১৯২৬-এ তৈরি নাখোদা মসজিদ কলকাতার সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সাদা মার্বেলের দেওয়াল, বেলজিয়াম কাচ, বিশাল নমাজ পড়ার জায়গা, দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো কাঠের ঘড়ি— সব মিলিয়ে এই মসজিদের ছত্রে-ছত্রে ইতিহাস। কিন্তু ১৯২৬ সালের আগেও নাখোদা মসজিদের একটা ইতিহাস ছিল। বর্তমানে যেখানে নাখোদা মসজিদ রয়েছে, সেখানে দু’টি ছোট মসজিদ ছিল। কচ্ছের মেমন সম্প্রদায়ের পূর্বপুরুষই সেই দু’টি মসজিদকে একত্র করে নাখোদা মসজিদের বর্তমান কাঠামো নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছিলেন।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবের প্রতিবাদে রাখিবন্ধনের জন্য নাখোদার পুরনো কাঠামোয় গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর— এমনটাই শোনা যায় বলে জানাচ্ছেন শিক্ষাবিদদের কাছ থেকে। তাঁদের কথায়, ‘রবীন্দ্রনাথ ধর্ম নির্বিশেষে সকলকেই রাখি পরাতে চেয়েছিলেন। তাঁর কাছে রাখিবন্ধনের অর্থ ছিল সমস্ত রকম বিভেদ-বিভাজনের ঊর্ধ্বে ওঠা একটি আদর্শ। শান্তিনিকেতনে রাখির কোন রূপ তাঁর কল্পনায় ছিল, তার নমুনা চিঠিপত্র থেকে পাওয়া যায়।’
সম্প্রীতির এমনই সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে চিৎপুরের নাখোদা মসজিদকে ঘিরে। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতেও ইতিহাসের সেই পথকেই আঁকড়ে থাকছেন নাখোদা মসজিদ কর্তৃপক্ষ। তাঁদের বক্তব্য, নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলুক, তবে তা যেন শান্তিপূর্ণ হয়। এ ক্ষেত্রে মহাত্মা গান্ধীর আদর্শকেই সামনে রাখতে চাইছেন তাঁরা। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, আগামী শুক্রবার নমাজের পরে মসজিদে জমায়েতের উদ্দেশ্যে শান্তি বজায় রাখা এবং শান্তির বার্তা সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো হবে।
কর্তৃপক্ষের তরফে একজন জানিয়েছেন, ‘কোনও আইন আমার পছন্দ না-ই হতে পারে। সে জন্য আন্দোলনের পথ তো রয়েছেই। কিন্তু সেই আন্দোলন যেন শান্তিপূর্ণ হয়। গান্ধীজিও আইন অমান্য আন্দোলন করেছিলেন। কিন্তু তার ভিতটা ছিল শান্তিপূর্ণ। কোনও রাজ্য, কোনও শহরেই শান্তি বিঘ্নিত করে প্রতিবাদ হোক, সেটা আমরা চাই না। এই বার্তাটা খুব স্পষ্ট ভাবে সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাই।’ মসজিদের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য মহম্মদ কাসিম বলেন, ‘কোনও পক্ষই যেন ভুলে না যাই যে, সবার উপরে ভারতীয় সংবিধান রয়েছে। সংবিধানের মর্যাদা যাতে ক্ষুণ্ণ না-হয়, সেটা সকলেরই দেখা দরকার।’
১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরেও শান্তিরক্ষার আবেদন জানিয়েছিলেন নাখোদার তৎকালীন ইমাম শেখ মহম্মদ সাবির। মসজিদ সূত্রের খবর, শান্তিরক্ষার বার্তা ছড়ানোর জন্য তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের তরফে অনুরোধ করা হয়েছিল মসজিদ কর্তৃপক্ষকে। এবারেও সেরকমই কোনো সম্প্রীতির বাঁধনে সমস্ত বিভেদ-বিভাজন মুছে দেওয়া যায় কিনা, তারই খোঁজ করছে নাখোদা মসজিদ।