‘আমার তো মনে হয় যেভাবে গোটা বাঙালী জাতির মুখ দেখা যেত উত্তম কুমারের মধ্যে। সেভাবে আর কেউ পারবে না নিজের জাতকে তুলে ধরতে। এমনকি তার মতো ওভাবে ধুতির কোঁচাও ধরতে পারবে না কেউ।’ উত্তম কুমার সম্পর্কে বলতে গিয়ে এক সময় ঠিক এ কথাই বলেছিলেন প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা রাজেশ খান্না। আজ ৩ সেপ্টেম্বর, ভারতীয় চলচ্চিত্রের মহানায়কের ৯৩ তম জন্মদিন।
১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কলকাতার আহিরীটোলায় জন্মগ্রহণ করেন উত্তম। তাঁর পিতার নাম সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায় এবং মাতার নাম চপলা দেবী। উত্তম কুমার হিসেবে খ্যাত হলেও, তাঁর আসল নাম ছিল অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। মাত্র দশ বছর বয়সেই গয়াসুর নাটকে অভিনয় করে প্রশংসা ও পুরস্কার লাভ করেন ছোট্ট অরুণ। তারপর কালের নিয়মে বেড়ে ওঠা। ১৯৪২ সালে কলকাতার সাউথ সাবার্বান স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন এবং পরে গোয়েঙ্কা কলেজে ভর্তি হন তিনি। কলকাতার পোর্টে চাকরি নিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও গ্র্যাজুয়েশন শেষ করতে পারেনি। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসে চলচ্চিত্র জগতে প্রতিষ্ঠা পেতে তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে।
উত্তম কুমার প্রথম নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন ১৯৪৯ সালে কামনা ছবিতে। এই ছবিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন ছবি রায়। তবে তাঁর প্রথম অভিনীত ছবি ছিল দৃষ্টিদান (১৯৪৮)। যেখানে তিনি নায়ক অসিত বরণের কিশোরকালের চরিত্রে অভিনয় করেন। বসু পরিবার (১৯৫২) ছবিতে তিনি প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এরপর সাড়ে চুয়াত্তর (১৯৫৩) মুক্তি পাবার পরে তিনি চলচ্চিত্র জগতে স্থায়ী আসন লাভ করেন। এই ছবির মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সফল উত্তম-সুচিত্রা জুটির সূত্রপাত হয়। ১৯৫৪ সালে জনপ্রিয়তার সব রেকর্ড ভেঙ্গে দেয় উত্তম-সুচিত্রার অগ্নিপরীক্ষা।
এরপর ১৯৫৭ সালে অজয় কর পরিচালিত ‘হারানো সুর’ ছবি মুক্তি পাওয়ার পরই গোটা দেশ ধন্য ধন্য করে ওঠে তাঁর অভিনয় ক্ষমতা দেখে। সেই বছর হারানো সুর পেয়েছিল রাষ্ট্রপতির সার্টিফিকেট অব মেরিট। ১৯৫৭ তে বাংলা ভাষার প্রথম সম্পূর্ণ রঙ্গিন ছবি ‘পথে হলো দেরী’তে অভিনয় করে করেন আরেক রেকর্ড। ১৯৫৩ থেকে ১৯৭৫ সার পর্যন্ত মোট ৩০টি ছবিতে সুচিত্রার সঙ্গে কাজ করেছেন উত্তম। তাঁর ও সুচিত্রা সেনের এই জুটি আজও স্মরণীয় হয়ে আছে দর্শক হৃদয়ে। বাংলা চলচ্চিত্রের অনেক দিন পার হয়ে গেলেও এই জুটির জনপ্রিয়তাকে এতটুকু স্পর্শ করতে পারেনি অন্য কোনও জুটি। তবে সুচিত্রা ছাড়াও সেই সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী সুপ্রিয়া দেবী, সাবিত্রী চ্যাটার্জী, মাধবী মুখার্জী, অপর্ণা সেন ও সুমিত্রা মুখার্জীর সঙ্গে জুটি বেঁধেও ব্যাপক সফলতা পান তিনি।
অন্যদিকে, রোমান্টিক নায়ক ছাড়াও অন্যান্য চরিত্রাভিনয়েও তিনি ছিলেন সমান দক্ষ। সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় দুটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। প্রথমটি নায়ক (১৯৬৬) এবং দ্বিতীয়টি চিড়িয়াখানা (১৯৬৭)। আবার বহু সফল বাংলা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি হিন্দি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। যার মধ্যে অন্যতম ছোটিসি মুলাকাত (১৯৬৭) দেশপ্রেমী (১৯৮২) ও মেরা করম মেরা ধরম, ‘অমানুষ’ প্রভৃতি অন্যতম। পরিচালক হিসেবেও তিনি সফলতা পেয়েছেন। ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী (১৯৮১), বনপলাশীর পদাবলী (১৯৭৩) ও শুধু একটি বছর (১৯৬৬) ছবির সাফল্য তাই প্রমাণ করে।
নিজের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে বাংলা-হিন্দী মিলিয়ে প্রায় ২০৯টি ছবিতে অভিনয় করেছেন উত্তম কুমার। এর মধ্যে বেশিরভাগই দর্শকনন্দিত ও ব্যবসা সফল। অসাধারণ অভিনয়ের জন্যই তাঁর ভক্ত ও দর্শককুল তাঁকে মহানায়ক উপাধি দেন। ১৯৬৮ সালে ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গী’ ও ‘চিড়িয়াখানা’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জাতীয় পুরস্কারও লাভ করেন তিনি। এছাড়াও পেয়েছেন দেশ-বিদেশের অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা। চলচ্চিত্র ছাড়াও মঞ্চ নাটকেও সমান তালে অভিনয় করেছেন তিনি।
এছাড়া সংগীতেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। ১৯৬৬ সালে মুক্তি পাওয়া ‘কাল তুমি আলেয়া’ চলচ্চিত্রের গানে সুরারোপ করেছেন। আবার ‘দৃষ্টিদান’ ছবিতে প্রথম গানও গেয়েছিলেন তিনি। ১৯৮০ সালের ২৪ শে জুলাই মাত্র ৫৩ বছর বয়সে জীবনের রুপোলী পর্দা ছেড়ে চলে যান মহানায়ক উত্তম কুমার। তবে আজও সকল অনুরাগীর স্মৃতিতে ‘হারানো সুর’ গান সেই ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’রূপী উত্তম। আজও সেই ‘নায়ক’-কে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে মনের মণিকোঠায় ‘সপ্তপদী’ জ্বালিয়ে রাখে বাঙালি তথা সমগ্র ভারতবাসী।