পুরুলিয়া রাজনওয়াগড়ে সেই গোপীধ্বজ গাছটির সামনে একটি চেয়ার পেতে বসে থাকতেন মহাশ্বেতাদেবী। মোড়া টেনে বসতে বলতেন অন্যদের। শবর রমণীদের ঘরকন্নার কথা শুনতেন। ছোটখাট সুখ দুঃখ ভাগ করে নিতেন। সেই তল্লাটের মানুষ সাহিত্যিক মহাশ্বেতার বদলে সমাজসেবী মহাশ্বেতাকেই বেশি চিনতেন। কারও দিদি, কারও কাছে মা-ও। তাঁর মৃত্যুতে তাই নিকটজনকে হারানোর শোকে ভেসেছিলেন তাঁরা। তাঁদের সঙ্গে মহাশ্বেতা দেবীর সম্পর্ক ছিল তো সেই কবে থেকে। ১৯৮৩-র নভেম্বরে পুরুলিয়া জেলার ১৬৪টি গ্রাম ও টোলার শবরদের একজোট করতে পুরুলিয়া ১ ব্লকের মালডি গ্রামে শবর উন্নয়ন সমিতির প্রাণপুরুষ পঞ্চকোট রাজবংশের উত্তরপুরুষ গোপীবল্লভ সিংহ দেও ‘শবর মেলা’র আয়োজন করেছিলেন। তখন থেকেই শবরদের জীবনযাত্রার উন্নতির জন্য উদ্যোগী হন মহাশ্বেতা। এই মেলার মঞ্চ থেকেই এক ছাতার তলায় চলে আসে বিনপুরের লোধা শবর সমিতি ও পুরুলিয়ার শবর উন্নয়ন সমিতি। নাম হয় ‘পশ্চিমবঙ্গ খেড়িয়া-শবর কল্যাণ সমিতি’। কার্যকরী সভাপতি হন মহাশ্বেতা। রাজনওয়াগড়ে তৈরি হয় তাদের দফতর। সেই ভবনেরই পরে নাম হয় মহাশ্বেতা ভবন। তারই সামনে সেই গোপীধ্বজ বৃক্ষ। ম্যাগসাইসাই পাওয়ার পরে ১০ লক্ষ টাকা এই সমিতিকেই দান করে দিয়েছিলেন মহাশ্বেতা।
প্রায় তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সময় পেলেই এখানে চলে আসতেন মহাশ্বেতা। ‘অপরাধ প্রবণ জনজাতি’ তকমাটা শবরদের উপর থেকে তুলে ফেলতে কলম তো ধরেইছিলেন, তাঁদের জীবনের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। সাধারণত থাকতেন রাজনওয়াগড়ে। পুরুলিয়া স্টেশনে সকালে ট্রেন থেকে নেমেই ‘ভাই’ বলে তাঁদের হাসিমুখে জড়িয়ে ধরতেন। তারপর পরিচিত সকলের খবর নিতেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। গ্রামের সকলেই স্কুলে যাচ্ছে কি না, সবাই বইপত্র পেয়েছে কি না— সব জানতে চাইতেন। সেখান থেকেই সঙ্গীদের নিয়ে কেন্দা থানার অকড়বাইদ, মানবাজারের জনাড়া, বরাবাজারের কুদা, বোরোর তিলাবনির মতো শবরদের গ্রামে গিয়েছেন বারবার। নদী দেখলে জলে নেমে পড়তেন। কখনও সারা দিন সেই ভেজা শাড়ি পরেই কাটিয়ে দিতেন। শবরদের বাড়িতেই খেতেন। কেউ নেশা করছে শুনলে তাঁকে বকাঝকাও করতেন। রোগ হলে হাসপাতালে নিয়ে না গেলেও তাঁর মুখ রাগে থমথমে হয়ে যেত।
শবরদের জন্য তাঁর আইনি লড়াইয়ের তালিকায় মাইলফলক হয়ে রয়েছে ডাকাতির অভিযোগে ধৃত কেন্দা থানার অকড়বাইদ গ্রামের বুধন শবরকে পুলিশের পিটিয়ে মারার অভিযোগ নিয়ে মামলাটি। এ ছাড়া শবরদের উন্নয়নে রাজ্য সরকারের বরাদ্দ অর্থের সদ্ব্যবহার নিয়েও তিনি হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন। ছাগল চুরির অভিযোগে তিলাবনি গ্রামের ললিত শবরের কব্জি থেকে কেটে নেওয়া হয়েছিল। কলকাতায় তাঁর চিকিৎসার জন্য মহাশ্বেতা সে দিন কী করেছিলেন তা এখনও এলাকার মানুষের মুখে মুখে ঘোরে।
যেদিন কলকাতায় যখন তাঁর শেষকৃত্য হচ্ছিল, কুদা গ্রামের চাকা নদীর ধারের শ্মশানে শবররা পুঁতেছিলেন একটা সেগুন গাছ। তাঁরা বলেছিলেন, ‘‘যত ঝড় জল হোক, জানতাম বিরাট একটি বৃক্ষের মতো আমাদের আড়াল করে রাখবেন তিনি। তাঁকে টলানো যেত না।’’ তাই ‘শবর-জননী’ বলেই চিনতেন তাঁকে মানুষ। দশ দিন পরে নিজেদের নিয়ম মতোই মহাশ্বেতার অন্তিম কাজ করেছিলেন শবরেরা।
মহাশ্বেতা নিজের জীবন দিয়ে দেখেছিলেন, পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াটা লোধা-শবর ছেলে মেয়েদের পক্ষে কতটা কঠিন। সেই অভিজ্ঞতা আর বোধ থেকেই পাশে থাকার চেষ্টা শুরু। অবশ্য অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন প্রবোধকুমার ভৌমিককে দেখে। লোধা-শবরদের জন্য তৈরি প্রবোধবাবু ‘বিদিশা’র সমাজসেবক সঙ্ঘ দেখেই কিছু করার ভাবনা। প্রহ্লাদকুমার ভক্তা গত শতকের সত্তরের দশকে ডেবরা ব্লকের চকসাহাপুর গ্রামে তৈরি করেন ‘চকসাহাপুর লোধাসমাজ সেবক সঙ্ঘ’। তখন তিনি কলেজের ছাত্র। ১৯৭২ সালে চারজন লোধা-শবর ছেলে মেয়েকে নিয়ে সঙ্ঘের কাজ শুরু হয়েছিল। টাকা পয়সার অভাব। এগিয়ে এসেছিল কলকাতার অগ্রণী ক্লাব, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ। সাহায্য মিলত। সাহায্য করতেন গ্রামবাসীরাও। তাঁদের সাহায্যে আনাজ ফলিয়ে ফসল বিক্রি করে সেই টাকায় প্রতিষ্ঠানের আবাসিক পড়ুয়াদের বিভিন্ন খরচ জোগানো হত। দুর্দিনে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তৎকালীন এসসি-এসটি ওয়েলফেয়ার দফতরের অধিকর্তা উজ্জ্বলকান্তি রায়। ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শন করে সরকারি অনুদানের প্রতিশ্রুতি দেন। উজ্জ্বলকান্তি মেদিনীপুরের জেলাশাসক হয়েছিলেন। পরে আবার এসসি-এসটি ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্টের অধিকর্তা হন। উজ্জ্বলকান্তি বুঝেছিলেন, লোধা যুবকটির বুকে আগুন আছে। সরকারি অনুমোদন মিলল ১৯৭৮ সালে। এলাকার কয়েকজন লোধা, সাঁওতাল, ভূমিজ ও মুন্ডা সম্প্রদায়ের যুবক প্রহ্লাদের পাশে দাঁড়ালেন। লড়াই করেই লোধাদের কাজ চলতে লাগল। ১৯৭৮ সালে সরকারি অনুমোদন মিলল। আরও কয়েকজন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। প্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য নিজের জমিতেই কাজ শুরু করেছিলেন প্রহ্লাদ ভক্তা। কিন্তু জনজাতি গোষ্ঠীর কল্যাণে চিন্তাভাবনা, কাজ এবং প্রতিবাদী ভূমিকার জন্য বিপাকেও পড়তে হয়েছে তাঁকে। ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থার সময়ে মিসা আইনে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন জেলাশাসক উজ্জ্বলকান্তির হস্তক্ষেপে গ্রেফতারি এড়িয়েছিলেন। আবার এই কাজের জন্যই অনন্য স্বীকৃতি মিলেছিল মহাশ্বেতাদেবীর কাছ থেকে। ১৯৮৩ সালে সিআরআই-এর অধিকর্তা অমলকুমার দাসের সৌজন্যে আলাপ হল মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে। মহাশ্বেতা নিজে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। প্রহ্লাদ ভক্তা কলকাতায় বালিগঞ্জের বাড়িতে দেখা করলেন। সেখানে এক রাত ছিলেন। পরদিন প্রহ্লাদ দেখেন, মহাশ্বেতা তাঁর জুতো পালিশ করছেন। প্রহ্লাদ বলেছিলেন, ‘‘দিদি আপনি ব্রাহ্মণ হয়ে এ কী করছেন!’’ জবাবে মহাশ্বেতা বললেন, ‘‘আমি তোর মা। তুই কীসে কম ব্রাহ্মণ রে।’’ মহাশ্বেতাদেবীর ‘বর্তিকা’ পত্রিকায় বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন প্রহ্লাদ। আমৃত্যু ‘শবর জননী’র সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। তাঁর মৃত্যুর দু’সপ্তাহ আগে দেখা করে এসেছিলেন প্রহ্লাদ।
চারজনকে নিয়ে যে আশ্রম চালু হয়েছিল এখন সেখানে থাকে ১৩০ জন। ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব মেদিনীপুর এবং হুগলি জেলার ২৫টি ব্লকের লোধা ও অন্য জনজাতির ছেলে মেয়ে এখানে থেকে এলাকার দু’টি প্রাথমিক এবং একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। খাওয়া, থাকা, চিকিৎসা বিনামূল্যে। বালিকা বিভাগে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির ৭০ জন আবাসিক রয়েছে। বালক বিভাগে প্রথম থেকে দশম শ্রেণির ৬০ জন আবাসিক আছে। প্রহ্লাদের আক্ষেপ, ‘‘এর বেশি পড়ুয়া রাখার অনুমোদন মেলেনি। পর্যাপ্ত সরকারি সাহায্য ও অনুমোদন না মেলায় ইচ্ছে থাকলেও বেশি পড়ুয়া রাখা সম্ভব হয় না। সেই কারণে ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মাত্র ২৯ জন লোধা জনজাতির ছেলে মেয়েকে মাধ্যমিক পাস করাতে পেরেছি।’’ এখন সংস্থার কর্মী ১১ জন। এ ছাড়া বাইরে থেকে কোচিং পড়াতে আসেন ১৮ জন তরুণ-তরুণী।
তাঁর জীবনবোধের মূল কথাই ছিল পরাজয় স্বীকার না করা। সচ্ছল পরিবারেই বড় হয়েছিলেন, কিন্তু যৌবনের প্রথমেই সচ্ছল জীবন ছেড়ে বেছে নিলেন একটা সংগ্রামী জীবন। গণনাট্য আন্দোলনের অগ্রদূত বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে সাংসারিক গাঁটছড়া বাঁধলেন।
বিজন ভট্টাচার্যের নির্দিষ্ট রোজগার ছিল না। সেলস গার্ল-এর কাজ করেছেন, ছোটখাটো ব্যবসা করেছেন, স্কুলে এবং কলেজে শিক্ষকতাও। সেই সঙ্গে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন যাবতীয় সামাজিক অন্যায় এবং অবিচারের বিরুদ্ধে। ব্রিটিশরা লোধা-শবরদের অপরাধপ্রবণ জাতি ঘোষণা করেছিল। স্বাধীন ভারতেও সেই ঘোষণা বহাল ছিল। তিনি একা লড়াই করে তা রদ করলেন। তিনি গড়েছেন আদিম জাতি ঐক্য পরিষদ এবং লড়েছেন। কখনও আইনি লড়াই, কখনও মিছিল-মিটিং। নানা জনকে নানা চিঠি লিখেছেন ভারতের মূলবাসীদের অধিকার রক্ষার জন্য।
তিনি শ্রীমতী মহাশ্বেতা দেবী। আদিবাসী ও অরণ্যের মূল অধিকারীদের লড়াইয়ের সেনাপতি।
মেদিনীপুর জেলার লোধা শবরদের মতো পুরুলিয়ার খেড়িয়া শবর গোষ্ঠীর উন্নতির জন্য তিনি ভাবনাচিন্তা করেছেন প্রচুর। বস্তুত, এই গোষ্ঠীগুলির সমন্বিত মননে মহাশ্বেতা দেবী আজও মাতৃরূপে বিরাজ করেন। ভূমিদাস প্রথার বিরুদ্ধে লড়েছেন, বলা যায়— ভারতের ভূমিদাস প্রথা নিয়ে তাঁর একটা থিসিস রয়েছে, যা সমাজবিজ্ঞানের গবেষকদের কাজে লাগবে। তিনি কমপক্ষে ২০টি সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয় ভাবে যুক্ত ছিলেন যার মধ্যে রিকশা শ্রমিক, বিড়ি শ্রমিক, এমনকী, বাউল ফকির, দরবেশ সংগঠনও আছে। তিনি সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলে বিনা বিচারে আটকে থাকা রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির জন্যও লড়াই করেছেন, সেই ধারাবাহিকতায় লড়াই করেছেন নর্মদা বাঁধ, গুজরাত হত্যাকাণ্ড, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়েও।
মহাশ্বেতা দেবীর লেখার টেবিল কখনও বদলায়নি। বালিগঞ্জ স্টেশন রোডে জ্যোতির্ময় বসুর বাড়িতে লোহার ঘোরানো সিঁড়িওয়ালা ছাদের ঘর, গল্ফ গ্রিন বা রাজডাঙা যেখানেই থাকুন না কেন, টেবিলটি সর্বদা অগোছালো। গাদাগুচ্ছের খাম, আবেদনপত্র, সরকারি লেফাফা, সম্পাদিত ‘বর্তিকা’ পত্রিকার প্রুফ-কপি ছড়িয়েছিটিয়ে। এক পাশে কোনও ক্রমে তাঁর নিজস্ব রাইটিং প্যাড ও কলমের সকুণ্ঠ উপস্থিতি। সাদা বড় সেই চৌকো প্যাডে ডট পেনে গোটা গোটা অক্ষরে লেখাই তাঁর অভ্যাস।
লেখা মানে, সাহিত্য অনেক পরে। কোন শবর গ্রামে টিউবওয়েল বসেনি, ব্যাঙ্ক কোন লোধা যুবককে ঋণ দিতে অস্বীকার করেছে— সরকারি দফতরে ক্রমাগত চিঠি লেখাই যেন তাঁর প্রথম কাজ। জ্ঞানপীঠ থেকে ম্যাগসাইসাই পুরস্কারে ভূষিত মহাশ্বেতা যতখানি লেখক, ততখানিই অ্যাক্টিভিস্ট। ৮৮ বছর বয়সেও নিজের হাতে ইনসুলিন ইঞ্জেকশনের ছুঁচ ফোটাতে ফোটাতে যিনি বলতেন, ‘‘তোমরা যাকে কাজ বলো, তার চেয়ে এ সব অকাজে আমার উৎসাহ বেশি।’’
একটিমাত্র অভিধায় মহাশ্বেতাকে ধরা তাই অসম্ভব। তিনি ‘হাজার চুরাশির মা’। ‘অরণ্যের অধিকার’-এর সেই প্রবাদপ্রতিম লাইন ‘উলগুলানের মরণ নাই’-এর জননী। অন্য দিকে তিনি সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের অন্যতম মুখ। এক দিকে তাঁর লেখায় বিহার-মধ্যপ্রদেশের কুর্মি, দুসাদ, ভাঙ্গিরা সজোরে বাঙালি পাঠকের দরজায় ঘা দেয়। আর এক মহাশ্বেতা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে দিল্লি বোর্ডের শিক্ষার্থীদের জন্য ‘আনন্দপাঠ’ নামে সঙ্কলন তৈরি করেন, জিম করবেট থেকে লু স্যুন, ভেরিয়ের এলউইনকে নিয়ে আসেন বাংলা অনুবাদে। তাঁর বাড়িতে গ্রাম থেকে আসা হতদরিদ্র মানুষের নিত্য আনাগোনা।
কয়েক বছর আগের কথা। কোনও কাজে কলকাতায় এসে এক শবর যুবক আস্তানা নিয়েছেন মহাশ্বেতার বাড়িতে। স্নান সেরে বেরিয়ে তাকের উপরে রাখা মহাশ্বেতার চিরুনি দিয়েই ঘসঘস করে চুল আঁচড়ালেন! এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিলেন সেখানে তখন উপস্থিত এক নামজাদা বাংলা দৈনিকের সাংবাদিক। জাতপাতহীন, শ্রেণিহীন, শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন এ শহরে অনেক বামপন্থীই দেখে থাকেন। কিন্তু নিজের ব্যক্তিগত তেল-সাবান চিরুনি অন্যকে ক’জন অক্লেশে ব্যবহার করতে দিতে পারেন? কী ভাবে এল এই অনায়াস আপনাত্তি? ২০০১ সালে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাককে বলেছিলেন মহাশ্বেতা, ‘যখন শবরদের কাছে গেলাম, আমার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর মিলে গেল। আদিবাসীদের নিয়ে যা কিছু লিখেছি, ওদের মধ্যেই তা খুঁজে পেলাম।’
নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা জনপ্রিয় হওয়ার অনেক আগেই তো মহাশ্বেতার লেখায় উঠে আসছিল অশ্রুত সব স্বর। ১৯৬৬ সালে বেরিয়েছিল ‘কবি বন্দ্যঘটী গাঞির জীবন ও মৃত্যু।’ সেখানে ঔপন্যাসিকের স্বীকারোক্তি: ‘অনেক দিন ধরেই ইতিহাসের রোমান্স আমাকে আর আকর্ষণ করছিল না। এমন এক যুবকের কথা লিখতে চেয়েছি যে তার জন্ম ও জীবনকে অতিক্রম করে নিজের জন্য একটি জগৎ তৈরি করতে চেয়েছিল, যে জগৎ তার নিজের সৃষ্ট।’ ‘চোট্টি মুণ্ডা ও তার তীর’-এও সেই অবিনশ্বর স্পিরিট: ‘চোট্টি দাঁড়িয়ে থাকে। নিরস্ত্র। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সে চিরকালের সঙ্গে মিলেমিশে হয়ে যায় নদী, কিংবদন্তী। একমাত্র মানুষই যা হতে পারে।’ এই প্রান্তিক জীবনের কাহিনিকার হিসেবেই মহাশ্বেতা পরিচিত হবেন আন্তর্জাতিক দুনিয়ার বিদ্বৎসমাজে। গায়ত্রী
চক্রবর্তী স্পিভাক ইংরেজিতে অনুবাদ করবেন মহাশ্বেতার লেখা। মহাশ্বেতাকে তাই দেখতে হবে বাংলা ছাড়িয়ে, ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে।
আন্তর্জাতিক মননের সঙ্গে মহাশ্বেতার পরিচয় অবশ্য জন্ম থেকেই। বাবা: কল্লোল যুগের বিখ্যাত লেখক যুবনাশ্ব বা মণীশ ঘটক। কাকা: ঋত্বিক ঘটক। বড়মামা: অর্থনীতিবিদ, ‘ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা শচীন চৌধুরী। মায়ের মামাতো ভাই: কবি অমিয় চক্রবর্তী। ক্লাস ফাইভ থেকে শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা। সেখানে রবীন্দ্রনাথ বাংলার ক্লাস নেন, নন্দলাল বসু ও রামকিঙ্কর বেইজকে শিক্ষক হিসেবে পাওয়া যায়। সময়টাও নজর করার মতো। ১৯২৬ সালের ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশের পাবনা (অধুনা রাজশাহি) জেলার নতুন ভারেঙ্গা গ্রামে মহাশ্বেতার জন্ম। ঠিক তার পরের বছরই জন্মাবেন ‘আগ কি দরিয়া’র লেখক কুরাতুলিন হায়দার। দু’জনের লেখাতেই মহাকাব্যিক বিস্তারে উঠে আসবে জাতপাত, পিতৃতন্ত্র। মহাকাব্যিক চেতনা থেকেই তো ‘স্তনদায়িনী’র নাম যশোদা। থানায় ধর্ষিতা দোপদী মেঝেন দ্রৌপদীরই আধুনিক সংস্করণ। ভারতীয় নিম্নবর্গ যে স্থবির অচলায়তন নয়, সেখানেও আছে খাড়াখাড়ি বিভাজন— তাও কি ধরা পড়েনি ‘শ্রীশ্রীগণেশমহিমা’য়: ‘‘ভাঙ্গিদের হোলির পরব শেষ হয় দু’টি শুয়োর মেরে, মদেমাংসে সারা রাত হল্লা করে। দুসাদরা এখানে ছিন্নমূল। ফলে বছর দুয়েক হল, তারাও ভাঙ্গিদের সঙ্গে হোলির দিনে মাখোমাখো করে।’’
সাহিত্যযাত্রার এই মোড়ে একদিনে এসে দাঁড়াননি মহাশ্বেতা। তাঁর পিছনে ছিল দীর্ঘ পরিক্রমা। ’৪৬-এ বিশ্বভারতী থেকে ইংরেজির স্নাতক। এমএ পাশ করে বিজয়গড়ে জ্যোতিষ রায় কলেজে পড়ানো। তার আগে ১৯৩৯ সাল থেকেই ‘রংমশাল’ কাগজে ছোটদের জন্য লেখালেখি শুরু। স্বাধীনতার বছরে ‘নবান্নে’র রূপকার বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিয়ে। সে সময়টা কখনও সংসার চালাচ্ছেন টিউশনি করে, কখনও সাবানগুঁড়ো বিক্রি করে। মাঝে এক বার আমেরিকায় বাঁদর চালান দেওয়ার পরিকল্পনাও নিয়েছিলেন, সফল হয়ে উঠতে পারেননি। ১৯৬২’তে বিবাহবিচ্ছেদ, পরে অসিত গুপ্তের সঙ্গে দ্বিতীয় বিবাহ। ১৯৭৬ সালে সেই দাম্পত্যেরও অবসান ঘটে।
ইতিমধ্যে, পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি একমাত্র পুত্র নবারুণকে বাবার কাছে রেখে, চেয়েচিন্তে একটা ক্যামেরা জোগাড় করে উঠে পড়েছিলেন আগরার ট্রেনে। তন্নতন্ন করে রানির কেল্লা, মহালক্ষ্মী মন্দিরে ঘুরলেন। সন্ধ্যার অন্ধকারে টাঙাওয়ালা, কাঠকুটোর আগুন ঘিরে বসা কিষাণ মেয়েদের থেকে গল্প শুনলেন, ‘রানি মরেনননি। বুন্দেলখণ্ডের মাটি আর পাহাড় আজও ওঁকে লুকিয়ে রেখেছে।’
এর পরেই ‘ঝাঁসির রানী’ উপন্যাস ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক হিসেবে বেরোল এবং একা একা ঘুরে বেড়িয়ে লেখার উপাদান সংগ্রহ করার বিপ্লবিয়ানায় মহাশ্বেতা তাঁর পূর্বসুরি লীলা মজুমদার, আশাপূর্ণাদের থেকে বেশ খানিকটা আলাদা হয়ে গেলেন। আলাদা হয়ে গেলেন তাঁর অকুণ্ঠ রাজনৈতিক উচ্চারণেও। ‘অগ্নিগর্ভ’ উপন্যাসের সেই মোক্ষম লাইন: ‘জাতিভেদের সমস্যা ঘুচল না। তৃষ্ণার জল ও ক্ষুধার অন্ন হয়ে রইল রূপকথা। তবু কত দল, কত আদর্শ, সবাই সবাইকে বলে কমরেড।’ কমরেডরা তো কোনও দিনই ‘রুদালি’, ‘মার্ডারারের মা’-এর সমস্যা দেখেননি। ‘চোলি কে পিছে’ গল্পের স্তনহীন নায়িকা যে ভাবে ‘লক আপে গ্যাংরেপ… ঠেকেদার গাহক করে, গানা বাজায়’ বলে চেঁচাতে থাকে, পাঠকেরও কানে তালা লাগে।
সব মিলিয়ে মহাশ্বেতা যেন প্রিজমের মতো। কোনও দিন রুক্ষভাষী, কোনও দিন আড্ডা না মেরে ছাড়বেনই না। শেষ দিকে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা, পুত্রশোক অনেকটাই ধ্বস্ত করে দিয়েছিল। তবু মহাশ্বেতাই কি হয়ে থাকলেন রাজনীতিসঞ্জাত বহুমুখী বাঙালির শেষ উত্তরাধিকার? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভামঞ্চে তাঁর উপস্থিতি নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেছেন। মহাশ্বেতা পাত্তা দেননি। লোকের কথায় পাত্তা দেওয়ার অভ্যাসটি কোনও দিনই তাঁর করায়ত্ত ছিল না।
মহাশ্বেতার লেখার মধ্যে, শিকড় খোঁজার চেষ্টার মধ্যে, নিহিত রয়েছে ইতিহাস-অন্বেষণ। প্রথম দিকের লেখা ঝাঁসীর রানীতেই যে ইতিহাস অন্বেষণ আছে তা নয়। লোকবৃত্ত এবং লোক ইতিহাসে তাঁর অসম্ভব ঝোঁক। অতীত, ইতিহাস তাঁর লেখায় এসেছে। বেশ কিছু লেখায়। যেমন চম্বা, দেওয়ানা, কবি বন্দ্যঘটি গাঞির জীবন ও মৃত্যু এ রকম নানা গল্পে। সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে তো অজস্র লেখা। বর্তমানও তো পরে ইতিহাস হবে। বর্তমানের মধ্যে স্থিত থাকে ইতিহাসের উপাদান। কিছু লেখায় এমন রূপকধর্ম রয়েছে, যা সর্বকালে প্রাসঙ্গিক। যেমন স্তনদায়িনী। সেটা একটা নির্দিষ্ট সময়কালের লেখা হয়েও চিরকালীন। শিল্পের জন্য শিল্প করেননি তিনি। তিনি বলেছিলেন যে লোককথা বা মৌলিক সাহিত্য থেকে পাওয়া উপাদানগুলিকে গভীর শ্রদ্ধা করেন তিনি। কেন না তা থেকে বোঝা যায় সাধারণ মানুষ ঘটনাটিকে কী চোখে দেখেছেন।
উনিশ শতকে বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের যাত্রা শুরু। তখন ঔপনিবেশিক শাসনের কাল এবং বাংলা উপন্যাস যাত্রায় ছিল ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রভাব। মূলত সেই সময় সামাজিক নকশামূলক রচনা এবং ইতিহাসকেন্দ্রিক রোমান্সের ধারায় আধুনিক উপন্যাসের সূচনা করেন প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-১৮৮৩), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪), কালীপ্রসন্ন সিংহ (১৮৪০-১৮৭০) প্রমুখ। তবে আধুনিক বাংলা উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সর্বজনস্বীকৃত।
সেই সময় ঔপন্যাসিকরা আর্থ-সামাজিকভাবে উচ্চ ও মধ্যবিত্তের অবস্থান থেকে এসেছিলেন। তাদের উপন্যাসে বাংলার ভূমি ও মানুষের উপস্থিতি থাকলেও তা ছিল ঔপনিবেশিক অবস্থান থেকে অভিজাত ও মধ্যবিত্তের প্রেক্ষাপটকে প্রাধান্য দিয়ে নির্মাণ। কাহিনী ও চরিত্র বিন্যাসে তা পরিলক্ষিত।
নিম্নবর্গের মানুষের কথা ছিল উচ্চবিত্তীয় সামান্ত মানসিকতার মধ্য থেকে উপস্থাপিত। তাই বলা যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮—১৮৯৪), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮)-এর উপন্যাস নিরীক্ষায় বাংলার শিকড়ের আখ্যান উপস্থাপিত হলেও তা ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রবহমানতায় আবিষ্ট উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত। তাঁদের দ্বারা উপন্যাস সাহিত্যের যে যুগের বিকাশ ঘটেছিল, তার বিরুদ্ধে চূড়ান্তভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয় ‘কল্লোল’ বাস্তবতার যুগে। এ সময় থেকে বাংলা উপন্যাস গতানুগতিক ইউরোপীয় উপন্যাসের বিষয় ও আঙ্গিকের অভিনবত্বে আচ্ছন্ন না থেকে নতুনভাবে ভারতীয় জীবনমুখিতায় অভিষিক্ত হতে শুরু করে। এই পরিবর্তনীয় ভাবধারায় বাংলা উপন্যাসে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জীবনের বাধা পরিধিকে অতিক্রম করে সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবর্গের মানুষের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১), বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬), সতীনাথ ভাদুড়ী (১৯০৬-১৯৬৫), অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১৯১৪-১৯৫১), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (১৯২২-১৯৭১) প্রমুখ ঔপন্যাসিক তাঁদের অনুসন্ধানী দৃষ্টিক্ষেপণে নতুন আখ্যান নিয়ে আসেন বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে। তাঁরা দীর্ঘদিনের অবহেলিত ও উপেক্ষিত নিম্নবর্গের সমাজ ও মানুষের কথা নিয়ে আসেন সংবেদনশীলভাবে।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপ্যাধ্যায় উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে যেসব চরিত্র তৈরি করেছেন, তার বেশিরভাগই ছিল উচ্চবর্গের মানুষ। তাঁর রচিত দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫), কপালকুণ্ডলা (১৮৬৬), চন্দ্রশেখর (১৮৭৫) প্রভৃতি উপন্যাস লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই, এসব উপন্যাসের চরিত্ররা সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণি থেকে উঠে আসা মানুষবিশেষ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপন্যাসে তুলে আনলেন উচ্চবিত্ত থেকে উচ্চ মধ্যবিত্তের মানুষের কথা, তাঁদের সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। তাঁর রচিত চোখের বালি (১৯০৩), গোরা (১৯১০), ঘরে-বাইরে (১৯১৬), যোগাযোগ (১৯২৯) প্রভৃতি উপন্যাসে তা স্পষ্ট। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উপন্যাস রচনায় উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্তের ঘরের কথা, নারীর কথা এলো সমাজের মানবিকবোধ পরিবার ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের আলোকে। তাঁর চরিত্রগুলো প্রধানত সামন্ততান্ত্রিক সমাজ থেকে তুলে আনা। এক্ষেত্রে তাঁর রচিত দেবদাস (১৯১৭), চরিত্রহীন (১৯১৭), শ্রীকান্ত (১৯১৭-৩৩), দেনাপাওনা (১৯২৩) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে নিম্নবর্গের মানুষের আখ্যান নিয়ে এলেন তিন বন্দ্যোপাধ্যায়। ভূমিমুখী ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাত তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাসের বিষয়বস্তুর নতুনত্বে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মানুষজনের গণ্ডি অতিক্রম করে নিম্নবর্গের মানুষজনকে নিয়ে এলেন কমিউনিস্ট-কথিত সমাজ রূপান্তরের মাধ্যমে। তাঁর রচিত ধাত্রীদেবতা (১৯৩৯), কালিন্দী (১৯৪০), গণদেবতা (১৯৪০) ও কবি (১৯৪৪) উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গণদেবতা উপন্যাসটি সম্পর্কে সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন— শুধু তারাশঙ্করেরই নয়, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যেরই একটি যুগ-পরিচায়ক উপন্যাস।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাসটি যে কারণে বিশিষ্ট হয়ে উঠে তা হলো অস্পৃশ্য ডোম বা দলিত জনগোষ্ঠী থেকে কবি নির্মাণ। অন্যদিকে হাঁসুলী বাঁকের উপকথা (১৯৪৭) উপন্যাসে তিনি হাঁসুলী নদীর বাঁকে বসবাসকারী কাহার সমাজের মানুষ। নাগিনীকন্যার কাহিনী (১৯৫৩)-তে তিনি বেদে সম্প্রদায়ের জীবনকে উপন্যাসে রূপ দেন। মূলত তিনি বীরভূম, মানভূম, সাঁওতাল পরগনা অঞ্চলের লোকজীবন, গণমানুষ, উপকথা-রূপকথা গ্রহণ করে আঞ্চলিক উপন্যাসের সূচনা করেন।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস পথের পাঁচালী (১৯২৮)-তে তিনি শুধু গ্রামীণ জীবনকে চিত্রিত করেই আলোচিত হননি বরং তার প্রাকৃতবাদের প্রকাশও ঘটে। তবে তাঁর আরণ্যক (১৯৩৯) উপন্যাসে অরণ্য প্রকৃতি ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি লক্ষণীয়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস প্রসঙ্গে অচ্যুত গোস্বামী বলেন— “…বিভূতিভূষণের উপন্যাসে প্রাকৃতবাদ উভয় অর্থে প্রতিফলিত হয়েছে। বাস্তবের বিজ্ঞানী-সুলভ চিত্রায়ণ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ‘ব্যাক টু নেচার’ আবেদন।” অন্যদিকে রাজনৈতিক উপন্যাস দিয়ে শুরু করলেও সতীনাথ ভাদুড়ী শিকড়সন্ধানী হয়ে চলে গেলেন একেবারে লাঞ্ছিত-বঞ্চিত শ্রেণির মানুষের কাছে ঢোঁড়াইচরিতমানস (১৯৪৯, ১৯৫১) উপন্যাসে। সপ্তকাণ্ডের রামায়ণের মতোই এই উপন্যাসে সাতটি কাণ্ডে বিভক্ত করে রচিত। সাত কাণ্ডের উপন্যাসে অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষজন অধ্যুষিত এলাকা তাত্মাটুলি-ধাঙড়পল্লীর কাহিনী ও ভারতবর্ষের ঔপনিবেশিক রাজনীতি, সামন্তবাদ, কংগ্রেসি গান্ধীবাদ প্রভৃতিকে সমান্তরালে চিত্রিত করেন।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৩৬), পুতুল নাচের ইতিকথা (১৯৩৬), তিনি পূর্ববঙ্গীয় ভাষার ব্যবহার ও নদীকেন্দ্রিক নিম্নবর্গের জেলে সম্প্রদায়ের জীবনকে উপন্যাসে নিয়ে আসেন। অন্যদিকে খোদ জেলে পরিবার থেকে উঠে এসে হৃদয়াবেগে স্ফূর্ত হয়ে উপন্যাস রচনা করেন অদ্বৈতমল্ল বর্মণ। নিম্নবর্গের জেলে সম্প্রদায়কে নিয়ে তাঁর অনবদ্য রচনা তিতাস একটা নদীর নাম (১৯৪৫-৪৭) উপন্যাসটি উল্লেখযোগ্য। নিম্নবর্গীয় আখ্যান নির্মাণে নিজস্ব ভাষার সক্রিয়তা তৈরি করেন কমলকুমার মজুমদার (১৯১৪-১৯৭৯)। তাঁর অন্তর্জলী যাত্রা (১৯৫৯) এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। এরপর অমিয়ভূষণ মজুমদার (১৯১৮-২০০১), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (১৯২২-১৯৭১), মহাশ্বেতা দেবী (১৯২৬-২০১৬), দেবেশ রায় (১৯২৬), অভিজিৎ সেন (১৯৪৫) বিষয়ের বহুমাত্রিকতায় যুক্ত হন। তাঁরা নিম্নবর্গের জীবনসংগ্রামের ধারাবাহিকতায় এসে প্রতিবাদী ও বিপ্লবী উপাখ্যান নিয়ে আসেন উপন্যাস সাহিত্যে। বিশ শতকে তাঁদের এই ধারাকে উপন্যাসের নবযাত্রা বলা যেতে পারে।
এই অভিযাত্রায় বিষয়ের বহুমাত্রিকতা ও দেশজ আখ্যানের অনুসন্ধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন মহাশ্বেতা দেবী। তিনি ইতিহাস ও রাজনীতি থেকে যে উপন্যাস রচনা শুরু করেন, সেখানে যেমন ঝাঁসির রানীর মতো চরিত্র রয়েছে তেমনি রয়েছে সার্কাসের শিল্পী ও নৃত্যশিল্পীদের আখ্যান। তাঁর শুরুর দিকের উপন্যাস ঝাঁসির রানী (১৯৫৬), মধুরে মধুরে (১৯৫৮), প্রেমতারা (১৯৫৯), আঁধার মানিক (১৯৬৬), বায়স্কোপের বাক্স (১৯৬৪)সহ প্রভৃতিতে নানা শ্রেণির জীবনের উপস্থিতি পাওয়া যায়। তবে তাঁর সবচেয়ে আলোচিত রাজনৈতিক উপন্যাস ‘হাজার চুরাশির মা’ (১৯৭৪), এই উপন্যাসকে তার সাহিত্যের বাঁক পরিবর্তনের সূচনা বলে মনে করা হয়। এটা তাঁর দ্বিতীয় পর্যায়ের রচনাকাল। এ সময় তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হলো : হাজার চুরাশির মা (১৯৭৪), ঘরে ফেরা (১৯৭৯), তিতুমীর (১৯৮৪), স্বেচ্ছা সৈনিক (১৯৮৬), অক্লান্ত কৌরব (১৯৮২), বিবেক বিদায় পালা (১৯৮৩), বন্দোবস্তি (১৯৮৮), মার্ডারারের মা (১৯৯২) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
এরপর তিনি ইতিহাস অনুসন্ধানে চলে গেলেন একেবারে প্রান্তিক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে। ইতিহাস, রাজনীতি ও উপকথাকে কেন্দ্র করে যে উপন্যাস লেখা শুরু করেন, তা সভ্য সমাজের মানুষের বিচরণের বাইরের জগৎ। সত্তরের মাঝামাঝি সময়ে তাঁর উপন্যাসকে নিয়ে গেলেন একেবারে অন্য আলোয়, যা তাঁর উপন্যাস রচনার তৃতীয় পর্যায় হিসেবে ধরা যায়। সেই পথে গিয়ে মহাশ্বেতা দেবী একের পর এক উপন্যাস রচনা করে স্বতন্ত্রতা প্রকাশ করেন। তিনি উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক ভৌগোলিক পরিবর্তনের সঙ্গে ভারতীয় রাজনৈতিক ইতিহাসের পরিবর্তনের ধারায় সে দেশীয় আদিবাসী জীবনের পরিবর্তন বর্ণনা করেন। পাহাড়ি অরণ্য জীবনের সঙ্গে উপন্যাসে ফুটে উঠে পরিবেশের বিপন্নতার চিত্র, যা আজকের পৃথিবীকেও বিচলিত করে, সেই আখ্যান সাহিত্যে রূপ দিয়ে আদিবাসী জীবনে ঘটে যাওয়া উলগুলান (১৯০০), কোলহান (১৮৩৫) এবং হুল (১৮৫৫-৫৬) সম্পর্কে পাঠক মনে সাড়া জাগান মহাশ্বেতা দেবী। তাঁর আদিবাসী জীবনকেন্দ্রিক উপন্যাসগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য : কবি বন্দ্যঘটী গাঞির জীবন ও মৃত্যু (১৯৬৭), অরণ্যের অধিকার (১৯৭৫), চোট্টি মুণ্ডা এবং তার তির (১৯৮০), সুরজ গাগরাই (১৯৮৩), স্বেচ্ছাসৈনিক (১৯৮৫), টেরোড্যাকটিল, পূরণসহায় ও পিরথা (১৯৮৭), বন্দোবস্তী (১৯৮৯), ক্ষুধা (১৯৯২), কৈবর্ত খণ্ড (১৯৯৪) প্রভৃতি। এছাড়া অরণ্যের অধিকার উপন্যাসের প্রেক্ষিতেই কিশোরদের জন্য বিরসা মুণ্ডা (১৯৮১) নামের একটি উপন্যাসও লিখেন। উল্লেখ্য, উপন্যাসগুলো রচনার ক্ষেত্রে রয়েছে বিষয়বস্তু এবং প্রকরণগত বিশিষ্টতা।
অরণ্যচারী জনগোষ্ঠীর মুখে মুখে ঘুরে ফেরা জীবন ও ঐতিহ্য থেকে সেই জাতিসত্তার যে ইতিহাস তিনি রচনা করেন, তা বঙ্কিমচন্দ্রের দেখানো পথে বা ভাবধারায়ও নয়, একেবারে তার নিজের মতো করে প্রকাশ। মহাশ্বেতা অন্ত্যজ আদিবাসীদের চোখ দিয়ে জীবনকে ব্যাখ্যা করেন। এসব উপন্যাসে প্রধান চরিত্রগুলো এসেছে আদিবাসী সমাজ থেকে। বিভূতিভূষণ যেমন তার ‘আরণ্যক’ উপন্যাসটিতে অরণ্যচারী প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা এনেছিলেন। যা ছিল একজন কলকাতার বাবুর চোখ থেকে দেখা। সেখানে মুগ্ধতা আর করুণার চোখে নির্মিত হয়েছিল প্রেক্ষাপট। কিন্তু মহাশ্বেতার অরণ্যের অধিকারের কথা সেই সমাজের জীবনাপোলব্ধি। তাঁদের বাঁচার অধিকার থেকে তুলে আনা প্রেক্ষাপট। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অরণ্যবহ্নি (১৯৬৬) ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহের অমর নায়ক সিধু-কানুর কৌমচেতনা ও দেশচেতনায় উজ্জীবিত উপন্যাস। সত্যেন সেনের বিদ্রোহী কৈবর্ত (১৯৬৯) উপন্যাসটি পাল যুগে উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্র অঞ্চলের শূদ্রস্থানীয় কৈবর্ত বিদ্রোহ নিয়ে রচিত। অবহেলিত কৈবর্ত বিদ্রোহ নিয়ে মহাশ্বেতা দেবীও একটি উপন্যাস রচনা করেছেন, কৈবর্ত খণ্ড (১৯৯৪) নামে। সমরেশ বসু (১৯২৪-১৯৮৮) রচিত মহাকালের রথের ঘোড়া (১৯৭৭) যা আদিবাসী জীবনঘনিষ্ঠ উপন্যাস। চল্লিশের দশকের কথকার সাবিত্রী রায় (১৯১৮-১৯৮৫) তাঁর পাকা ধানের গান (১ম পর্ব ১৯৫৬, ২য় পর্ব ১৯৫৭ এবং ৩য় পর্ব ১৯৬৫ সালে) লিখেন। যেখানে তিনি হাজং অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলনের প্রেক্ষিত নিয়ে আসেন ।
মহাশ্বেতা দেবীর বিশিষ্টতা তিনি বাংলা সাহিত্যে সর্বাধিক আদিবাসী জীবনকেন্দ্রিক উপন্যাস রচনা করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তাঁর কাছে সাহিত্য শুধু বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনার মিশ্রণ নয়, বরং সাহিত্যও শ্রমসাধ্য বিষয়। মহাশ্বেতার কলমের কালি বুলেটের মতো সমাজকে বিদ্ধ করে। ধীমান দাশগুপ্ত মহাশ্বেতার সাহিত্যকৃতির নান্দনিক তাৎপর্য ব্যাখ্যায় বলেন— “মহাশ্বেতার সাহিত্যিক ক্ষেত্রটিকে, বলা যায়, মানিকের রিয়ালিজম, সতীনাথের ফর্ম্যালিজম এবং তারাশঙ্করের এক্সপ্রেশনিজমের এক একীভূত ক্ষেত্র। আমার বিচারে মানিক বা তারাশঙ্করের চেয়েও সতীনাথের সঙ্গে মহাশ্বেতার আত্মীয়তা যেন অধিক। … সতীনাথের মতোই মহাশ্বেতাও ‘শ্রেণিবিভক্ত বর্ণবিচ্ছুরিত যৌনতাশাসিত ধর্মসাপেক্ষ প্রাদেশিকতা-নির্ভর’ এক ভারতবর্ষের লেখক।”
বাংলা সাহিত্যে মহাশ্বেতা দেবীকে নিছক সমাজতাত্ত্বিক নয় বরং সমাজ মনস্তাত্ত্বিক বলা যেতে পারে। এক স্বতন্ত্র ঘরানার লেখক তিনি। বলা যায় পোস্টমডার্নিজমের ক্ষেত্রে সাব-অলটার্ন আসার আগে থেকেই মহাশ্বেতা সাহিত্যে নিজের মতো করে সাব-অলটার্ন চর্চা করে গেছেন। অনেক বেশি শিকড়ে গিয়েই তিনি অরণ্যের অধিকার লিখেছেন, তা প্রমাণিত হয় যখন তিনি আদিবাসী মুণ্ডা সমাজের ঘরের লোক হয়ে ওঠেন। সেই আদিবাসী সমাজ তাকে ‘মারাং দাই’ বলে স্বীকার করে নেয়। মহাশ্বেতা দেবী কাজের প্রতি এতই সচেতন থেকেছেন যে তিনি আদিবাসী সংস্কৃতির ইতিহাসের মাধ্যমে তথা তাঁদের লোকগাথা, উপকথা, মিথকে কেন্দ্র করে যে জীবন ও সংগ্রামকে তুলে ধরে উপন্যাস লিখেছেন, তা মোটেও আরোপিত হয়ে ওঠে না বরং জীবনের প্রতিচ্ছবি হয়ে যায়। এভাবে সত্তুরের দশকের পর তিনি পুরোপুরিভাবে সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে এসটাবলিশমেন্ট-বিরোধী হয়ে ওঠেন।
মহাশ্বেতা দেবীর আদিবাসী উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে। উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে ঘটনার নাটকীয়তার চেয়ে মানব-চরিত্রের দিকে বিশেষ মনোযোগ তিনি দিয়েছেন। তার উপন্যাসের বেশিরভাগ প্রধান চরিত্রগুলো আদিবাসী শ্রেণি থেকে উঠে আসা মানুষ। অরণ্যের অধিকার এ বীরসা মুণ্ডা, ধানী মুণ্ডা, সুগানা, করমি, কোমতা, সালী ও ডোনকা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। চোট্টি মুণ্ডা এবং তীর উপন্যাসটিতে চোট্টি মুণ্ডা, ধানী মুণ্ডা, দুখিয়া, হরমু, পাহানসহ অসংখ্য চরিত্র মুণ্ডা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। এছাড়া কবি বন্দ্যঘটী গাঞির জীবন ও মৃত্যু-তে কবি বন্দ্যঘটী গাঞি, সুরজ গাগরাই-এর সুরজ গাগরাই, নান্দি কালু সুমরাই প্রমুখ কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলো আদিবাসী মানুষ। তবে টেরোড্যাকটিল, পূরণ সহায়ও পিরথা-এর প্রধান চরিত্র এনেছেন নিম্ন মধ্যবিত্ত হিন্দু সমাজের প্রতিনিধি, অন্যদিকে বিখিয়সহ বেশ কিছু চরিত্র আদিবাসী। তার চরিত্রেরা আদিভারতীয় অধিবাসী, নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি।
মহাশ্বেতা দেবী উপন্যাসে অসংখ্য বীরের কাহিনী তুলে এনেছেন। এই বীরের কাহিনী শুধু বীরসা চরিত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এছাড়াও আরও বীর চরিত্র আমরা পেয়েছি। যেমন— চোট্টি মুণ্ডা এবং তার তীর-এর চোট্টি একজন বীর তীরন্দাজ। সুরজ গাগরাই-এর সুরজ চরিত্রটিতেও বীরের উপস্থিতি দেখতে পাই। মহাশ্বেতা দেবী লেখাকে সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গায় নিয়ে গেছেন। তার উপন্যাস বেশিরভাগই সময়ের দলিল হয়ে পৌঁছে যাবে ভবিষ্যতের দিকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় অরণ্যের অধিকার উপন্যাসটি। এ ক্ষেত্রে মহাশ্বেতা গ্রন্থটির ভূমিকায় বলেছেন— “এ উপন্যাস রচনায় সুরেশ সিং রচিত Dust storm and Hanging mist বইটির কাছে আমি সবিশেষ ঋণী। সুলিখিত তথ্যপূর্ণ গ্রন্থটি ছাড়া বর্তমান উপন্যাস রচনা সম্ভব হতো না।” সুরেশ সিং-এর বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে। মহাশ্বেতা তার অরণ্যের অধিকার রচনা প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে। কিন্তু সুরেশ সিং-এর বই দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৮৩ সালে। Birsa Munda and His Movement-১৮৭৪-১৯০১ নামে। ইতিহাস-গবেষণা ও উপন্যাস রচনার এমন পারস্পরিক সমন্বয় খুব একটা ঘটে না। এ থেকে বলা যায় যে, মহাশ্বেতা দেবী ইতিহাস থেকে এমন চরিত্র নির্মাণ করেন, যা নিজেই ইতিহাস হয়ে যায়।
মহাশ্বেতা দেবী আদিবাসী উপন্যাসে লোকজনের মুখে মুখে ঘুরেফেরা ভাষার অনবদ্য ব্যবহার করেন, তা চমৎকারভাবে চলতি বাংলার সঙ্গে অঞ্চলিক শব্দের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে। তাঁর উপন্যাসের ভাষায় কাব্যিক বাহুল্য পূর্ণ নয়। ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যের সঙ্গে পরিমিতি বোধ লক্ষণীয়। উপন্যাসে মহাশ্বেতা দেবী ভূমিলগ্ন-আদিবাসীর জীবন আখ্যানকে এমনভাবে তুলে এনেছেন যা মূলত হাজার বছরের ভারতীয় প্রান্তিক আদিমজনের জীবন-সংস্কৃতিরই সাক্ষ্যবাহী। যা বাংলা উপন্যাসকেও নতুন আঙ্গিকে সমৃদ্ধ করেছে।
তিনি একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। বর্তিকা। বর্তিকার প্রতিটি সংখ্যা, সমাজবিদ্যার গবেষকদের সংগ্রহ করে রাখার মতো। একটি সংখ্যার সূচিপত্র এ রকম: লোধা জীবনের কথা, পশ্চিম মেদিনীপুরের ভূমিদাস প্রথা, ঝাড়খণ্ডের লোকগীতিতে কৃষক, ডোম জাতির কথা, অরণ্যের প্রতিরোধ, বেঙ্গল পেপার মিলের শ্রমিক, নিজের কথা: চুণী কোটাল, এ ছাড়া কিছু গল্প-কবিতা। গল্প লিখেছেন নবারুণ ভট্টাচার্য, অভিজিৎ সেন, জয়ন্ত জোয়ারদার এবং মদন দত্ত, প্রহ্লাদ ভুক্তা, ভজহরি মালো। এই মদন দত্ত তখন একজন রিকশাচালক। আজ তিনি একজন আলোচিত লেখক মনোরঞ্জন ব্যাপারী। সেই বর্তিকা পত্রিকায় একজন স্বল্পশিক্ষিত চর্মকার যেমন নিজের লেখা লিখেছেন, একজন সব্জি বিক্রেতাও তেমনই।
তাঁর মতো বিশ্বব্যাপী খ্যাতি এ সময়ের অন্য কোনও সাহিত্যিকের হয়নি। ভারতের বহু ভাষায় তাঁর বহু লেখা অনূদিত হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য বহু ভাষায়। ২০০৬ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার থিম দেশ ছিল ভারতবর্ষ। উদ্বোধন করেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। ইংরাজি, ফরাসি, স্প্যানিশ, জার্মান, ইতালিয়ান তো বটেই, জাপানি এবং কোরিয়ান ভাষাতেও তাঁর বই অনূদিত হয়েছে।
সব মরণ নয় সমান। তিনি নেই, কিন্তু আছেন। মৃত্যুর পরই পুনর্জন্ম হয় একজন প্রকৃত লেখকের। তিনি বাংলা লেখার যে পরিধি বিস্তীর্ণ করেছেন, পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের দায় সেই পরিধির আরও বিস্তার ঘটানো। তবেই মহাশ্বেতা দেবীকে সম্মান দেখানো হবে।
(তথ্যসূত্র:
১- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৯শে জুলাই ২০১৬ সাল।
২- উইকিপিডিয়া।
৩- বাংলাপিডিয়া।
৪- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩০শে জুলাই ২০১৬ সাল।
৫- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫শে ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত