বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী রামচন্দ্র গুহ ক’দিন আগে একটা দামি কথা বলেছেন – ‘মেরুদণ্ড থাকলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও শরদ পাওয়ারের মত নতুন দল গঠন করতেন জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া।’ আজকের রাজনীতিতে এই মেরুদণ্ডেরই খুব অভাব। খোদ কংগ্রেসেই কি আজ মেরুদণ্ডী নেতা খুব একটা পাওয়া যাবে? গতানুগতিকতা এবং সুযোগ সন্ধানে ব্যস্ত এখনকার রাজনীতি ঝোপ বুঝে কোপ মারতেই অভ্যস্ত। যেমন সিন্ধিয়া মারলেন। সেখানে মেরুদণ্ডের খুব একটা দরকার হয় না, স্রোতে গা ভাসালেই চলে। কর্তাভজা সম্প্রদায়ের লোক হওয়াই সেখানে মোক্ষ লাভের পথ। এখন লোকে দল তখনই ছাড়েন যখন দলে তিনি খুব একটা পাত্তা পাচ্ছেন না এবং তার প্রাপ্তিযোগের সম্ভাবনা খুবই কম। আদর্শকে ভালবেসে বা অন্যায়ের প্রতিবাদে দল ছাড়ার ঘটনা আজকের রাজনীতিতে খুব একটা ঘটেনা বললেই চলে।
এখন অন্যায়ের প্রতিবাদে দল ছাড়া কঠিন ব্যাপার এবং আরও কঠিন হল দল ছেড়ে নতুন দল গঠন করে সফল হওয়া। অনেক দুঁদে রাজনীতিবিদও একাজটা করতে ব্যর্থ হন। যেমন প্রণববাবু কিংবা সৈফুদ্দিন চৌধুরী। অথচ পাণ্ডিত্য, যোগাযোগ, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, সাংগঠনিক দক্ষতা এই দুজনের কিন্তু কম ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এরা পারেননি। আমার মনে হয় এর একটা বড় কারণ হল এদের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত ‘করেই ছাড়বো’ গোছের জেদটাই কম ছিল। প্রণববাবু কিংবা সৈফুদ্দিনদের সঙ্গে তার সবচেয়ে বড় তফাৎ হল কংগ্রেস ছাড়ার পর তিনি বিভিন্ন ইস্যুতে একের পর এক আন্দোলন সংগঠিত করেছেন। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে আমরা সেই লড়াইয়ের একটা চূড়ান্ত চেহারা দেখেছি। উপরোক্ত দু’জন তা করতে পারেননি। আর জ্যোতিরাদিত্য তো প্রথম থেকেই সরাসরি ক্ষমতার কোলে গিয়ে বসেছেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি শরদ পাওয়ারের সঙ্গে এক জায়গায় বসাতে চাই না। দীর্ঘদিনের সাংবাদিক জীবনে আমি বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই দেখে আসছি। সে এক বিস্ময়কর যাত্রা! কালীঘাটের যে জায়গা থেকে তিনি উঠে এসেছেন শুধু প্রদেশ কংগ্রেস কেন, কংগ্রেসের কোন সর্ব ভারতীয় নেতাই সে জায়গা থেকে উঠে আসেননি। শুরুর দিকে কোনরকম পৃষ্ঠপোষকতা পাননি তিনি। যে সব প্রবীণ কংগ্রেস নেতারা এখন তার সঙ্গে আছেন তারাই একসময় তাকে ‘পাগলি’ ইত্যাদি বলে চূড়ান্ত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন। আনন্দবাজারে থাকাকালীন আমি যখন খবরের সূত্রে তার কাছে যেতাম তখন আমিও তাদের ব্যঙ্গ বিদ্রূপের শিকার হতাম। ভাবতে ভাল লাগে তারা এখন চমৎকার নিজেদের পাল্টে ফেলেছেন! তার বিরুদ্ধে লাগাতার কুৎসা চালিয়ে গেছেন বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। কিন্তু সাধারণ কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে তখনই তার প্রবল জনপ্রিয়তা ছিল। সিপিএমের হাতে অত্যাচারিত কংগ্রেস কর্মী ও সমর্থকদের পাশে সবার আগে গিয়ে দাঁড়াতেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর কাউকে তখন তার ধারেকাছে দেখা যায়নি। সিপিএমের সঙ্গে তলায় তলায় সমঝোতা করে চলা কংগ্রেসে থেকে অত্যাচারিত কর্মীদের পাশে দাঁড়ানো যাচ্ছেনা বলেই তিনি দল ছেড়ে নতুন দল গড়তে বাধ্য হন।
আজকে দেখি কত সহজে লোকে সিন্ধিয়ার মত এক দল থেকে আরেক দলে চলে যাচ্ছেন। এই ব্যাপারটা আমার মোটেই ভাল লাগেনা। আদর্শের প্রতি মানুষের আনুগত্য কী এতই কম! বাংলায় দল ছেড়ে বেরিয়ে এককভাবে নতুন দল গড়ে সাফল্য পাওয়া বেশ কঠিন। আর কঠিন রাজ্যে ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকা সিপিএমের মত একটা রেজিমেন্টেড পার্টিকে গোহারান হারিয়ে ক্ষমতা দখল করা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তা করে দেখিয়েছেন। শুরুতে কোন বুদ্ধিজীবী, মিডিয়াও তার পাশে ছিলনা। একশ্রেণীর গণমাধ্যমে তিনি ছিলেন শুধুই ব্যঙ্গের খোরাক। বস্তুত সিপিএমের বিরুদ্ধে রাজ্যের মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ এবং অনুগত কর্মী বাহিনী ছাড়া তার আর কিছুই ছিল না। প্রথম দিকে রাজ্য কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা তার সঙ্গে আসেননি, বিরাট কোন আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা তার ছিল না। ঘৃণা, বিদ্বেষ, লাগামছাড়া কুৎসা এবং বারবার শারীরিক আক্রমণ চলেছে তার ওপর।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশের আর কোন রাজনৈতিক নেতা বা নেত্রীর ওপর এত লাগাতার শারীরিক আক্রমণ হয়নি। এমনভাবে কুৎসা ও চরিত্রহননও করা হয়নি আর কোন নেতাকে। আজ ছবিটা বদলেছে কিন্তু সেসময়ে বাংলা তথা ভারতের মিডিয়ার কোন আনুকূল্য তিনি পাননি। লড়াইয়ের মধ্যে দিয়েই তিনি এগিয়েছেন, বেড়েছে দল। জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া বা রাহুল গান্ধীর মত সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো রাজনীতিবিদদের সঙ্গে তার কোন তুলনাই চলে না।
একটা দল থেকে বেরিয়ে নতুন দল গড়ে সফল হওয়ার ব্যাপারটা শুধু বাংলা কেন, ভারতের রাজনীতিতেও বেশি নেই। বাংলার আজকের রাজনৈতিক নেতাদের প্রায় কেউই পুরনো দল ছেড়ে বেরিয়ে নতুন দল গড়ে ক্ষমতায় আসা নেতা নন। সেদিক থেকে সাফল্য, সংগ্রাম, ত্যাগ, নিষ্ঠা সবকিছুতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু বাংলা কেন ভারতের রাজনীতিতে একটা ব্যতিক্রম। মেরুদণ্ডের জোর তার বরাবরই বেশি। অমেরুদণ্ডীদের ভিড়ে তাই তাকে আলাদা করে চেনা যায়।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত