মঙ্গলবার ব্যাঙ্গালোরে বসেছিল ইনফোসিস পুরষ্কার ২০১৯ প্রদান অনুষ্ঠানের আসর। আর সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিয়েই ফের কেন্দ্রীয় নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুললেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্যের নামে বৈদিক গণিত এক কল্পনার জগতের জন্ম দেয়, যা শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিক নয়, বরং পিছিয়ে নিয়ে যাবে অনেকটাই, এমনটাই দাবি করলেন তিনি। সরব হলেন বিভাজনের বিরুদ্ধেও।
প্রসঙ্গত, ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় বৈদিক গণিতের পাঠক্রম চালু করার ব্যপারে দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা চালাচ্ছে আরএসএস। তারই বিরোধিতায় মুখ খুলে অমর্ত্য বলেন, দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বৈদিক গণিতের পাঠ খারাপ প্রভাব ফেলবে। তাঁর কথায়, ‘শিক্ষাব্যবস্থায় ভারতীয়করণের নামে বিজ্ঞান ও গণিতের পাঠে যে বদল আনার চেষ্টা চলছে সেটা শুধুমাত্র দেশের নেতামন্ত্রীদেরই খুশি করবে। আধুনিক বিশ্ব থেকে অনেকটাই পিছিয়ে নিয়ে যাবে দেশের বিজ্ঞান গবেষণাকে।’ তিনি এ-ও বলেন যে, বিশ্বজুড়ে গণিত ও বিজ্ঞানের যে সূত্রগুলিকে মেনে চলা হয়, বৈদিক গণিত তার থেকে অনেকটাই আলাদা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাল্পনিক। সেইসব সূত্রের চর্চা যদি শুরু হয়, তাহলে আধুনিক গবেষণার সঙ্গে আরও কোনও সম্পর্কই থাকবে না।
উল্লেখ্য, নতুন শিক্ষানীতির খসড়া নিয়ে হইচই এখনও থামেনি। বহুদিন ধরেই তার শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে সরব আরএসএস। ইংরেজির ওপর ‘অযৌক্তিক’ নির্ভরতা কমানো থেকে বিদ্যালয়ে বৈদিক গণিত চালু করার মতো প্রস্তাব আগেও দিয়েছিলেন সঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত। স্কুলের সিলেবাসে প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বৈদিক গণিত চালু করার জন্য ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (এনসিআরআইটি)-এ সুপারিশ করেছিল আরএসএস। এ নিয়েই নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ বলেন, বৈদিক গণিত পড়ানোর নামে হিন্দুত্ববাদীদের তরফে এই অপপ্রচার চালানো হচ্ছে যে আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণার অধিকাংশই ভারতীয় মুনি-ঋষিরা অনেক আগেই আবিষ্কার করে ফেলেছেন।
অমর্ত্য বলেন, ‘গণিত চর্চায় প্রাচীন ভারতের অবদান আছে মানছি। গণিতের স্বর্ণযুগ যে সময়টাকে বলা হয় সেটা কিন্তু বৈদিক যুগ নয়। অথচ হিন্দুত্ববাদীরা সেই মিথ্যা দাবিই করে আসছেন।’ ৮৬ বছরের অর্থনীতিবিদের কথায়, ভারতীয় গণিতের পথপ্রদর্শক আর্যভট্ট কিন্তু বৈদিক যুগের নন। তিনি গণিতকে যে মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন পরে সেই ধারা বজায় রাখেন ব্রহ্মগুপ্ত, ভাস্কর-সহ অন্যান্য ব্যক্তিত্বরা। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করার বদলে যদি মনে করা হয় প্রাচীন ভারতের সব গবেষণা ও আবিষ্কার ঋষিমুনিদের চমৎকারে হয়েছে, তাহলে তো গোড়ায় গলদ থেকে যায়!
তাঁর সাফ কথা, ‘বৈদিক গণিতকে প্রকৃতঅর্থে গণিত বলাই যায় না। অনেকক্ষেত্রেই দেখা গেছে এর সঙ্গে বৈদিক যুগের কোনও সম্পর্ক নেই, গোটাটাই বিভ্রান্তিকর।’ এর পাশাপাশি তিনি বলেন, ‘বন্ধুত্ব এবং জ্ঞানচর্চার মধ্যে সম্পর্ক সবসময়ই খুব গভীর। আমরা যখন অন্যের কাছ থেকে শিখি, তখন আমাদের বৌদ্ধিক প্রসারও ঘটে। বন্ধুত্বের গঠনমূলক ভূমিকা শুধু দেশের সীমানা পেরিয়েই কার্যকর থাকে তা নয়। দেশের মধ্যেও সেই ভূমিকা তৈরি হয়। গোষ্ঠীতে বা অন্য কিছুতে বিভাজন শুধু আমাদের সামাজিক জীবনটাকেই নষ্ট করে না, একইসঙ্গে আমাদের বৌদ্ধিক উন্নতিতেও বাধা সৃষ্টি করে। দেশের ভেতরে যেমন দেশের বাইরেও তেমন। আসলে জ্ঞানের উন্নতির ক্ষেত্রে বন্ধুত্বের ভূমিকা অপরিসীম৷’