একঘেয়ে জীবন থেকে মুক্তি পেতে যারা ছুটে যেতে চান প্রকৃতির কোলে তাঁদের জন্যে অপেক্ষা করে থাকে আসাম। জীবনের একঘেয়েমি ক্লান্তিকর মুহূর্ত গুলোকে আড়াল করতে অন্যতম সেরা জায়গা মেঘ, পাহাড়-পর্বত, ঝর্ণা আর জলপ্রপাতের রাজ্য ভারতের স্কটল্যান্ড খ্যাত মেঘালয়ের শিলং ও পৃথিবীর সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের এলাকা চেরাপুঞ্জি।পাহাড়-মেঘবৃষ্টি-মন্দির-সবুজ-কুয়াশা সবকিছু হাতের মুঠোয় পেতে চান যারা তাঁদের জন্যে আদর্শ আসাম। যে আসামের কোণায় কোণায় এখন ঘিরে আছে এনআরসির আতঙ্ক।
আসামের অন্যতম আকর্ষণ কামাক্ষ্যা মন্দির। কথিত আছে সতীর দেহ কাঁধে যখন প্রলয়নৃত্য করেছিলেন শিব তখন সতীর যোনিচ্ছদ পড়েছিল এখানে। প্রত্যেক বছর অম্বুবাচীর সময় অগণিত ভক্তদের ভিড় হয় এখানে। তবে শুধু অম্বুবাচী নয়, সারা বছর পুণ্যারথীদের আগমন লেগেই থাকে এই জাগ্রত মন্দিরে। তাই ঘোরার সঙ্গে যারা পুণ্য লাভ করতে চান তাঁদের প্রথম পছন্দ এই মন্দির। তবে গৌহাটি শহরে শুধু কামাক্ষ্যা নয় রয়েছে আরও অনেক মন্দির, যেমন নবগ্রহ মন্দির, উমানন্দ মন্দির, জনার্দান মন্দির, আসাম ষ্টেট মিউজিয়াম, আসাম ষ্টেট জু, শ্রীমান্ত সংকরাদেভ কলাশেট্র (নাচ, গান ও নাট্যকেন্দ্র)।আসামের বাসিন্দারা খুব অতিথি বৎসল হয় তবে এনআরসির জেরে নাগরিকত্ব হারানোর ভয়ের ছাপ পড়েছে সেই সুনামে।
আসামের আরো এক আকর্ষণ কাজিরাঙা ন্যাশনাল পার্ক, যা আসামের গোলাঘাট এবং নাগাওন জেলায় অবস্থিত। এই বন একশৃঙ্গী গণ্ডারের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। এছাড়া এ বন বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবেও স্বীকৃত। গুয়াহাটি থেকে ২১৭ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। আসাম সরকার ও স্থানীয় বিভিন্ন বন্যপ্রাণী সংস্থা পরিচালিত ২০১৫ সালের মার্চ মাসের গণনা অনুযায়ী কাজিরাঙা বনে গণ্ডারের সংখ্যা ২ হাজার ৪০১টি। এছাড়া এ বনে প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্ত মিলে বাঘের সংখ্যা ২৫১টি। বিশ্বের অন্য সুরক্ষিত এলাকার মধ্যে এ বনেই বাঘের সর্বোচ্চ ঘনত্ব রয়েছে। এশীয় হাতীর অভয়ারণ্যের জন্য এ বন বিশেষভাবে পরিচিত। এছাড়া বনে প্রায় ৫০০ প্রজাতির পাখি দেখা যায়। এরমধ্যে বিশ্বের অনেক বিপন্ন বা মহাবিপন্ন পাখিও আছে।
আসাম মানেই শিলং, চেরাপুঞ্জীর বিখ্যাত মেঘ এবং বৃষ্টি ।শিলংয়ের অন্যতম আকর্ষণ উমিয়াম লেক। স্কটল্যান্ডের সমুদ্র শাখা বা হ্রদের সাথে তুলনাময়, উমিয়াম লেক শিলং থেকে বেশ কিছু দূরত্বে অবস্থিত। কেউ যদি শুধুমাত্র পর্যটকদের থেকে নির্বিঘ্নে একটি ছবির মতো নিখুঁত প্রশান্ত হ্রদের ধারে বসে থাকতে ভালবাসেন, উমিয়াম লেক সেইরকম একটি স্থান হতে পারে।
আপনি ঝর্ণা প্রেমী হলে যেতে ভুলবেন না এলিফ্যান্ট জলপ্রপাত। এলিফ্যান্ট জলপ্রপাত নামকরণ করা হয়েছে কারণ জলপ্রপাতটির নিকটে একটি হস্তী-আকৃতির পাথর রয়েছে। যদিও এই প্রস্তরটি দীর্ঘদিন আগে একটি ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, কিন্তু নামটি এখনও অটল রয়েছে। জলপ্রপাতটি তিনটি ধাপে রয়েছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে ঐশ্বর্যশালী হল তৃতীয় নির্ঝরটি। নীচেরটি দেখতে হলে একজন দর্শককে বেশ কিছু শ্রেণীবদ্ধ ধাপ নীচে নামা প্রয়োজন। জলোচ্ছাসের শব্দ ও শীতল বায়ু এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা তৈরি করে।শিলং পরিভ্রমণে গেলে, এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ কেন্দ্র শিলং টপ, যেখানে পাড়ি দেওয়াটা সর্বদাই একটি ভালো ধারণা। এখানকার টিলা ও উপত্যকাগুলির দৃশ্য খুবই উত্তেজনাপূর্ণ এবং এখানকার বাতাস লক্ষণীয়ভাবে খুবই সতেজ।
শিলং-এর নিকটবর্তী অন্যান্য বেশ কিছু দর্শনীয় চমৎকার স্থানগুলির মধ্যে রয়েছে মৌসিনরাম, চেরাপুঞ্জি ও দ্বাকি। চেরাপুঞ্জি, পৃথিবীর সবোর্চ্চ বর্ষণমূখর বা সিক্ত স্থান ছিল, কিন্তু বর্তমানে এই শিরোণাম মৌসিনরাম দ্বারা গৃহীত হয়েছে। দ্বাকি, মেঘালয় ও বাংলাদেশ সীমান্তের উপর আচ্ছাদিত রয়েছে। এটি পাথুরে ও খুবই উষ্ণতম স্থান, কিন্তু একটি বিদেশী মাটির উপর পা স্পর্শ করার প্রলোভনে, দ্বাকি অনেক পরিদর্শককে প্রলুব্ধ করে। প্রিয় পাহাড়ের গা ঘেঁষা রাস্তায় ছুটছে গাড়ি আচমকাই আকাশের মেঘ ছুঁয়ে যাচ্ছে আপনাকে, আর তারপরেই চেরাপুঞ্জীর বিখ্যাত বৃষ্টি ভিজিয়ে যাচ্ছে আপনাকে,যাবতীয় মনখারাপ মুছতে বাধ্য।
চেরাপুঞ্জীতে ঘুরতে যাওয়ার পক্ষে ডিসেম্বর মাসে উপযুক্ত। এই সময় বৃষ্টি অপেক্ষাকৃত কম থাকে। চারপাশে পাহাড় দিয়ে ঘেরা চেরাপুঞ্জি অপরূপ সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে বসে আছে আপনার অপেক্ষায়। এখানে আসলে যে স্থানগুলি আপনি দেখতে পাবেন সেগুলি হল-নঃকলিকাই জলপ্রপাত, মৌসুমি কেভ, লিভিং রুট ব্রিজ, ডেন্টিন জলপ্রপাত, ইকোপার্ক, ম্যাডাক ড্যাম্প ভ্যালি, চেরাপুঞ্জি শহর, থাঙ্কা রাং পার্ক, প্রেস গোমুখ কেভ ইত্যাদি।
আসাম-গৌহাটি-শিলংয়ের মত সুন্দর স্থান খুব কমই আছে। এখানকার বেশিরভাগ মানুষই পর্যটনশিল্পের ওপর ভিত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।তবে পাকদন্ডী পাহাড়ের পথের মতই মানুষকে ঘিরে ধরেছে এনআরসির আতঙ্ক। আর সেই ছাপ ধরা পড়ছে পর্যটকদের ভ্রমণেও। তবুও সেই সব অতিক্রম করে অতিথিদের সাধ্যমত সেবা করেন আসামের বাসিন্দারা।
কিভাবে যাবেন- হাওড়া থেকে কামরূপ এক্সপ্রেস, সরাইঘাট এক্সপ্রেস। গৌহাটী পৌঁছে স্টেশনের বাইরেই গাড়ি থাকে, যা ভাড়া করে পৌঁছে যেতে পারবেন মেঘবালিকাদের আপন দেশে।
বিমানে গেলে কলকাতা বিমানবন্দর থেকে গৌহাটির বিমান আপনার জন্যে অপেক্ষারত।
কি কিনবেন – আসামের অন্যতম বিখ্যাত জিনিস মেখলা এবং মাদুর।