গত শনিবার হিন্দী দিবসের দিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর হিন্দী ভাষাকে দেশের সাধারণ ভাষা করার পক্ষে জোর সওয়াল করার পর থেকেই বিরোধিতায় ঝড় উঠেছে দেশ জুড়ে। পরিস্থিতি এমনই যে, শাহের ‘এক দেশ, এক ভাষা’ সংক্রান্ত বক্তব্যের পর দক্ষিণ ভারতে রীতিমতো ভাষা আন্দোলন শুরু হওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে। ডিএমকে নেতা এম কে স্ট্যালিন দলকে নির্দেশ দিয়েছেন আবার এক ভাষা আন্দোলনের জন্য সবাই তৈরি থাকুন। এবারের লড়াই আরও তীব্র করতে হবে হিন্দী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে।
প্রসঙ্গত, দিন দুয়েক আগেই জোর করে হিন্দী চাপানোর বিরুদ্ধে মুখ খুলে মোদী সরকারকে ‘জাল্লিকাট্টুর থেকেও বড় প্রতিবাদ হবে’ হবে বলে তীক্ষ্ণ ভাষায় হুমকি দিয়েছিলেন অভিনেতা-রাজনীতিক কমল হাসান। তার পরপরই দক্ষিণী সুপারস্টার রজনীকান্তও একইসুরে মুখ খুলেছেন। রজনীকান্ত বলেছেন, হিন্দী আগ্রাসন মেনে নেওয়া হবে না। ভাষা আমাদের অস্তিত্ব। সেই অস্তিত্বকে যারা ধাক্কা দিতে চাইবে তাঁদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে মানুষ।
ফলে তামিলনাড়ু, কর্ণাটক,কেরল, তেলেঙ্গানায় এই ভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের আঁচ ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে। মিছিল, বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। স্ট্যালিনের ভাষা আন্দোলনের ডাক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এই প্রথম নয়, এর আগে দক্ষিণ ভারতে হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে একাধিক আন্দোলন হয়েছে। আর সেই রক্তক্ষয়ী আন্দোলনগুলিকে স্মরণ করেই হয়তো এবার নিজের বক্তব্য থেকে সামান্য হলেও সরে এসেছেন অমিত শাহ।
গতকাল শাহ বলেছেন, হিন্দিকে জোর করে চাপানোর কথা আমি বলিনি। আমার বক্তব্য ছিল মাতৃভাষার পাশাপাশি দ্বিতীয় যোগাযোগের ভাষা হিসাবে হিন্দিকে গ্রহণ করা এবং চালু করা। আমি নিজেই অহিন্দিভাষী রাজ্য গুজরাতের বাসিন্দা। সুতরাং আমি কেন আঞ্চলিক ভাষাকে সরিয়ে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করব? শুধু তাই নয়। এটা নিয়ে অযথা রাজনীতি হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
উল্লেখ্য, ব্রিটিশ ভারতে ১৯৩৭ সালে মাদ্রাজ রেসিডেন্সিতে হিন্দী ভাষাকে স্কুলে আবশ্যক সাবজেক্ট হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়। প্রতিবাদে ই ভি রামস্বামীর (পেরিয়ার) নেতৃত্বে প্রবল বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে গোটা মাদ্রাজ রেসিডেন্সিতে। তিনবছর ধরে ওই বিক্ষোভ, আত্মহত্যার চেষ্টা, ভাঙচুর, গুলি চালনার ঘটনা ঘটে। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস পরিচালিত মাদ্রাজ রেসিডেন্সির সরকারকে পদত্যাগ করতে হয় ১৯৩৯ সালে। ১৯৪০ সালে ওই সার্কুলার প্রত্যাহার করা হয়।
ভারতীয় সংবিধানে বলা হয়, দেশে অফিসিয়াল ভাষা হবে হিন্দী এবং সহযোগী ভাষা ইংরাজি। তবে এটা হবে ১৫ বছরের জন্য। তারপর থেকে দেশের অফিসিয়াল ভাষা হবে হিন্দী। ১৯৬৩ সাল থেকে সেরকমই প্রস্তুতি চলে। দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাঘাম (ডিএমকে)-এর পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্তের প্রবল বিরোধিতা শুরু হলে ১৯৬৩ সালেই প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু অফিসিয়াল ল্যাংগুয়েজ অ্যাক্ট ১৯৬৩ লাগু করেন এবং জানিয়ে দেন হিন্দী ও ইংরাজি দুই ভাষাই অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে থাকবে ১৯৬৫ সালের পরও।
কিন্তু ১৯৬৪ সালে নেহরুর মৃত্যুর পর যতই ১৯৬৫ সাল এগিয়ে আসে ততই প্রচার শুরু হয় পুনরায় হিন্দীকেই একমাত্র অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে চালুর জন্য। আর সেই প্রচারের জেরে দক্ষিণ ভারতজুড়ে আন্দোলন শুরু হয়। তামিলনাড়ুর ওই ভাষা আন্দোলনের তীব্রতা এতই ছিল যে রীতিমতো ভাষাদাঙ্গাও হয়। সরকারিভাবে ৭০ জনের মৃত্যু হলেও বলা হয় বেসরকারি মৃত্যুর সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী এরপরই ঘোষণা করেন যতদিন পর্যন্ত অহিন্দি রাজ্যগুলি চাইবে ততদিন পর্যন্ত ইংরাজিও থাকবে অফিসিয়াল ভাষা। ১৯৬৭ সালে ইন্দিরা গান্ধী আইন সংশোধন করে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন হিন্দীর পাশাপাশি ইংরাজি অফিসিয়াল ভাষা থাকবে অনির্দিষ্টকালের জন্য। কিন্তু এত প্রয়াস সত্ত্বেও কংগ্রেস আর জনমত সঙ্গে পায়নি।
১৯৬৭ সালে বিধানসভা ভোটে স্রেফ হিন্দী বিরোধী ভাষা আন্দোলনে ভর করেই তামিলনাড়ুতে ডিএমকে কংগ্রেসকে পরাজিত করে সরকারে ক্ষমতায় আসীন হয়। এবং তারপর থেকে আজ পর্যন্ত কংগ্রেস অথবা কোনও উত্তর ভারতের পার্টি তামিলনাড়ুতে আর সরকারে আসতে পারেনি। সুতরাং এই ইতিহাস জানা সত্ত্বেও হিন্দী ভাষার পক্ষে সওয়াল করার ফল যে তাঁকে ভুগতে হবে, তা ভাল মতোই আন্দাজ করতে পারছেন ঘাঘু রাজনীতিক শাহ। তাই আগেভাগেই ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমে পড়েছেন তিনি।