এবার ঝুলি থেকে বেরিয়ে পড়ল বেড়াল। এনআরসির সঙ্গে এনপিআরের সম্পর্ক নেই বলে বিজেপির পক্ষ থেকে যে প্রচার চালানো হচ্ছে, তা আদৌ সত্য নয়। এনপিআরের আসল উদ্দেশ্য এনআরসির বাস্তবায়ন ঘটানোই। মোদী সরকারের মুখোশ খুলে দিল বর্তমান এনপিআরের প্রি-টেস্ট ফর্ম। এক নতুন তথ্য সামনে আসায় এ কথা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। এই তথ্য অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা ২০২০ সালের এনপিআর সমীক্ষার ছাড়পত্র দেওয়ার আগে কয়েকটি রাজ্যে ৩০ লক্ষ অধিবাসীর ওপর ‘প্রি-টেস্ট’ চালিয়েছে। সেই প্রি-টেস্টের ফর্মে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল বেশ কিছু বাড়তি প্রশ্ন, যেগুলি ১০ বছর আগের এনপিআরে ছিল না।
এই নতুন প্রশ্নগুলি এনআরসি এবং নাগরিকত্ব সম্পর্কিত। যেমন, কারও বাবা-মা অথবা স্বামী-স্ত্রী যদি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে না থাকেন, তাহলে তার বিবরণ চাওয়া হয়েছে। এমনকী, পরিবারের প্রধানের বাবা–মায়ের জন্ম তারিখ, জন্মস্থান জানতে চাওয়া হয়েছে। জানতে চাওয়া হয়েছে, বাবা–মা ভারতের বাইরে জন্মালে, কোন দেশের কোথায়, কবে জন্মেছেন। বিরোধীদের অভিযোগ, এইভাবে সুকৌশলে এনপিআরের ফর্মে এনআরসির প্রশ্ন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। জেনেবুঝে বর্তমান এনপিআরের সঙ্গে ইউপিএ জমানার এনপিআরকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। অথচ, দুইয়ের মূল ফারাক নাগরিক ও নিবাসীর।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে তৎকালীন ইউপিএ সরকার জনসংখ্যা পঞ্জীতে নাগরিক নয়, এদেশের নিবাসীদের তথ্য সংগ্রহ করেছিল। তাতে মোট ১৪টি সাধারণ প্রশ্ন নিয়ে বাড়ি বাড়ি পৌঁছেছিলেন সরকারের প্রতিনিধিরা। কারও ব্যক্তিগত পরিসরে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ ওঠেনি। এমনকী, ইউপিএ সরকার বাতিল করে দিয়েছিল অটলবিহারী জমানার নাগরিকদের পরিচয়পত্র দেওয়ার পাইলট প্রজেক্ট। ১৩টি রাজ্য ও ১টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে নাগরিকদের পরিচয়পত্র দেওয়ার জন্য চালু হয়েছিল প্রকল্পটি। ২০০৬ সালের অক্টোবরে সেই প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বৃহস্পতিবার কংগ্রেস নেতা তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র রাষ্ট্রমন্ত্রী অজয় মাকেন জানিয়েছেন, ‘মোদীর এনপিআর এবং ১০ বছর আগে ইউপিএ জমানার এনপিআর–এর মধ্যে কতকগুলি মূল পার্থক্য রয়েছে। এবার ব্যক্তিগত পরিসরে হস্তক্ষেপ করে আধার, মোবাইল, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইত্যাদির তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে। এর অর্থ হল, সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বলছে। এনপিআরের আড়ালে এনআরসি আনছে মোদি সরকার।’ তাঁর দাবি, ২০১০ সালে যখন এনপিআরে দেশের সমস্ত নিবাসীর তথ্য সংগ্রহ করাই লক্ষ্য ছিল। তাতে কোথাও এনআরসির কথা বলা নেই। সেই সময়কার এনপিআরের ফর্মে মোট ১৪টি প্রশ্ন ছিল। সাধারণ তথ্য চাওয়া হয়েছিল।
২০০৩ সালে এনডিএ সরকার নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করেছে। তাতে কয়েকটি উপ ধারা ঢোকানো হয়। তার মধ্যে ১৪এ উপ ধারায় বলা হয়েছে, সরকার চাইলে নাগরিকপঞ্জী তৈরি করতে পারে। বিষয়টি সরকারের ইচ্ছার ওপর ছাড়া হয়েছে। তারপর বিধি তৈরি হয়েছিল। তারপর থেকে বারবার মোদী সরকার বা বিজেপি এনআরসির কথা বলেছে। ২৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলায় এসে এনআরসির কথা বলেছেন। সংসদে দাঁড়িয়ে অমিত শাহও বলেছেন। দলের কার্যকরী সভাপতি জে পি নাড্ডাও একাধিকবার এনআরসির কথা বলেছেন। এমনকী আইন পাশের পরেও।
তবে বিক্ষোভ সামাল দিতে মোদী এখন বলছেন, এনআরসি নিয়ে সরকারি স্তরে কোনও আলোচনা হয়নি। কোথাও ডিটেনশন ক্যাম্পও হচ্ছে না। তবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য মিথ্যা প্রমাণ করেছে তাঁর সরকারই। বৃহস্পতিবার সরকারের তরফে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ডিটেনশন ক্যাম্প নতুন নয়। বিগত কয়েক দশক ধরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ডিটেনশন ক্যাম্প রয়েছে। গত জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক মডেল ডিটেনশন সেন্টার/হোল্ডিং সেন্টার/ক্যাম্প ম্যানুয়াল তৈরি করে বিতরণ করেছিল। এই ডিটেনশন ক্যাম্পগুলি আসলে এক ধরনের জেলখানা। যেখানে বিদেশি নাগরিকদের দেশে ফেরত পাঠানোর আগে প্রয়োজনীয় নথি যাচাই করার জন্য রাখা হয়।
এই মুহূর্তে রাজনৈতিক মহল বলছে, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনকে অস্ত্র করে এনআরসির নামে আসলে ধর্মীয় বিভাজনই করতে চাইছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। তাই কংগ্রেস আমলের এনপিআরে নাগরিকদের পিতা-মাতার জন্ম সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে কোনও প্রশ্ন না থাকলেও, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে শুরু হতে যাওয়া এনপিআরের ওই প্রশ্নটি রাখা হয়েছে। পঞ্চাশ বছর আগে যাঁরা সাবেক পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশ গঠনের পর এদেশে এসেছেন, তাঁদের বাবা-মায়ের জন্মতারিখ ইত্যাদি অনেকের পক্ষে দেওয়া সম্ভব হবে না। তখনই তাঁকে সন্দেহভাজন নাগরিক ঘোষণার সম্ভাবনা তৈরি হবে। আর সেই রন্ধ্রপথেই ঢুকবে বিভাজনের উপাদান।