নৈহাটি-নিবাসী ভূপতিরঞ্জন দাস ছিলেন এক অদ্ভুত ধরনের গবেষক। তাঁর গবেষণায় প্রথার চোখরাঙানি ছিল না, পাণ্ডিত্যের অভিমানও না, অথচ বৈচিত্র ছিল। শ্রীচৈতন্যের নবদ্বীপ থেকে নীলাচল গমনের পথপঞ্জিকা আর যাত্রাপথের হদিশ নিয়ে তাঁর অদ্ভুত গবেষণার কথা শুনে সুকুমার সেন নাকি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন, ‘এসব কথা কোনো পণ্ডিত লিখতে পারবে না। ঘরকুনো সব। পথে বেরোয় না, মানুষের কাছে যায় না কেউ। খালি লাইব্রেরিতে বসে টোকে। সব হল টোকা পণ্ডিত…।’ কথাগুলো লিখেছিলেন সত্যজিৎ চৌধুরী, তাঁর গবেষণার রকমফের বইটিতে। গবেষণা যে কত বিচিত্র হতে পারে, সময়ে-সময়ে প্রথাবিরুদ্ধও, তা আমরা জানি। প্রথার নিগড় মানতে গেলে সৃষ্টিও থমকে দাঁড়ায়। বিজ্ঞান গবেষণার বেলায় এ-কথা বর্ণে বর্ণে সত্যি; অবশ্য ইতিহাস বা সাহিত্য গবেষণার বেলায় তেমন দৃষ্টান্ত কম। কম বলেই বোধহয় সুকুমারবাবুর ধমক বার বার মনে পড়ে।
একটু খটকাও লাগে। গবেষণা যে-পথেই হোক না কেন, লাইব্রেরি তো পরিহারযোগ্য না। সে শুধু ঘরকুনো, টোকা পণ্ডিতের সাজানো বাগানও না। লাইব্রেরি ব্যবহারেরও রকমফের আছে। যেমন করেছেন দীপক গোস্বামী, তাঁর পরশুরামের চতুঃরঙ্গ বইটিতে। পরশুরামের রঙ্গময় রচনাগুলোতে স্নিগ্ধ কৌতুকের বর্ণালি যে কেমন বিস্তৃত ছিল, তা মনোযোগী পাঠকের জানা। কিন্তু রচনাগুলো কি মৌলিক, না কি সেগুলো অন্য কোনও সৃষ্টির অনুপ্রেরণায় রচিত? অনুপ্রেরণার সেই আদ্যবীজ তো কালের গভীরে তলিয়ে গেছে। সেখান থেকে তাকে তুলে আনা বড় দুরূহ কাজ। দীপকবাবু সেই উৎস সন্ধানে পরিব্রাজক হয়েছেন, লাইব্রেরির দুনিয়াতেই। বিশ্বে এখন অন্তর্জাল ছড়ানো। সে আসলে আর এক লাইব্রেরি— বিপুল, বিশাল। যে নিষ্ঠা, পরিশ্রম আর অনুকরণীয় অধ্যবসায় সম্বল করে তিনি প্রাক-সৃষ্টি আর উত্তর-সৃষ্টির মধ্যে যোগসূত্র রচনা করার কাজটি সম্পন্ন করেছেন তা বাংলা সাহিত্য-গবেষণার জগতে মান্য হয়ে থাকবে। প্রসঙ্গত, তিনিও নৈহাটিরই হাওয়া-খাওয়া মানুষ।
পরশুরামের লেখাজোখা, বিশেষ করে রঙ্গরস নিয়ে আলোচনা আগেও হয়েছে। তা সত্ত্বেও আজকের এই বিরস দিনে অমন এক জন মানুষকে নতুন করে পেতে ইচ্ছে করে। একাধারে সূক্ষ্ম রসবোধসম্পন্ন, যন্ত্রবিজ্ঞানী, রসায়নবিদ, কৌতুককাহিনির রচয়িতা, সুগম্ভীর ভাষাতাত্ত্বিক আর অভিধান-রচয়িতা এই বাংলায় আমাদের সংসারে যে তাঁর সৃষ্টিশীল প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন তা আমাদের বিস্মিত করে, গর্বিতও। আবার একই সঙ্গে একটু বেদনাও জাগে যখন দেখি, প্রায় কুম্ভীলকবৃত্তির দায়ে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। কেউ কেউ অবশ্য অতটা কঠোর না-হয়ে মোলায়েম ভাষায় উদ্বেগ জানিয়েছিলেন, পরশুরাম কি মার্কিন লেখক অধ্যাপক স্টিফেন লিকককে অনুসরণ করেছেন? আবার কেউ কেউ, যেমন ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক সজনীকান্ত দাস তাঁর প্রতি কটূক্তি বর্ষণের কাজে এমন প্রবল কুশল যে হ্যাঁচকা টানে তাঁকে প্রায় আদালতে নিয়ে যান আর কী! সৃষ্টির ‘মৌলিকত্ব’ সন্ধানে শিক্ষাভিমানী বাঙালির অমন প্রবণতা অবশ্য আজও প্রবহমান।
সাহিত্যে মৌলিক সৃষ্টি বলে কিছু হয় কি না, সেই তর্কে কেউ কেউ বলেন, সব সৃষ্টিই আসলে পূর্বসূরিদের নবায়ন। পরশুরামের বেলায় সংযমস্নিগ্ধ রসিকতা, বৈঠকি মেজাজ আর সুনিপুণ ব্যঙ্গই হয়তো বাংলা সাহিত্যে মৌলিক; অন্য কোনও মৌলিকতার কথা সেখানে অবান্তর। যাঁরা অমন অবান্তর কর্মে লিপ্ত ছিলেন তাঁরা কিন্তু এ কথা ভাবেননি যে সমাজজীবনের বিচিত্র সংস্কার, মিথ্যাচার, স্বার্থপরতা এবং অনুরূপ অসংখ্য অসংগতির পটভূমিতে এক-একটি গল্পের ছায়াকে নতুন রূপ দেওয়ার অনবদ্য কাজটাই আসলে ছিল মৌলিক। মনে পড়ে, ভূমেন্দ্র গুহরায়কে এক বার কথায় কথায় জীবনানন্দ বলেছিলেন, ‘তুমি কি কুম্ভীলকবৃত্তির কথা বলছ?… তুমি যে সমাজে বাস করো, সে সমাজের ভাষাও তোমার জিভে চলে আসে।… তুমি যদি অ্যাডগার অ্যালান পোর, ইয়েটসের, কিটসের বা এলিয়টের সমাজে বাস করো, তোমার জিভে কী ভাষা আসবে? সেই ভাষাই চলে আসে জিভে। তাকে কুম্ভীলকবৃত্তি বলে না।’
সহজ কথায়, কুম্ভীলকবৃত্তি মানে, অন্যের রচনা নকল করে নিজের বলে চালিয়ে দেওয়া। পরশুরামের বেলায় এই অপবাদটা যে কোনও ক্রমেই খাটে না, তা দেখাতে গিয়ে দীপকবাবু চারটি রঙ্গরচনা নিয়ে কথা বলেছেন— চিকিৎসা-সংকট, উলট-পুরাণ, আনন্দীবাঈ, রাজমহিষী। এগুলোতে নাকি যথাক্রমে উইলিয়াম কেন, রাজনারায়ণ বসু, জার্মান নাট্যকার ইউলিউস বাউআর এবং পি জি ওডহাউস-এর ছায়া অথবা প্রভাব ফুটে উঠেছে। সাহিত্য সৃষ্টির কাজে ছায়া থাকে, পরিচিত কাঠামোর পুনর্বিন্যাস থাকে আর, এমনকী, পূর্বসূরিদের প্রভাব তো থাকেই। পরশুরামের রচনাগুলোতে তা কীভাবে এসেছে, কোথায় তার সূত্র, কী তার পরিণতি, এ-সব নিয়েই দীপকবাবুর গবেষণা। তা করতে গিয়ে তাঁকে নতুন ও পুরনো রচনার সাদৃশ্য-অসাদৃশ্য দেখাতে হয়েছে। তাঁর অনুপুঙ্খ আলোচনা পাঠককে ঋদ্ধ করবে। আর সেই সঙ্গে দেখিয়ে দেবে, পরশুরামের রচনায় রসোল্লাস কীভাবে কালের সীমানা ছাড়িয়ে রসোত্তীর্ণ হয়ে গেছে।
রবীন্দ্রনাথ ‘গড্ডলিকা প্রবাহ’ পড়ে লিখেছিলেন, ‘বইখানি চরিত্র চিত্রশালা।’ পরশুরামের ‘গড্ডলিকা’ নামে সুপরিচিত বইখানি যে রবীন্দ্র-সমালোচনায় ‘গড্ডলিকা প্রবাহ’ নামেই অভিহিত হয়েছিল এবং ঠিকই হয়েছিল, সে-কথা পাঠকদের কাছে নিবেদন করার জন্য পরিমল রায়, কাজী অনির্বাণ ও দীপংকর বসু রাজশেখর-পরশুরামের পাণ্ডুলিপি, আঁকাপত্র ও আরও অনেক কিছু নিয়ে সুদৃশ্য অ্যালবামকল্প একটি গ্রন্থ নির্মাণ করেছেন। গড্ডলিকা-র সমালোচনা-সঙ্কলন, পরশুরাম বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ লেখা, রাজশেখর পরিকল্পিত বিজ্ঞাপন, তাঁর ব্যবহার্য দ্রব্যের চিত্র, পারিবারিক ছবি— এমন নানা রকমারি জিনিস এতে মিলবে। কেউ ভাবতেই পারেন পরশুরামের সাহিত্য-পাঠের জন্য এ এক প্রয়োজনীয় নথিখানা। তাঁর সাহিত্য পাঠে এই মুদ্রিত নথিখানাটি যেমন কাজে লাগবে তেমনই কাজে লাগবে ব্যক্তি পরশুরামের ‘সাংস্কৃতিক অনুশীলন’ অনুধাবন করতে।
এ বই নির্মাণের মূল গায়েন পরিমল রায়, তবে দোহাররাও কম যান না। পরিমল রায় অবশ্য গায়েন-দোহার ভেদে নারাজ। তিন নির্মাতার নাম হাইফেন সংযুক্ত, এক লাইনে সহাবস্থিত। পরিমল রায় তাঁর পরশুরামের লেখাপত্র ও ব্যক্তিজীবন বিষয়ক তথ্যনিষ্ঠ সংক্ষিপ্ত অথচ জরুরি লেখাটিতে দাবি করেছেন, গড্ডলিকা বইটির প্রচ্ছদে বর্ণলিপি আর চিত্রলিপি দুইয়ের ব্যবহার লক্ষণীয়। ‘‘বর্ণলিপিতে প্রকাশিত গড্ডলিকা এবং তারই সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে চিত্রলিপিতে বিচিত্রিত মানুষের ঢল— প্রবাহ শব্দটির দ্যোতক।’’ তাই রবীন্দ্রনাথ এই বইকে ‘গড্ডলিকা প্রবাহ’ নামে ঠিকই অভিহিত করেছিলেন। কথাটা মানা যায় আবার যায়ও না, কারণ বইয়ের প্রথম সংস্করণের আখ্যাপত্রে কেবল বর্ণলিপি ব্যবহৃত এবং তা ‘প্রবাহ’হীন ‘গড্ডলিকা’। তবে স্বীকার করতেই হবে পরশুরামের বই কেবল পড়ার নয় দেখারও। পাঠকরা যাতে ঠিকমতো ‘চরিত্র চিত্রশালা’ দেখতে পান সে দায়িত্বও গ্রহণ করেছিলেন স্বয়ং লেখক। পরশুরাম যে ভাবে প্রকাশের জন্য গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি নির্মাণ করতেন তা আর কোনও আধুনিক লেখক করতেন বা করেন কি না বলা কঠিন। তাঁর হাতের লেখাটি স্পষ্ট, গোটা গোটা। ত্রয়ী সম্পাদিত এই বইটির আগেই বাঙালি পাঠক দীপংকর বসুর সৌজন্যে তাঁর ‘দাদু’র (আসলে মায়ের দাদু) হাতের লেখার নিদর্শন দেখতে পেয়েছিলেন। রাজশেখর তাঁর দৌহিত্রী-পুত্রের জন্য হাতে লিখে বই তৈরি করে দিয়েছিলেন। এক সময় বাঙালি-পরিবারে হাতে লেখা পত্রিকার চল ছিল। পরিবারের স্বজনদের জন্য সুন্দর হাতের লেখায় সাময়িকপত্র প্রকাশিত হত। অমুদ্রিত সেই পত্র সবাই চেটেপুটে পড়তেন।
রাজশেখর তাঁর পাণ্ডুলিপিতে যেখানে শব্দ কাটতেন সেখানে কাটার চিহ্ন বড় সযত্ন। রবীন্দ্রনাথের মতো কাটাকুটিকে তিনি ছবিতে রূপান্তরিত করতেন না। তবে নিজের বইয়ের জন্য ছবির খসড়া আঁকতেন। দীপংকর বসু আলোচ্য বইয়ে যে রচনাটি লিখেছেন তাতে জানিয়েছেন, পরশুরামের গ্রন্থের অলঙ্করণ শিল্পী যতীন্দ্রকুমার সেনকে পরশুরাম খসড়া ছবি এঁকে দিতেন। সেই খসড়া ছবি সামনে রেখে যতীন্দ্র তাঁর অলঙ্করণ নির্মাণ করতেন। ‘বসুধারা’ পত্রিকায় একদা প্রকাশিত ‘কলাকুশলী পরশুরাম’ লেখাটি পড়লে বোঝা যাবে যতীন্দ্রের আঁকায় পরশুরামের খসড়া রেখা কী গভীর প্রভাব ফেলেছিল— যতীন সেন যেন কেবলই দাগা বুলিয়েছেন। নিজেই সেকথা জানাচ্ছেন যতীন, ‘‘যেমন তাঁর ছিল যান্ত্রিক বুদ্ধি তেমনই ছিল চিত্রবিদ্যায় অপরূপ দক্ষতা। … চরিত্রগুলির চিত্ররূপ… তিনি স্কেচ করে ও লিখে আমাকে জানিয়েছিলেন সেসব আমি জনসাধারণকে উপহার দিচ্ছি।’ (‘বসুধারা’, আষাঢ় ১৩৬৭)। এই অ্যালবামকল্প বইটিতে পাঠক পরশুরামের খসড়া আঁকা আর যতীন্দ্রের একাধিক প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা গ্রন্থে প্রকাশিত আঁকার বহুরূপ দেখতে পাবেন। পরশুরাম কেবল শব্দে ছবি আঁকতেন না, রেখাতেও ছবি আঁকতেন। তাই পাণ্ডুলিপি ও ছবির খসড়া যেন তাঁর ছবি-দেখা মনের রেখা-লেখার সমবায়। সত্যজিৎ তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণের আগে যে ভাবে মনের ছবিকে নিজের খেরোর খাতায় ফুটিয়ে তুলতেন এও যেন তেমন। কেবল পার্থক্য এই পরশুরাম গ্রন্থ-নির্মাণ-কুশলী আর সত্যজিৎ চলচ্চিত্র-নির্মাণ-কুশলী। দুজনের কাজের মাধ্যম আলাদা, তবে মনে মিল ছিল।
শুধু গ্রন্থ নির্মাণে নয় যতীন্দ্রকুমারের সহায়তায় রাজশেখর বসু বেঙ্গল কেমিক্যালের জন্য ওষুধের রঙিন বিজ্ঞাপন সৃষ্টিতেও মন দিয়েছিলেন। পাইরেক্স এই ওষুধটির বিজ্ঞাপনী বাক্য ‘আর জ্বর হয় না’। ওপরে এক ঢাকি সদানন্দে ঢাক বাজাচ্ছেন। বেঙ্গল কেমিক্যালের চন্দন-সাবানের বাক্সটি নজর টানে। নৃত্য-বিভঙ্গরত আনন্দময় রমণী শরীর আর চপল হরিণীদের ছবি শোভিত বাক্স। সুবাসিত চন্দনের ব্যবহার প্রসাধন কার্যে বহু দিন ধরেই চলে আসছে। তাই বাক্সের রমণী শরীরগুলি আধুনিকাদের নয়– আশ্রমরমণীরাও তো হরিণনয়না, তাঁদের তপোবনের স্মৃতি-সুবাস যেন বেঙ্গল কেমিক্যাল আধুনিকদের কাছে নিবেদন করছে।
এর থেকে আবার কেউ পরশুরামকে হালের অতীতকৌশলী পুঁজিবাদী-ধর্মব্যবসায়ী বলে ভাববেন না। সব ব্যাদে আছে এমন নির্বিচার অপবিজ্ঞানবাদী ছিলেন না তিনি। বিরিঞ্চিবাবার ধর্মব্যবসা তিনিই ফাঁস করেছিলেন, পরে সেই ‘মহাপুরুষ’কে ছবিতে জনপ্রিয় করেন সত্যজিৎ। বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনের যুক্তিবাদী, নিয়মতান্ত্রিক, সুদর্শন, শ্রীময় পরিসর গড়ে তুলতে রাজশেখর সচেষ্ট হয়েছিলেন। এই বইয়ের গোড়ার দিকে রয়েছে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের মূল্যায়ন ‘রাজশেখর বসু’। অচিন্ত্যকুমার কল্লোল-যুগের লেখক। যৌবনের উৎসাহে কল্লোলের লেখকেরা নর-নারীর সম্পর্কের মধ্যে, শহরের বাইরে প্রান্তবাসী মানুষের জীবনে অন্য এক অপ্রাতিষ্ঠানিক রূপের অনুসন্ধান করেছিলেন। রাজশেখর বসু কিন্তু প্রতিষ্ঠানবিরোধী ছিলেন না। পরশুরামের গল্পের রায়বাহাদুর স্বয়ম্বর সভান্তে নিজের চির-পুরাতন চির-নতুন গৃহিণীকেই পুনশ্চ মাল্য অর্পণ করেছিলেন। তবে জীবনের উৎকেন্দ্রিক সমস্যাগুলিকে রাজশেখর ও পরশুরাম কেউই অস্বীকার করেননি। সহোদর মনোবিজ্ঞানী গিরীন্দ্রশেখরের সঙ্গে রাজশেখরের ভাব-বিনিময় স্বাভাবিক। প্রেমচক্রের বিচিত্র গতি, পুরুষের নারী-শরীর লাভ, যৌনতা না আহার্য কোনটি গুরুত্বপূর্ণ, মহিলা কবির কল্পিত পুরুষের প্রতি অতিশারীরিক প্রেমের কবিতা— সবই পরশুরামের লেখার বিষয়। তবে পরশুরাম নবীন-যুবাদের মতো সেই প্রেম-কল্লোলে ডুবে যাননি। তাঁর দৃষ্টি তটস্থ, নিরাসক্ত। সেই নিরাসক্তি থেকেই তিনি ঈশ্বর মানেন না, তাঁর প্রয়াণ যে সজ্ঞানে হবেন না তা বোঝেন। তাই নির্দেশ দেন, ‘সজ্ঞানে গঙ্গাপ্রাপ্তি’ যেন তাঁর ক্ষেত্রে লেখা না হয়। আশি অতিক্রম করেছিলেন তিনি। মানুষ দীর্ঘজীবী হতেই পারেন, চিরজীবী নন। আশি উত্তীর্ণ মানুষের মৃত্যু অনিবার্য। তাই বলে গিয়েছিলেন, ‘পত্রের ইতি’তে ‘ভাগ্যহীন’ না লিখতে। তাঁর প্রয়াণের পর আদ্যশ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণপত্রে ‘বিনীত’ লেখা হয়েছিল। অচিন্ত্যকুমার যখন রাজশেখর সম্বন্ধে এই সব কথা লিখছেন তখন কল্লোলের কোলাহল অতীত স্মৃতি। অচিন্ত্যকুমারেরাও বোঝেন যুক্তিবাদী, শ্রীময় বাঙালিজীবন শ্রদ্ধা করার মতো।
রাজশেখরের এই নিয়মতান্ত্রিক যুক্তিবাদী জীবনযাত্রার মডেলটি যে উনিশ শতকেই কোনও কোনও বাঙালি চিন্তক গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন তা বুঝতে পারি, তিনি তাঁর হাতে লেখা না-ছাপা ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’র ভূমিকায় লিখেছিলেন যে কোনও বিদ্যার দুই শ্রেণি— তত্ত্ববিষয়ক ও ব্যবহারবিষয়ক। তাঁর জীবনের ব্যবহারিক দিকের নানা-চিহ্ন অ্যালবামকল্প এই বইয়ের পাতায়-পাতায় ফুটে উঠেছে। মনে হয় অতীতসর্বস্ব, হিন্দুত্ববাদের এক রকম জগঝম্পের কাছে আজ যখন একদল মেরুদণ্ডহীন বাঙালি গড্ডলিকা প্রবাহবৎ আত্মসমর্পণ করছেন, তখন পরশুরামের সুদৃঢ়-ব্যবহারিক জীবন আমাদের বিকল্প আদর্শ হতে পারে।
জীবন থেকে আবার লেখায় ফিরি। এই অ্যালবাম-গ্রন্থের শেষের দিকে রয়েছে অবনীন্দ্রনাথের ‘ভূশণ্ডীর মাঠ যাত্রা’-র লিখিত খসড়ার প্রতিলিপি। অবনীন্দ্রনাথের যাত্রার অবলম্বন পরশুরামের গল্প ‘ভুশণ্ডীর মাঠে’। তাঁরা একে অপরের গুণগ্রাহী। অবনীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে রাজশেখর বলেছিলেন, ‘‘… তাঁর সাহিত্যরচনায় নিজের চারিত্রিক স্পর্শ এমন করে রেখে গেছেন যে পড়লেই তাঁর সান্নিধ্য অনুভব করা যায়।’’
১৬ মার্চ ১৯৬০ সাল। সম্ভবত জীবনের একমাত্র সাক্ষাৎকারটি দিয়েছিলেন রাজশেখর বসু। ৮০ বছরের জন্মদিনের ঠিক দু’দিন আগে। তখন তিনি সাবধানী। ক্ষোভ, অনুযোগ কিংবা বিতর্কমূলক কোনও প্রসঙ্গ আসতেই বলেছিলেন, “এসব কথা টুকবেন না। এসব কথা শুধু আপনার এবং আমার মধ্যে। এখন এই বয়সে, আমি আমার বন্ধুদের কাউকেই ক্ষুণ্ণ করতে চাই না।” তাই হয়তো এমন বিপুল বৈচিত্রময় জীবন কাটিয়েও, একাধারে রসায়নবিদ ও রসসাহিত্যিক হওয়া সত্ত্বেও, কোনও স্মৃতিকথা বা জীবনচরিত লেখেননি।
এক বার দ্বারভাঙা ঘুরে এসে চন্দ্রশেখর বসু বললেন, “ফটিকের নাম ঠিক হয়ে গেছে।” মহারাজ লক্ষ্মীশ্বর সিংহ বললেন, “তোমার দ্বিতীয় ছেলের নামও একটা শেখর হবে নাকি?” দ্বারভাঙার রাজা আশীর্বাদ করেছেন, তিনিই ছেলের শিরে আছেন, ছেলের নাম হল রাজশেখর।
রাজশেখরের ছেলেবেলাটা আর পাঁচ জনের মতো ছিল না। কিছুটা সুকুমার রায়ের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। সুকুমারের বোন পুণ্যলতা চক্রবর্তীর লেখা থেকে জানা যায়, যখনই কোনও খেলনা দেওয়া হত তাঁকে, সেটা কী ভাবে চলে, তা ঠুকে-ভেঙে দেখার চেষ্টা করতেন সুকুমার। রেকর্ডার ভেঙে দেখতে চাইতেন, কোথা থেকে আওয়াজ বেরোয়। রাজশেখরও তেমনই। যে কোনও খেলনা— টিনের ইঞ্জিন, রবারের বাঁশি, স্প্রিংয়ের লাট্টু— হাতে দেওয়া হোক না কেন, এক ঘণ্টার মধ্যে লোহা-পাথর-হাতুড়ি দিয়ে তা ভেঙে ফেলতেন। প্রশ্ন— কেন বাজে? কেন ঘোরে? এক বার কলকাতা থেকে স্প্রিংয়ের নতুন ইঞ্জিন আসার পরে মা লক্ষ্মীমণি বললেন, “দেখিস্ যেন ভাঙ্গিস না।” অমনি চার বছরের রাজশেখরের মুখ গম্ভীর, খেলনা নেবেই না! তার পরে যা খুশি করার অনুমতি মিলতেই ইঞ্জিন শতটুকরো। আর একটু বড় হতে এল আড়াই টাকার ইঞ্জিন, সেটা স্পিরিট দিয়ে চালানোর চেষ্টা হল। শোঁ শোঁ হিস হিস আওয়াজ হল, কিন্তু চলল না। একটু পরে দড়াম করে বিকট আওয়াজে সেই আড়াই টাকার বয়লার ফাটল। রাজশেখর অবশ্য আগে থেকেই বিপদ বুঝে সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছিল, “দাদা পালাও। পালাও!” আর ছোটবেলা থেকে এই সব দেখে ভাইয়ের প্রতিভায় মুগ্ধ বড়দাদা শশিশেখর লিখছেন, ‘সায়েনটিফিক মেকানিক্যাল ব্রেন’।
সপ্রতিভ মস্তিষ্কের লেখাপড়ার শুরুটাও, অর্থাৎ হাতেখড়ি, দুর্দান্ত রোমহর্ষক। দু’জন লোক একটা বড় কাগজ ধরে দাঁড়িয়ে থাকত, আর পায়জামা-চায়না কোট করা রাজশেখর পেনসিল নিয়ে ছুটে এসে কাগজটা ফুটো করে দিত। পেনসিলটা ভেঙে যেত। ব্যস, হাতেখড়ি! পকেটে অটোমেটিক পেনসিল আর হাতে লোহার স্ট্র্যাপ বা কাঠের ‘সোঁটা’, লেখাপড়ার জন্য আর কী চাই! এ হেন রাজশেখরের বয়স যখন চার, তখন সে প্রথম ফুলস্টপ দিতে শিখল।
রাজশেখর দ্বারভাঙায় আসে সাত বছর বয়সে। ছ’বছরের বড় শশিশেখর তখন বাবার বাক্স থেকে ‘বেগাম’ সিগারেট চুরি করে খায়। ভাই একটু বড় হতেই সে বলে, “ওরে ফটিক, একটা সিগারেট টান দিকি, এতে ভারি মজা!” রাজশেখরের অবশ্য বিশ্রী লাগল, একটু টেনেই ফেলে দিল। বৃদ্ধ বয়সে দিল্লিতে এক অপারেশনের সময় রাজশেখরকে অন্যমনস্ক করতে ডাক্তার সিগারেট খাওয়ার পরামর্শ দেওয়ায় তিনি বলেছিলেন, “খাই না। … আমার দাদা একবার লুকিয়ে খাইয়েছিল ছেলেবেলায়।” ডাক্তার ঠাট্টা করেছিলেন, “ইউ অট টু হ্যাভ কন্টিনিউড ইট!” প্রবল রোগযন্ত্রণাতেও হো হো করে সে কী হাসি!
নেশা ছিল না, আট বছর বয়সে আমিষ খাওয়ার পাটও চুকিয়ে দিয়েছিল। কারণ, ঘৃণা। কলে ইঁদুর পড়লে মারত না, ছেড়ে দিত। দেখেশুনে কেউ কেউ বলেছিলেন, ছেলে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নেবে। অনেক পরে ‘আমিষ নিরামিষ’ প্রবন্ধে অঘোর দত্তের বয়ানে শোনা যায়, “যদি জেরা কর কেন রুচি হয়না, তবে ঠিক উত্তর দিতে পারব না। হয়তো পাকযন্ত্রের গড়ন এমন যে আমিষ সয় না কিংবা পুষ্টির জন্য দরকার হয় না। হয়তো ছেলেবেলায় এমন পরিবেশে ছিলাম বা এমন কিছু দেখেছিলাম শুনেছিলাম বা পড়েছিলাম যার প্রভাব স্থায়ী হয়ে আছে।”
জীবনের প্রথম সাত বছর মুঙ্গের জেলার খড়্গপুরে কাটে রাজশেখরের। ১৮৮৮ সালে দ্বারভাঙা আসার পরে রাজ স্কুলে ভর্তি হন, ১৮৯৫-এ এন্ট্রান্স পাশ। সেই স্কুলে তখন তিনিই একমাত্র বাঙালি ছাত্র। ১৮৯৫ থেকে ’৯৭ দু’বছর পটনা কলেজে ফার্স্ট আর্টস পড়েন। এ বার বাঙালি সহপাঠীর সংখ্যা জনাদশেক। লেখাপড়ার সঙ্গে কিছু সাহিত্য-আলোচনারও সূত্রপাত ঘটল। ১৮৯৭-এ কলকাতা এসে প্রেসিডেন্সি কলেজের বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হলেন, দু’বছর পরে কেমিস্ট্রি এবং ফিজিক্সে সেকেন্ড ক্লাস অনার্স নিয়ে বিএ পাশ করলেন। পরের বছর কেমিস্ট্রিতে এমএ পরীক্ষায় ফার্স্ট হলেন। এর পরে আবার বিএল পড়া। কিন্তু মাত্র তিন দিন আদালতে গিয়েই মোহভঙ্গ।
জীবনের মোড় বদলাল ১৯০৩ সালে, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সঙ্গে আলাপে। বেঙ্গল কেমিক্যাল ওয়ার্কসের রসায়নবিদ বা কেমিস্টের পদে যোগ দিলেন রাজশেখর। তিন বছরের মধ্যে সংস্থার সর্বময় কর্তা হয়ে বসলেন। ১৯৩২ সালে অবসর গ্রহণ পর্যন্ত সংস্থার জন্য প্রাণপাত করে কাজ করলেন। ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে অবসর নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাই টেকনিক্যাল অ্যাডভাইসর হিসেবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সংস্থার জন্য কাজ করে গিয়েছেন।
রাজশেখরের গল্প পড়ে প্রফুল্লচন্দ্র বলেছিলেন, “এই বুড়া বয়সে তোমার গল্প পড়িয়া হাসিতে হাসিতে choked হইয়াছি।” সাহিত্যে হাসি ঝরে পড়লেও ব্যক্তিগত জীবন আমোদ-আহ্লাদে কাটত না তাঁর। ১৯৩৪ সালে রাজশেখরের জীবনে সম্ভবত সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটে যায়। ১৭ই এপ্রিল কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে মেয়ে ও জামাইয়ের মৃত্যু হয়। মনের ভিতরে গভীর আঘাত পেয়েছিলেন রাজশেখর, বাইরে তার প্রকাশ প্রকট ছিল না। লিখেছিলেন ‘সতী’ নামে এক আশ্চর্য কবিতা —
“চকিতে উঠিয়া রথে বসে সীমান্তিনী
বিদ্যুৎ-প্রতিমা সম। শিরে হানি’ কর
বলে যম — ‘কি করিলে কি করিলে দেবী!
নামো নামো এ রথ তোমার তরে নয়।”
এই ঘটনার আট বছর পরে স্ত্রীর মৃত্যু হয়। ঘটনার পরে সমবেদনা জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য। বেদনাহত রাজশেখরের প্রত্যুত্তর ছিল — “মন বলছে, নিদারুণ দুঃখ, চারিদিকে অসংখ্য চিহ্ন ছড়ানো, তার মধ্যে বাস করে স্থির থাকা যায় না। বুদ্ধি বলছে, শুধু কয়েক বছর আগে পিছে। … এবারে শোক উস্কে দেবার লোক নেই, আমার স্বভাবও কতকটা অসাড়, সেজন্য মনে হয় এই অন্তিম বয়সেও সামলাতে পারব।” চিঠির শেষে গীতার বাণীও জুড়ে দিয়েছেন, যার সারমর্ম— দুঃখে যিনি উদ্বিগ্ন হন না, বিষয়সুখে নিস্পৃহ থাকেন, যাঁর রাগ-ভয়-ক্রোধ নিবৃত্ত হয়েছে, সেই মননশীল পুরুষই স্থিতপ্রজ্ঞ।
দশ রকম বিপদের ভিতরেও দশ হাতে কাজ করে গিয়েছেন রাজশেখর। তিনি সত্যিকারের এক স্থিতপ্রজ্ঞ মানুষ। তাই হয়তো খুব নীরবে কাজ করার ক্ষমতা ছিল রাজশেখরের। তাঁর জন্মশতবর্ষে প্রকাশিত হল এমন এক কাণ্ডের ইতিবৃত্ত, যা এত কাল কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পাননি। অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষের নেতৃত্বে মানিকতলা বোমা মামলার ঘটনায় বোমার ফর্মুলা এবং যাবতীয় মালমশলা সরবরাহ করতেন রাজশেখর! ধরা পড়লে সোজা সেলুলার জেল, তবু নির্ভয় কাজ করে গিয়েছেন। এবং নীরবে। কাউকে না জানিয়েও যে দেশের কাজে ব্রতী হওয়া যায়, নাতনি আশা সে খবর দূরদর্শনে প্রকাশ না করলে কেউ কখনও জানতে পারত কি?
ব্যক্তি রাজশেখরের আরও কিছু টুকরো ছবি পাওয়া যায় যায় নাতনির ছেলে দীপংকরের বয়ানে। দীপংকরের জন্ম ১৯৪১ সালের ১৯শে জুন। অনেকে বলেন, একের পর এক কাছের মানুষকে হারানোর পরেও যে রাজশেখরের মধ্যে অনবরত প্রাণশক্তির সঞ্চার হত, তার একটা কারণ এই প্রাণোচ্ছ্বল প্রদৌহিত্র। দীপংকর লিখছেন, “রাজশেখর বসুকে সকলেই চিরকাল রাশভারী ও গোমড়ামুখোই জেনেছেন। তাঁর ছেলেমানুষী মজা দেখেছি কেবল আমরাই।”
১৪ নম্বর পার্শিবাগান লেন ছিল বসু ভাইদের পৈতৃক বাড়ি। সেখানে এক বিরাট আড্ডা বসত, মধ্যমণি মেজভাই রাজশেখর। মজলিশ প্রত্যেক দিনই বসত, তবে জমজমাট হত ছুটির দিন রবিবারে, বৈঠকখানা গমগম করে উঠত। কত নামকরা ডাক্তার, অধ্যাপক, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, শিল্পী, ইতিহাসবিদ সেখানে আসতেন। যদুনাথ সরকার, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মানুষেরা হাজির হতেন। মজলিসে চা, দাবা, তাসের সঙ্গে চলত মনস্তত্ত্ব, বিজ্ঞান, শিল্প, কাব্য, পুরাণ, ইতিহাস, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। আড্ডার একটা নামও ছিল— ‘উৎকেন্দ্র সমিতি’। প্রথমে একটা ইংরেজি নাম ছিল, পরে তা বদলে বাংলা নাম দেন রাজশেখর। রবীন্দ্রনাথের যেমন ‘বিচিত্রা’, সুকুমার রায়ের যেমন ‘মানডে ক্লাব’, রাজশেখরের তেমনই ‘উৎকেন্দ্র সমিতি’। রাজশেখর এখানে প্রাণ খুলে কথা বলার সুযোগ পেতেন, আবার লেখার প্রচুর রসদ সংগ্রহ করতেন এখান থেকেই। পরশুরামের গল্পেও এর উল্লেখ পাই— ‘বিরিঞ্চিবাবা’ গল্পের চৌদ্দ নম্বর হাবশীবাগান লেনের আড্ডা।
সৈয়দ মুজতবা আলী রাজশেখরকে লেখা এক চিঠিতে মন্তব্য করেছিলেন— “আপনার সমস্ত পাণ্ডুলিপি যদি হারিয়ে যায় আমাকে বলবেন, আমি স্মৃতি থেকে সমস্ত লিখে দোব।” তাঁর গল্পের কেমন আকর্ষণ, এ থেকেই স্পষ্ট।
এমনিতে হাসির গল্প লেখার বিপদ আছে। পাঠক ভাবেন, হেসেই কাজ শেষ, অনেক সময়ই তলিয়ে দেখেন না। কিন্তু পরশুরামের হাসির গল্পে সামাজিক মন থেকে ব্যক্তিমন সবই ধরা পড়ত ভাষার জাদুতে। ‘কজ্জলী’, ‘হনুমানের স্বপ্ন’, ‘গামানুষ জাতির কথা’, ‘ধুস্তরী মায়া’, ‘কৃষ্ণকলি’, ‘নীল তারা’, ‘আনন্দীবাঈ’, ‘চমৎকুমারী’ ইত্যাদি গল্পের ভিতরেই ছড়িয়ে আছে এমন হাজার ঐশ্বর্য। পাঠক জানেন, গল্পগুলো আস্বাদে কেমন আরাম-স্বস্তি।
প্রমথনাথ বিশী লিখছেন— “শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড গল্পটি প্রকাশিত হওয়া মাত্র (১৯২২) বাঙালী পাঠকের কান ও চোখ সজাগ হয়ে উঠল, এ আবার কে এলো? Curtain Raiser হিসাবে গল্পটি অতুলনীয়। এক গল্পেই আসর মাত।” এর পরে আর পাঠকের উৎসাহে ভাটা পরার কোনও অবকাশ দেননি রাজশেখর, থুড়ি পরশুরাম। তখন তিনি এই নামে লেখেন। ৪২ বছর বয়সে প্রথম লেখা ছাপছেন, আর তাতেই হইহই ফেলে দিচ্ছেন বাঙালি পাঠকসমাজে। আগে কিছু লিখেছেন? বিজ্ঞাপন আর ক্যাটালগ ছাড়া কিছু নয়, অন্তত ছাপার জন্য নয়। কেন লিখছেন? প্রথম গল্প সম্পর্কে বলছেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে অনেক কোম্পানি রাতারাতি গড়ে ওঠে, আবার ডুবেও যায়। অসাধু ব্যবসায়ীদের সেই ব্যঙ্গচিত্র আঁকাই তাঁর উদ্দেশ্য। আর ছদ্মনাম? আসলে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার জন্য সম্পাদক জলধর সেন গল্প দিতে বলেছিলেন, স্বনাম ব্যবহারে আপত্তি ছিল রাজশেখরের, তাই এই ব্যবস্থা। সে দিন কোনও কারণে বাড়িতে তারাচাঁদ পরশুরাম স্যাঁকরা এসেছিল। সেই নামটাই লেখায় বসিয়ে দেন। এর মধ্যে কোনও পৌরাণিক কটাক্ষ বা শ্লেষ নেই, এমনকি তা যে এর পরে স্থায়ী হতে পারে, তা-ও ভাবেননি। আসলে, সাহিত্যজগতে রাজশেখরের প্রবেশই হঠাৎ।
মনে রাখা দরকার, যে বয়সে অধিকাংশ লেখক মধ্যপর্বে পৌঁছে যান, সে বয়সে রাজশেখরের আত্মপ্রকাশ। ধীরে-সুস্থে পাঠকসমাজ তৈরি করা, তাঁদের রুচিতে অভ্যস্ত করানো, এটাই ট্র্যাডিশন। তা না, দুম করে মধ্যগগনে সূর্য উঠে পড়লে মুশকিল বইকি! অবশ্য বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ বা মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ও এমন অকস্মাৎই ছিল। তাঁদের মতো রাজশেখরও চমক হয়ে থেকে যাননি। এর পরে ‘গড্ডলিকা’ আর ‘কজ্জলী’ বইয়ে লিখেছেন এগারোখানা গল্প। আর ধীরে ধীরে শ্যামানন্দ ব্রহ্মচারী, গণ্ডেরিরাম বাটপাড়িয়া, নন্দবাবু, তারিণী কবিরাজ, কেদার চাটুজ্যে, লাটুবাবু, নাদু মল্লিকেরা বাঙালি জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে।
ও দিকে বেঙ্গল কেমিক্যালের কাজও চলছে পুরোদমে। শ্রমিক ও কারিগরদের সঙ্গে সান্নিধ্য ফুটে উঠছে কলমে। জানাচ্ছেন, তাঁদের সঙ্গে একেবারে পরিবারের মতো করে মিশতেন। ‘চমৎকুমারী’ বইয়ের ‘ভূষণ পাল’ গল্পে সে প্রসঙ্গে আসছে। তবু ‘বিচিন্তা’ প্রবন্ধগ্রন্থে লিখছেন, তাঁকে মোটেও ‘রাসায়নিক সাহিত্যিক’ বলা চলে না। দুই কাজ এক সঙ্গে সামলালেও ওই সম্বোধনে ঘোর আপত্তি। আসলে ব্যক্তি স্রষ্টার উপরে সৃষ্টি নির্ভর করে, এমন মনেই করতেন না রাজশেখর। ‘সাহিত্যিকের ব্রত’ প্রবন্ধে লিখছেন, “লেখক নিরামিষ ভোজনের পক্ষপাতী বা ফলিত জ্যোতিষে বিশ্বাসী হতে পারেন, রাজনীতির ক্ষেত্রে যোগবলের প্রভাব মানতে পারেন বা সোভিএট তন্ত্রের একান্ত অনুরাগী হতে পারেন— লেখকের রচনায় তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাসের উল্লেখ থাকতে পারে, কিন্তু রস-বিচারের সময় তার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় না।”
এমনকি নিজেকে ‘রসসাহিত্যিক’ বলতেও ঘোর আপত্তি ছিল রাজশেখরের। বলতেন, “রসসাহিত্যিক আবার কি; আমি কি হাঁড়িতে রস ফুটিয়ে তৈরী করি।”
উল্লেখ করতেই হয়, রান্নায় দারুণ আগ্রহ ছিল রাজশেখরের। চমৎকার আচার বানিয়ে বয়ামে বয়ামে সাজিয়ে রাখতেন। তবে চেনা রান্নায় রাজশেখরকে চেনা মুশকিল। তাঁর ‘সিগনেচার’ আবিষ্কারে। হেঁশেলের সুবিধের জন্য বানিয়েছিলেন তরল মশলা। শিশিতে ভরে রেখে দিতেন, প্রয়োজন মতো কাজে লাগাতেন। এক্সপেরিমেন্ট করে বানিয়েছিলেন জিলিপির পুডিং আর কুমড়োর স্যান্ডউইচ।
আরও অনেক খুঁটিনাটি কাজ জানতেন রাজশেখর। এক জীবনে এত কিছু শিখেছিলেন কী করে, সেটা অবশ্যই বিস্ময়ের। দীপংকর বলছেন, রাজশেখর নাকি নিজেকে ‘জ্যাক অব অল ট্রেড্স মাস্টার অব নান’ বলতেন। আর দীপংকর সেটা বদলে করছেন— ‘জ্যাক অব অল ট্রেড্স মাস্টার অব ফিউ’। জানেন সব কিছু এবং পারেনও অনেক কিছু। কী কী পারতেন? গোনার জন্য তৈরি করেছিলেন অ্যাবাকাস। বই বাঁধাতে পারতেন, কাজের জন্য ফাইল নিজেই বানিয়ে নিতেন। নিজে হাতে সেলাই করে নিতেন ক্যাম্বিসের ব্যাগ। নিজের পোশাক নিজে কাচতেন। দাড়ি কামিয়ে ব্লেড রোদে দিতেন। যে সাদা খদ্দরের গলাবন্ধ কোট আর ধুতি পরে বাইরে বেরোতেন, তাতে অনেক পকেট থাকত, চশমা-পেনসিল-ইরেজ়ার-ছুরি রাখার ব্যবস্থা।
এত কাজ করতে গেলে নিজেকে শৃঙ্খলিত করাও জরুরি। কঠিন নিয়মে জীবনযাপন বেঁধেছিলেন রাজশেখর। কোথাও বেড়াতে গেলে রেলের কামরায় রাজশেখরের করে দেওয়া ছক অনুযায়ী এক ভৃত্য সব জিনিসপত্র সাজিয়ে দিত। সঙ্গে থাকত ছোট মই, মেরামতির প্রয়োজন হলে নিজেই সারতেন। খুব খুঁতখুঁতেও ছিলেন। দরজা-জানালার
রং হত শুকনো পাতার মতো, চুনকামে নীল রং ব্যবহার করতেন না। তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী সেজে উঠেছিল বকুলবাগানের বাড়ি।
শেষ বয়সে, ১০ই জানুয়ারি ১৯৬০ সালে, এক সংবর্ধনাসভায় রাজশেখর বলেছিলেন — “আসলে আমি আধা মিস্ত্রী, আধা কেরানী। অভিধান তৈরী আর পরিভাষা নিয়ে নাড়াচাড়া মিস্ত্রীর কাজ, রামায়ণ মহাভারত অনুবাদ কেরানীর কাজ।” আর নিজের
গল্প লেখা নিয়ে বলেছিলেন, “তাঁর অভিজ্ঞতার পুঁজি বেশি নয়।” কী ভাবে হল সে সব কাজ?
চলিতভাষা ব্যবহার করে এবং নানা জটিলতা ও দুরূহতা পরিহার করে রামায়ণ-কাহিনিকে তিনি যেন প্রায় উপন্যাসের মতো আকর্ষণীয় করে তুলেছিলেন। তিন বছর পরে হাত দেন আরও দুরূহ মহাভারত অনুবাদের কাজে। বিপুলায়তন পুরাণ-কাব্যের নির্যাস অটুট রেখে সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করেন রাজশেখর।
অন্য দিকে বাংলা বানানের সামঞ্জস্য রক্ষার্থে একটি অভিধান তৈরি করার জন্য ভাষা-উৎসাহী ও ভাষা-প্রাজ্ঞ রাজশেখরকে অনুরোধ করেন ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। একা এ কাজ সম্ভব নয়, তাই সহযোগী হন সুরেশচন্দ্র মজুমদার ও শৈলেন্দ্রকৃষ্ণ লাহা। যে সমস্ত শব্দের একাধিক বানান আছে, তার তালিকা তৈরি করেন। বানান নির্বাচনের মতামত চেয়ে তালিকা পাঠিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, যোগেশ বিদ্যানিধি, প্রমথ চৌধুরী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর কাছে। ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয় ‘চলন্তিকা’, প্রথম মুদ্রণে শব্দের তালিকা ২৬০০০, পরে ৩০০০০। সব সময়ে ব্যবহারের উপযোগী এই অভিধান বাঙালির ঘরে ঘরে শোভা পেতে লাগল। স্বীকৃতি এল রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে— “এতদিন পরে বাঙলা ভাষার অভিধান পাওয়া গেল।”
‘চলন্তিকা’র পরিশিষ্ট অংশে বিষয় অনুযায়ী প্রচুর পরিভাষা সাজিয়েছিলেন রাজশেখর। যেমন বিজ্ঞান সংক্রান্ত পরিভাষার তালিকায় ঠাঁই পেয়েছিল ‘পাটীগণিত’, ‘বীজগণিত’, ‘বলবিদ্যা’, ‘পদার্থবিদ্যা’ ইত্যাদি। তাঁর সেই ভূমিকা আরও বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল ১৯৩৪ সালে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিভাষা সমিতিতে। রাজশেখর ছিলেন সভাপতি। সদস্য ছিলেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, দুর্গামোহন ভট্টাচার্য, অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ, প্রমথনাথ বিশী প্রমুখ।
রাজশেখরের কাছেই শোনা, কেউ নাকি ‘দি পোলিস ওয়্যার পেট্রলিং দি রোডস’-এর বাংলা করেছিলেন ‘পুলিশ রাস্তায় পেট্রল ছিটাইতেছিল।’ সেই সূত্রেই বাংলা পরিভাষার প্রয়োজনীয়তার কথা বারবার বলতেন তিনি। তাঁর মতে, শব্দগুলি প্রথম প্রথম একটু কানে লাগলেও পরে দিব্যি চলতে থাকে। রেডিয়ো-অ্যাক্টিভের বাংলা ‘তেজস্ক্রিয়’, সে কালে চলত না, এখন নির্বিবাদে চলে। ধ্রুপদী ভাষা থেকে শব্দ আহরণ করে নতুন শব্দ গঠন করতে হবে। এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের অনেকখানি দায়িত্ব আছে বলে মনে করতেন রাজশেখর। জনতা বই পড়ে যতটা না ভাষা শেখে, তার চেয়ে অনেক বেশি এবং তাড়াতাড়ি শেখে খবরের কাগজ থেকে। সংবাদপত্র রোজ পড়া হচ্ছে, পাঠকসংখ্যাও অনেক বিস্তৃত, অতএব জনতার সঙ্গে যোগাযোগও। রাজশেখর বলছেন, “ভুল পরিভাষার প্রচারে সাংবাদিকরাই বেশি দায়ী।” কিছু ভুল ধরিয়েও দিয়েছেন তিনি। ‘আয়রন ওর’ কখনওই ‘আকরিক লৌহ’ নয়, ‘লৌহ আকরিক’। ‘পেট্রোলিয়াম ফাউন্ড’ বললে বাংলায় লেখা হয় ‘পেট্রল পাওয়া গিয়েছে’, কিন্তু তা ভুল। মাটির নীচে পেট্রল পাওয়া সম্ভব নয়, সেখানে কেবল পেট্রোলিয়ামই পাওয়া যায়। এক বিখ্যাত ইংরেজি সংবাদপত্রে সাংবাদিকদের ভুল সংশোধনের জন্য ভাষাবিদদের নিয়োগ করা হত বলে শোনা যায়। তাঁদের নির্দেশ মতো শব্দচয়ন করা হত। বাংলাতেও সেই ব্যবস্থার কথা বলেছিলেন রাজশেখর।
বেঙ্গল কেমিক্যালে যোগ দেওয়ার পরে নিজের এই আগ্রহকে খুব কার্যকরী ভাবে ব্যবহার করেছিলেন রসায়নবিদ রাজশেখর। তাতে রসায়নের কী উপকার হয়েছিল, সে হিসেব বিজ্ঞানীরা করবেন। কিন্তু বাংলা ভাষার যে দুর্দান্ত একটা লাভ হয়েছিল, এ নিয়ে সন্দেহ নেই। তৎসম, তদ্ভব, ইংরেজি ও বাংলা মিশিয়ে জিনিসের নিত্যনতুন নামকরণ করতেন তিনি। ‘কীটনাশক পদার্থ’ হল ‘মারকীট’, ‘সুগন্ধ-সার’ বা ‘এসেন্স’ হল ‘কনসেন্ট’, ‘ডায়াবেটিসের ওষুধ’ হল ‘ডায়াবিনল’, ‘কাশির ওষুধ’ হল ‘কাসাবিন’, ‘স্নায়ুস্নিগ্ধকারী ওষুধ’ হল ‘কোয়াটিন’, ‘আইওডিন প্রলেপ বা মলম’ হল ‘আইডোলেপ’, ‘বোরিক মলম’ হল ‘বোরোলেপ’। এ রকম অসংখ্য ওষুধ, রাসায়নিক ও প্রসাধনী শুধু কাজের গুণে নয়, নামের গুণেও জনপ্রিয় ছিল। এগুলি যখন বিজ্ঞাপন হিসেবে পত্রিকার পাতায় বেরোত, তখন সেই বয়ানও নিজে হাতে লিখতেন রাজশেখর। অফিসের খাতায় সইও করতেন বাংলায়। ‘ডেসপ্যাচ স্লিপ’কে লিখতেন ‘যা-পত্র’, ‘ভিজিটিং অর্ডার স্লিপ’কে ‘দ্র. পত্র’।
রাজশেখরের কৃতিত্ব, অসংখ্য পরিভাষা সৃষ্টি করা। তবে তাঁর নিজের জন্যও একটি নাম জুটেছিল, সৌজন্যে সুনীতিকুমার— ‘সুবুদ্ধিবিলাস’। সুরুচি, শৃঙ্খলা আর বুদ্ধির এক আশ্চর্য সমাবেশ ঘটেছিল এই মানুষটির মধ্যে।
(তথ্যসূত্র:
১- পরশুরামের চতুঃরঙ্গ: অন্য রচনা-অনুপ্রাণিত পরশুরামের চারটি ব্যঙ্গ গল্পের সমীক্ষা, দীপক গোস্বামী, এম. সি. সরকার অ্যাণ্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড (২০১৮)।
২- গড্ডলিকা-প্রবাহ: পরশুরাম বিচিত্রিত, যতীন্দ্রকুমার সেন চিত্রাঙ্কিত, বিংশ শতাব্দী (২০১৮)।
৩- পরশুরামের গল্প: দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়, উজ্জ্বল গঙ্গোপাধ্যায়, পুস্তক বিপণি (২০১১)।
৪- পরশুরামের গল্প: জীবনদৃষ্টি ও শিল্পরূপ, সঞ্জীব দাস, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ (২০১২)।
৫- পরশুরামের চরিত্রশালা, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, অবভাস (২০১১)।
৬- আনন্দবাজার পত্রিকা: ৯ই ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সাল, ২৬শে অক্টোবর ও ৭ই ডিসেম্বর ২০১৯ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত