1994–র নভেম্বর–ডিসেম্বর। আমার স্ত্রী নিবেদিতা তখন সাত মাসের সন্তান সম্ভবা। ওর অনেক দিনের আবদার ছিল, মাদারের সামনে একবার ওকে নিয়ে যেতে হবে। আবদার এই কারণে যে মাদার যখনই অসুস্থ হয়ে নার্সিংহোমে থেকেছেন, আমি সেখানে পড়ে থাকতাম দিন–রাত এক করে। আর এত ছবি তুলতাম বলেই হয়তো মাদার তখন আমাকে খুব স্নেহও করতেন। তাই নিবেদিতার এহেন আবদারের যথেষ্ট কারণ ছিল।
![সন্ত টেরিজা ----অশোক মজুমদার 2 14095917 300053563695744 2536066861302561607 n](https://ekhonkhobor.com/wp-content/uploads/2019/08/14095917_300053563695744_2536066861302561607_n.jpg)
কিন্তু, নিবেদিতাকে যেটা সেদিন বলতে পারিনি তা হল, ওভাবে মাদারের সঙ্গে আমি ওর আলাপ করিয়ে দিতে পারব না। সেটা আমার পেশা আর মানসিকতার বিরোধী (যদিও আমি জানি সাংবাদিকতায় এমন অসাংবাদিকসুলভ কাজ আমার অনেক পরিচিতেরাই করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন)। যাই হোক, নিবেদিতা হয়তো বুঝেছিল, অশোককে দিয়ে একাজ হওয়ার নয়।
যে সময়টার কথা বলছি, ঠিক তখন বেশ কয়েকদিন উডল্যান্ডসে কাটিয়ে মাদার হাউসে ফিরেছেন মাদার টেরিজা। ২৫ ডিসেম্বরের বিশেষ প্রার্থনায় সেদিন মাদারের থাকার কথা। খুব সকাল সকাল নিবেদিতাকে নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম। ওকে বসিয়ে রাখলাম অন্য অনেক দেশি–বিদেশি সাক্ষাৎপ্রার্থীর সঙ্গে। আমি ততক্ষণে নিজের ছবি তোলার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। মাদার বেরোলেন। এক ঝলক সবাইকে দেখে নমস্কার জানালেন। আমাকেও দেখতে পেয়ে ‘হ্যালো, হাউ আর ইউ…’ বলে উঠলেন। তারপর প্রার্থনা কক্ষের দিকে এগোতে থাকলেন। আমি ছবি তুলতে তুলতে হঠাৎ দেখি, মাদার আবার পিছন ফিরে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের বসার জায়গায় ফিরে যাচ্ছেন।
এর পর আমাকে প্রায় হতবাক করে দিয়ে তিনি ঠিক নিবেদিতার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ও উঠে দাঁড়াতেই ওর পেটে হাত বুলিয়ে জানতে চাইলেন, ক’মাস চলছে। উত্তর শুনে মাথায় হাত রেখে পরম স্নেহে নিজের আর গর্ভস্থ সন্তানের যত্ন নেওয়ার পরামর্শ দিলেন। তার পরে আবার ধীরে ধীরে ফিরলেন প্রার্থনা কক্ষের দিকে। আর আমি? এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল চোখের সামনে, অথচ ক্যামেরা হাতে নিয়েও নিবেদিতার পেটে–মাথায় মাদারের হাত বুলনোর ছবি তুলতেই ভুলে গেলাম।
এর তো আর রি–প্লে হবে না! তবে আলাপের শেষে মাদারের সঙ্গে হাসিমুখে দাঁড়ানো নিবেদিতার এই কাঁপা–কাঁপা ছবিটি সযত্নে রেখে দিয়েছিলাম, যা আজ আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করলাম। আর হ্যাঁ, নিজের অভিজ্ঞতায় আজ বুঝেছি, কেন মাদার সন্ত।
রোমাঞ্চ হচ্ছে এটা ভেবেই যে, ৪ সেপ্টেম্বর ভ্যাটিকানে তাঁকে সন্ত ঘোষণার শুভক্ষণে আমি হাজির থাকব এই বাংলার সবার দিদি এবং ‘বাংলা’ নামকরণের মা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ও, বলে রাখি, গর্ভস্থ অবস্থাতেই মাদারের স্নেহ–স্পর্শ পাওয়া আমার বড় ছেলে ঋকের জন্ম হয় 1995–র ৫ জানুয়ারি।
পুনশ্চ: এই মাদারের জন্য ছবি তুলে কালো গ্রিল দেওয়া সাদা বাড়ির কাগজে জমা দিতে গিয়েও আমাকে কম লাঞ্ছনা সইতে হয়নি। বার্তা সম্পাদক প্রয়াত বিজয় চক্রবর্তী, এবং তাঁরও পরে আরও দুই বার্তা সম্পাদক আমাকে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, সম্পাদকের (অধুনা অপসারিত) নির্দেশে মাদার টেরিজা, মহাশ্বেতা দেবী এবং মেধা পাটকরদের ছবি এখানে অত বেশি ছাপা হয় না। আমি যতই ওঁদের ছবি তুলি না কেন, বার্তা সম্পাদকের টেবিলে জমা না দিয়ে সে সব যেন নিজের কাছেই রেখে দিই। জানি, ৫ সেপ্টেম্বরের কাগজে কালো গ্রিল–সাদা বাড়ির কাগজে সে নীতির জলাঞ্জলি হয়েছেই দেখতে পাব। যেমন হয়েছে সেই সম্পাদকের।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত