১৯৪২ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর।
বেলা তিনটে।
পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য নিবেদিত বিপ্লবী জনতার মিছিল চলছে এগিয়ে তমলুক থানা ও দিওয়ানি আদালতের দিকে। তমলুক শহরের চারটে প্রধান প্রবেশপথে সেই মিছিল আটকানোর জন্য মোতায়েন করা হয়েছে ব্রিটিশ পুলিশ। বিপ্লবীদের মুখে স্লোগান, ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’, ‘বন্দেমাতরম’, ‘গান্ধীজি কি জয়’।
মেদিনীপুরের তমলুক শহরের উত্তর দিকের গ্রাম হোগলা, আলিনান, জ্যামিট্যা, সোয়াদিঘি, খোসখানা, ডিমারী, বিশ্বাস, ধলহারা, মথুরি, সিউরি থেকে দলে দলে সাধারণ মানুষ রূপনারায়ণ নদের পাড় ধরে হেঁটে আসছে স্লোগান দিতে দিতে। বছরের পর বছর ব্রিটিশ শাসকের অমানবিক অপমানকর অত্যাচার আর সহ্য করা যাচ্ছে না। নিজের দেশেই পরাধীন। সারা শরীরের রক্ত ফুটতে শুরু করেছে জনতার।
পায়রাটুঙ্গি খালের কাছে দেওয়ানি কোর্টের পেছনে বানপুকুর পাড়ে বিশাল ব্রিটিশ সেনাবাহিনী অহিংস জনতার মিছিলের পথ আটকে দাঁড়াল। আর এগোলেই গুলি করা হবে। এগোনো চলবে না। সঙ্গে চলল অকথ্য ভাষায় অপমানকর কথা আর অশ্রাব্য গালাগালি। উদ্যত বন্দুকের সামনে তখন আগুনময় উদ্বেলিত জনতা।
হঠাৎই মথুরি গ্রামের ১৩ বছরের ছোট্ট রোগা বালক লক্ষ্মীনারায়ণ দাস ছুটে গিয়ে এক ব্রিটিশ পুলিশের হাত থেকে উত্তেজিত হয়ে ছিনিয়ে নিতে গেল নেট বন্দুক। সেই ছোট্ট বালককে পুলিশের বীরপুরুষরা বন্দুকের বাঁট আর বেয়োনেট দিয়ে থেঁতলে থেঁতলে খোঁচা মেরে মেরে খুন করে ফেলল। মৃত্যুযন্ত্রণার বুকচেরা চিৎকার-আর্তনাদ কিছুটা হতচকিত করে ফেলল জনতাকে।
ঠিক তখনই সেই মিছিলের মধ্যে থেকে লোকজন ঠেলে এগিয়ে এলেন ৭৩ বছরের এক বৃদ্ধা।
সামনের একজনের হাত থেকে একটা ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা নিজের হাতে নিয়ে নিলেন। সামনের একটা বাড়ির দালানে উঠে হতচকিত জনতাকে আহ্বান করে বললেন,
“হয় জয়, না হয় মরণ। হয় এগিয়ে যাব নয় মরব। আমি সকলের আগে থাকব। কেউ পিছিয়ে যেও না। এসো। আর যদি কেউ না আসো তবে আমি একাই এই পতাকা নিয়ে এগিয়ে যাব। তাতে যদি মর্তে হয় মরব। এসো আমার সঙ্গে।”
সেই মহীয়সী প্রবীণা পতাকাটি নিয়ে শুরু করলেন হাঁটা। দেশমুক্তির এক অদম্য জেদ এই বৃদ্ধার অন্তরে-বাহিরে। সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ শাসকের পুলিশের দিক থেকে হুমকি এল, “খবরদার, এক পা এগোলেই গুলি করব।”
যদিও সেই হুমকি টলাতে পারেনি এই তেজস্বিনী বৃদ্ধার গতিপথ। তাঁর লক্ষ্য পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন, দেশের স্বাধীনতা, একমাত্র স্বাধীনতা। অকুতোভয় সেই বৃদ্ধা ‘বন্দেমাতরম’ বলতে বলতে এগিয়ে চললেন।
হঠাৎ একটি গুলি ছুটে এসে বিদ্ধ করল বৃদ্ধার ডান হাত। রক্তের লাল নদী যেন বইতে লাগল তাঁর ডান হাত দিয়ে। তবুও দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে চলতে লাগলেন বৃদ্ধা, অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যেও পতাকাটিকে ডান হাতে আঁকড়ে ধরে বানপুকুরের পাড় ধরে।
ব্রিটিশের সেনাবাহিনী আবার গুলি চালাল বৃদ্ধার শরীর লক্ষ করে এবং বৃদ্ধার বাম হাতে গিয়ে বিদ্ধ হল সেই গুলি। রক্তে ভেসে যাচ্ছে দেশমাতৃকার সেই বীরাঙ্গনার পরনের সাদা থান কাপড়টা। গুলিবিদ্ধ জখম হাত দিয়ে বুকের মাঝে পতাকাদণ্ডটি সন্তানকে আঁকড়ে ধরে রাখার মতো সজোরে ধরে রেখে বৃদ্ধা এগিয়ে চলেছেন, মুখে ‘বন্দেমাতরম। কপালে, মুখে, ঘামের বিন্দুগুলো যেন হীরকখণ্ডের জ্যোতির্ময় দ্যুতি ছড়িয়ে দিচ্ছে। রক্তের স্রোত বইছে সারা শরীরে, লাল রক্তের ফোঁটায় ফোঁটায় ভিজে যাচ্ছে পরাধীন দেশের মাটি। বৃদ্ধার কণ্ঠে তবু সেই মুখরিত উচ্চারণ ‘বন্দেমাতরম’, ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’। রক্তাক্ত গুলিবিদ্ধ শরীর নিয়ে দু’হাতে দেশের পতাকাটি বুকে আঁকড়ে ধরে বীর দর্পে পরাধীন ভারতবর্ষের বীরমাতৃকা এগিয়ে চলেছেন।
ব্রিটিশ শাসকের অমানবিক পুলিশকর্মীরা তখন বিস্মিত, ভীত। তাই তারা আরও ন্যক্কারজনক ঘৃণ্য হিংস্রতার পরিচয় দিল।
আবার চলল গুলি।
সেই গুলি গিয়ে বিদ্ধ হল সেই অহিংসার প্রতীক প্রবীণা মহীয়সীর কপালের কাছে বাঁ চোখের নীচে। গুলিটা তাঁর মাথার খুলি ফাটিয়ে বেরিয়ে গেল। আগ্নেয়গিরির মতো শত সহস্র কোটি ধারায় ছিটকে পড়ল রক্তের বন্যা। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। তখনও তাঁর বুকে চেপে ধরা সেই পতাকাটি। রক্তে ভিজে উঠেছে ত্রিবর্ণ পতাকা। নিথর হয়ে পড়ে রইলেন ‘গান্ধীবুড়ি’, ‘বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনী হাজরা’।
সে দিন মাতঙ্গিনী হাজরা ছাড়াও ব্রিটিশের গুলিতে তমলুকের মাটি লাল হয়েছিল মথুরি গ্রামের লক্ষ্মীনারায়ণ দাস, দ্বারিবেরিয়ার পুরীমাধব প্রামাণিক, মাশুরির জীবনকৃষ্ণ বেরা, আলিনানের নগেন্দ্রনাথ সামন্ত, ঘটুয়ালের পূর্ণচন্দ্র মাইতি, তমলুকের নিরঞ্জন জানা, কিয়াখালির রামেশ্বর বেরা, হিজলবেড়িয়ার নিরঞ্জন পাখিয়াল, খনিকের উপেন্দ্রনাথ জানা ও ভূষণচন্দ্র জানা এবং নিকাশীর বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী-সহ বারোজন দেশপ্রেমিক শহিদের তাজা রক্তে।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণকারী নারীদের মধ্যে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, শান্তি ঘোষ, সুনীতি চৌধুরী, কল্পনা দত্ত, বীণা দাশ ও উজ্জ্বলা মজুমদার প্রভৃতির নাম যেমন অমর হয়ে আছে, তেমনি সন্ত্রাসবাদ পরিহার করেও যেসব বীরাঙ্গনারা জ্বলন্ত দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্তে দেশবাসীদের উদ্বুদ্ধ করে গেছেন মাতঙ্গিনী হাজরা ছিলেন তাঁদেরই অন্যতম। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও ভারতের নারীদের মুকুটমণি স্বরূপা- ‘গান্ধী বুড়ি’ খ্যাত ৪২ এর অগাস্ট আন্দোলনে মাতঙ্গিনীর মূলমন্ত্র ছিলো- ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’ (করো, না হয় মরো)। স্বীকার করতেই হয় যে মাতঙ্গিনী জীবন বিসর্জন দিয়ে এই মন্ত্রের আরাধনায় সিদ্ধি লাভ করেছিলেন।
ছোট্ট গ্রাম হোগলা। মেদিনীপুর জেলার তমলুক থানার এলাকাধীন। ওই গ্রামে অতি গরিব এক চাষি পরিবারে ১৮৭০ সালের ১৭ই নভেম্বর জন্মেছিলেন মাতঙ্গিনী। ঐতিহাসিকেরা অনেক চেষ্টা করে বের করেছেন তাঁর জন্মের সালটি। তাঁর পিতার নাম ছিল শ্রী ঠাকুরদাস মাইতি। মা, শ্রীমতী ভগবতী মাইতি। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্রের বাবা ও মায়ের নামের সঙ্গে আশ্চর্য রকমের মিল।
মাত্র এগারো বছর বয়সেই মাতঙ্গিনীর বিয়ে হয় পাশের আলিনান গ্রামের পাত্র ত্রিলোচন হাজরার সঙ্গে। বিবাহিত জীবনও বেশিদিন স্থায়ী হলো না। মাত্র আঠারো বছর বয়সেই স্বামীকে হারালেন। ছেলে-মেয়েও কিছু হয়নি। এই অকাল বৈধব্যে তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করলেন দেশকে বিদেশির শাসনমুক্ত করে দেশবাসীর মুখে হাসি ফোটানোর চেয়ে বড়ো ধর্ম আর কিছুই থাকতে পারে না।
সাধারণ কৃষক বাড়ির সন্তানহীনা, নিরক্ষর, বাল্যবিধবা ছিলেন তিনি। খুব সাধারণ হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন অসাধারণ, অনন্যা। তাই তিনি স্বপাকে আতপচালসিদ্ধ আর নিরামিষ আহার করতেন। থাকতেন তাঁর স্বামীর বাড়ির এক গোলাঘরে।
বর্তমানের বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী, তমলুকেরই সন্তান ড. মণি ভৌমিক তখন বারো বছরের এক গ্রাম্য বালক। সেদিনের সেই অতি সহজ সরল কপর্দকশুন্য মাতৃময়ী বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা হয়ে উঠেছিলেন মণি ভৌমিকের বাল্য বয়সের বন্ধু। তাঁর নিজের বর্ণনায়, “তাঁর বাবার বাড়ির অবস্থা ভালো ছিল না। তিনি আঠারো বছর বয়সে বিধবা হওয়ার পরে ধান ভাঙার কাজ করে, একটি ঝুপড়ির মধ্যে থেকে তাঁর জীবন ধারণ করতেন। আমি তখন হাড় জিরজিরে নিঃসঙ্গ গরিব এক বালকমাত্র। কিন্তু স্নেহমমতার দৃপ্ততায় এবং দীপ্ততায় মাতঙ্গিনী হাজরা হয়ে উঠেছিলেন আমার বন্ধু এবং উপদেষ্টা।”
১৯৩০ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে শুরু হল লবণ সত্যাগ্রহ আইন অমান্য আন্দোলন। মেদিনীপুরের কাঁথিতেই প্রথম লবণ তৈরি শুরু হলো। খবর পেয়েই পুলিশ গ্রামে ঢুকল। ঘর-বাড়ি সব জ্বালিয়ে দিলো। নানান অত্যাচার শুরু করে দিলো। তবুও মেদিনীপুর শায়েস্তা হলো না। শাসককুল চাইলো লবণ তৈরির একচেটিয়া অধিকার তাদের হাতে থাকুক। কিন্তু দেশের মানুষ চাইলো লবণ তৈরির ক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতা।
১৯৩২ সালে গান্ধীর আইন অমান্য আন্দোলন-এ (লবণ সত্যাগ্রহ) মাতঙ্গিনী অংশগ্রহণ করে আলিনান লবণ কেন্দ্রে লবণ উৎপাদন করেন এবং লবণ আইন অমান্য করার জন্য তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হওয়ার পর শাস্তি হিসেবে তাঁকে দীর্ঘ পথ হেঁটে যেতে বাধ্য করা হয়। তিনি চৌকিদারি ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়ার আন্দোলনেও অংশ নেন। ওই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের শাস্তিদানের উদ্দেশ্যে সরকার কর্তৃক গঠিত বেআইনি আদালতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে স্লোগান দিয়ে আদালত ভবনের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময়ে তাঁকে আবার গ্রেফতার করা হয়। এ সময়ে তাঁকে ছয় মাসের কারাদন্ড দিয়ে বহরমপুর জেলে পাঠানো হয়।
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর মাতঙ্গিনী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কার্যাবলির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত হয়ে পড়েন। গান্ধীর সত্যিকার অনুসারীর মতো তিনি চরকায় সুতা কাটা ও খদ্দরের কাপড় বোনায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৩৩ সালে তিনি শ্রীরামপুর মহকুমা কংগ্রেস সম্মেলনে যোগদান করেন। সেখানে প্রতিবাদকারীদের উপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে। তিনি সর্বদা মানবতাবাদী উদ্দেশ্য সাধনে নিয়োজিত থেকেছেন। তাঁর অঞ্চলে যখন মহামারী আকারে বসন্ত-রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে, তখন তিনি আক্রান্ত পুরুষ, নারী ও শিশুদের সেবা করেছেন। জনগণ সোহাগভরে তাঁকে ‘গান্ধী বুড়ি’ বলে ডাকত।
পরবর্তী ঘটনাটি ১৯৩৪/৩৫ সালের।
অবিভক্ত বাংলার লাটসাহেব মি. অ্যান্ডারসন গোঁ ধরেছেন তমলুকে দরবার করবেন। হৈ হৈ রৈ রৈ কাণ্ড। মেদিনীপুরবাসীরা লাটসাহেবকে দরবার কিছুতেই করতে দেবে না। তাঁরা দেখিয়ে দিতে চান আর কিছুতেই ইংরেজদের গোলামি করতে রাজি নয়। ইংরেজ সরকারও তাদের সংকল্পে অটল। সংঘাত অনিবার্য হলো।
লাটসাহেব এলেন জেদের বশে। এমন সময় হাজার কণ্ঠে ধ্বনি উঠল– ‘লাটসাহেব তুমি ফিরে যাও- ফিরে যাও। তোমার কোনো কথা আমরা শুনতে রাজি নই। ঢের হয়েছে। তোমাদের দাসত্ব আর আমরা সহ্য করতে পারছি না। আমরা চাই তোমাদের হাত থেকে মুক্তি। বন্ধ করো তোমাদের শোষণ ও লুণ্ঠন। বন্ধ করো তোমাদের পুলিশি জুলুম। লাটসাহেব তুমি ফিরে যাও।’ আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠল, ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনিতে।
শোভাযাত্রা এগিয়ে চলল দরবারের দিকে। শত শত পুলিশও রুদ্ররূপে হাজির।
সেই শোভাযাত্রার পুরোভাগেই ছিলেন মাতঙ্গিনী। পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করল। মাতঙ্গিনী দু’মাস সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেন। বিচারের রায় ঘোষণার পর মাতঙ্গিনী হাসিমুখে বলেছিলেন,
‘দেশের জন্য, দেশকে ভালোবাসার জন্য দণ্ডভোগ করার চেয়ে বড়ো গৌরব আর কী আছে?’
মাতঙ্গিনীকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে ১৯৪২ সালের অগাস্ট বিপ্লব। ১৯৪২ সালের ৯ আগস্ট তারিখে ওই আন্দোলনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে গান্ধী-‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ডাক দেন। দেশনায়ক সুভাষচন্দ্রের প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত হলো জাতির জনকের আবেগ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাজেহাল ইংল্যান্ডকে ক্ষমতাচ্যুত করার একটা সুবর্ণসুযোগ দেখা দিলে সাফল্যের সম্ভাবনা ব্যর্থ হয়।
১৯৪২ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর। অগাস্ট বিপ্লবের জোয়ার তখন মেদিনীপুরে আছড়ে পড়েছে। ঠিক হয়েছে একসঙ্গে তমলুক, মহিষাদল, সুতাহাটা ও নন্দীগ্রাম থানা আক্রমণ করে দখলে নেয়া হবে।
মাতঙ্গিনী স্বেচ্ছাসেবকদের বোঝালেন গাছ কেটে ফেলে রাস্তা-ঘাট সব বন্ধ করে দিতে হবে। টেলিফোন ও টেলিগ্রাফের তার কেটে দিতে হবে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিতে হবে। পাঁচদিক থেকে পাঁচটি শোভাযাত্রা নিয়ে গিয়ে তমলুক থানা এবং একই সঙ্গে সমস্ত সরকারি অফিসগুলি দখল করে নিতে হবে। ২৯শে সেপ্টেম্বর পাঁচটি দিক থেকে পাঁচটি শোভাযাত্রা এগিয়ে চলল তমলুক অধিকার করতে। হাজার হাজার মেদিনীপুরবাসী শামিল হয়েছিলেন ওই শোভাযাত্রায়। হাতে তাঁদের জাতীয় পতাকা। মুখে গর্জন ধ্বনিত ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো- করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে- বন্দে মাতরম্’।
গুর্খা ও ব্রিটিশ গোরা সৈন্যরা তৈরি হলো অবস্থার মোকাবিলার জন্য। হাঁটু মুড়ে বসে গেলো তাঁরা। তারপরই তাঁদের বন্দুকগুলো গর্জে উঠল। মারা গেলেন পাঁচজন। আহত হলেন আরও বেশ কয়েকজন। আহত রামচন্দ্র বেরার দেহটা টানতে টানতে থানার সামনে এনে ফেলে রাখল কোনও এক ব্রিটিশ পুলিশ। জ্ঞান ফিরে আসতেই সবার অলক্ষ্যে রামচন্দ্র বেরা বুকে ভর করে হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে হেঁটে থানার দিকে এগিয়ে চললো। থানা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেই উল্লসিত ফেটে পড়ে বলে উঠলেন- ‘থানা দখল করেছি’। তারপরই তাঁর শরীর নিথর নিস্পন্দ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
উত্তর দিক থেকে আসছিল মাতঙ্গিনীর দলটি। তাঁরা থানার কাছাকাছি আসতেই পুলিশ ও মিলিটারি অবিরাম গুলিবর্ষণ শুরু করে দিল। বিদ্রোহীদের মধ্যে থেকে বেশ কয়েকজন কিছুটা পিছু হটে গিয়েছিল। তাদের সতর্ক করে দিয়ে মাতঙ্গিনী বললেন- ‘থানা কোন্ দিকে? সামনে, না পেছনে? এগিয়ে চলো। হয় থানা দখল করো, নয়ত মরো। বলো- ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’-‘বন্দে মাতরম্।’
একটি বুলেট তাঁর ডান হাতে লাগতেই হাতের শাঁখটি মাটিতে পড়ে গেল। দ্বিতীয় বুলেটের আঘাতে বাঁ-হাতটা নুয়ে পড়ল। কিন্তু ওই অবস্থাতেও ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীতে কর্মরত ভারতীয় সৈনিকদের উদ্দেশ্য করে মাতঙ্গিনী বলে চলেছেন,
‘ব্রিটিশের গোলামি ছেড়ে গুলি ছোঁড়া বন্ধ করো- তোমরা সব আমাদের মতো স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে হাত মেলাও।’
প্রত্যুত্তরে উপহার পেয়েছিলেন কপালবিদ্ধ করা তৃতীয় বুলেটটি। প্রাণহীন দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল। কিন্তু জাতীয় পতাকাটি তখনও তাঁর হাতের মুঠোয় ধরা ছিল। ১৯৪২ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বরের এই দিনটিতেই ব্রিটিশের বুলেটকে বুকে ধারণ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মাতঙ্গিনী।
তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার স্বদেশের জন্য মাতঙ্গিনী হাজরার মৃত্যুবরণের দৃষ্টান্তটিকে সামনে রেখে মানুষকে বিপ্লবের পথে উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিল। উল্লেখ্য, এই সমান্তরাল সরকারটি ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত সফলভাবে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়। পরে গান্ধীজির অনুরোধে এই সরকার ভেঙে দেওয়া হয়েছিল।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করলে অসংখ্য স্কুল, পাড়া ও রাস্তার নাম মাতঙ্গিনী হাজরার নামে উৎসর্গ করা হয়। স্বাধীন ভারতে কলকাতা শহরে প্রথম যে নারীমূর্তিটি স্থাপন করা হয়েছিল, সেটি ছিল মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তি। ১৯৭৭ সালে কলকাতার ময়দানে এই মূর্তিটি স্থাপিত হয়।
তমলুকে ঠিক যে জায়গাটিতে তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন, সেই জায়গাটিতেও তাঁর একটি মূর্তি আছে। ২০০২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলন ও তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গঠনের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ভারতের ডাকবিভাগ মাতঙ্গিনী হাজরার ছবি দেওয়া পাঁচ টাকার পোস্টাল স্ট্যাম্প চালু করে।
আজ থেকে ৭৭ বছর আগে মেদিনীপুরের মাটিতে এক বীরাঙ্গনা অকুতোভয় মহীয়সী নারীর যে দেশপ্রেম এবং আত্মত্যাগ দেখেছিল ব্রিটিশ শাসক, তাতে তারা উপলব্ধি করেছিল, এ দেশে আর বেশিদিন তাদের অত্যাচার চলবে না। মাত্র পাঁচ বছর পরেই ভারত ছেড়ে তাদের চলে যেতে হয়েছিল – ভারতবর্ষ পেয়েছিল স্বাধীনতার আস্বাদন। শহীদমাতৃকা মাতঙ্গিনী হাজরার বলিদানের আজ ৭৭তম পবিত্র বছরে এবং দিনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা বলতে পারি- ওগো আমাদের বীরব্রতী শহিদ জননী, মাতঙ্গিনী তোমার আঁচলে বাঁধা রয়েছে – যুগযুগান্ত ধরে বাঁধা থাকবেই আমাদের জন্ম জন্মান্তরের রক্ত ঋণ, যা অপরিশোধ্য চিরকাল, চিরদিন।
(তথ্যসূত্র:
১- ইতিহাসের পাতা থেকে (প্রথম খণ্ড), প্রথম প্রকাশ- জানুয়রি, ২০০৮, মিত্রম্ প্রকাশনী, কলকাতা।
২- সংগ্রামী জাতীয়তাবাদ: মেদিনীপুর ও মানভূম (১৯০০-১৯৪৭), ড. শ্যামাপ্রসাদ বসু, দে’জ পাবলিশিং।
৩- আমাদের পূর্ব মেদিনীপুর, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, বাকপ্রতিমা (২০১৪)।
৪- মেদিনীপুর প্রতিভা, ড. বিমল কুমার শীট, প্রভা প্রকাশনী (২০১১)।
৫- দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ ও বিপ্লবী মেদিনীপুর, প্রবীর জানা, ছায়া পাবলিকেশন (২০১৩)।
৬- উইকিপিডিয়া।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত