‘দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খানখান’ – হীরক রাজার দেশে মূর্তি ভাঙার মধ্যে দিয়ে এভাবেই সাধারণ মানুষের জয় বার্তা সূচীত হয়েছিল। কিংবা হালের বাহুবলী সিনেমাতেও দেখা যায় সোনার মূর্তি ভেঙে ফেলা হচ্ছে। গড়িয়ে পড়ছে মাথা। আর নতুন রাজা হচ্ছেন বাহুবলী।
এ হল রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে সাধারণের প্রতিবাদ। সময় বদলেছে। গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল। কিন্তু মূর্তি ভাঙার সেই রাজনীতি বদলায়নি। সিনেমা তো বাস্তবেরই অংশ। আধুনিক সমাজ জীবনেও ক্ষমতাশালী সংগঠকরা মূর্তি ভাঙতে-ফেলে দিতে-কালি ছেটাতেই ব্যস্ত, এখনও। শুধু সাধারণের হাতিয়ার এখন চলে গেছে সঙ্ঘবদ্ধ রাজনৈতিক দলের হাতে।
কখনও বিদ্যাসাগর, কখনও মহাত্মা গান্ধী, কখনও মাইকেল, কখনও লেনিনের মূর্তি ভাঙা হচ্ছে আবার কখনও বা চে’ গেভারা’র ছবিতে কালি ছেটাচ্ছে! অর্থাৎ সারা বিশ্ব যাঁদের নিয়ে আলোড়িত, গোটা দুনিয়া যাঁদের নিয়ে গুণগান করে, তাঁদের ওপরই নেমে আসছে গেরুয়া থাবা। ভেঙে গুড়িয়ে রাস্তায় পড়ে থাকছে মূর্তি। ভূলুন্ঠিত হচ্ছে সমাজ সংস্কারকদের আবক্ষ মূর্তি। আসলে ভূলুন্ঠিত হচ্ছে সমাজের শুভবুদ্ধি।
রাজনৈতিক মহলের মতে, বিদ্যাসাগর যে সমাজের কথা বা নারীদের যে স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন, তা গ্রহণ গেরুয়া শিবিরের পক্ষে সম্ভব নয়। লেনিন বা চে’র মূর্তি-ছবি তাঁদের কাছে শত্রুর মতোই। গান্ধীর আদর্শ তাঁদের মানার প্রশ্নই ওঠে না। তাই আক্রমণ করো সেগুলোতেই, যাতে সেই মানুষগুলোর নীতি-আদর্শকে আঘাত করা যায়। মনীষীদের অপমানের নেপথ্য আসলে সেই রাজনীতিরই চেনা ছক, আদর্শ ভেঙে নতুন ‘পথ’ তৈরির কৌশল।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিরোধী মতের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা। শুনেছে নামের আগে মাইকেল আছে। অতএব এই ব্যক্তি হিন্দু থেকে খ্রিস্টান হয়েছে। মানুষটি গত হয়েছেন। এখন তো আর গোবর খাইয়ে ঘর ওয়াপসি করানোরও সুযোগ নেই, অতএব মূর্তিই ভাঙো। প্রশ্ন ওঠে, যারা নিজেদের হিন্দু বলেন, রামকৃষ্ণ পরমহংসকে মানেন, অথচ তাঁর ‘যত মত তত পথ’ আদর্শকে মানেন না। যারা নিজেদের ভারতের ঐতিহ্যের ধারক-বাহক বলে প্রচার করেন, তাদের কাছে এটা দ্বিচারিতা নয়?