এই উঠ্ উঠ্….ঘুমের মধ্যে কার ডাক শুনে চমকে উঠে দেখলাম অমর মহারাজ জানলায় দাঁড়িয়ে ডাকছেন। আমি চমকে উঠে ভাবলাম মহারাজ নিশ্চয়ই সব জেনে গেছেন। এবং আমার আশংকা সত্যি করেই উনি বললেন “কি করেছিস তুই? কোথায় ফেলেছিস ?” ঘাবড়ে গিয়ে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় করবো না, ভুল হয়ে গেছে বলতে বলতে কাঁদো কাঁদো আমাকে উনি বললেন “চল আমায় দেখাবি”। আমি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে উনাকে সেই জায়গায় নিয়ে গেলাম। সাথে আরও যারা থাকতাম সবাই একসাথে। উনি গম্ভীর হয়ে শুধু বলেছিলেন “ও এই কাজটা করেনি, ওকে দিয়ে করানো হয়েছে, আর কে করিয়েছে তাও আমি জানি, আজ যা করেছো তার চেতনা একদিন তোমাদের হবে, সেদিন বুঝবে ভেঙেচুরে কিছু পাওয়া যায়না।।” ওই সদ্য ভোরের আধা অন্ধকারে মহারাজের কথাগুলো আমার মনে হয়েছিল যেন কোন সুদূর থেকে কেউ আমায় বলছে। তারপর উনি প্রেয়ার হলে গিয়ে আমাকে শাঁখ বাজাতে নির্দেশ দিলেন। শাঁখের শব্দে আমাদের প্রতিদিনের পাঠ, ভজন আর মহারাজের বক্তৃতা দিয়ে দিন শুরুই প্রথম কাজ ছিলো। কিন্তু সেদিনের মহারাজের কথায় কিছু একটা ছিল যা অনেকের সাথে আমাকেও কাঁদতে বাধ্য করলো। এরপর সবাই চলে গেলে আমি বললাম ” মহারাজ একটা জিনিস আমার কাছে আছে ওটা আমি ফেলিনি”। উনি বললেন “কি ?” আমি বললাম “বিবেকানন্দের ছবিটা”। উনি আবার বললেন “ওটা ফেলিসনি কেন?” আমি বলেছিলাম ” ওঁর কথা যখন আপনি বলেন খুব ভালো লাগে শুনতে, তাই বাড়ি নিয়ে গিয়ে মা বাবাকে দেখাবো বলে”। মহারাজ হেসে বললেন “ছবিটা নিয়ে আয়, আজ ঐটাতেই শুধু পূজো হোক, অন্যগুলো জোগাড় করতে একটু সময় লাগবে তো”। এই ছিলো বিবেকানন্দের সাথে আমার প্রথম পরিচয়, মনের টান।
ঘটনা ছিলো সুদূর বীরভূমের, রামপুরহাট থেকে ২৮কিমি দূরে পাহাড়ি টিলাভরা জঙ্গলের, তুম্বনী ফরেস্টের শ্রী শ্রী মায়ের শিষ্য মুকুন্দ দাসের রামকৃষ্ণ বিদ্যাপীঠের। যেখানে আমি পড়তাম। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। বাবা রেলের খালাসি। কেজি প্রতি দশ পয়সা কম হবে বলে মা সারাদিন ধানসিদ্ধ করে চাল করতেন বাড়িতে। ডোবার ধারে ধারে এমনিই হওয়া শাকপাতা, একটু ডাল, কোনো কোনোদিন সুতো দিয়ে কাটা হাঁসের ডিমের চার টুকরোর ঝোল আর কখনো মাস দুমাসে একদিন মাংস এই ছিলো দিনলিপি। চিরকালীন পড়াশোনায় অনাগ্রহী সেই আমি ক্লাস ফোরে ফেল করলাম। এরকম আশ্চর্য্য ঘটনায় অবাক হয়ে বাবা কোনো এক বন্ধু মারফৎ আমাকে মিশনে ভর্তি করে দিলেন। সত্তরের দশক। বীরভূম ছিলো নকশালদের গোপন কারবার ও আস্থানার পীঠস্থান। মিশনেও ছড়িয়ে গেছিলো তার শাখা প্রশাখা। রেডবুক, দেশব্রতী পেপার পড়ে আর দাদাদের কথা যতটুকু বুঝেছিলাম তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে ক্লাস সিক্সেই ওদের সাথে জড়িয়ে পড়লাম। নাম লেখালাম ওদের দলে। ভাবতে লাগলাম বিপ্লব করেই সমাজ পরিবর্তন হবে। অনুঘটক হয়ে সাথে ছিলো মা বাবার কষ্টটা, ওটা কোথাও গিয়ে বিঁধতো সবসময়। ক্লাস সেভেনে ওই নকশাল দাদাদের বিপ্লব চেতনায় বিপ্লবী হয়ে মঠের মন্দিরের তালা খুলে পরিত্যক্ত কুয়োয় চাদরে মুড়ে ফেলে এসেছিলাম রামকৃষ্ণ, সারদা মা, ও শালগ্রাম শিলা। শুধু বিবেকানন্দের ছবিটা ছাড়া। তারপর তো যা হবার তা হলো। ধরা পড়লাম। রামপুরহাট জেলে তিনমাস, তখন ক্লাস এইট। ততদিনে বাবা বর্ধমান থেকে বদলি হয়েছেন। চলে এলাম হাওড়ার রেল কোয়ার্টারে। নাইন না পড়া আমি সালকিয়ার হিন্দু স্কুলে টেন ইলেভেনের গন্ডি ডিঙিয়ে স্কটিশ চার্চে পা রাখলাম ফিলোসফি অনার্সে। চলার সাথে তাল মেলাতে গিয়ে বর্ধমান, বীরভূম, হাওড়াকে পিছনে ফেলে জীবনের তালে তাল মেলাতে কলকাতা এলাম। শৈশবের গেঁথে যাওয়া গ্রাম্য জীবন আর কোথাও একটা মিশনের পিছুটান শহুরে জীবনকে খাপ খাওয়াতে দিচ্ছিলো না, সাথে ছিল পড়াশোনা না ভালো লাগার জন্মগত স্বভাবটি। এইসব মিলেমিশে কলেজে পড়ার সময় স্বাভাবিক বিপ্লবী মনে খেয়াল এলো পড়াশোনা করে কোনো লাভ নেই। বিশ্বভ্রমণ করাই আমাদের একমাত্র পথ বেছে নেওয়া উচিত। এই ভাবনার দোসর হয়ে মালদার বিমান সঙ্গী হলো। সেই কাজে বিবেকানন্দকে পথসাথী করলাম। কারণ শৈশবের শেষ প্রান্তের ওই মঠের সংশ্রব আমার বেশিদিনের না হলেও আমার অন্তরাত্মায় কোথাও লুকিয়ে ছিলো। আমি ঠিক বুঝতে না পারলেও কোনো একটা চেতনা আমায় এগিয়ে নিয়ে যেত। হয়তো তারজন্যই আমাদের এই ধারণা হয়েছিলো বিবেকানন্দ সাথে থাকলে মানুষ খেতে দেবে, আশ্রয় দেবে, অর্থ সাহায্য করবে। সেই ভরসা সম্বল করে কারো এক সূত্রে গুপ্তিপাড়ায় একজন মহারাজের সন্ধান পেলাম, তিনি সেখানে মঠ গড়ার কাজে সদ্য হাত দিয়েছিলেন। সটান হাজির হলাম তাঁর কাছে। তিনি তো আমাদের উদ্দেশ্য শুনে অবাক হলেন, খুব হেসেওছিলেন বোধয় আমাদের ছেলেমানুষিতে কিন্তু যেটা করলেন সেটা হচ্ছে তিনি আমাদের ফেরালেন না। শুরু হলো আমাদের আশ্রমিক জীবন। রোজ আমরা সাইকেলে করে গ্রামে গ্রামে গিয়ে প্রচার করতাম রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের কথা, সঙ্গে কোনোদিন মহারাজ বা তাঁর একজন সহযোগী থাকতেন। এই করতে করতে আমরা বেশ গুছিয়ে নিয়েছিলাম নিজেদের। আমাদের কথা শুনতে লোকজন হতেও লাগলো। আমাদের সাথে সহকারী হয়ে যিনি যেতেন তিনি একদিন মহারাজকে বললেন এরা ভালোই করছে। মহারাজ মনস্থির করেই ফেলেছিলেন আমাদের দীক্ষিত করার ব্যাপারে। কিন্তু আবারো বাদ সাধলো নাগরিক জীবন। মা বাবা জেনে গিয়ে আমাদের বিবেকানন্দের ভরসায় বিশ্বভ্ৰমনে ইতি ঘটালেন ঠিক ২ মাস ১৭ দিনের দিনে।
