বাড়ির ঠিকানা ১৭৪-ই রাসবিহারী অ্যাভিনিউ। ২০০৮ সালে পেশায় কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার অর্ণব মিত্র কিছু না জেনেই, নির্দিষ্ট কোনও উদ্দেশ্য ছাড়াই এই বাড়িটি কিনে ফেলেন। এরপর হঠাৎই একদিন বাড়ির ইলেকট্রিক বিল এলে তাতে চোখে পড়ে দেবব্রত বিশ্বাসের নাম। যে নামে মুগ্ধ হয়েছে একসময়ের আপামর বাঙালি। খোঁজ নিয়ে অর্ণববাবু জানতে পারেন এই বাড়িতেই থাকতেন দেবব্রত বিশ্বাস। এখানেই তাঁর উদাত্ত গলার গান ও সুর মিলে মিশে একাকার হয়ে যেত।

জানামাত্রই তাঁর মাথায় আসে এই বাড়িতেই খোদ শিল্পীকে নিয়ে কিছু একটা করার কথা। আর তারপরই যাত্রা শুরু মাড ক্যাফের। প্রতি বছর দেবব্রত বিশ্বাসের জন্মদিনে এই ক্যাফেতেই একটি দারুণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন অর্ণববাবু। যা এখন একপ্রকার রীতিতে পরিণত হয়েছে। এ বছরও তার অন্যথা হয়নি।

গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা- এমন এক আবহেই শুরু হয়েছিল দেবব্রত বিশ্বাসের এবারের জন্মদিনের অনুষ্ঠান। প্রতিদিনের মত বৃহস্পতিবারও ক্যাফে জুড়ে বাজছিল দেবব্রত বিশ্বাসের গান। দোতলার ঘরে আয়োজন করা হয়েছিল এক ছোট্ট অথচ গভীরতার হাত ছুঁয়ে থাকা অনুষ্ঠানের। নাম দেওয়া হয়েছিল, ‘এসো শ্যামল সুন্দর – জর্জ-এর আহ্বান বৃষ্টির সাড়া’। অনুষ্ঠানের শুরুতেই ‘জর্জদা’র’ স্মৃতিচারণা করেন সুরকার দেবজ্যোতি মিশ্র।

দ্বিতীয় পর্বে দশটি বর্ষার গানে শ্রোতাদের মনে প্লাবণ আনলেন মনোজ মুরলী নায়ার। আর প্রতিটি গানের আগে সেই গান রচনার প্রেক্ষাপটের বর্ণনা দিয়ে যোগ্য সঙ্গত করেন সাংবাদিক-লেখক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর ভাষ্যে উঠে আসে একদিকে যেমন উঠে আসে রবীন্দ্রনাথের জীবনের অন্ধকার সময়ের কথা। তেমনি ফুটে ওঠে কীভাবে একাকিত্ব মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে তাঁর রচিত একের পর এক গানে।

জীবনের এক প্রান্তে এসে রবি ঠাকুর নিজের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, বিধাতা ছেলেবেলা থেকে আমাকে একাকিত্বের পথিক। সে কথাও মনে করিয়ে দেন রঞ্জনবাবু। তাঁর ধারাভাষ্য শুনে দর্শকাসনে বসে থাকা প্রতিটি মানুষের চোখের সামনে ভেসে উঠেছে, পদ্মার দিগন্ত বিস্তৃত প্রবাহমানতায়, খোলা আসমানের তলায় ভাসতে ভাসতে কীভাবে একের পর এক বর্ষার গান লিখে চলেছেন তিনি।

রঞ্জনবাবুর ভাষ্য থেকেই জানা যায়, ইতালি থেকে পেরু যাওয়ার পথেই ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কাছ থেকে শান্তিনিকেতনের জন্য অর্থ সাহায্য চান রবীন্দ্রনাথ। বিনিময়ে তাঁকে লিখে দেন একটি গান। এ হেন এক-একটি ভাষ্যের পর মনোজ মুরলীর গাওয়া রবীন্দ্র সঙ্গীতগুলি যেন ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল উপস্থিত সকল শ্রোতাকে। যে গানগুলি এক সময় শোনা যেত দেবব্রত বিশ্বাসের কন্ঠে।
কখনও ‘এমনও দিনে তারে বলা যায়’ বা ‘আমার নিশীথ রাতের বাদল ধারা’, কখনও আবার ‘এসো নীপবনে’ বা ‘ তিমির অবগুন্ঠনে’ – অকালশ্রাবণ নেমে এসেছিল গোটা মাড ক্যাফে জুড়ে। মনোজ মুরলীর সঙ্গীত পরিবেশনা আর রঞ্জনবাবুর ধারাভাষ্যের বর্ষণে বাঁধ মানেনি আকাশও। বৃষ্টিমুখর হয়ে উঠেছিল বৃহস্পতিবারের সন্ধ্যা। উপস্থিত সকলে ভাবছিলেন, ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে’ বুঝি!

অনুষ্ঠানের একেবারে শেষ লগ্নে মনোজ মুরলী ধরলেন ‘শেষ গানেরই রেশ নিয়ে যাও চলে’ গানটি। আর ঠিক তাঁর আগেই রঞ্জনবাবু জানিয়ে দিয়েছেন, জীবনের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছেছেন রবীন্দ্রনাথ। কানে শুনতে পারছেন না ঠিক করে। প্রতি মুহূর্তে ধারেকাছে টের পাচ্ছেন মৃত্যুর উপস্থিতি। এমন সময়ই একটি গান লিখে শৈলজানন্দকে ডেকে সুর করতে বলেন তিনি। যে গানের ছত্রে ছত্রে মৃত্যুচেতনা।
‘সময় পাবেনা আর, নামিছে অন্ধকার/ গোধূলিতে আলো-আঁধারে পথিক যে পথ ভোলে।’ বাইরে তখন ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। সেই মুষলধারার মধ্যেই মনোজ গাইছেন, ‘পশ্চিমগগনে ওই দেখা যায় শেষ রবিরেখা/ তমাল-অরণ্যে ওই শুনি শেষ কেকা।’ শুধু কি মনোজই গাইছেন? তাঁর সঙ্গে কি গলা মেলাচ্ছেন না অধুনা মাড ক্যাফে হওয়া ১৭৪-ই রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের সেই মানুষটা! শ্রোতাদের কানে যেন ভেসে উঠল ‘জর্জদা’র’ কন্ঠ, ‘শেষবার মোর আঙিনায় দ্বার খোলে।’
নিজস্ব চিত্র