আজ মহালয়া। পিতৃপক্ষের অবসান ঘটিয়ে দেবীপক্ষের সূচনা। রোজকার নিয়ম বদ্ধ জীবনে বাঙালিয়ানা হারাতে বসলেও হারায়নি সবটা। এখনো পুজো, মহালয়াতে উদ্বেল হয় বাঙালি। বাঙালির দুর্গাপূজায় এই মহালয়া তিথিতেই তো দেবী প্রতিমার চক্ষুদান করা হয়। প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা এই রীতি মেনে আজও বালুরঘাটে মহালয়া তিথিতেই দুর্গা প্রতিমার চক্ষুদান করেন মৃৎশিল্পীরা। শাস্ত্র মতে মহালয়ায় থাকে ঘোর অমাবস্যা। এদিন মর্ত্যে দেবীর আগমন এর সাথে সাথেই সূচনা হয় মাতৃপক্ষের। আজকের দিনটাকে ঘিরে অধীর অপেক্ষা করেন মৃৎশিল্পীরা।
চক্ষুদান সম্পর্কে কাশী বোস লেনের পুজোর শিল্পী প্রদীপ দাস বলেন, বহু দিন ধরেই দেখে আসছি রীতি মেনে মহালয়ার সকালে ঐতিহ্যশালী বাড়িগুলিতে প্রতিমার চক্ষুদান পর্ব সম্পন্ন হয়ে থাকে। এক বছরের অপেক্ষা শেষে আসে বিশেষ এই দিনটি। তবে বাড়ির ঠাকুরের চক্ষুদানের সময় যে ধরনের আবেগ কাজ করে, তা হয়তো থিম পুজোর ক্ষেত্রে কিছুটা কম। কিন্তু আমার কাছে দুর্গাপুজোর সবটাই অনন্য সাধারণ। খুঁটিপুজো থেকে শুরু করে চক্ষুদানপর্ব সবই আমার কাছে প্রিয়। পাশাপাশি তিনি বলেন, সমগ্র মানবজাতির কাছেই চোখ অমূল্য সম্পদ। চোখ দিয়েই আমরা মাকে এবং মা আমাদের দেখেন। ফলে আমার কাছে এই চক্ষুদান পর্বের অন্যরকম গুরুত্ব রয়েছে। এবারে আমাদের মণ্ডপে প্রতিমার চক্ষুদান হয়েছে মহালয়ার দু’দিন আগে, রাত ৯টা নাগাদ।
নলীন সরকার স্ট্রিটের পুজোর শিল্পী মানস দাস বলেন, দেবীর চক্ষুদান অনেক বড় বিষয়। মহালয়ার দিনে হওয়া এই চক্ষুদান পর্বেই প্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়। অনন্য রূপ পান দেবী। এটা আমার কাছে শ্রেষ্ঠ দিন। কার্যত এদিন থেকেই আমার কাছে পুজোর শুরু। এর আগে পুজো পুজো ব্যাপার থাকলেও আসল আমেজ শুরু হয় দেবীরপক্ষের দিন থেকেই। তাই রীতি মেনে আমিও মহালয়ার সকালেই দেবীর চক্ষু অঙ্কন করে থাকি। এবারেও তার অন্যথা হচ্ছে না।
আহিরীটোলা সর্বজনীনের শিল্পী তন্ময় চক্রবর্তী বলেন, দেবীর চক্ষুদান পর্বের মাধ্যমে মণ্ডপে মায়ের উপস্থিতি তৈরি হয়। এই রীতির পরই মা আমাকে দেখতে পান। এটা সম্পূর্ণ অন্যরকমের অনুভূতি। ভাষায় যা প্রকাশ করা শক্ত। চক্ষু অঙ্কনের পরই শিল্পীর হাতে তৈরি প্রতিমায় যেন প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়। তবে এবারে আমাদের প্রতিমা নিয়ে আসা হয়েছে ভুবনেশ্বর থেকে। দেবী মূর্তি পাথরের, মাটির নয়। তাই চক্ষুদানের ব্যাপার এই বছর নেই। কিন্তু চক্ষুদান পর্ব উপলক্ষে মহালয়ার সন্ধ্যায় এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে উপস্থিত থাকছে আসন্ন ব্যোমকেশ ছবির পুরো টিম। এছাড়া রয়েছে ওস্তাদ আমজাদ আলি খানের বিশেষ একটি অনুষ্ঠান।
এখন অবশ্য চক্ষুদানপর্ব অধিকাংশ পুজো প্যান্ডেলেই উৎসবের আদলে পালিত হয়। নামী তারকাদের উপস্থিতিতে চক্ষু অঙ্কন করেন শিল্পীরা। কথিত আছে, দুর্গাপুজোর প্রথম প্রচলন হয় সত্যযুগে, বৈশ্য দুর্গামূর্তি তৈরি করে তিন বছর পুজো হয়। এরপর ত্রেতা যুগে রাবণ বসন্তকালে দেবী দুর্গার পুজো শুরু করেন। সেই কারণেই এই পুজোর নাম হয় বাসন্তী পুজো। কিন্তু রামচন্দ্র রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণের আগে শরত্কালে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন। আর অসময়ে করা রামচন্দ্রের এই পুজোকে বলা হয় অকাল বোধন। তারপর থেকে বাঙালিরা যুগ যুগ ধরে ওই সময়েই পুজো করে আসছেন। যা পরিচিত শারদীয়া দুর্গাপুজো হিসেবে।