রাত্রি তার ঘন কালো পক্ষ বিস্তার করে দিয়েছে বিরাট এ কলকাতা মহানগরীর বুকে। কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি। জনহীন রাস্তা যেন ঘুমন্ত অজগরের মতো গা এলিয়ে পড়ে আছে। সাড়া নেই, শব্দ নেই। … কিরীটী একা একা পথ অতিক্রম করে চলেছে। পকেটের মধ্যে কালো পাথরের ড্রাগনটি। আশ্চর্য, কিরীটীর যেন মনে হয়, নিঃশব্দে কে বুঝি আসছে কিরীটির পিছু পিছু! যে আসছে তার পায়ের শব্দ পাওয়া যায় না কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যায়, সে আসছে।
সাদাকালো পৃষ্ঠায় ছমছমে আলোআঁধারির এমন কত কত নিঝুম রাতের রহস্য। শিরদাঁড়ায় কাঁপন ধরিয়ে বুঁদ করে ফেলত। দিনের দিনের দিন। দুপুরের পর দুপুর। রাতের পর রাত।
কিরীটী। কিরীটী রায়। নামটা বলা মাত্রই বইয়ের পাতা ফুঁড়ে উঠে আসে ‘ইরেজিস্টেবল’ এক পুরুষ। নীহাররঞ্জন গুপ্তের লেখনি-সন্তান। সত্যসন্ধানী।
চেহারার বর্ণনা — ‘‘প্রায় সাড়ে ছ-ফুট লম্বা। গৌরবর্ণ। মজবুত হাড়ের ফ্রেমে বলিষ্ঠ এক পৌরুষ। মাথা ভর্তি ব্যাকব্রাশ করা কোঁকড়ানো চুল। চোখে পুরু লেন্সের কালো সেলুলয়েড চশমা। নিখুঁতভাবে কামানো দাড়িগোঁফ। ঝকঝকে মুখ। মুখে হাসি যেন লেগেই আছে। আমুদে, সদানন্দ। এবং প্রখর রসবোধ। অসাধারণ বাকচাতুর্য। কিন্তু মিতবাক।’’
এ-ই কিরীটী রায়। যে নামের সঙ্গে ওই চরিত্র এক অনিবার্য আকর্ষণে দুর্দান্ত শরীরী আর জীবন্ত। অসম্ভব উজ্জ্বল তার পুরুষালি উপস্থিতি। প্রত্যেকটা জায়গায়। বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দার এমন হাজিরা বোধহয় সেই প্রথম বার।
বইয়ের কুচকুচে কালো প্রচ্ছদ। তাতে অদ্ভুত এক হলদেটে আঁচড়ে পুরুষমুখের সাইড ফেসের সিল্যুট। মাথায় সাহেবি টুপি একটু বাঁকানো। টুপির হুডে কপালের অর্ধেকটা ঢাকা। ঠোঁটে জ্বলন্ত চুরুট। তার থেকে ধোঁয়া উঠছে।
নিশুতি রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে এসে দাঁড়ায় কালো অ্যাম্বাসাডর। দরজা খুলে ততোধিক নিঃশব্দে নেমে আসে আগাপাস্তলা সাহেবি পোশাকের এই পুরুষ। বডি ল্যাঙ্গুয়েজে মার্জারি ক্ষিপ্রতা। দৃঢ় পা ফেলে প্রবল আত্মবিশ্বাসে সে এগিয়ে যায় নিশানার দিকে। অটল লক্ষ্যভেদ।
সত্তর-আশির দশকের সদ্য ফোটা কিশোরী থেকে প্রায় সব যুবতীর ‘হার্টথ্রব’ এই কিরীটী রায়। আর কিশোর-যুবকদের কাছে তিনি যেন লৌহমানব!
কিরীটী রায় বিবাহিত। তাঁর স্ত্রী কৃষ্ণা। টালিগঞ্জের বাড়ির সংসারে আছে ড্রাইভার হীরা সিং, পরিচালক জংলী। প্রায় সব সময় সঙ্গে থাকে সহকারী সুব্রত। ঘোরতর সংসারী। কিন্তু রক্তমাংসের ভেতরে ঢুকে প্রবলপ্রতাপান্বিত এই কিরীটী অবলীলায় শরীরমনের দখল নিয়েছে বছরের পর বছর। চুম্বক টানে আবিষ্ট করে তার পুরো অধিকার কায়েম করেছে। অলস সময়ে ক্যাজুয়াল ড্রেসে হয় ড্রেসিং-গাউন নয়তো, ‘‘কিমানো পরে পাইপে ধূমপান করতে করতে মাঝেমাঝেই তার টালিগঞ্জের বাড়ির পোর্টিকোতে এসে’’ দাঁড়ায় সে, আর কেজো সময়ের কিরীটী মানেই কালো অ্যাম্বাসাডর, হাভানা চুরুট আর কালো পানামা হ্যাট …!
সময়ের ফেরে দৃশ্যপট বদলে বদলে যেত শুধু। কিন্তু কিরীটীকে ঘিরে মৌতাত যেন কিছুতেই পাল্টানোর নয়।
কেমন করে ‘জন্ম’ হল এমন প্রবল পরাক্রম ‘পুরুষ’ কিরীটী রায়ের? কেনই’বা?
নীহাররঞ্জন বলছেন, ‘‘আমি অনেক রহস্যকাহিনি রচনা করেছি। এর মূলে আছে আমার জীবনে দেখা দুটি ঘটনা। যা, বিশেষ করে দ্বিতীয়টি, মনকে নাড়া দিয়েছিল সাঙ্ঘাতিক ভাবে। এবং সেটা আমার প্রথম যৌবনকাল।’’
পটভূমি তাঁরই পাড়ার এক পোড়ো জমিদারবাড়ি। যেখানে এক দুপুরে অন্তঃস্বত্ত্বা বিধবা বৌদিকে গুলি করে খুন করে যক্ষারোগ-আক্রান্ত তাঁর রুগ্ণ সুপুরুষ দেওর। সঙ্গে সঙ্গে ওই বন্দুকেই শেষ করে দেয় নিজেকে।
লেখক বলছেন, ‘‘ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়ালাম। শ্বেতপাথরের মেঝের ওপর পড়ে আছে দুটি দেহ। রক্ত চাপ চাপ জমাট বেঁধে আছে। কে বুঝি সাদা পাথরের মেঝের ওপর মুঠো মুঠো রক্তগোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে দিয়েছে। পাশে পড়ে দোনলা বন্দুকটা।
আর প্রথম ঘটনাটি তাঁর বাল্যকালের। তাঁরই বিচারে, ‘‘সেটি মর্মন্তুদ হলেও তার মধ্যে তেমন রহস্যের ইশারা ছিল না। সেটি ছিল গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা।’’
দুটি ঘটনারই কেন্দ্রে অসামান্যা রপসী দুই যুবতী নারী, অবৈধ ত্রিকোণ প্রেম, পরিণতিতে অস্বাভাবিক মৃত্যু। নীহাররঞ্জনের কথায়, ‘‘কেউ জানতেও পারল না মেয়েটি তার গোপন ভালবাসার জন্যই শেষপর্যন্ত আত্মহত্যা করেছিল।’’
সকলের অজ্ঞাত সেই মৃত্যুর কারণ বহুদিন তাঁর মনের মধ্যে প্রকাশের তাগিদে তাঁকে পীড়ন করেছে। ‘‘এবং সেই তাগিদই পরবর্তী কালে আমার প্রথম যৌবনে জমিদারিবাড়ির নিষ্ঠুর হত্যা-রহস্যের সঙ্গে একাকার হয়ে আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল ‘জোড়া খুন’ রহস্য কাহিনি রচনা করতে।’’
সেই যে বীজ পোঁতা হয়েছিল, তার থেকেই মগজের কোষে জন্ম নিয়েছিল কিরীটী রায়ের ভ্রূণ।
কিরীটী-জন্মের পূর্বশর্ত হিসেবে যদি কাজ করে থাকে এ দু’টি কাহিনি, দ্বিতীয় কারণটি অবশ্যই গোয়েন্দা কাহিনি-লেখক পাঁচকড়ি দে।
নীহাররঞ্জন নিজে জানিয়েছেন, ‘‘ইতিপূর্বে পাঁচকড়ি দে’র খানকয়েক রহস্য উপন্যাস পড়েও ক্রাইমজগতের সঙ্গে কিছুটা পরিচয় ঘটেছিল। কেবল পরিচয়ই নয়, মনের মধ্যে কিছুটা রোমাঞ্চও সৃষ্টি করেছিল। … গোয়েন্দা-চরিত্রটির মধ্যে রীতিমতো যেন একটা রোমাঞ্চকর আকর্ষণ অনুভব করতাম।’’
পাঁচকড়ি দে। ঊনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের গোড়ার দিক জুড়ে গোয়েন্দাকাহিনি রচনায় দাপটে আধিপত্য করে গেছেন।
বাংলা সাহিত্যের প্রথম রহস্য উপন্যাস লেখক হিসেবে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের নাম করা হয়। পুলিশ বিভাগে কাজ করতেন, অপরাধ জগৎ নিয়ে জানাবোঝা ছিল তাঁর অগাধ। তবু বাংলায় রহস্যরোমাঞ্চ লেখার গোড়ার পর্বে তাঁকে টেক্কা দিয়েছেন পাঁচকড়ি। তাঁর ‘হত্যাকারী কে?’, ‘নীলবসনা’ সেই সময়ে ঘোরতর আলোড়ন ফেলে দেওয়া কাহিনি।
পাঁচকড়ি দে’র যে গোয়েন্দা-চরিত্রটির মধ্যে নীহাররঞ্জন ‘রীতিমতো আকর্ষণ’ অনুভব করতেন, সেই ডিটেকটিভ-চরিত্র দেবেন্দ্রবিজয়— ধূতিপাঞ্জাবি, পাম্পশ্যু, অ্যালবা়ট কাটা চুলের শক্ত শারীরিক কাঠামোর এক নিপাট বাঙালি। যে আড়ি পেতে অপরাধীদের কথা শোনে। ছ্যাকরা গাড়িতে করে তাদের তাড়া করে। তার চরম প্রতিপক্ষ পাপিষ্ঠা জুলিয়া। আর তার গুরু অরিন্দমবাবু। যে অনেকটা শার্লক হোমস-এর দাদার মতো। রাস্তাঘাটে বেশি বেরোয় না। বাড়িতে বসে রহস্যের ‘ডিটেকশন’ করে।
এই পাঁচকড়ি দে’র দেবেন্দ্রবিজয় এক ইউনিক বৈশিষ্ট্য রাখে তাঁর ‘বিষম বৈসূচন’ কাহিনিতে। বৈসূচন— অর্থাৎ নারীবেশে ছলনাকারী পুরুষ।
সেই সময় এমনই জনপ্রিয় হয়েছিল তাঁর গোয়েন্দাকাহিনি, যে তখনকার এক বিখ্যাত সাহিত্যপত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, যোগেশচন্দ্র বাগলদের মতন দিকপালদের সঙ্গে পাঁচকড়ি দে নামটি বড় ‘পয়েন্ট সাইজ’-এ ‘বিশেষ আকর্ষণ’ হিসেবে বিজ্ঞাপন করা হয়েছিল।
পাঁচকড়িতে প্রচণ্ড আকর্ষিত হলেও কিন্তু নীহাররঞ্জনের কিরীটী এই ঘরানা থেকে একেবারেই আলাদা। দেবেন্দ্রবিজয়ের নিপাট বাঙালি চেহারা বা স্বভাবের সঙ্গে কোথাও কিরীটীর অণুমাত্র মিল নেই।
তেমন মিল নেই অন্য কোনও গোয়েন্দাজুটির সঙ্গে। সে হেমেন্দ্রকুমার রায়ের জয়ন্ত-মানিক, সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা-তোপসে, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ-অজিত— যেই হোন না কেন! এদের সক্কলের থেকে এক্কেবারে অন্যরকম কিরীটি-সুব্রত। মধ্যবিত্ত ঘেরাটোপের বাইরে বাঁচা দু’জন মানুষ। এদের আছে সব সময়ের গাড়ি, আছে হোটেল-বিলাস। অ্যাসিসটেন্ট সুব্রত তো এক-এক সময় প্রায় নায়কোচিত।
এ প্রসঙ্গে পরে ফিরছি। তার আগে কিরীটী-কাহিনির অন্য আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের কথা বলে নিই। —গোয়েন্দাকাহিনির ভেতরে যৌন-আবেগ, রিরংসা, প্রচণ্ডতা মিশিয়ে নীহাররঞ্জন একেবারেই দলছুট করে দিয়েছিলেন কিরীটী-রহস্যরোমাঞ্চর কাহিনিগুলোক। বলা যেতে পারে, বাংলার এই কাহিনি-ধারাকে অনেকটা ‘এ’ মার্কা করেছেন নীহাররঞ্জনই।
কেমন? নমুনা দেওয়া যাক।
‘আলোক আঁধারে’। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পিকনিক। তার মাঝেই খুন হল দলের মক্ষিরানি মিত্রাণী। পোস্টমর্টেম করে পুলিশ জানতে পারল, কেবল খুন নয়, তার আগে তাঁকে ধর্ষণও করা হয়েছে।অনুসন্ধানে নেমে কিরীটীর প্রাথমিক অনুমান, হত্যাকারী এমনই একজন, যে মেয়েটিকে দীর্ঘদিন ধরে চিনত। গভীরভাবেই আসক্ত ছিল তার প্রতি। আর এই দৈহিক লালসাই খুনের কারণ।
‘‘নগরনটী’’। এখানেও গল্প দানা বাঁধছে যাদের নিয়ে, তাদের পরিচয়গুলো একবার দেখুন। এক সুন্দরী নারী, তার অক্ষম স্বামী, তিন জন পুরুষ-মক্ষিকা, এক চিত্রাভিনেত্রী।
এর পর ‘অহল্যা ঘুম’, ‘হীরকাঙ্গুরীয়’, ‘ঘুম ভাঙার রাত’, ‘নীলকুঠি’ এই চারটি গল্পর কথায় আসুন। প্রতিটিতে প্রাধান্য পেয়েছে যৌনবোধের বিকৃতি। এ ভাবে মাঝে মাঝেই যৌনতা বিভিন্নভাবে কাহিনির মূল উপজীব্য হয়ে ধরা পড়েছে নীহাররঞ্জনের কাহিনিতে।
আরেকটি ব্যাপারও আছে। পেশায় ডাক্তার নীহাররঞ্জন চিকিৎসাশাস্ত্রের কিছু জ্ঞান তাঁর কাহিনির মধ্যে এনেছেন প্রায়ই। ‘ক্যাকটাসের বিষ’, ‘মরফিন’, ‘একিমোসিস’ ‘হাইপোডার্মিক নীডল’-এর মতো গল্পে তার নমুনা মিলেছে। নীহাররঞ্জনের কাহিনিতে প্রায়ই প্রাধান্য পেয়েছে অবচেতন মনের দুঃস্বপ্ন, মৃত্যুভয়, আত্মহত্যা প্রবণতার মতো মনস্তাত্ত্বিক বিষয়।
একটি কাহিনিতে উনি দেখাচ্ছেন, ভয় থেকে কী ভাবে মানুষের স্মৃতিভ্রংশ বা অ্যামনেসিয়া হয়। এ ধরনের উপাদান বাংলা রহস্যকাহিনিতে হয়তো’বা তাঁরই সংযোজন। হিচকক-এর গল্পে যার ছায়া আছে, কিন্তু বাংলায় কিরীটীর আগে এ ধরনের বিষয় কেউ দেখেছেন কি?
তৃতীয় যে বিষয়টি কিরীটীকে একটু হলেও আলাদা করে তা হল, জীবনদর্শন নিয়ে সে খুব স্পষ্টবাদী। সোচ্চার। স্বচ্ছও।
এ নিয়ে কিরীটী অমনিবাসের এক খণ্ডের ভূমিকায় বার্ণিক রায়ের কথা শোনা যাক— ‘‘কিরীটীর ধর্মবোধ লেখকেরও, বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে যার মিল প্রচণ্ড। কেননা: ‘প্রৌঢ় বয়েসে পৌঁছে বুঝতে পারছি— সব কিছুর ওপরে একজন আছেন। — তিনি পাপীকে শাস্তি দেন, তেমনি ক্ষমাও করেন পাপীকে। তাঁর এক চোখে অনুশাসনের প্রতিজ্ঞা, অন্য চোখে ক্ষমার অশ্রু। ভুলে যাও। ভুলে যাও সব ব্যাপারটা।’’’
‘রহস্যভেদী’ গল্পের উদাহরণ দিচ্ছেন তিনি। —‘‘বন্ধুর পিসিমা যখন তাঁর বখা ছেলের ত্রাণের জন্য জমির দলিল চুরি করে পুত্র শম্ভুকে রাত্রে হাতে তুলে দিতে গিয়ে কিরীটীর কাছে ধরা পড়েছে, তখন পিসিমার মাতৃহৃদয়ের কান্নার কাছে তার সত্যানুসন্ধানকে সে প্রকাশ করতে পারেনি, দলিল ফিরিয়ে দিয়েছে বটে বন্ধুর পিতাকে, কিন্তু কী ভাবে কার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, তা সে … প্রকাশ করতে পারে নি। সে বলছে: কাকাবাবু, পৃথিবীতে সব অপরাধেরই কি শাস্তি হয়? আপনার দলিলের প্রয়োজন, দলিল পেয়েছেন। আর একটা অনুরোধ আপনার কাছে— এ বিষয়ে কোনও উচ্চবাচ্চ্য করতে পারবেন না আপনি।’’’
আরেকটি জায়গার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যেখানে কিরীটী বলছেন— ‘‘এ সংসারে পাপ-পুণ্য পাশাপাশি আছে। পুণ্যের পুরস্কার, পাপের তিরস্কার— এটাই নিয়ম। আজ পর্যন্ত পাপ করে কেউ রেহাই পায়নি। দৈহিক শাস্তি বা দশ বছরের জেল হওয়া অথবা দ্বীপান্তরে যাওয়াটাই একজন পাপীর শাস্তিভোগের একমাত্র নিদর্শন নয়। ভগবানের মার এমন ভীষণ যে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরও তার কাছে একান্তই তুচ্ছ।’’
গোয়েন্দা হয়ে এমন দার্শনিক কথা আর কাকে বলতে শুনেছি!
ক্ষুরধার বুদ্ধি। কিন্তু ঘরে বাইরে নির্ভেজাল বাঙালি। কথাতেও ছুরি বসাতে পারেন, কিন্তু গাড়িটা, বাড়িটা নিজের নয়। জ্ঞানে ঋদ্ধ, কিন্তু শখ-আহ্লাদের বিশেষ বহর নেই। সাজেও যে বাহার আছে, তাও নয়।
কিরীটী-পূর্ব তো বটেই, কিরীটীর সময়েরও প্রায় সব রহস্য-সন্ধানীর পরিচয়ই তাই। সবারই একটা ঘরেলু ভাব। যে-কারণে সিনেমায় ব্যোমকেশ চরিত্র করার জন্য উত্তমকুমার পর্যন্ত নিজেকে ‘ডিগ্ল্যামারাইজ’ করেছিলেন।
নীহাররঞ্জনের কিরীটী কিন্তু প্রথম থেকেই স্টার। বাঙালি হয়েও নিখুঁত তার সাহেবিয়ানা। অসম্ভব স্টাইলিশ। দুর্দান্ত গ্ল্যামারাস। অমোঘ তার স্টার আকর্ষণ। কেন? আলাদা করে কোনও ব্যাখ্যা নেই। নেই কোনও বিশদ বর্ণনাও।
কোনান ডয়েলের শার্লক হোমস বা আগাথা ক্রিস্টির হারকিউল প্যয়রো জন্মগতভাবে ওয়েষ্টার্ন, তবু বিনা আয়াসে, সহজাত দক্ষতায় তার দারুণ সাহেবিয়ানায় কিরীটী কোথায় যেন ওঁদেরও পাল্লা দেন। সেটা শুধু তাঁর হ্যাট-কোট, স্যুট-বুট, হাভানা চুরুট বা কেতা দুরস্ত ইংরেজি কথার জন্য নয়! বারবার মনে হয়, তার এই নিখুঁত ওয়েস্টার্ন ইমেজ, স্টাইল এবং গ্ল্যামার এক্কেবারে ভেতর থেকে উঠে আসা— ‘কামিং ফ্রম উইদিন’। এবং এখানেই নীহাররঞ্জনের অসাধারণ মুন্সিয়ানা।
এমন এক গোয়েন্দাপ্রবরের কথা নীহাররঞ্জন ভেবেছিলেন, নির্ঘাত অনেক অঙ্ক কষেই, নইলে ‘স্টার্টিং পয়েন্টে’ই ফারাকটা এ ভাবে চোখে পড়ত না। অথচ এই নায়কোচিত সত্যসন্ধানীর জন্মটা হয়েছিল একেবারেই আকস্মিক! বড়ই আচমকা। আলটপকা।
সে কেমন?
‘কালো ভ্রমর’ কিশোর ক্রাইম-থ্রিলার–এর সাত বছর কেটে গেছে। মেডিকেল কলেজের ফিফথ ইয়ারের ডাক্তারি-ছাত্র তখন নীহাররঞ্জন। সে সময়ই তিনি হঠাৎই লিখলেন দ্বিতীয় পর্বের ‘কালোভ্রমর’। তাতেই আবির্ভাব কিরীটী রায়ের।
নীহাররঞ্জন নিজে স্বীকার করেছেন, ‘‘… আজ মনে হয় ভাগ্যিস ‘কালোভ্রমর’ দ্বিতীয় পর্ব রচনায় হাত দিয়েছিলাম, নচেৎ ‘কিরীটী’ হয়তো কোনও দিনই জন্মাত না।’’
সত্যিই, কালো ভ্রমরের মতো দুর্দান্ত খলনায়কের জন্য দরকার হয়েছিল তেমনই একজন প্রোটাগনিস্ট— নায়ক। শুধু নায়ক নয়, অধিনায়ক— ক্যাপটেন! ওইরকম দুর্ধর্ষ ক্রিমিনালের সঙ্গে সমান তালে মোকাবিলা করার জন্য। জন্ম হল কিরীটী রায়ের মতো সত্যসন্ধানীর। যে যুদ্ধ জয় করবে ক্ষুরধার মগজ দিয়ে। তার অসম্ভব শরীরী আকর্ষণের উপস্থিতি কিংবা অনুপস্থিতি দিয়ে। এবং শেষমেশ নিশ্চিতভাবে হারিয়ে দেবে তার ‘সুপিরিয়র হিউম্যানিটি’ দিয়ে।
মনে করুন, শেষ পর্যন্ত কিরীটী রায় অসীম করুণায় ফাঁসির দড়ি না পরিয়ে নিজের জীবন নিজেকেই শেষ করার সুযোগ দিয়ে সম্মান দেখায় কালো ভ্রমরের মতো ‘গুণী’ দুর্বৃত্তকে।
এই মানবিকতা, এই মহত্ত্ব কিরীটী রায়কে সুপার হিরো করেছে। এ ব্যাপারে নীহাররঞ্জন বলছেন, ‘‘সে এমন একটা মানুষ— এমন একটা চরিত্র— যার প্রথম প্রকাশই হবে বিশেষ একটা আবির্ভাব। একটা ক্যারেকটার… চরিত্রও চিন্তা করে নিলাম, কিন্তু কী দেব তার নাম?’’
এ নিয়েও কম ফাঁপরে পড়েননি তিনি। ভাবেন, ভাবেন আর ভাবেন। কত নাম লেখেন, আর কাটেন।
শেষে পথ দেখাল কিনা দার্জিলিঙে কাঞ্চনজঙ্ঘা!
বিশাল পাহাড়ের সামনে দাঁড়ানো অসহায় জনক। কুয়াশা আর মেঘে সব ঢাকা। হঠাৎই সরে গেল মেঘ। মিলিয়ে গেল কুয়াশা। কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষারচুড়ো ঝলমল করে উঠল। সূর্যের সোনালি আলোয়। লেখক মুগ্ধ চোখে দেখলেন সোনার কিরীট পরা কাঞ্চনজঙ্ঘা। ধবল চুড়োয় অপূর্ব সোনার মুকুট। মুহূর্তে ঝলসে উঠল সঠিক নাম। সোনার মুকুট— সোনার কিরীট যে ধারণ করে সে-ই তো কিরীটী! পুরো নাম ‘কিরীটী রায়’।
জোর করে সাহেব বানানো ‘রে’ নয়’ অথচ পুরোদস্তুর সাহেবি কেতার টিপটপ দুর্দান্ত চরিত্র তার ব্যক্তি পরিচয়ে নিখাদ বাঙালি।
অনেকটাই মনে করায় জেমস্ বন্ড-কে। গায়ের সঙ্গে সেঁটে থাকা ব্লন্ড চুলের লাস্যময়ী সুন্দরী নিয়ে শন কনারি বা রজার মুরের দারুণ ম্যাসকুলিন জেমস বন্ড। সিনেমার পরদায় চোখে দেখা তাঁদের অ্যাপিলের সঙ্গে কোথায় যেন মিলে যায় চোখে না-দেখা পৌরষের বাঙালি কিরীটী রায়!
কিরীটীর এই গ্ল্যামার নড়িয়ে দিয়েছিল খোদ মহানায়ককেও! এতটুকু বাড়িয়ে বলা নয়, বাঙালির চূড়ান্ত ‘গ্ল্যামারগন’ এই পুরুষ একেবারে মোহাচ্ছন্ন, আবিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন কিরীটীতে।
এতটাই সে প্রবল আকর্ষণ যে, ‘কিরীটী রায়’ করার আর্জি নিয়ে উত্তমকুমার নিজে একবার গিয়েছিলেন নীহাররঞ্জনের কাছে। ঘটনাটি শোনা লেখকের সেজ মেয়ে করবী সেন ও নাতনি চন্দ্রিকার কাছে।
তারপর? সটান ‘না’ করে দিয়েছিলেন কিরীটীর ‘জনক’।
কারণ? তাঁর কাছে সেলুলয়েডের একমাত্র কিরীটী রায় ছিলেন অভিনেতা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। অজিতেশ অবশ্য কোনওদিনই জানতে পারেননি সে-কথা। কেননা তাঁকে জানাননি লেখক। তিনি নাকি ছিলেন নীরব-অপেক্ষায়! তাই’বা কেন, সে-রহস্যের অবশ্য সমাধান হয়নি আজও।
অনুমান একটা করা যায় বটে।
মানসপুত্রের স্নেহে ভালবাসায় নীহাররঞ্জন ছিলেন অসম্ভব জারিত। হয়তো’বা অতিরিক্ত স্পর্শকাতরও। যে কারণে কিরীটীকে নিয়ে একের পর এক অভিযানে নামা তাঁর পক্ষে যতটা সহজ ছিল, তাঁর ‘অবয়বকে’ বাস্তবে রূপ দেওয়ার পেছনে তিনি ছিলেন ততটাই দ্বিধাগ্রস্ত, সংশয়াকীর্ণ। কে বলতে পারে, হয়তো আতঙ্কিতও!
প্রৌঢ়ত্বের শেষে এসে তিনি একবার বলেন, ‘‘অনেক কথা আজ আর আমার মনেও পড়ে না— কেবল মনে আছে আমি পেয়েছিলাম ‘আমার কিরীটী’-কে… অনেক কাহিনি রচনা করেছি কিরীটীকে কেন্দ্র করে এবং সে সব ক্ষেত্রে প্রেরণা জুগিয়েছে আমার ওই ‘কিরীটীই’। আমার সৃষ্ট বহু চরিত্রের মধ্যে যে একক— অনন্য।’’ … এও বলছেন তিনি, ‘‘আমি জানি ‘কিরীটী’ শুধু একা আমার নয়— বহু বহু জনার প্রিয়— আমার লেখক জীবনের সে এক বিশেষ প্রাপ্তি— স্বীকৃতি। …প্রৌঢ়ত্বের সীমা অতিক্রম করতে বসে আজ তাই বারবার মনে হয় ওকে খুঁজে না পেলে আমার কিছুই পাওয়া হত না।’’ মানসিক ভাবেও তিনি কিরীটীর সঙ্গে কতটা সংযুক্ত ছিলেন, এ ক’টা কথাতে বোধহয় তার জোরালো ছায়া মেলে।
কিরীটী রহস্য গোগ্রাসে গিলতে গিলতে বড় হয়েছেন বা প্রাপ্ত বয়েসেও কিরীটী-আবেশ কাটিয়ে উঠতে পারেননি, এমন মানুষ আজও অগুনতি। পরের পর কাহিনিগুচ্ছের বিশাল ব্যাপ্তিতে অসম্ভব রকম জীবন্ত, বিভিন্ন এবং অনন্য কিরীটী রায়। কখনও তার দেখা মিলেছে ‘রহস্যভেদী চক্রী’ বা ‘হলুদ শয়তান’-এ, কখনও ‘ডাইনীর বাঁশী’ থেকে ‘বিষকুম্ভ’, ‘মৃত্যুবাণ’, ‘আদিম রিপু’, ‘বত্রিশ সিংহাসন’, ‘পদ্মদহের পিশাচ’-এ অথবা কখনও ‘অবগুণ্ঠিতা’র মতো কাহিনিতে। প্রত্যেকটি কাহিনির এমনই পরিণতি, অন্তিম শব্দটা পড়ার পরও কেবলই যেন গুনগুন করে ভেসে ওঠে একটিই বাক্য— শেষ হইয়াও হইল না শেষ!
‘কিরীটী তত্ত্বে’ আবিষ্ট প্রমথনাথ বিশীর দরাজ সার্টিফিকেট— ‘‘কাহিনী শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে কাহিনীর ঊর্ধ্বে জেগে থাকে পাঠকমনে রহস্যকাহিনীর রহস্যভেদী নায়ক কিরীটী রায়ের ব্যক্তিত্ব, তার তীব্রতীক্ষ্ণ যুক্তিবোধ, পরিমিতিবোধ, ক্ষুরধার বুদ্ধির মালিন্যমুক্ত ঔজ্জ্বল্য নিয়ে। যা কিরীটী রায়কে সমসাময়িক ডিটেকটিভ কাহিনীর নায়কদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠত্বের আসন দিয়েছে এবং তার স্রষ্টাকে দিয়েছে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রত্যক্ষ সাফল্য।’’
এত গেল সৃষ্টির কথা। কিন্তু সৃষ্টির স্রষ্টা, তাঁকে না জানলে, না চিনলে যে তাঁর সৃষ্টিকেও চেনা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।
ফিরে যাওয়া যাক সত্তরের দশকের কাছাকাছি সময়ে।
মাঝ-আকাশের গনগনে আঁচ ক্রমেই তাপ বাড়াচ্ছে মাটির। কোনারকের সূর্যমন্দির। দর্শনে গিয়েছেন সপরিবারে নীহাররঞ্জন গুপ্ত। সিঁড়ি দিয়ে নামছেন সবাই। নীহাররঞ্জন গুপ্ত, তাঁর স্ত্রী এবং তাঁর চার কন্যা। হঠাৎ দেখা গেল, নীচ থেকে উপরে উঠছেন এক ভদ্রলোক। খুবই চেনা। স্যুটেড-বুটেড। প্রায় ছ’ফুটের মতো লম্বা। মার্জার গতিতে নীহাররঞ্জন গুপ্তের দিকে ধেয়ে এলেন তিনি! দেখে কারও বিশ্বাসই হচ্ছিল না। ভদ্রলোক এসে নীহাররঞ্জনের সঙ্গে হাত মেলালেন। তার পরই শুরু হল তাঁদের পরস্পরের আলাপ। বাকিরা তখন পাশে দাঁড়িয়ে নির্বাক শ্রোতা। সেই ভদ্রলোককে পরিবারের বাকিরা বিলক্ষণ চিনতেন। তিনি বলরাজ সাহানি। নীহাররঞ্জনের সঙ্গে তাঁর চেনাশোনা ছিল অনেক কালের। তত দিনে, নীহাররঞ্জনের কাহিনি নিয়ে তৈরি সিনেমা ‘লাডলা’য় অভিনয় করে ফেলেছেন বলরাজ ও নিরূপা রায়। নিজের স্ত্রীর সাথে বলরাজের পরিচয় করিয়ে দিয়ে নীহাররঞ্জন বলেছিলেন, ‘‘জুঁই (তাঁর স্ত্রীর ডাকনাম, ভাল নাম কনক), ওঁর ছবি তো অনেক দেখেছ! এ বার চাক্ষুষ করলে।’’
কোনারকের সূর্যমন্দির, পুরী আর বারাণসী – এগুলো ছিল নীহাররঞ্জনের প্রিয় জায়গাগুলোর কয়েকটা। প্রায় প্রতি বছরই এর যে কোনওটায় ঘুরতে যেতেন সপরিবারে। বেড়ানোতে ছিল তাঁর প্রবল শখ। আর শখ ছিল আড্ডায়। প্রতি রবিবারের সকালে চলে যেতেন জমাটি আড্ডায়। তিনি তখন সপরিবারে গোলপার্কে থাকতেন। বাড়ির নাম ছিল ‘উল্কা’, তাঁরই লেখা একটি কাহিনির নামে। সকাল থেকেই আনচান করতেন তিনি। বেলা একটু গড়াতেই চলে আসতেন সর্দারজি। তাঁর বাড়ির বিশ্বস্ত ড্রাইভার। তাঁর একটা কালো রঙের ফিয়েট ছিল। প্রথম দিকে অবশ্য অ্যাম্বাসাডর ছিল। গাড়ি করে নীহাররঞ্জন যেতেন সোজা উত্তরে, সেই টালা পার্কে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে। দুপুর গড়িয়ে যেত তাঁদের আড্ডায়। সঙ্গে থাকত শুধু মুড়ি আর চানাচুর।
এই প্রসঙ্গে নীহাররঞ্জন কন্যা শ্রীমতী করবী সেন (সেজ মেয়ে) জানিয়েছেন, “কিরীটীর সংসারের হীরা সিংহকে কেন জানি না আমার মনে হত, সর্দারজির আদলেই গড়েছিলেন বাবা! কোনও দিন অবশ্য যাচাই করা হয়নি বাবার কাছে!”
রবিবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি দিনগুলো নীহাররঞ্জনের ব্যস্ততাতেই কেটে যেত। শ্যামবাজার স্ট্রিটে (পরে ধর্মতলা স্ট্রিটে) ডাক্তারি চেম্বার, লেখালেখি, পুজোপাট, পোষ্যের যত্ন নেওয়া, তার সঙ্গে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে গল্পগুজব তো থাকতই!
নীহাররঞ্জন ও কনক, দু’জনেই সকাল-সকাল উঠে পড়তেন। স্নান সেরে তিন তলায় গোপালসেবা করা ছিল তাঁদের বাঁধা। ঠাকুরঘরে ছিল দু’খানি গোপাল। একটি কষ্টি পাথরের, অন্যটি অষ্ট ধাতুর। কষ্টি পাথরের গোপাল ঠাকুরটি বাড়িতে আসার একটি গল্প রয়েছে। একদিন নাকি নীহাররঞ্জন স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন, ‘‘বৃন্দাবন থেকে আমাকে নিয়ে যাও।’’ নীহাররঞ্জন গিয়েছিলেন। আর এই গোপালমূর্তিটি তাঁর ওখান থেকেই পাওয়া। কলকাতা ফিরে গোপালকে বাড়িতে এনে প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। তার পর তাঁর রোজের সেবা চলত। ঠাকুরঘরে ধুতিটা লুঙ্গির মতো করে পরতেন নীহাররঞ্জন। খালি গা। সদ্য স্নান করে বেরিয়ে পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল। নিষ্ঠা ভরে পুজো করতেন তিনি। পাশে থাকতেন তাঁর স্ত্রী কনক। পুজো শেষ হলে বোতামখোলা জামাটি গায়ে উঠত। এ বার সময় হত প্রাতঃভ্রমণের। রবীন্দ্র সরোবরের ধারে। সঙ্গে তখন অবশ্যই থাকত তাঁর প্রিয় জ্যাকলিন। নামটা নীহাররঞ্জনেরই দেওয়া ছিল। জ্যাকলিন ছিল জাতে অ্যালসেশিয়ান। কোনও এক হিন্দিভাষী তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন এই সারমেয়-শাবক। নীহাররঞ্জন ছিলেন তাঁর চিকিৎসক। পরে তিনি জ্যাকলিনের এক সঙ্গীও নিয়ে আসেন বাড়িতে। তার নাম দেন টাইগার। প্রাতঃভ্রমণ থেকে ফিরে প্রাতরাশ। শেষে রুপোর সাজি থেকে এক খিলি পান। পানের সঙ্গে ভুরভুরে গন্ধজর্দা। যে-সে জর্দা নয়। নাখোদা মসজিদের কাছে কোনও এক দোকান থেকে নিয়ম করে ‘গুলি জর্দা’ কেনা ছিল তাঁর বহু কালের অভ্যাস। মাঝেসাঝেই নীহাররঞ্জন বলতেন, ‘‘নাখোদার এই জর্দার যে স্বাদ, সে আর কোথাও পাই না।’’ তবে এই সামান্য ‘জর্দা-বিলাস’টুকু ছাড়া খাওয়াদাওয়া নিয়ে তাঁর তেমন বাছবিচার ছিল না। তবে বাঙাল পরিবারের সন্তান তো! মাছের প্রতি ঝোঁকটা ছিল একটু বেশিই ছিল। বাংলাদেশের নারাইল জেলার ইটনা গ্রামে ছিল তাঁর দেশের বাড়ি। তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিলেন কবিরাজ। পাতে সর্ষে-ইলিশ দেখলে সে দিনের খাওয়াদাওয়াটা যেন অন্য মাত্রা পেত নীহাররঞ্জনের! চিংড়ি অবশ্য না-পসন্দ ছিল। কিন্তু তাঁর কন্যার যেহেতু পছন্দ করত, তাই বাজার থেকে বেছে বেছে চিংড়ি আনতেন মাঝেসাঝেই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নীহাররঞ্জন ছিলেন সেনাদলের ডাক্তার। সে কথা তাঁর কন্যারা ছোট থেকেই শুনে শুনে বড় হয়েছেন। প্রায়ই তাঁর কন্যারা তার গল্প শুনতে চাইতেন তাঁর কাছে। যুদ্ধের গল্প, সিপাইয়ের গল্পে আগ্রহ দেখে নীহাররঞ্জন তাঁর সেজ কন্যার নাম দিয়েছিলেন ‘সিপাই’। ছোট মেয়েদের প্রতি স্নেহ নীহাররঞ্জনের চিরকালই খুব বেশি ছিল।
কন্যাদের কাছে তাঁদের বাবা মানেই গল্পের খনি ছিলেন। হাজার ব্যস্ততা থাক, রাতের দিকে কন্যাদের নিয়ে নীহাররঞ্জন গল্পের আসর বসাতেনই বসাতেন। খাওয়ার টেবিলেও বসে বসে আড্ডা জমত।
তেমনই এক গল্প তিনি তাঁর কন্যাদের শুনিয়েছিলেন তাঁর বিলেতযাত্রা নিয়ে। জাহাজে করে চলেছেন ইংল্যান্ড। উচ্চশিক্ষার জন্য। প্রাতরাশের সময় ভীষণ বিপত্তি। ছুরিতে কেটে কেটে খাবার খেতে হবে। সাহেবি কেতা। পুরোদস্তুর বাঙালি আমার নীহাররঞ্জনের কাছে সে ছিল বড়ই বিড়ম্বনার। তবু অপটু হাতেই নীহাররঞ্জন ছুরি ধরলেন। গোড়াতে বেশ চলছিল। কিন্তু ডিম সেদ্ধটা কাটতে গিয়েই ঝামেলা পাকল। ফস করে ছুরি পিছলে অর্ধেকটা ডিম গিয়ে ছিটকে পড়ল পাশেই বসা এক মেমসাহেবের কোলে। তাতে নীহাররঞ্জন তো লজ্জায় এক শেষ! মেমসাহেব অবশ্য পুরো ব্যাপারটি নিজেই সামলে নিয়েছিলেন।
তবে কন্যাদের নিয়ে নীহাররঞ্জন যে কতটা স্পর্শকাতর ছিলেন সেটা ব্যক্ত করেছেন তাঁর সেজ কন্যা শ্রীমতী করবী সেন। তাঁর ভাষ্যে, “আমরা চার বোন। বাবা-মায়ের আদরের চার কন্যা। মেয়েসন্তান তো অনেকেরই পছন্দের নয়! ঠারেঠোরে কেউ কেউ কথা শোনাতেন। কিন্তু সে সব বাবার কানে গেলেই হল, এমন তেড়ে উঠতেন যে, যিনিই বলুন, দ্বিতীয় বার কিছু বলার আগে ভেবে দেখতেন।”
তবে নীহাররঞ্জনের একজন পুত্র-সন্তানও ছিল। মানসপুত্র বলাই ভাল। তিনি গোয়েন্দাপ্রবর কিরীটী রায়। সে পুত্র নীহাররঞ্জনের এতই প্রিয় ছিল যে, মহানায়ক উত্তমকুমারকেও এক বার বাবা কিরীটী চরিত্রে অভিনয় করার প্রবল ইচ্ছে থেকে বিরত করেন।
একদিন মহানায়ক সোজা এসে হাজির হলেন তাঁর বাড়িতে। ফিয়েট গাড়ি থেকে নামলেন। ধবধবে ধুতি-পাঞ্জাবি। হাতে কিং সাইজ সিগারেট। বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে শেষ সুখটানটা দিয়ে পায়ে সিগারেট পিষে দিলেন রাস্তায়। বাড়িতে ঢুকে নীহাররঞ্জনের ঘরে গিয়ে এ-কথা সে-কথার পর সটান ওঁর আর্জি, ‘‘কিরীটী করতে চাই, সিনেমায়।’’ কিরীটীতে এতটাই মুগ্ধ ছিলেন উত্তমকুমার! কিন্তু নীহাররঞ্জনকে সে দিন টলাতে পারেননি স্বয়ং মহানায়কও! অতিথিকে খাতির-যত্নের ত্রুটি করেন নি নীহাররঞ্জন। কিন্তু যথাসময়ে বিনীত ভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘‘না। আপনি ‘কিরীটী রায়’ হলে কিছুতেই মানাবে না!’’
নীহাররঞ্জন যে কিরীটীকে সেলুলয়েডে আনতে চাননি, তা নয়। কিন্তু নীহাররঞ্জন ভাবতেন, কেউ যদি এই চরিত্র করতে পারেন, তবে তিনি অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়! অজিতেশবাবু অবশ্য জানতে পারেননি তাঁর এই ইচ্ছের কথা!
নীহাররঞ্জনের বর্ণনায় কিরীটী রায় যেমন, নীহাররঞ্জন নিজেও অনেকটা ছিলেন তেমনই। মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল, ব্যাকব্রাশ করা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর চুল আঁচড়ানোটা ছিল দেখার মতো। কিরীটীর চোখে পুরু লেন্সের সেলুলয়েড চশমা। নীহাররঞ্জনেরও তাই।
উল্কাবাড়ির ‘মেজানাইন ফ্লোরে’ এক চিলতে একটা ঘর ছিল। বাড়িতে থাকলে, দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরে নীহাররঞ্জন ঘুমোতে যেতেন না। ওটাই ছিল তাঁর লেখার সময়। খাওয়াদাওয়া সেরে মোজাইকের মেঝেতে শোনা যেত তাঁর পায়ের খসখস শব্দ। সুইং ডোর ঠেলে তিনি ঢুকতেন সেই ঘরে। গায়ে গোল গলা গেঞ্জি, নয় বোতাম খোলা শার্ট। ও ঘরের তিন দিকের দেওয়ালে কাঠের বুক সেল্ফ। ঠাসা বইপত্র। এক কোণে তাঁর স্ত্রীর সেতারটি রাখা। খড়খড়িওয়ালা জানালাও ছিল। তার ফাঁক দিয়ে নজরে পড়ত একটি কলেজের গার্লস হস্টেল। নীহাররঞ্জনের ‘বেলাভূমি’ কাহিনিতে যে হস্টেলের কথা আছে, এই হস্টেল সেটিই। চেয়ারটা টেনে তিনি বসতেন লেখার টেবিলে। ততক্ষণে ঘরের মেঝেয় তাঁর চার কন্যা হয়তো শুয়ে পড়েছেন। তিনি লিখতে বসতেন। এমনিতে যে মানুষ গল্পগাছা করে কাটাতেন, লেখার সময় আশেপাশে কোনও কথা তাঁর সইত না। চাপা স্বরে দু’একটা কথা বললেও বিরক্ত হতেন। বকা দিতেন। তার পরে অবশ্য ফের লেখা।
কিরীটীর সঙ্গে তাঁর যেমন মিল, তেমন আবার ছিল অমিলও। কিরীটী গৌরবর্ণ। তাঁর গায়ের রং খানিক তামাটে। কিরীটীর উচ্চতা প্রায় সাড়ে ছ’ফুট। তিনি কমবেশি পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি।
কন্যা শ্রীমতী করবী সেন তাঁর স্মৃতিচারণে একটি বিশেষ ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন- “আমার দুই মেয়ে চন্দ্রিকা আর মন্দিরা তখন খুবই ছোট। বাবা এক দিন আদর করে দুই নাতনির জন্য শাড়ি কিনে আনলেন। মন্দিরা তা নিয়ে ভীষণ খুশি। কিন্তু কী ভাবে শাড়ি পরা হয়, তখনও সে জানত না। অগত্যা গেল, দাদুর কাছেই। আধো আধো গলায় তার আবদার, ‘‘পরিয়ে দাও।’’
পান চিবোতে চিবোতে বাবা মজা করে বললেন, ‘‘তার থেকে বল, নিজেই পরে নিই।’’
তখন তো কথাটা শুনে খুব হেসেছি। আর বিশেষ কিছু মনে হত না। কিন্তু এখন, যখন চাইলেও বাবাকে আর পাব না, ওই টুকরো স্মৃতিগুলোই কেমন একটা ভরাট আকাশের জন্ম দেয় মনে। ভাবি, অমন একজন মাপের মানুষ ভিতরে ভিতরে কতটা সোজাসাপটা সরল হলে তবে ছোটদের সঙ্গেও ও ভাবে মিশে যেতে পারে।”
আরেকটি ব্যাপার নীহাররঞ্জনের মধ্যে ছিল প্রবল। সেটা হল, ফেলে আসা পৈতৃক ভিটে নিয়ে অসম্ভব টান। তিনি প্রায়ই সে কথা তাঁর কন্যাদের বলতেন। সত্তর শতকের মতো জায়গার ওপর ছিল তাঁর দেশের দোতলা বাড়ি, পুকুর, বাগান। প্রবেশপথ দুটি। তিরিশের দশকে সেই বাড়ি ছেড়ে এ পার বাংলায় চলে আসেন নীহাররঞ্জন। তখন তাঁর বয়স ছিল মোটে চোদ্দো-পনেরো। কোন্নগর, কৃষ্ণনগরে কিছু কাল পড়াশোনার পর ভর্তি হয়ে যান কারমাইকেলে। এখন যার পরিচয়, আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ। তার পর তো নানা খাতে বয়েছে নীহাররঞ্জনের জীবন, কিন্তু ভিটের টান তাঁর কোনও দিনই ফিকে হয়নি। এমনকী বাংলাদেশ নিয়েও তিনি খুব কাতর থাকতেন। সত্তরের দশক, তখন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। প্রায় প্রতি দিন তিনি খবর শুনতেন মন দিয়ে। যুদ্ধ শুরু হলে রোজ সাহিত্যিক বন্ধুবান্ধব, সাংবাদিকদের কাছে খবর নিতেন, কত দূর সফল হলেন মুক্তিযোদ্ধারা। তখন নীহাররঞ্জনের আদর্শ হয়ে ওঠেন শেখ মুজিবর রহমান। তাঁর মধ্যে মুজিবর ও বাংলাদেশ-প্রীতি কতটা নিবিড় ছিল, সেটা বোঝা গিয়েছিল আরও পরে। নীহাররঞ্জনের ‘লালুভুলু’ উপন্যাসের কাহিনি নিয়ে ছবি হল। পরিচালনায় অগ্রদূত। সেই ছবি দুই বাংলাতেই বেশ জনপ্রিয় হয়। এর অনেক পরে উপন্যাসটিকে সম্মান জানাতে ঢাকা থেকে সপরিবার নিমন্ত্রণ আসে তাঁর কাছে। আমন্ত্রণ সাদরে গ্রহণ করে তিনি সপরিবারে বাংলাদেশ যান। এর কিছু কাল আগে মারা গিয়েছিলেন মুজিবর। তাঁর কন্যারা দেখেছিলেন, নীহাররঞ্জন যেখানেই যাচ্ছেন, মুজিবরের স্মৃতি হাতড়াচ্ছেন। একদিন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা তাঁর কাছে এলেন, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন। কথায় কথায় হাসিনা গভীর শোকের সঙ্গে দেখালেন, ঠিক কোথায় বঙ্গবন্ধুকে গুলি করা হয়। সকলে দেখেছিলেন, হাসিনার মুখে তাঁর পিতৃহত্যার নৃশংস কাহিনি শুনতে শুনতে নীহাররঞ্জনের দু’চোখের কোণ চিকচিক করে উঠছে বাধ-না-মানা জলে। সকলে তাঁকে বিড়বিড় করে বলতে শুনেছিলেন, ‘‘জয় বাংলা।’’
(তথ্যসূত্র:
১- দেশ সাহিত্য সংখ্যা (১৩৮২)।
২- কিরীটী অমনিবাস,মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ।
৩- ৬ই মে ২০১৭ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় শ্রী নীহাররঞ্জন গুপ্তের স্মৃতিতে তাঁর সেজ কন্যা শ্রীমতী করবী সেনের লেখা প্রবন্ধ।
৪- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৪ই ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত