১৪ই আগস্ট বিজেপির সর্বভারতীয় সদর দফতরে তখন শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে পৌঁছে গিয়েছেন তিনি। শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক সেরে বিজেপিতে যোগ দেবেন তাঁরা, সাংবাদিক সম্মেলন করে তাঁদের দলে স্বাগত জানানো হবে— এই আনুষ্ঠানিকতাটুকুই শুধু বাকি। ঠিক সেই সময়েই উঠেছিল ‘ঝড়’। যেই মুহূর্তে জানতে পারেন রায়দীঘির তৃণমূল বিধায়ক দেবশ্রী রায়ও বিজেপিতে যোগ দেবেন বলে হাজির হয়েছেন, সেইসময়ই ক্ষোভে ফেটে পড়েন অধ্যাপিকা বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। শোভনের পাশাপাশি তিনিও জানিয়ে দেন, দেবশ্রী যোগ দিলে বিজেপিতে যোগ দেবেন না তাঁরা। এর জেরেই সেদিন আর বিজেপিতে যোগ দেওয়া হয়নি দেবশ্রীর।
ফলে তাঁর সক্রিয় রাজনীতিতে পদার্পণের দিন থেকেই শিরোনামে জায়গা করে নিয়েছেন বৈশাখী। সময়ের সঙ্গে বেড়েছে সেই বিতর্ক। সঙ্গে অস্বস্তি বেড়েছে গেরুয়া শিবিরেরও। যার ফলে এবার তাঁকে নিয়ে বিক্ষোভ শুরু খোদ দলের অন্দরেই। কারণ অধ্যাপিকাকে সামলাতে নাস্তানাবুদ বিজেপি নেতারাও।
প্রসঙ্গত, গত ১৪ আগস্ট দিল্লীতে তাঁর যোগদানের পর থেকেই ঝড় চলছে বিজেপির অন্দরে। যোগদানের দিনই বিজেপির সদর দফতরে দেবশ্রী রায়কে নিয়ে যেমন একপ্রস্থ ‘নাটক’ করেন তিনি, তেমনি বৈশাখীকে নিয়ে কলকাতায় রাজ্য বিজেপির সদর দফতরেও একপ্রস্থ নাটক হয় গত ২০ আগস্ট।
ওদিন, শোভন চট্টোপাধ্যায়কে সংবর্ধনা দেওয়া হবে রাজ্য বিজেপির সদর দফতরে, সে কথা সোমবার রাতেই এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়েছিল। সাংবাদিকদের কাছে পাঠানো ওই আমন্ত্রণপত্রে শোভনের নাম থাকলেও ছিল না বৈশাখীর নাম। এতেই ক্ষুব্ধ হয়ে দিল্লীর নেতৃত্বকে ফোন করে তিনি জানান, রাজ্য বিজেপি নেতারা তাঁকে মর্যাদা দিচ্ছেন না। পাশাপাশি এ-ও জানিয়ে দেন যে, ‘অপমান’ সহ্য করে রাজনীতি করবেন না। এরপরই দিল্লীর হস্তক্ষেপে তড়িঘড়ি আমন্ত্রণপত্রে বৈশাখীর নাম ঢোকানো হয়। রাজ্য নেতৃত্বের তরফ থেকে বৈশাখীকে ফোন করেও দুঃখপ্রকাশ করা হয় এবং জানানো হয় যে, শোভনের সঙ্গে তাঁকেও সংবর্ধনা দেওয়া হবে। শেষমেশ দুপুরে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিজেপির সদর দফতরে হাজির হন তিনি।
এখানেই শেষ নয়, সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শেষে ছিল বিজেপি বিধায়কদের বৈঠক। বিধায়ক হিসাবে তাতে যোগ দেন শোভন চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু বৈশাখী সেই বৈঠকে যোগ দিতে গেলে তাঁকে রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বাইরে অপেক্ষা করতে বলেন। জানান, বৈঠকটি যেহেতু বিধায়কদের তাই বিধায়ক নন এমন কেউ সেখানে হাজির থাকতে পারবেন না। দিলীপের এ হেন নির্দেশে ক্ষুব্ধ হয়ে বিজেপি কার্যালয় থেকে বেরিয়ে নিজের গাড়িতে গিয়ে বসেন তিনি। প্রায় ৫০ মিনিট সেখানেই বসে ছিলেন তিনি। অপেক্ষা করছিলেন শোভনের। এমনকী সেদিনের সাংবাদিক সম্মেলনে দিলীপ রসিকতা করে শোভন এবং তাঁকে ডাল-ভাতের সঙ্গে তুলনা করলেও বিরক্ত হন বৈশাখী।
বৈশাখীর দাবি, বিজেপিতে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সমান মর্যাদা দিতে হবে তাঁকে। এখানেই বিপাকে পড়েছেন রাজ্যের গেরুয়া শিবিরের নেতারা। প্রাক্তন মেয়র তথা চার দশকের জনপ্রতিনিধি শোভনকে গুরুদায়িত্ব দিতে আপত্তি নেই তাঁদের। কিন্তু রাজনীতিতে আনকোরা বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে সেই প্রাধান্য দেওয়া সম্ভব নয়। বিজেপি নেতৃত্বের একাংশের মতে, দলে বৈশাখীর মতো প্রচুর অধ্যাপক রয়েছেন। রয়েছেন চিকিৎসক, আইনজীবীরাও। হঠাৎ বৈশাখীকে কোনও বড় দায়িত্ব দিলে তাঁরা নিজেদের বঞ্চিত মনে করতে পারেন। এ কথা বোঝাতেই বুধবার রাতে শোভনের বাড়িতে যান বিজেপি নেতা অরবিন্দ মেনন ও জয়প্রকাশ মজুমদার। গভীর রাত পর্যন্ত চলে সেই বৈঠক।
সূত্রের খবর, বৈঠকে বৈশাখীকে যে দলে শোভনের সমান প্রাধান্য দেওয়া সম্ভব নয় তা স্পষ্ট করা হয়েছে। সঙ্গে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁর অযৌক্তিক বায়না কিছুতেই মানবে না দল। এমনকী, দেবশ্রী রায়কে দলে স্বাগত জানাতে যে রাজ্য বিজেপি প্রস্তুত, এবং এ বিষয়ে শোভন যেন আপত্তি না করেন, এই বার্তাও দিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে খবর। আর তারপরই বৃহস্পতিবার সাংবাদিক বৈঠকে দেবশ্রী রায়ের বিজেপিতে যোগদান নিয়ে ইঙ্গিতবহ মন্তব্য করেন দিলীপ। বলেন, দেবশ্রী রায়ের যোগদান নিয়ে দলে কোনও আপত্তি নেই। এখন বৈশাখীর ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা যাচ্ছে, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, রাজনীতি থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরিয়ে নেবেন নিজেকে। আনুষ্ঠানিক ভাবে বিজেপি ত্যাগ না করলেও তিনি যে ক্রমশই অন্তরালে চলে যাবেন, সে কথা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে জানিয়েও দিয়েছেন বৈশাখী।