অলোকদা, তারাপদদা’রা যখন চিত্রসাংবাদিক হিসেবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তখন আমি চিত্রসাংবাদিকতায় আসিনি। যখন এলাম, তখন তারা যাকে বলে খ্যাতির মধ্যগগনে। সত্যি বলতে কি, আমার মত অনেকেই তখন ওদের মত ছবি তোলার চেষ্টা করতাম। কিন্তু কীভাবে যেন কিছুতেই ওদের ছাপিয়ে যেতে পারতাম না। সে টাইমিং বলুন বা ছবির বিষয় কিংবা সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় পৌঁছনো – ওরা যাকে বলে ঠিক মেরে বেরিয়ে যেতেন। সেই অলোকদা প্রয়াত হলেন, দেশের চিত্রসাংবাদিকতায় এক নক্ষত্র পতন হল।
অলোকদা, গলায় সোনার চেন, কোট-টাই পরে ছবি তুলতে একমাত্র তুমি। আর সব চিত্রসাংবাদিকদের সঙ্গে তোমার ব্যবহার এত খারাপ ছিল যে আজকের সময় হলে তোমার প্রতিদিন মাথা ফাটতো। তবুও আমরা তোমার অত্যাচার সহ্য করেছি! কেন জানো? ছবিতে তুমি আমাদের প্রতিদিন একশো গোল দিতে। তোমরা দুজনেই এমনিতে গম্ভীর মানুষ, চট করে কারো সঙ্গে ঘনিষ্ট হতে না। আমাদের মত জুনিয়র ফটোগ্রাফারদের সঙ্গে তোমরা দুজনেই একটা দূরত্ব বজায় রাখতে। বোঝাই যেত তোমরা একটা আলাদা ক্লাস। কিন্তু সেই আবরণটা সরিয়ে ভিতরে ঢুকতে পারলেই বোঝা যেত আসলে এটা নিজেদের আত্মবিশ্বাস ও উৎকর্ষের গর্ব। সেসময় বাংলা তো বটেই দেশের সব চিত্রসাংবাদিকরা তোমাদের ভয় করতো। বাঙালি হিসেবে এটা আমাদের গর্ব। তোমাদের কাজ দেখেই আমি ও আমার সব সতীর্থ চিত্রসাংবাদিকরা কাজ শিখেছি।
কুম্ভে গিয়ে ছবি তোলা নিয়ে তোমার সঙ্গে আমার হাতাহাতি হয়েছিল। ফিরে এসে দেখি আমার ব্যাগ টেন্টের বাইরে, কারণ তুমি আমায় তোমার টেন্ট থেকে বার করে দিয়েছিলে। দু’রাত বাইরে ছিলাম। তারপর বন্ধু আলোকচিত্রী অলোকেশের সহায়তায় রঘুবীর সিং এর টেন্টে জায়গা পাই। সে এক বিরল অভিজ্ঞতা। তোমাদের দুজনের মধ্যেই কোন দিন প্রিয় হওয়ার কোন চেষ্টা দেখিনি। বাংলার চিত্রসাংবাদিকদের কাজের প্রশংসা সারা ভারতে হয়, তোমরা দুজনে সেই প্রশংসার ভিত গড়ে দিয়েছিলে নিজেদের কাজের মধ্যে দিয়ে। খবরের কাগজে ছবিরও যে একটা বিরাট ভূমিকা আছে তোমাদের ছবিগুলো তা যেন চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়। সত্যি বলতে কি আমরা তাদের পরবর্তী প্রজন্মের চিত্রসাংবাদিকরা কেউই তোমাদের ছাপিয়ে যেতে পারিনি। তোমার আর তারাপদদার ছবির লড়াই আমরা মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতাম। কোন দিন তুমি থাকতে প্রথম পাতায়, তারাদা’র ছবি ভেতরের পাতায়। আবার কোন দিন ঘটতো তার ঠিক উল্টোটা। তোমরা জানতেও পারতে না আমাদের মত অর্বাচীন ফটোগ্রাফাররা তোমাদের ছবি নিয়ে মদের আড্ডায় কী তুলকালাম করছে। আমার খুব ইচ্ছা ছিল তোমাদের দুজনকে পাশে বসিয়ে ছবি নিয়ে আলোচনা করবো। সে কথা তোমাদের বলেও ছিলাম, তা আর হোল না।
সময় পেলেই এসএসকেএম-এ তোমার কাছে যেতাম। এই শরীর নিয়েও তোমার হম্বিতম্বি আমায় অবাক করতো। বারবার বলতে আমার ছবিগুলো নিয়ে কিছু একটা করিস আর বৌদিকে দেখিস। অলোকদা তুমি দেখে যেতে পারলে না পরবর্তী প্রজন্মের চিত্রসাংবাদিকরা কেউ তোমার খারাপ ব্যবহার মনে রাখেনি। তাদের মনে সব জায়গা জুড়ে আছে একটা সময় দেশের অন্যতম সেরা চিত্রসাংবাদিক অলোক মিত্রের কথা। গভীর রাত অবধি হাসপাতালে এসে তোমাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছে তারা।
আমি কাজের সূত্রে বাইরে ছিলাম, পরে ফিরেছি। একদিকে ভালোই হয়েছে ওই চুল্লির গনগনে আগুনে তোমার মত দাপটে মানুষটাকে ঠেলে ঢোকাতে দেখতে হয়নি। কোট-টাই পড়া স্মার্ট অলোকদাকেই আমি মনে রাখবো। অফিসে তুমি আমাকে দাড়ি বলে ডাকতে। আর আমার পোশাক নিয়ে তোমার ছিল প্রবল আপত্তি, আবার একইসঙ্গে বৌদির পাঠানো লুচি তরকারি দিয়ে বলতে – এই নে খা। তোমার তোলা রবিশঙ্কর ও সত্যজিৎ রায়ের সই করা যে ছবিগুলো রয়েছে তা নিয়ে আইএনসিতে একটা প্রদর্শনী করার চেষ্টা করছি।
অলোকদা-তারাদা কথাটা শুধু যে আমরা বলতাম তাই নয়, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানতেন তোমাদের এই জুড়ির কথা। তুমি যখন রোগশয্যায় তখন একদিন কথা প্রসঙ্গে তোমার অসুস্থতার কথা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তুলতেই তিনি বললেন – কোন অলোকদা? আমি বললাম – দিদি সেই অলোকদা-তারাদা। সঙ্গে সঙ্গে তিনি চিনতে পারলেন। এরপর তোমার সব চিকিৎসার দায়িত্ব রাজ্য সরকার নিয়েছিল। আমরা বাংলার সব আলোকচিত্রীরা এজন্য তার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।
সত্যিই অপূরণীয় ক্ষতি, অলোকদা তোমাকে ভোলা কঠিন। তোমার ছবিই তোমার কথা বারবার মনে করিয়ে দেবে।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত