বাণিজ্য চুক্তি করলে দেশজুড়ে অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হবে। অনেক মানুষ কাজ হারাবেন। চীনা দ্রব্যে ছেয়ে যাবে বাজার। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা মার খাবেন। প্রথম থেকেই এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে আসছিল বিরোধীরা। বিরোধিতা এসেছিল আরএসএসের তরফেও। অবশেষে ঘরে-বাইরে সাঁড়াশি চাপের মুখে পড়ে শেষ মুহূর্তে ১৬ দেশের আরসিইপি চুক্তি থেকে সরে মোদী সরকার।
তবে ওই প্রস্তাবিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ছেড়ে বেরিয়ে আসার পরে বাণিজ্যে আরও বেশি রক্ষণশীলতার খোলসে সেঁধিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে কেন্দ্র। প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মনমোহন জমানায় হওয়া যাবতীয় চুক্তি খতিয়ে দেখার। উল্টো দিকে, ভারতের বাজারকে পাখির চোখ করে তাকে চুক্তির টেবিলে টেনে আনতে দিল্লীর তোলা সমস্ত সমস্যা মেটাতে আগ্রহ দেখাচ্ছে চীন।
যা দেখে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনা পণ্যে দেশের বাজার ছেয়ে যাওয়ার আশঙ্কা যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু তা হলে আরও আগে দিল্লী তা নিয়ে সুর চড়াল না কেন? এভাবে হঠাৎ সমস্ত পুরনো চুক্তি খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের ভাবমূর্তি মলিন করবে বলেও আশঙ্কা তাঁদের।
প্রসঙ্গত, মঙ্গলবারই বেজিং জানিয়েছিল, চুক্তি নিয়ে ভারতের সংশয় দূর করতে আগ্রহী তারা। বুধবার চিনের উপ বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং শুয়েন বলেন, ‘আরসিইপি-তে যোগ দিলে লাভ ভারতেরই। কারণ, এতে রপ্তানির বিপুল বাজার খুলবে ভারতীয় পণ্যের জন্য।’ তাঁর যুক্তি, শেষে ১৬টি দেশের এই চুক্তি হলে, এটিই হবে বিশ্বের বৃহত্তম অবাধ বাণিজ্য অঞ্চল। কারণ এখানেই বিশ্বের প্রায় অর্ধেক লোকের বাস। দুনিয়ার ২৫-৩০ শতাংশ উৎপাদন হয় এই অংশে।
বিশেষজ্ঞরা মানছেন যে, এই চুক্তির জেরে চিনা পণ্যে ভারতের বাজার ছেয়ে গেলে বা নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার দুগ্ধজাত পণ্য ঘরে-ঘরে ঢুকে পড়লে, বিপদে পড়বেন চাষিরা। মাথায় হাত পড়তে পারে ছোট শিল্প ও ব্যবসায়ীদের। কিন্তু যে ভাবে দিল্লী একেবারে শেষ মুহূর্তে চুক্তি থেকে বেঁকে বসেছে, তাতে বিশ্ব মঞ্চে ভারতের প্রতিশ্রুতির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে বলে আশঙ্কা তাঁদের।
দিল্লী স্কুল অব ইকনমিক্সের অর্থনীতির অধ্যাপক দিব্যেন্দু মাইতির কথায়, ‘ভারতের কৃষি বা শিল্প যে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যোঝার অবস্থায় নেই, তা কেন্দ্র জানে। কিন্তু এই বিশ্বায়নের জমানায় বিচ্ছিন্ন থেকে বড় অর্থনীতি বা উন্নত দেশ হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। তা হলে আগামী দিনে কীভাবে তাদের সেই লড়াইয়ে নামার উপযুক্ত করে তোলা হবে? যখন থেকে এই চুক্তির কথা শুরু, সেই ২০১২ সাল থেকেই বা ওই চেষ্টা করা হল না কেন? এখনও কোথায় তার রূপরেখা?’
আর এক অর্থনীতিবিদের প্রশ্ন, ‘এখন হঠাৎ পুরনো চুক্তি খতিয়ে দেখতে বসলে, কোন ভরসায় ভারতের সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদি চুক্তিতে হাত মেলাবে কোনও দেশ?’ তাঁর মতে, কেন্দ্রে সরকার বদলায়। কিন্তু আগের সরকারের চুক্তি বা নীতি পরের সরকার এসে আমূল পাল্টে দিলে, আন্তর্জাতিক দুনিয়ার বিশ্বাস ধাক্কা খাবে। আস্থায় চিড় ধরবে বিদেশি লগ্নীকারীদের। তাই প্রতিযোগিতা না-এড়িয়ে আগামী দিনে বরং তাতে লড়ে বিশ্বের বাজার দখলের প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি, পরিকাঠামো ইত্যাদি তৈরির পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁরা।