দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মাস কয়েক আগেই আসামে প্রকাশিত হয়েছে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী বা এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা। যার ফলে ‘নিজভূমে পরবাসী’ হতে হয়েছে ১৯ লক্ষ ৬ হাজার ৬৫৭ জন মানুষকে। এবার সেই এনআরসি-ছুটদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়া শুরু হয়েছে। কাগজে-কলমে যতই প্রতিশ্রুতি মিলুক, কার্যক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা বুঝতে পারছেন, কত বড় সর্বনাশের মুখে পড়েছেন তাঁরা। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া নতুন করে সীমান্ত পুলিশের রিপোর্ট নিয়ে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের বিচার তো রয়েইছে!
প্রসঙ্গত, শাহ থেকে শুরু করে অনেকেই বলেছিলেন, এনআরসি-ছুটদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের আগে অসমের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালের বক্তৃতা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। তাঁর দলের অন্য নেতারা হিন্দুদের অভয়বাণী দিয়ে চলেছেন। তাঁদের একটাই কথা, এনআরসি অর্থহীন। ট্রাইব্যুনাল, হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্ট না বললে কাউকে ‘বিদেশি’ বলে ধরা হবে না। প্রয়োজনে আইনি সহায়তার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে অন্য ছবি।
আসামে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রয়োজন হয় টিআরসি বা টেম্পোরারি রেসিডেন্সিয়াল সার্টিফিকেট। জেলাশাসক এই শংসাপত্র দেন। ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেলে এটা লাগে। সার্টিফিকেটে লেখাই থাকে, শুধুমাত্র পড়াশোনার জন্য এই শংসাপত্র বৈধ, অন্য কোনও বিষয়ে গ্রাহ্য হবে না। এনআরসি-ছুটরা এই টিআরসি পাচ্ছেন না। সরাসরি না বলা হলেও, অনেককে ইচ্ছাকৃত দেরি করিয়ে ভর্তির সময়সীমা পার করে দেওয়া হচ্ছে।
বিজেপি শাসিত আসামে চাকরি নেই বললেই চলে। যাও বা আছে, তাও ‘কিনতে’ হয় বলেই অভিযোগ। তবে সেই ‘কেনা চাকরি’ও মূল্যহীন হয়ে পড়ছে এনআরসি-ছুটদের জন্য। কারণ সেই এনআরসি! তালিকায় নাম নেই। ফলে পুলিশ ভেরিফিকেশনে আটকে যাচ্ছে। বাঙালি হলে তো কথাই নেই। একই ছবি ট্রেড লাইসেন্স বার করা থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
সামান্য স্কুল-কলেজে ভর্তির জন্য সার্টিফিকেট বার করতে লাগে অন্তত তিনটি প্রমাণ। প্রথমত, ১৯৭১ সালের আগের ভোটার–তালিকায় নিজের না থাকলে বাবা–মা অথবা ঠাকুর্দা–ঠাকুমার নাম। দ্বিতীয়ত, মেয়াদি পাট্টা জমি। মানের মাটির (অসমে জমিকে মাটি বলা হয়) দলিল। তৃতীয়ত, পুরপ্রধান বা কাউন্সিলর, এমএলএ বা এমপির সার্টিফিকেট। তার পর সেগুলি যাচাই করে দেওয়া হয় অসমে ভর্তি হওয়ার গেটওয়ে টিআরসি।
লামডিঙের সৌরভ দাশ। ২০১৭ সালে জোরহাট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর বাবা স্বপন দাশ আসামেরই একটি সমবায় ব্যাঙ্কে চাকরি করেন। সমস্ত কাগজপত্র আছে। এনআরসি তালিকায় নামও রয়েছে তাঁদের। তবু সময়মতো টিআরসি পাননি। ফলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া হয়নি সৌরভের। ঠিক তেমনই বদরপুরের রেল সাফাইকর্মী এক বাশফোড় পরিবারের মেয়ে চাকরি পায় সম্প্রতি। কিন্তু এনআরসিতে নাম নেই। আটকে আছে পুলিশ ভেরিফিকেশন। এমন উদাহরণ অজস্র।
এ ছাড়া তো রয়েছেই ডি-ভোটার নোটিস জারি। সীমান্ত পুলিশ নতুন করে নোটিস জারি করে মানুষকে ডাকছেন ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে। এনআরসি তালিকা প্রকাশের পর এ ধরনের তলব ফের শুরু হয়েছে। সেখানে প্রমাণ করতে হচ্ছে ভারতীয়ত্ব। অথচ এনআরসির সরকারি বিজ্ঞপ্তি এখনও জারি হয়নি। নিয়ম মেনে এনআরসি-ছুটদের জানানোও হয়নি কেন বাদ পড়েছে তাঁদের নাম। সূত্রের খবর, বাদ দেওয়া হয়েছে মর্জিমতো। ‘অযৌক্তিক ও অন্যায় ভাবে’। কারণ বাবা-মা ভারতীয়, সন্তান বিদেশি, এমন উদাহরণ রয়েছে। ভাইবোনেদের মধ্যেও স্বদেশি ও বিদেশির ফারাক। ফলে প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও যে নাম ওঠেনি, এর থেকেই তা স্পষ্ট।