এরপর বিশ্বে বহু ভ্রমণ করেছি। আজও করছি। আমাদের জীবন কোন ভাবনা থেকে কোথায় নিয়ে যায় তা সে কখনো আন্দাজ দেয়না। আমরা শুধু তাকে অনুসরণ করি। অনেকেই সেই ভাবনাতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব খুঁজে পান। আমি কোনদিন পাইনি। আমার চলার পথে কোথাও কোনোদিন ঈশ্বর ছিলোনা আজও নেই। তবুও সেই ছোটবেলা থেকে বড়োবেলা হয়ে জীবনের অনেকটা পথ হেঁটে আমি মনের মধ্যে কোথাও একটা বিবেকানন্দকে নিয়ে চলছি। এমন নয় যে আমি তাঁর বহু বই পড়েছি বা তাঁর জীবন আমার জীবনের পাথেয় করেছি। কিন্তু কোথাও একটা যোগসূত্রে আমায় তিনি বেঁধেছেন। এই টানকে যদি ভক্তি বলে তো ভক্তি, যদি ঈশ্বর চেতনা বলে তো তাই। আমি জানিনা হয়তো জানতে চাইওনা। এই চেতনাকে সঙ্গী করেই আমার পথ চলছে আজও। নাহলে কোথায় কোন অজ গ্রামের একটি ক্লাস ফোর ফেল করা ছেলেকে শোধরাতে বাবা যাকে মিশনে দিয়েছিলো সেই ছেলে শোধরানো তো দূর জেলযাত্রা করে সকল আশা দুঃস্বপ্নে পরিণত করেছিলো। সেদিনই শেষ হয়ে যেতে পারতো সবকিছু। সকল পথ বন্ধ হয়ে এলোমেলো খাতে বয়ে যাওয়াটা নিয়তি কেন হয়নি আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সেদিনের কথা ভাবাটাও স্পর্ধার। সেই অজানা চেতনাকে বুকে বয়েই আমি আজ মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছি। ছোটবেলায় লুকিয়ে রাখা যে ছবিকে আঁকড়ে আমার এক চেতনার জন্ম হয়েছিল সেই অনুভূতির কাছেই ঋণী হয়ে একদিন শেষযাত্রায় সামিল হবো।
গতকাল সেই মহান মানুষটির জন্মদিন ছিলো। একদিনের উৎসবে মেতে ওঠার মতো করে চারদিকে নানাভাবে উদযাপন করা হলো। রাজনীতিও কম হলো না। কিন্তু কোথাও কি তাঁকে অনুভব করা হলো। তিনি যে শুধু একটি মহাপুরুষ নন তিনি যে একটি জীবনদর্শন। রাজনীতির পরিসরে বহু বছরের অভিজ্ঞতায় আমার সবসময়ই মনে হয়েছে বিবেকানন্দই সেই পথ যা আমার দেশের মানুষকে ছায়া দেবে। যে ভারতবর্ষ তাঁর কাছে ছিলো যৌবনের উপবন বার্ধক্যের বারাণসী সেই ভূমি আজ কালের বিবর্তনে কলুষিত। রাজনীতির কুটিল চালে মানুষে মানুষে বিভেদের ষড়যন্ত্রের স্বীকার। অশান্ত আজ চারদিক। এই পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে অস্থিরতার যে চোরাস্রোত বয়ে যাচ্ছে তার থেকে মুক্তির উপায় হয়ে কেউ কি আলো দেখাবে আমাদের। ক্লান্ত, রিক্ত, যন্ত্রণায় জর্জরিত ভারতবাসী আজ দিশাহীন। যুগে যুগে এরকমই অনন্ত অন্ধকারের সরণি বেয়ে কোনো না কোনো হাত এগিয়ে এসেছে তলিয়ে যাবার আগে টেনে তোলার জন্য। জানিনা উত্তরকালে হয়তো সেইজন অপেক্ষা করে আছে। আশায় বুক বেঁধে আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা কি শেষ হবে একদিন ??
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত