‘ফ্যাসিবাদী শক্তি আসামে বাঙালি নির্মূল অভিযান চালাচ্ছে’- আসামে বাঙালিদের ভোগান্তি দেখে বারবারই এই অভিযোগ উঠেছে সে রাজ্যের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে৷ ইতিমধ্যেই লাখ দুয়েক বাঙালি নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণে ব্যস্ত। জেল খাটছেন ৯৮৮ জন। আবার ২৭ জন প্রাণও হারিয়েছেন ডিটেনশন ক্যাম্পে। তবে শুধু ডিটেনশন ক্যাম্পেই নয়, এনআরসির তালিকায় নাম সংযোজন করাতে গিয়েও মৃত্যু ঘটেছে কারও কারও।
যেমন মধ্য আসামের আঁচলপাড়া গ্রামের থেকে ৪৫০ কিমি দূরের কেন্দ্রে নিজের নাম সংযোজন করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন কৃষক হানিফ আলি। ১৪ জনের পরিবারের মাথায় তখন আকাশ ভেঙে পড়েছিল। এনআরসির তালিকায় তাঁদের নাম ছিলই ঠিকই কিন্তু প্রাণের বদলে ‘নাম’ চেয়েছিলেন কি তাঁরা? হানিফ আলির বছর পঁচিশের ভাইপো মনিরুল ইসলাম আজও বলেন, ‘আমাদের মতো মানুষরা চাইছে সর্বস্ব দিয়ে এনআরসির তালিকায় নিজের নাম তুলতে। আর কতবার নিজেদের ভারতের নাগরিক প্রমাণ করতে হবে আমাদের? এই হেনস্তা না করে তো মেরে ফেলা ভাল!’
এনআরসিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া আসলে আগুনের পথ পেরনো। আসামের বাঙালিরা যার ভুক্তভোগী। তথ্য প্রমাণের নামে দিনের পর দিন কী হেনস্থা চলছে, তা আসামের মানুষই জানেন। ফতুর হয়ে গিয়েছেন বহু মানুষ। লোকসভা ভোটের আগে থেকেই এনআরসি করে মানুষকে ভয় দেখানোর কাজ শুরু করেছিলেন বিজেপির নেতারা। বস্তুত, তাদের উদ্দেশ্যই ছিল এনআরসিকে হাতিয়ার করে মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করা। এই অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে করে আসছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। একই সুর বিরোধীদেরও।
ইতিমধ্যেই আসামে চূড়ান্ত এনআরসি তালিকা থেকে নাম বাদ গিয়েছে ১৯ লক্ষ মানুষের। তার মধ্যে ১২ লক্ষই হিন্দু। এবার তাঁদের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে গিয়ে প্রমাণ করতে হবে, তাঁরা এদেশেরই বৈধ নাগরিক। আর এনআরসি তালিকা থেকে বাদ যাওয়া নাম তোলাতে ফের খসবে মোটা অঙ্কের গাঁটের কড়ি। আইনজীবীদের টাকা জোগাতেই হিমশিম খেতে হবে তাঁদের। গরিব মানুষ এত টাকা কোথায় পাবেন, তা নিয়েই উঠছে প্রশ্ন।
এনআরসি থেকে বাদ যাওয়া ব্যক্তির খরচ আকাশ ছোঁয়া। কারণ, যখন একটি পরিবারের মধ্যে শুধুমাত্র একজন তালিকা থেকে বাদ যান, তখন নাম তোলার প্রক্রিয়ায় শুধুমাত্র বাদ যাওয়া ব্যক্তিই নন, বরং তাঁকে এনআরসি কর্তৃপক্ষের সামনে হাজির করতে হয় পরিবারের সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক সদস্য কিংবা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের। সেই সদস্যরা বিবেচিত হন বাদ যাওয়া ব্যক্তির সাক্ষী হিসেবে। খরচ একলাফে আরও অনেকটাই বেড়ে যায়।
কারণ একবার নয়, প্রয়োজন অনুযায়ী বারবার একই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হতে পারে বাদ যাওয়া ব্যক্তিকে। সেই সঙ্গে রয়েছে ভৌগোলিক দূরত্বের বিষয়টি। অনেক সময় এনআরসি খসড়া থেকে বাদ যাওয়া ব্যক্তিকে এনআরসি সেবা কেন্দ্রের তরফে নোটিশ পাঠানো হয়েছে, বাবা-মা কিংবা দাদু-ঠাকুমাদের উত্তরাধিকার প্রমাণে যেতে হবে অন্য জেলায়। ফলে স্বভাবতই খরচ বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণ। কোথায় যাবেন গরিব মানুষ? প্রশ্ন তুলছেন আসামের এনআরসি-ছুটরা।
মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা গোষ্ঠী রাইটস অ্যান্ড রিস্কস অ্যানালিসিস (আরআরএজি) গ্রুপ সম্প্রতি প্রকাশ করেছে এমনই একটি সমীক্ষা রিপোর্ট। যাতে এনআরসি খসড়া তালিকা থেকে বাদ পড়া মানুষের ফের নাম তোলানোর প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে কত খরচ হয়েছে তার হিসেব কষা হয়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। রিপোর্ট বলছে, সমীক্ষায় যে ৬২ জনের সঙ্গে কথা বলা হয়েছিল, তারা এনআরসির শুনানিতে হাজির হয়েছিলেন। নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে তাঁদের মোট খরচ হয়েছে ১১ লক্ষ ৮২ হাজার টাকা, অর্থাৎ মাথা পিছু ১৯ হাজার ৬৫ টাকা।
আরআরএজির ডিরেক্টর সুহাস চাকমা বলছেন, যদি এনআরসি থেকে বাদ যাওয়া ব্যক্তিরা মাথা পিছু ১৯ হাজার ৬৫ টাকা করে খরচ করেন, তাহলে খসড়া থেকে বাদ যাওয়া ৪১ লক্ষ ১০ হাজার ১৬৯ জনের মোট খরচ দাঁড়ায় ৭ হাজার ৮৩৬ কোটি ৩ লক্ষ ৭১ হাজার ৯৮৫ টাকা। নাম তোলাতে গিয়ে কেউ বিক্রি করেছেন গরু-বাছুর, আবার কেউ বেচে দিয়েছেন সাধের সুপারি বাগান, কাঁঠাল বাগান, কৃষি জমি। আর যাঁদের সে সব কিছুই নেই, তাঁরা চড়া সুদে টাকা ধার করে খরচ মেটানোর চেষ্টা করেছেন। বাচ্চা, বুড়ো, গর্ভবতী সবাই প্রায় নিশিধরার মতো দৌড়াদৌড়ি করেছেন।
প্রসঙ্গত, এনআরসির পরিণাম কী ভয়ংকর হতে পারে, কীভাবে লক্ষ লক্ষ বাসিন্দার নাম নাগরিকের তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়, আসাম তার টাটকা প্রমাণ। আসাম বুঝিয়ে দিয়েছে, নিজের দেশে বাপ-ঠাকুর্দা-চোদ্দো পুরুষের ‘অস্তিত্ব’-এর কাগজপত্র দেখাতে না পারলে, বা দেখালেও যাঁদের নথিপত্র সরকারের কাছে ‘গ্রহণযোগ্য’ বা ‘যথেষ্ট’ বলে মনে হবে না, তাঁরা বংশপরম্পরায় এ দেশে বসবাসকারী হলেও পার পাবেন না।