গত পরশু থেকে মধুর কথা খুব মনে পড়ছে। অনেকদিন দেখা হয় না। মাঝখানে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, খোঁজখবর নিয়েছিলাম কিন্তু হাসপাতালে গিয়ে আর দেখা করা হয়ে ওঠেনি। শুনেছি বাড়ির লোকের অমতেই মধু হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছে। মধু এরকমই, যা একবার মনস্থির করে তা করেই ছাড়বে। মধু মানে আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু লেখক-সাংবাদিক বিশ্বজিৎ রায়। টলস্টয় কাণ্ডের সুবাদে সারা দেশের মিডিয়ায় সম্প্রতি যার নাম বারবার ভেসে উঠেছে। আমরা এখন জেনে গিয়েছি ওয়র অ্যান্ড পিস বলে বর্ণিত গ্রন্থটি আসলে বিশ্বজিৎ রায় সম্পাদিত ওয়র অ্যান্ড পিস ইন জঙ্গল মহল – পিপল, স্টেট, অ্যান্ড মাওয়িস্ট নামে সম্পূর্ণ একটা আলাদা বই। উপন্যাস নয়, এটা আদতে একটা সংকলন গ্রন্থ।

কলেজে পড়ার সময় মধুর সঙ্গে আমি দীর্ঘদিন ছাত্র রাজনীতি করেছি। ওর সব বক্তব্য ও কাজের সঙ্গে আমি একমত নই, তা হতে হবে এমন কোন কথাও নেই। কিন্তু একথা মানি যেটা ও বিশ্বাস করে তার জন্য নিজের ক্ষতি স্বীকার করে ও লড়ে যাবে এবং জনবিরোধী কোন কাজ ওকে দিয়ে করানো যাবেনা। আমি যখন আনন্দবাজারে কাজ করছি তখন মধু সরকার বাড়ির টেলিগ্রাফ কাগজের সাংবাদিক। নিজের স্বাধীন মত ও বিশ্বাসের জন্য মালিকদের ধামাধরা রিপোর্টার নামধারী পোর্টারদের কাছে ওর নানাভাবে হেনস্থা হওয়ার কথাও জানি। তবু ওকে কব্জা করা যায়নি, যা মনে করেছে তাই বলেছে। আমরা জানি কীভাবে নানা সূত্র থেকে টাকাপয়সা জোগাড় করে মধুর মত মানুষদের রাষ্ট্রকে বহুত্বের পথে ফিরিয়ে আনার জন্য এইসব কাজগুলো করতে হয়। সবাই যখন চেনা ছকে বেঁচে থাকতে চাইছে তখন কোবাদ গান্ধী, বিনায়ক সেনদের মত মানুষরা পৃথিবীতে প্রতিবাদ বলেও যে একটা ব্যাপার আছে তা আমাদের মনে করিয়ে দেন। মধু সবসময় এই প্রতিবাদের রাস্তাতেই হেঁটেছে। তাদের পথ নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে কিন্তু প্রতিবাদটা মিথ্যা হয়ে যায়না।
আমার প্রশ্ন মধু মানে বিশ্বজিৎ রায়ের সম্পাদিত বইটি পুলিশ বাজেয়াপ্ত করলো কেন? সেটা কি নকশালপন্থী কোন নেতার বাড়িতে তার বইটি পাওয়ার জন্য? এ এক অদ্ভুত কাজীর বিচার! তাহলে তো কোন নকশালপন্থীর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ থেকে প্রেমচাঁদ যার বইই পাওয়া যাক না কেন তা রাষ্ট্রবিরোধী এবং পুলিশ সেটা বাজেয়াপ্ত করবে! বইটি নিষিদ্ধ কিনা তার খোঁজখবর নেওয়ার ফুরসৎও আইনশৃঙ্খলার রক্ষকদের নেই। আরও অদ্ভুত কথা হল জঙ্গল মহলের নানা সমস্যা নিয়ে লেখা এই সংকলন গ্রন্থটির সমালোচনা করেছে নকশালপন্থীরাই। কারণ, সেখানে কয়েকটি লেখায় গণতান্ত্রিক উপায়ে সমস্যার সমাধান করার কথা লেখা হয়েছে! এ এক অদ্ভুত সমাপতন! একটা জায়গায় এসে রাষ্ট্র ও নকশালপন্থীরা এক জায়গায় মিলে যাচ্ছে – কারণ কেউই সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না।
কী জানি আমার অল্প বুদ্ধি তাই সব গুলিয়ে যায়। তবে একটা কথা পরিষ্কার বুঝতে পারছি কোন একটা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুললে বা সমালোচনা করলে কোন বই বা মানুষের গায়ে একটা ছাপ লাগিয়ে দেওয়ার রাজনীতি সমস্যাটাকে আরও জটিল করবে। রাষ্ট্র ও শাসকদল যেন এখন কে কী করবে তা ঠিক করে দিচ্ছে। মোদি ওয়র অ্যান্ড পিস পড়লে সেটা ধ্রুপদী সাহিত্য। আর সেই নামের কাছাকাছি কিছু বিরোধী রাজনীতিবিদদের বাড়িতে পাওয়া গেলে তা নিষিদ্ধ বই! গোটা বিশ্বের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে এমন অপকর্ম যারা করেছেন তাদের কে মানুষ প্রত্যাখান করেছেন। তবুও বিরোধিতার ভয় পাওয়া শাসকরা একই ভুল বারবার করে মুর্খামির দৃষ্টান্ত তৈরি করেন।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কথাটা ইদানিং স্বাধীন ভারতে যেন এক ঠাট্টা হয়ে উঠেছে। কিন্তু মধুর মত মানুষেরা কথা বলবেই। নীরব থেকে স্থিতাবস্থার দাসত্ব করায় তারা বিশ্বাসী নন। তাই এদের ওপর, এদের যে কোন কাজের ওপর বারবার নেমে আসবে শাসকদের আক্রমণ। মানুষকে একসঙ্গে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে পথে নামতে হবে। এটা মোটেই সরকার কেমন একটা বোকামি করে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়েছে মার্কা একটা হাস্যকর ব্যাপার নয়। আদতে এটা ভিন্ন মতের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা।
নিষিদ্ধ না হলেও বিশ্বজিৎ রায়ের ওয়র অ্যান্ড পিস ইন জঙ্গল মহল বইটা বাজেয়াপ্ত করার ঘটনা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করার ঘটনারই একটা উদাহরণ। যাইহোক এই বিতর্কের সুবাদে মধুর এই বইটার কথা মানুষজন জানলো। তাদের মধ্যে খুব সামান্য কয়েকজনও জঙ্গল মহলের যুদ্ধ ও শান্তির প্রকৃত ছবিটা ঠিক কী তা নিয়ে জানতে উৎসাহী হলে, বইটি সংগ্রহ করলে বা পড়লে প্রকাশনাটা তার প্রার্থিত তীরে পৌছতে পারবে।
সাবাস বিশ্বজিৎ
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত