মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার মেডিকেল ইস্যুতে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেটাতেই সিলমোহর দিল দেশের শীর্ষ আদালত। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়। অন্ধ্রপ্রদেশ, গোয়া, গুজরাত, হিমাচল প্রদেশ, কেরল, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, রাজস্থান, তামিলনাড়ু ও তেলঙ্গনার পলিসিকেও বৈধতা দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। জানিয়ে দিল, একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত গ্রাম্য এলাকায় চিকিৎসার যে বন্ড তা একদম ঠিক।
প্রসঙ্গত, এক রাজ্যে পড়াশোনা করে নিজের সুবিধামতো অন্য রাজ্যে গিয়ে চিকিৎসা করার অভিযোগ ডাক্তারদের উপর বহুদিনের। আর তাই অনেক রাজ্যই এমবিবিএস অথবা স্পেশ্যালাইজেশনের সময় ডাক্তারদের দিয়ে কিছু বন্ড সই করিয়ে নেয়, যাতে ডাক্তারি পাশ করার পর অন্তত একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত গ্রাম্য এলাকায় ডাক্তারি করতে হবে তাঁদের। এই বন্ডের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন ডাক্তাররা। সেই অভিযোগ খারিজ করে দিল দেশের শীর্ষ আদালত।
মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এল নাগেশ্বর রাও-এর নেতৃত্বাধীন একটি ডিভিশন বেঞ্চ এই পলিসির বৈধতার কথা জানিয়ে দেন। এই পলিসি অনুযায়ী, একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত গ্রাম্য এলাকায় চিকিৎসা করাতে বাধ্য হন ডাক্তাররা। ডাক্তারদের অরিজিনাল মার্কশিট, সার্টিফিকেট ও অন্যান্য কাগজপত্রও জমা নিয়ে নেওয়া হয় রাজ্যের তরফে।
এই ব্যাপারে আগেই সরব হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এনআরএস হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তারদের উপর মারধরের ঘটনায় জুনিয়র ডাক্তার ও ইন্টার্নদের অনশন চলাকালীন মমতা বলেছিলেন, এখান থেকে ডাক্তাররা পাশ করে বেরিয়ে অন্য রাজ্যে চলে যায়। ডাক্তারদের পড়ার জন্য সরকারের অনেক টাকা খরচ হয়। অথচ তার বদলে রাজ্যের কোনও সুবিধা হয় না। এর ফলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার সমস্যা হয়। মমতার এই বক্তব্যকেই এ দিন যুক্তিযুক্ত বলল দেশের শীর্ষ আদালত।
এ দিন সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দেয়, এই পদ্ধতি একদম সঠিক। সেইসঙ্গে মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়াকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, প্রতিটা রাজ্যের জন্য একটা নির্দিষ্ট পলিসি বানাতে। জানানো হয়েছে, যে সব ডাক্তাররা সরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রেই এই নিয়ম লাগু হবে। অ্যাসোসিয়েশন অফ মেডিক্যাল সুপার স্পেশ্যালিটি অ্যাসপিরেন্টস অ্যান্ড রেসিডেন্টস-এর তরফে রাজ্য সরকারগুলির এই পলিসির বিরুদ্ধে পিটিশন দাখিল করা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে। এই পিটিশনে বলা হয়, এই ধরণের বন্ডের মাধ্যমে ডাক্তারদের মৌলিক অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। ডাক্তারদেরও তাঁদের কেরিয়ারের কথা ভাবতে হয়। কিন্তু এই ধরণের পলিসির ফলে তা করা সম্ভব হয় না বলেই অভিযোগ করেন তাঁরা। সেই সব পিটিশনকে খারিজ করে দিয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত।
সুপ্রিম কোর্টের তরফে জানানো হয়েছে, ডাক্তারি পড়ার জন্য একটা বড় টাকা খরচ হয় রাজ্য সরকারগুলির। বিভিন্ন ধরণের স্পেশ্যালাইজ কোর্স, মেডিক্যাল কলেজ চালানো, ছাত্র-ছাত্রীদের স্কলারশিপ দেওয়া প্রভৃতির পিছনে যে খরচ হয়, তার বেশিরভাগটাই সরকারি খাত থেকে খরচ করা হয়। আর এটা পুরোটাই করা হয়, রাজ্যের বিশেষ করে গ্রাম্য এলাকার পিছিয়ে পড়া ও গরিব মানুষদের চিকিৎসার জন্য। তাই তার বদলে ডাক্তারদের কাছ থেকে এটুকু আশা করতেই পারে সরকার। যখন কোনও ছাত্রী ডাক্তারিতে ভর্তি হয়, তখন যেমন স্কলারশিপ সহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা সে পায়, তেমনই ডাক্তার হওয়ার পরও তার উপরে কিছু কর্তব্য থাকে। এই বন্ডে সই করা সেই কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। তাই এই পলিসি তোলা কোনও ভাবেই সম্ভব নয়।
দেশের শীর্ষ আদালতের তরফে আরও বলা হয়, রাজ্যের পিছিয়ে পড়া ও গরিব মানুষদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করা প্রতিটা সরকারের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। এই কর্তব্য সংবিধানের ২১ নম্বর ধারার আওতায় পড়ে। কিন্তু যদি রাজ্যের ডাক্তাররা বাইরে চলে যান, তখন সেই পরিষেবার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবা খারাপ হয়। তার সঙ্গে সংবিধান না মানার মতো অপরাধও সেটা। ডাক্তারি পরিষেবা একটা সেবামূলক কাজ। তাই এ ক্ষেত্রে সেই সেবার মানসিকতা সব ডাক্তারদের মধ্যে থাকা উচিত বলে মনে করে সুপ্রিম কোর্ট।