ভোটে জিততে বরাবরই সাম্প্রদায়িক তাস খেলতে দেখা গিয়েছে গেরুয়া শিবির। বিজেপির ধর্মীয় মেরুকরণ ও ভাগাভাগির রাজনীতির বিরুদ্ধে বারবারই সোচ্চার হয়েছে দেশের বিরোধীরা। একাধিকবার এ প্রসঙ্গে মোদী-শাহদের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। কিন্তু তাতেও দমে না গিয়ে, লোকসভা ভোটের পর থেকে আরও দ্বিগুণ আগ্রাসন দেখিয়ে বাংলায় জাতপাতের রাজনীতি আমদানি করছে বিজেপির নেতা-কর্মীরা। নিম্নবর্ণের মানুষকে খেপিয়ে তোলা হচ্ছে তৃণমূলের সমর্থক উচ্চবর্ণের মানুষের বিরুদ্ধে। এমনটাই মনে করছেন তৃণমূল নেতারা। তার পাশাপাশি তাঁরা লক্ষ্য করেছেন, গত লোকসভা নির্বাচনের আগে থেকে রাজ্য জুড়ে প্রায় ১০ হাজার ‘একল বিদ্যালয়’ তৈরি করেছে আরএসএস। পড়ুয়াদের উপস্থিতি যাচাই হচ্ছে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিতে। জাত ও ধর্মভিত্তিক এই মিশেলের মোকাবিলায় এবার কোমড় বেঁধে নামছে তৃণমূল।
তৃণমূলের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা প্রশান্ত কিশোর রবিবার তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন, হিন্দু-মুসলিম ভোট মেরুকরণের নতুন এক পন্থা নিয়েছে বিজেপি। গো-বলয়ের কায়দায় বাংলাতেও আমদানি করা হয়েছে ‘দলিত’ তত্ত্ব। সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষকে খেপিয়ে অতিরিক্ত ৩-৪ শতাংশ ভোট গেরুয়া শিবিরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। তিনি এ কথাও জানিয়েছেন, বেশ কিছুদিন ধরে উত্তরবঙ্গ–সহ রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় তফসিলি জাতি, অনগ্রসর শ্রেণি ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের ‘মগজধোলাই’ প্রক্রিয়া চলছে। মূলত বোঝানো হচ্ছে, বিগত কয়েক দশক ধরে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, মন্ত্রী, আমলারা সবাই উচ্চবর্ণের প্রতিনিধি। নিম্নবর্ণের প্রতি বঞ্চনা করে একদিকে শাসন করছে উচ্চবর্ণ, অন্যদিকে তোষামোদ করা হচ্ছে সংখ্যালঘুদের।
শুধু তাই নয়। এই তত্ত্ব আরও গভীরে পৌঁছে দিতে অনগ্রসর–অধ্যুষিত এলাকায় গড়ে তোলা হচ্ছে ‘একল বিদ্যালয়’। গোটা রাজ্যে যার সংখ্যা এই মুহূর্তে কমপক্ষে ১০ হাজার। যেখানে একজন মাত্র শিক্ষক রয়েছেন। তিনি ছাত্রছাত্রীদের ‘হিন্দুত্ব’র পাঠ পড়াচ্ছেন। পড়ুয়াদের শেখানো হচ্ছে, ক্লাসে উপস্থিতির জানান দিতে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি তুলতে হবে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মত, এতদিন বাংলায় রাজনৈতিক দল এবং নেতাদের ভাবমূর্তিই ছিল রাজনীতির নির্ণায়ক শক্তি। কিন্তু গত লোকসভা নির্বাচনে মতুয়া, আদিবাসী-সহ বিভিন্ন পিছিয়ে থাকা মানুষকে উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলার কাজে নেমেছে বিজেপি। বিশেষজ্ঞ মহল মারফত এমন তথ্য পেয়ে প্রথমে তা যাচাই করেছে তৃণমূল। সূত্রের খবর, সাংগঠনিকভাবে এর সত্যতা পেয়ে তার মোকাবিলায় নামছে তৃণমূল।
জানা গেছে, রাজ্যের সব ক’টি জেলায় দলের তফসিলি জাতি, উপজাতি এবং অনগ্রসর শ্রেণির শাখা সংগঠনগুলির নেতাদের সক্রিয় হতে বলা হয়েছে। প্রয়োজনে সংগঠনের দায়িত্বে আনা হবে লড়াকু নেতাদের। সোমবার তৃণমূলের এক প্রবীণ সাংসদ বলেছেন, ‘এমনটা যে হচ্ছে তার আঁচ আমরা পেয়েছিলাম। উপযুক্ত পদক্ষেপ করা হয়েছে। শুরু থেকেই আমাদের দলে তফসিলি জাতি, উপজাতি ও অনগ্রসর শ্রেণির শাখা সংগঠন রয়েছে। কিন্তু বাংলার দীর্ঘ ইতিহাস ও সংস্কৃতি অনুযায়ী রাজনৈতিকভাবে তাদের কাজে লাগানোর কথা কখনও ভাবা হয়নি। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের আগে থেকেই রাজ্য জুড়ে জাতপাতের রাজনীতি আমদানি করছে বিজেপি। ফলে তড়িঘড়ি আমাদের দলের শাখা সংগঠনগুলিকে এ ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। বাংলায় জাতপাতের রাজনীতি বরদাস্ত করা হবে না।’
এমনিতে গো-বলয় ও আশপাশের রাজ্যগুলিতে ‘দলিত’ শব্দটি রাজনৈতিকভাবে বিশেষ প্রচলিত। কয়েকটি দলের শক্তপোক্ত ভোটব্যাঙ্ক। কিন্তু বাংলায় এতদিন রাজনৈতিক দলগুলি অথবা ভোটারদের এ নিয়ে ভাবতে হয়নি। কিন্তু এবার তৃণমূলের নজরে বিষয়টি এনেছেন প্রশান্ত কিশোর। দলকে তিনি বলেছেন, গত কয়েক মাস ধরে অত্যন্ত গোপনে রাজ্য জুড়ে ‘দলিত’ ভাবাবেগ উসকে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। প্রচার করা হচ্ছে, নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল এবং এনআরসি নিয়ে। বোঝানো হচ্ছে, ২০১৪-র ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিবেশী দেশ থেকে বাংলায় আসা হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। নাগরিকত্ব পাবেন না মুসলিমরা। তবে বিজেপির তরফে মানুষকে এই ভুল বোঝানোর কর্মসূচী বানচাল করে দিতে বদ্ধপরিকর তৃণমূল। তাই ইতিমধ্যেই ময়দানে নেমে পড়েছেন দলের নেতা-কর্মীরা।