রাজনীতিবিদ বললেই আগে মানুষের মনে একটা ছবি ভেসে উঠতো। নম্র ও সজ্জন একটা মানুষ; পড়নে সাধারণ পোশাক ; লোকের বিপদে সে কোন পক্ষের মানুষ তা না দেখে ঝাঁপিয়ে পড়েন; প্রবল প্রতিপক্ষও যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোন অভিযোগ তুলতে পারেন না এমন একজন ব্যক্তিত্ব। কিছুদিন আগে খবরের কাগজে সিপিএম নেতা ও চারবারের বিধায়ক বাদল জমাদারের অসুস্থতার খবর পড়তে পড়তে আমাদের ছাত্রজীবনে দেখা সেই সব রাজনীতিবিদদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। ডান – বাম সব দলেই এরা ছিলেন। আমার বয়সী কিংবা আমার থেকে অন্তত যারা বছর দশকের ছোট তারা সবাই এদের দেখেছেন। এদেরকে দেখে রাজনীতি না করা সুবিধাবাদী মানুষরা রাজনীতিবিদদের শ্রদ্ধা করতে শিখতো। এখন যা ব্যতিক্রম তখন তাই ছিল সাধারণ। সততা ও আদর্শ এখন এতটাই বিরল যে বাদলবাবুদের মত মানুষদের তা মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে।
একদা ভাঙড় থেকে জেতা সিপিএম বিধায়ক বাদল জমাদার আর্থিক অনটনের জন্য চিকিৎসা করাতে পারছেন না। খবরটা দুঃখজনক ঠিকই কিন্তু একইসঙ্গে তা আমাদের আজকের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের দুরাবস্থা ও অধঃপতনের কথা মনে করিয়ে দেয়। বিধায়ক তো দূরের কথা এখন প্রায় সব দলেই বিরাজমান পাড়ার নেতাদের বিত্তবৈভব ও হাঁকডাক দেখলে চমকে উঠতে হয়। বাদলবাবুর মত চারবার বিধায়ক অথচ বাড়ি, গাড়িহীন, বাসে করে বিধানসভায় কিংবা পায়ে হেঁটে দোকান বাজার, ব্যাঙ্ক, পোস্টঅফিসে যাওয়া বিধায়কের কথা এখন মানুষ ভাবতেও পারেন না। বিধায়ককে লাইন দিয়ে কোন জিনিস কিনতে তারা কস্মিনকালেও দেখেন নি। বাদলবাবু কিংবা তৃণমূল নেত্রী ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত নিরাভরণ জীবনযাপন কোটিতে গুটিকের মত শুধুই দৃষ্টান্ত হিসেবে জেগে থাকে। বাদলবাবুদের মত মানুষদের দেখে মানুষের মনে বেঁচে থাকে শ্রদ্ধা, আদর্শ, বিশ্বাস কথাগুলো।
কয়েকমাস আগে বাড়িতেই পড়ে গিয়ে একটা পা ভেঙেছে তাঁর। তারপর থেকে তিনি বিছানায় শয্যাশায়ী। অর্থের অভাবে হাসপাতালে নয়, বাড়ির দাওয়ায় পড়ে আছেন তিনি। বাড়ির লোক নিজেদের সামান্য কিছু জমি বিক্রি করে বাইপাসের ধারে একটা বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেছিলেন তাঁকে। কিন্তু চিকিৎসার খরচ সামলাতে না পেরে আবার বাড়িতেই ফিরিয়ে এনেছেন। জেলার কয়েকজন নেতা বাড়িতে এসে দু একবার দেখা করে গেলেও সিপিএমের ধোপদুরস্ত পোশাক ও শুভ্র ধুতি-পাঞ্জাবীশোভিত চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলা নেতাদের কেউই তাঁর বাড়িতে আসেননি। আমার একটা প্রশ্ন আছে, ক্ষমতায় না থাকলেও সিপিএম এখনও মোটেই কোন গরীব দল নয়, তবুও বাদলবাবুর চিকিৎসার ব্যাপারে দলীয় উদ্যোগ এত কম কেন?
খবরের কাগজের প্রতিবেদনে দেখলাম সিপিএম বলছে ‘ওঁর চিকিৎসার খানিকটা ব্যয়ভার বহন করবে দল’ কিংবা ‘নতুন করে কী করা যায় তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা হচ্ছে’। এই ‘খানিকটা’ আর ‘ভাবনাচিন্তা’ কথাটা নিয়েই আমার আপত্তি আছে। খানিকটা কেন? তাঁর পুরো চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে দলের অসুবিধা কোথায়? তিনমাস শয্যাশায়ী একজন সৎ, নিষ্ঠাবান, জনপ্রিয় কমরেডের চিকিৎসার ব্যাপারে ভাবনাচিন্তার কী আছে তা আমার এই মোটা মাথায় ঢুকলো না। আসল কথা হল, বাদলবাবুদের মত মানুষেরা সবজান্তা শহুরে কমরেডদের বারবার নানা অসুবিধার মধ্যে ফেলে দেন তাই তারা এদের পছন্দ করেন না।
১৯৯১ থেকে ২০০৬ টানা তিনবার বিধায়ক ছিলেন বাদল জমাদার। ২০১১তে দলের রথী মহারথীরা প্রবল তৃণমূল ঝড়ে উড়ে গেলেও সেবারও ভাঙড়ের দাপুটে তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলামকে হারিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এমন সৎ ও সংগ্রামী মানুষ কী করে নিজের দলেই এত অবহেলিত থাকেন তার কারণ বোঝা কঠিন। একটা কারণ অবশ্য বোঝা যায় আজকের রাজনীতি বাদল জমাদারদের মত মানুষদের বাদ দিয়ে চলতে চায়। খবরের কাগজের পাতা খুললেই কিংবা টিভিতে চোখ রাখলেই দেখি কেন্দ্রীয় নেতাদের পাহাড়প্রমাণ কেলেঙ্কারি ও দুর্নীতির কাহিনী। আজ একে ধরা হচ্ছে তো কাল ওকে ধরা হচ্ছে। একজন দুর্নীতির অভিযোগে ফেরার তো আরেকজন আত্মসমর্পণ করছেন। কাউকে ধরা হলেই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ও অপরাধগুলি এড়িয়ে গিয়ে বলা হচ্ছে – উনি দীর্ঘদিনের নেতা, বহুদিনের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, ওর শরীর ভালো নয়, শতাব্দী প্রাচীন দলের ভাবমূর্তি নষ্টের ষড়যন্ত্র ইত্যাদি ইত্যাদি। যেন নেতা, মন্ত্রী, অসুস্থরা দেশের সব আইনকানুনের বাইরে। তাদের যেন সাতখুন মাফ! অভিযোগ তুললেই বলা হবে চক্রান্ত করা হচ্ছে! এই অসৎ রাজনীতিতে বাদলবাবুদের জায়গা কোথায়?
স্বাভাবিক কারণেই রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের প্রতি মানুষের ভক্তি একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। করেকম্মে খাওয়া রাজনীতিবিদদের দঙ্গলে বাদল জমাদাররা জেগে থাকেন একেকটা দ্বীপের মত। সততা ও স্বচ্ছতার এই দৃষ্টান্তগুলি নতুন প্রজন্মকে রাজনীতির প্রতি, মানুষের লড়াইয়ের পাশে দাঁড়ানোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তুলবে। দুর্নীতির সাগর এড়িয়ে এই দ্বীপে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই।
বাদল জমাদারের কথা লিখতে লিখতে বহু পুরনো একটা শ্লোগান মনে পড়ে গেল। ছাত্ররাজনীতি করার সময় কথায় কথায় খুব ‘লাল সেলাম’ বলতাম। বাদলবাবুকে লাল সেলাম দিতে খুব ইচ্ছে করছে।
বাদল জমাদার লাল সেলাম।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত