সঠিক ঠিকানা কারোরই জানা নেই। তবে শোনা যায় যে, কোনো-কোনোদিন সে রাতের আঁধারে গা ঢাকা দিয়ে তাদের ভিটেয় ফিরে আসে, আর গুমরে গুমরে কাঁদে।
এই অবাঞ্ছিত উপদ্রব থেকে রেহাই পাওয়ার বিস্তর চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর এবার নতুন মালিকরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, ওই ভিটের পুরোনো মাটির ঘরগুলো ভেঙে ফেলে সেখানে টানা বেড়ার ঘর তুলে স্বল্প আয়ের লোকদের ভাড়া দেবে। তাতে এ-উপদ্রবের হাত থেকে রেহাই মিলবে, সেইসঙ্গে মাসান্তে পকেটে কিছু টাকাও আসবে।
বাড়িটা ভেঙে ফেললে লোপ পাবে সূর্যবংশীয়দের শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকুও। সূর্য সেন পল্লীতে আর সবাই, সবকিছুই আছে, থাকবে, শুধু নেই এবং থাকছে না তাঁর বংশের স্বজন-পরিজনরা ছাড়া।
ইতিহাস! তুমিও কি ফাঁসুড়ে শিবু ডোমের মতো নেশায় আজও বেহুঁশ? শিবু ডোম কিন্তু আজ আর বেহুঁশ নয়, আজ সে স্পষ্ট করে দিয়েছে সবকিছু। কিন্তু তোমার কী হবে ইতিহাস!
(তথ্যসূত্র:
১- সূর্য সেন: চট্টগ্রাম সশস্র বিপ্লব ও স্বাধীনতা সংগ্রাম, অমলেন্দু দে, প্রতিভাস (২০১৪)।
২- ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রাম: মাস্টারদা সূর্য সেন ও সূর্যসাথীরা, জামাল উদ্দিন, বলাকা প্রকাশন (২০১৪)।
৩- সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন, চিন্ময় চৌধুরী, দে’জ পাবলিশিং।
৪- মুক্তির সোপান জালালাবাদ, সুরেশ দে।
৫- ভারতের স্বধীনতা সংগ্রাম: চট্টগ্রাম বিদ্রোহ ও বিপ্লবী মহানায়ক সূর্য সেন, শরীফ শমশির, অনিন্দ্য প্রকাশ (২০১১)।
৬- প্রথম দিনের সূর্য: সূর্য সেন, শামসুল আলম সাঈদ, সাহিত্য প্রকাশ (২০১৫)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত