পুরোহিত বললেই তথাকথিত, চিরাচরিতভাবে আমাদের সমাজ বুঝে নেয়, তিনি পুরুষ ছাড়া মহিলা হতেই পারেন না। আর যদিও বা হন, তাহলে অবশ্যই পুরোহিতের পূর্বে লিঙ্গ বোঝানোর জন্যে ‘মহিলা’ প্রয়োগ করতেই হবে। ‘মহিলা পুরোহিত’।একবিংশ শতাব্দীর মাটিতে দাঁড়িয়েও আমরা ভুলতে পারলাম না কর্ম নারী-পুরুষ দেখে হয় না। নারী-পুরুষের বিভাজন অহরহ কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের মনে কাজ করে চলেছে। সমাজের বিকৃত এই ট্যাবু ভাঙার গল্প নিয়েই মুক্তি পেল অরিত্র মুখোপাধ্যায়ের প্রথম সিনেমা ‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি’। অভিনয় করেছেন ঋতাভরী, সোমা চক্রবর্তী, ,সোহম মজুমদার, মানসী সিংহ, শুভাশিস মুখোপাধ্যায় এবং অম্বরীশ ভট্টাচার্য।
এ ছবির কেন্দ্র চরিত্র ‘শবরী’ নামের এক কন্যা। শর্বরী দত্ত, পুরুষদের পোশাক বানিয়ে যিনি তাক লাগিয়েছিলেন, তিনি তো ‘শর্বরী’। এ কন্যার নাম ‘শবরী’ হ্যাঁ, ‘শবরীর প্রতীক্ষা’। এই শবরীকেও বুক পাষাণ করে অপেক্ষা করতে হয় তার অন্তরের সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। সামাজিক সত্য আর আন্তরিক সত্যের মধ্যে যে কোনও রকমই মিল থাকতে পারে না, তা জেনেও, আমরা মুখ বুজে আন্তরিক সত্যকে চেপে রেখে, মিথ্যা সামাজিক সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে করতে তিল তিল করে ক্ষয়ে যাই। তার পর একদিন সমস্ত সত্য বৈদ্যুতিক চুল্লির ভোল্টেজে ভষ্মীভূত।
মেয়েরা সব পারে। সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে যেমন দায়িত্ব সামলাতে পারে তেমনই নারায়ণের পুজো থেকে কন্যাদান সবই করতে পারে। এমনই ছক ভাঙার গল্প বলছে ব্রহ্মা জানে গোপন কম্মটি। ছোট থেকেই যে কোনও মেয়েকে শেখানো হয়, ঋতুমতী অবস্থায় ঠাকুর ঘরে ঢুকবে না। ঠাকুর ছোঁবে না। কারণ তখন নারীদেহ অশুচি! যে দেহে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয় তা আবার কখনও অশুদ্ধ হতে পারে না। সারদা দেবী মাসিক চলাকালীন ভবতারিণীর ভোগ রান্না করতেন। তা কিন্তু রামকৃষ্ণের অমতে নয়। রামকৃষ্ণদেব চাইতেন বলেই তিনি রান্না করতেন ঠাকুরের জন্য। সাম্প্রতিক অতীতে শবরীমালা নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছে সেকথা কারোর অজানা নয়।
গাঙ্গুলি আমাদের ওভার বাউন্ডারি, আর গঙ্গোপাধ্যায় আমাদের দেখাল বাউন্ডারির মধ্যেই বাউন্সার। এক পুরুষের হাত দিয়েই বেরুলোনারী সুরক্ষার এই ছবি, অরিত্রকে কি আমরা ‘প্যাড ম্যান’ বলব? না, তা বলব না, কারণ ছবির শেষ দৃশ্যটি অতীব চমত্কার, স্যানিটারি ন্যাপকিনের উপরে থাকা স্টিকারটি (যেটা খুলে, ‘সিল’ ভাঙতে হয় ‘ন্যাপকিন’-এর), সেই স্টিকার মেঝে থেকে উড়ে যায় দিগন্তে— অনেক উঁচুতে। এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়…
মাসের পাঁচটি দিনকে লাল গোলে চিহ্নিত না করে হার্ট সাইন বা লাভ সাইনে চিহ্নিত করা যায়, সেটা শেখালেন অরিত্র, থুড়ি শবরী। ‘মাসিক’ বা ‘পিরিয়ড’-এর দিনগুলো যদি ‘লাভ’ চিহ্নিত হতে পারে, তা হলে মনে মনে ওই পাঁচদিন হটব্যাগকে দূরে রাখতে পারবে অনেক মেয়েই। ঋতুপর্ণর ‘চোখের বালি’ সিনেমায়, বিনোদিনী ঐশ্বর্যর যখন থোলো রক্ত ছলকে পড়ে রান্নাঘরের মেঝেয়। রবীন্দ্রনাথ লেখেননি, ঋতুপর্ণ দেখিয়েছেন রক্তাক্ত সত্যকে। বিধবার পিরিয়ড হওয়াটাও সে সময়ে অন্যায় ছিল, সাদা থানে লাল রক্ত— বিরক্ত।
অরিত্র তাঁর প্রথম ছবি ‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি’-তে সেই অবচেন বিরক্তি, ভীতির থেকে আলোয় আনলেন আমাদের। শান্তিনিকেতনে বয়ঃসন্ধি কাটানো অরিত্র-র ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত গানে, বাঁশরীর সুরে যে আবহ রচনা করেছে, ব্রিটিশ রাজশক্তির কৌলিন্য রায় বাহাদুর বাড়িগুলো যে এখনও বাতাসীপুরের মতো গ্রামেগঞ্জে প্রাচীন স্থাপত্য বহন করে চলেছে গোলা-পায়রার নিঝুম বকমবকমে— সে সব মনে করিয়ে দেয়, সাদাকালো যুগের ছবির গায়ে আজকের ছবিটা যেন লাল সিঁদুরের টিপের মতো নতুনের আগমন।