বিগত কয়েক বছরে বাম-কংগ্রেসকে পিছনে ফেলে, রাজ্যে প্রধান বিরোধী হিসেবে উঠে এসেছে গেরুয়া শিবির। কিন্তু শীতকালীন অধিবেশনে দেখা গেল, রাজ্যে শাসকের প্রধান প্রতিপক্ষ হলেও বিধানসভায় কার্যত নিষ্প্রভই বিজেপি। বরং অধিবেশনে কংগ্রেস ও বামই বিরোধীর ভূমিকায় প্রধান মুখ হয়ে উঠেছে। পরিষদীয় রাজনীতির অনভিজ্ঞতাই তাদের এই দুর্দশার কারণ বলে স্বীকার করে নিয়েছেন বঙ্গ বিজেপির নেতারা।
প্রসঙ্গত, চলতি বিধানসভার শুরুতে বিজেপির বিধায়ক সংখ্যা ছিল ৩। বিগত সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে একলাফে দুই থেকে আঠারো সাংসদ হয়েছে তাদের। ভোট প্রাপ্তির নিরিখে রাজ্যের প্রায় ৪০ শতাংশ তাদের দখলে। বর্তমানে বিধানসভায় বিজেপির প্রতীকে জেতা সদস্যের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ছয়। এছাড়া তৃণমূল সহ বিভিন্ন দল থেকে ইস্তফা না দিয়েই পদ্ম শিবিরে নাম লেখানো বিধায়কের সংখ্যা আট। অর্থাৎ রাজ্য বিধানসভায় মোট ১৪ জন বিধায়ক রয়েছেন বিজেপি শিবিরে।
কিন্তু দেখা গেল, শক্তি বাড়লেও চলতি বিধানসভায় বিরোধী দল হিসেবে বিজেপির অস্তিত্বের সঙ্কট তীব্র। পরিষদীয় রাজনীতিতে বিরোধী হিসেবে তাঁরা ছন্নছাড়া। উল্টে প্রতিদিনই বিধানসভা অধিবেশনে তৃণমূলের সঙ্গে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ কংগ্রেস ও বাম সদস্যরা। বিরোধী ভূমিকায় প্রচারের সবটুকু আলো শুষে নিচ্ছেন তাঁরা। বাম ও কংগ্রেস সদস্যরা ওয়াকআউট করে গেলেও বিরোধী বেঞ্চে টিমটিমে জনা তিনেক বিধায়ক।
আসলে দলের মুখ্য সচেতক থেকে শুরু করে সব বিজেপি সদস্যই বিধানসভায় আনকোড়া। পরিষদীয় রীতিনীতি, কৌশল— কিছুই তাঁদের আয়ত্বে নেই। উল্টে শাসকদলের খোঁচাও হজম করতে হচ্ছে নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের বাংলার প্রতিনিধিদের। মঙ্গলবার যেমন অধিবেশনে পঞ্চায়েত নিয়ে আলোচনায় বিজেপির মনোজ টিগ্গাকে কটাক্ষে বিঁধলেন বর্ষীয়ান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়।
মনোজের উদ্দেশ্যে সুব্রত বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে বিধানসভা অধিবেশনে কিছু বলতে গেলে প্রমাণ্য নথি হাতে রাখতে হয়। নতুন এসেছেন বলে মনোজের পক্ষে তা সম্ভব হচ্ছে না। মনগড়া তথ্য দিলে অধ্যক্ষ নতুন বিধায়ক বলে তাঁকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। কিন্তু তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সভার শেষে মনোজ বস্তুত মেনেই নিলেন নিজের দুর্বলতার কথা। শুধু তিনি নিজেই নন, বিজেপি পরিষদীয় দলের একই হাল।
গত বিধানসভায় শমীক ভট্টাচার্য একমাত্র বিজেপির প্রতিনিধি হয়েও অধিবেশনে যতটা সক্রিয় ছিলেন, তার তুলনায় তাঁরা যে যথেষ্ট নিষ্প্রভ, তা মেনে নিয়েছেন মনোজ। তাঁর মতে, রাজ্য বিজেপিতেও এমন কেউ নেই, যাঁর কাছ থেকে পরিষদীয় কৌশলের পাঠ নিতে পারেন তাঁরা। তিনি বলেন, কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের সদস্যরা অনেকেই অভিজ্ঞ। তাই তাঁরা বিরোধী আসনকে যেভাবে ব্যবহার করতে পারছেন, তা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব।
বিরোধী বিজেপির এই হাল নিয়ে মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, রাস্তাঘাটে মানুষের দাবি নিয়ে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শাসকের আসনে বসেছে তৃণমূল। যার নেতৃত্বে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু স্রেফ হাওয়া দিয়ে কিছু আসন পেয়ে গিয়ে এখন যে তারা দিশাহারা, তা বিধানসভায় বিজেপির আচরণ দেখলেই টের পাওয়া যায়।
আবার পরিষদীয় রাষ্ট্রমন্ত্রী তাপস রায়ের ব্যাখ্যা, পরিষদীয় গণতন্ত্রে ‘অ্যাসেম্বলি বিলংগস টু অপোজিশন’ বলে একটা কথা আছে। কিন্তু বিজেপির সেই ‘অপোজিশন’ হওয়ারই যোগ্যতা নেই। তারা রাজ্যে ক্ষমতা দখলের দিবাস্বপ্ন দেখছে। উল্লেখ্য, কোনও বিল পাশ না করেই মঙ্গলবার শেষ হয় বিধানসভার অধিবেশন। অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, আগামী বছরে পরবর্তী অধিবেশন। আপাতত অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতুবি।