”পূর্ব বঙ্গের ফরিদপুরের মাদারিপুর সাব ডিভিশনের ভোজেস্বর গ্রামে আমার জন্ম হয়, দিনটি ১৮৯৬ সালের ২০ শে আগস্ট, দিনের আলো ফুটিবার আগেই আমি ধরিত্রীর মুখ দেখিয়াছিলাম, আমার পিতা সেই সময় ঘরে ছিলেন না, পিতৃদেবের নাম শ্রীযুক্ত বাবু শ্যামলাল পাল, বরিশালের ঝালকাটি বন্দরে তেজারতির কারবার করিতেন, আমি পিতার প্রথম এবং একমাত্র সন্তান।”
কথাগুলো একজন প্রখ্যাত ফুটবলারের আত্মজীবনীর অংশবিশেষ, আত্মজীবনীটির লেখক গোষ্ঠ পাল। ভাষার মতোই তাঁর চরিত্রটি ছিলো সরল, সাধাসিধে এবং স্পষ্ট। এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে আরো কতগুলো বৈশিষ্ট — আত্মসম্মানবোধ, খেলোয়ারী মনোভাব, ওদার্য এবং আনুগত্যবোধ, যেগুলো আজ মাঠ এবং মাঠের বাইরে খুঁজেই প্রায় পাওয়া যায়না। গোষ্ঠ পালের আমলে মোহনবাগান সেরকম বড় ধরনের প্রতিযোগিতায় জয় পায়নি। গোষ্ঠর সময় মোহনবাগান আই এফ এ শিল্ড বা লীগ, রোভার্স, ডুরান্ড কোনো ট্রফিই জিততে পারেনি। লীগই প্রথম পায় গোষ্ঠ পাল অবসর নেবার চার বছর পর। তাহলে গোষ্ঠ পালের কৃতিত্বটা কোথায়?
আসলে শক্তিমান সাহেব দলগুলোর সঙ্গে সমান সমান লড়াই করাই ছিল তখন এ -দেশের ক্লাব গুলোর লক্ষ, যে কাজে গোষ্ঠ পাল এবং মোহনবাগান ক্লাব বিশেষ পারদর্শিতা দেখায়। ক্যালকাটা ক্লাব, উরস্টার্স, নর্থ স্ট্যাফর্ড, লিস্টার্স, মিডলসেক্স, হাইল্যান্ড ইনফ্যান্টি — প্রায় সবার বিপক্ষেই মোহনবাগান তীব্র লড়াই গড়ে তুলেছিল, এবং এই লড়াইয়ের পুরোভাগে ছিলেন গোষ্ঠ পাল। ভারতে যতদিন ফুটবল খেলা থাকবে ততদিন গোষ্ঠ পাল নামটি অমর থাকবে।
শক্ত সমর্থ, পেশীবহুল চেহারার গোষ্ঠ পালের মধ্যে যেমন ছিল হারকিউলিসের মতো শক্তি, তেমনি বুলটেরিয়ারের মতো গোঁ। তাঁর খেলার বৈশিষ্ট্য ছিলো লম্বা কিক, নির্ভয় ট্যাকলিং, ঠান্ডা মাথায় প্রতিপক্ষকে তাড়া করা, বুদ্বিদীপ্ত ভাবে নিঃশব্দে বল ছিনিয়ে নেওয়া আর মাথার কাজ।
তখন সাহেব অধ্যুষিত আই.এফ.এ মোহনবাগানের প্রতি অন্যায় আচরন করতো। এই অন্যায়ের সাথে আপস না করে গোষ্ঠ মাথা উঁচু করে খেলাই ছেড়ে দিয়েছিলেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই পুরো ভূখণ্ড ছিল ব্রিটিশদের দখলে। এই শতাব্দীতে পৃথিবীতে ঘটেছে অসংখ্য উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কিন্তু পুরো ভারতবর্ষের মানুষ ব্যতিব্যস্ত ছিল ব্রিটিশদের শাসন বা অত্যাচার সহ্য করার আর গুটিকয়েক আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলার চেষ্টায়। এর মধ্যেই কিছু আন্দোলন ছিল গর্ব করার মতো, কিছু কিছু অনুষঙ্গ ছিল ভাল লাগার, কিছু কৃতিত্ব ছিল প্রশংসনীয়, যেসব পরবর্তী সময়ে ইতিহাসে পরিণত হয়। তেমনি এক কৃতিত্বের স্বীকৃতি ‘চীনের প্রাচীর’ উপাধি।
গ্রেগরিয় পঞ্জিকা অনুসারে ১৮০১ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত সময়কাল ঊনবিংশ শতাব্দী। এই শতাব্দীতে স্পেনিয়, পর্তুগিজ ও উসমান সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয় এবং রোমান সাম্রাজ্য ও মোঘল সাম্রাজ্যের পতন সম্পূর্ণ হয়। নেপোলিয়নীয় যুদ্ধগুলো শেষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিশ্বের নেতৃত্বে আবির্ভূত হয়। বিশ্বের এক চতুর্থাংশ জনগণ ও এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড এ সাম্রাজ্যের অধীনস্থ ছিল। সারা বিশ্বে দাস প্রথা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। বিদ্যুৎ, স্টিল ও পেট্রোলিয়ামের ব্যবহার বেড়ে যায় ও একটি দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব ঘটে। যার ফলশ্রুতিতে জার্মানি, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং এরা নিজ নিজ সাম্রাজ্য বিস্তারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, রাশিয়া ও চীন অন্যান্য বিশ্বশক্তির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। ফলে এ সাম্রাজ্যগুলোতে সামাজিক নৈরাজ্য বেড়ে যায়।
এই পুরো শতাব্দীতে ভারতবর্ষ জুড়ে ছিল ব্রিটিশদের সাম্রাজ্য। সেই সময়ে এই বাংলায় জন্ম নেয় এক রহস্য বালকের। তখন খেলাধুলার খুব একটা প্রচলন ছিল না। কিন্তু সেই বালক ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলা আরম্ভ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ভারতের হয়ে ফুটবল খেলেছেন। হয়েছেন জাতীয় ক্লাবের অধিনায়ক। পেয়েছেন ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’ উপাধি। খেলোয়াড়ি জীবনে ভূষিত হয়েছেন ‘চীনের প্রাচীর’ উপাধিতে। তিনি গোষ্ঠ পাল।
গোষ্ঠ পালের জন্ম ১৮৯৬ সালের আজকের দিনে (২০ আগস্ট)। তিনি তৎকালীন বাংলাদেশের মাদারীপুর সাব ডিভিশনের ভোজেস্বর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তার বাবা শ্রীযুক্ত বাবু শ্যামলাল পাল ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। কিন্তু আদরের একমাত্র সন্তান বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই ফুটবলের প্রতি আসক্ত এটি দেখে বাবাও আর না করেননি।
মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি কলকাতার একটি ক্লাবে খেলার সুযোগ পান। এই বয়সেই তিনি কুমারটুলির হয়ে মাঠে নামেন। ১৯০৭ থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতার কুমারটুলি ক্লাবে খেলেছেন। মোহনবাগানের খেলোয়াড় রাজেন সেনের সহায়তায় তিনি ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে মোহনবাগান দলে যোগ দেন। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে মোহনবাগানের হয়ে তিনি প্রথম খেলেন। এরপর ২৩ বছর ধরে মোহনবাগানের হয়ে খেলেছেন। পরাধীন ভারতে সবুজ-মেরুন রঙের জার্সি গায়ে মোহনবাগান রক্ষণে তার বিক্রমকে ভয় পেত বুট পরা ইংরেজ ফুটবলাররাও।
গোষ্ঠ পাল খেলতেন রাইট ব্যাক পজিশনে। খেলার সময় বুট পরা ইউরোপিয় খেলোয়াড়দের তিন খালি পায়ে খেলে প্রতিরোধ করতেন। ভারতীয় দল নিয়ে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিংহলে (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) যান। পরের বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের অধিনায়ক নির্বাচিত হন। পরে তিনি আঘাতের কারণে যেতে পারেন নি। ১৯২৪ সালে ভারতীয় জাতীয় দলেরও অধিনায়কত্ব পান। তিনি হকি খেলাতেও দক্ষ ছিলেন এবং ক্রিকেট এবং টেনিসও খেলতেন। ১৯৩৫ সালে তিনি ফুটবল থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৬২ সালে ভারত সরকার গোষ্ঠ পালকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি ভারতের প্রথম ফুটবল খেলোয়াড় যিনি পদ্মশ্রী উপাধি পেয়েছেন। মোহনবাগান ক্লাব ২০০৪ সালে তাকে মরনোত্তর ‘মোহনবাগান রত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করে। কলকাতায় তার নামে একটি রাস্তা গোষ্ঠ পাল সরণি আছে। এই রাস্তায় তার একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। মোহনবাগান ক্লাবের ভেতরে তার নামে একটি সংগ্রহশালা ‘গোষ্ঠ পাল সংগ্রহশালা’ তৈরি হয়েছে। তার উপর ভারতে ডাকটিকিটও প্রকাশিত হয়েছে।
গোষ্ঠ পাল ফুটবল খেলে উপমহাদেশে সেই বিংশ শতাব্দীতে নাম কুড়ালেও কখনোই বাংলাকে ভোলেননি। এমনকি তার আত্মজীবনীতেও তিনি বারবার লিখেছেন বাংলার কথা, তৎকালীন পূর্ব বাংলার (বর্তমানে বাংলাদেশ) কথা।
মোহনবাগানের ওয়েবসাইটে গোষ্ঠ পাল সম্পর্কে বলা হয়েছে, আত্মজীবনীর ভাষার মতোই তার চরিত্রটি ছিলো সরল, সাধাসিধে এবং স্পষ্ট। এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে আরো কতগুলো বৈশিষ্ট- আত্মসম্মানবোধ, খেলোয়াড়ী মনোভাব, ওদার্য এবং আনুগত্যবোধ, যেগুলো আজ মাঠ এবং মাঠের বাইরে খুঁজেই প্রায় পাওয়া যায় না।
আজও আকাশবাণী কলকাতার সামনে তাঁর মূর্তিতে ফুলের রাশি জমা হয়েছে। মোহনবাগান ক্লাবে তাঁর চিত্রলানছিত পতাকা উড়েছে, ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন উৎসব মুখর হয়ে উঠেছে। আর যারাই ফুটবলে পা ছোয়াবেন, তাঁরাই নিজেদেরকে ভাববেন গোষ্ঠ পাল। শরীর ও স্বাস্থের এই স্তম্ভে নানা পালোয়ানের কথা আসবে। তাঁর সূচনাতেই এক ‘পালোয়ানে’ র কথা বলছি। তিনি পালোয়ান না হয়েও ‘ পালওয়ান’ – ওয়ান এন্ড অনলি পাল ফুটবল জগতে – গোল পাল, পাল নম্বর ওয়ান।
জানি না, ফরিদপুর জেলার মাদারিপুর সাব ডিভিশনের ভোজেশ্বর গ্রাম, এখন আর গণ্ডগ্রাম নেই নিশ্চয়ই, সেই ভোজেশ্বর গ্রাম উৎসবে উন্মাদ হয়ে উঠবে কিনা ২০ অগাস্ট ১৮৯৬ সালে তার জন্মের কথা স্মরণ করে। কিন্তু পরিবারের কারও না কারও স্মৃতিতে মেদুর হয়ে উঠবে।
এই ছেলেটা জন্মাল, বাবা শ্যামলাল ছেলের মুখ দেখবেন বলে কর্মক্ষেত্র থেকে কলকাতায় এসে টুকিটাকি জিনিসপত্র কেনার সঙ্গে একটা সোনার বিছেও কিনে নিয়েছিলেন। সেটা নিয়ে কর্মক্ষেত্র বরিশাল থেকে আর বাড়ি ফিরতে পারেননি তিনি। কলকাতাতেই অসুস্থ হয়ে পরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। গোষ্ঠ তখন মাস দেড়েকের। মা বিধবা হয়ে বাপের বাড়ি ভাগ্যকুলে চলে এলেন ছেলেকে নিয়ে। মা – দিদিমার যত্নে তিনি বরো হয়ে উঠলেন। বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে বলতেন – “বাবারে আমি দেখিই নাই। তার সম্পর্কে কী কমু?? আমার মায় – ই সব। মা আমারে বড় করসে।” অথচ কোনও এক প্রকাশকের অনুরোধে যে আত্মজীবনী তিনি লিখতে শুরু করেছিলেন, পাতা ২০ লেখার পর আর লিখে উঠতে পারেননি, সেই অসমাপ্ত “আত্মকথা” শুরু হয়েছিল বাবাকে দিয়েই।
এখন মনে হয় যদি সম্পূর্ণ আত্মচরিত্রটি আমরা পেতাম! গোষ্ঠ পাল বয়সে বাড়তে লাগলেন। পড়াশুনোর কথা বলছি না, বারছিলেন তিনি দুষ্টুমিতেও। মা বঁটিতে বসে ডাঁটা কাটতে কাটতে একটা কী দরকারে উঠে গিয়েছিলেন। প্রকৃতি শূন্যস্থান পরিহার করে না। সেই সুত্রে গোষ্ঠ এসে মায়ের শূন্যস্থান গ্রহণ করলেন এবং ডাঁটা কাঁটা শুরু করলেন। হঠাত ডাঁটার বেমক্কা চাপে বঁটির ডগা ছিটকে উঠে সোজা ধারাল দিকটি দিয়ে গোষ্ঠর ডান কাঁধে গেঁথে গেল। গোষ্ঠ কিন্তু চিৎকার করলেন না। চোখ দিয়েও জল গড়াল না। মনে একরাশ কষ্ট – ডাঁটা কাঁটা হলো না। মা এসে ব্যাপার দেখে একেবারে হইচই ফেলে দিলেন। ডাক্তার ডাকা হল। তিনি এসে পটি বেঁধে দিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করলেন – এতটাই যখন সহ্যশক্তি তখন বড় হয়ে একটা কেউকেটা হবেই গোষ্ঠ। শুনে পড়শিদের কেউ কেউ ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে উঠেছিলেন ” কেউকেটা হইব না ছাই – ডাকাইত হইব”।
তো ডাকাত তিনি হয়েইছিলেন – তবে আসল নয়, নকল। সিনেমায়। ১৯৩২ সাল। তখন নির্বাক যুগের শেষ। ন্যাশনাল পিকচার্স লিমিটেড নামে নতুন চিত্র প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তাঁরা একটি নির্বাক ছবি উপহার দিলেন – “গৌরিশঙ্কর”।
পরিচালক এন্ডিমুর রায় – অর্থাৎ আনন্দমোহন রায়। এতে ভোলা সর্দার এর ভূমিকায় অভিনয় করলেন গোষ্ঠ পাল। ভোলা ছিলো ডাকাতদের সর্দার। কথাপ্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি – এই অভিনয় দেখেছিলেন আরবি – রাখাল ভট্টাচার্য স্বয়ং। সেই ডাকাত গোষ্ঠ ছিলেন স্বদেশি ডাকাত – তাই পায়ে চেন বাধা থাকলেও পরনে ছিলো বিপ্লবীর পোশাক – খদ্দর।
পড়াশুনায় খুব একতা ভালো ছেলে ছিলেন মনে করার কারণ নেই। বিদ্যাসাগর কলেজে প্রথম দিকে ক্লাস করেছেন। ভাজ্ঞিস করেছিলেন – নইলে এ সময়ে ” বাংলার ক্রিকেটের জনক” অধ্যক্ষ সারদারঞ্জন রায়ের সান্নিধ্যে আসতে পারতেন না।
একটু বড় হতেই ভাগ্যকুল থেকে ভোজেশ্বর এলেন। ছোট মামা আর বাড়ির পরিচারক ছিলেন বন্ধু। এখানে পেলেন সরোজ রায়কে। দু’জনের খুব ইচ্ছে ফুটবল খেলার, বড় ফুটবলার হওয়ার। গোষ্ঠের বাবার জ্যাঠতুতো ভাই মতিলালবাবু একদিন একটা বল কিনে এনে দিলেন। সেই বলকে ঘিরেই একদল বন্ধু জুটল, গড়ে উঠল একটা ক্লাব। নাম হলো তার ” দি ক্যালকাটা ইউনিয়ন ক্লাব”। ততদিনে গোষ্ঠ পাল কলকাতায় এসে গিয়েছেন। থাকেন কুমারটুলিতে। সেখানে একটি ফুটবল সংস্থা কলকাতার নজর কেড়ে নিয়েছিল – “কুমারটুলি জুভেনাইল”। সেখানে ফুটবলার হিসেবে খেলতে পাওয়াটা গৌরবের বিষয় ছিল। গোষ্ঠ ঘটনাক্রমে সেই ক্লাবের খেলোয়াড় হিসেবে যোগ দিলেন।
এর মধ্যে ১৯০৫ – এর ঘটনাগুলো ঘটে গেছে বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দলোনকে ঘিরে। গোষ্ঠও জড়িত কিছুটা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববিজয়ের মাত্র দু’বছর আগে যে কাণ্ডটা ঘিতে গিয়েছিল – তাও মনে হয় একধরনের বিশ্বজয়ের মতই। ১৯১১ সাল। প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে মোহনবাগান আইএফএ শিল্ড জয় করল এটা সংবাদ তো বটেই, তবে সংবাদটা আরও বড় ছিল, কারণ প্রতিপক্ষ ছিল সাহেবদের দল।
১৯১১ – এর পর ভাগ্যকুলের রায়মশায়রা খুব চেষ্টা করেও মোহনবাগানের গোটা দলটাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারলেন না। তবে দুই ফুটবলার রাজেন সেন আর অভিলাষ তাঁদের টুর্নামেন্টে খেলতে গেলেন স্থানীয় একটি ক্লাবের হয়ে। এই খেলায় “হোস্ট টিম” ভাগ্যকুল ক্লাবের হয়ে নামলেন ১৬ বছরের গোষ্ঠ পাল। তাঁর খেলার ধরন খুব ভালো লেগে গেল রাজেন সেনের। তিনি গোষ্ঠ পালকে মোহনবাগানে খেলার অফার দিয়ে কলকাতা ফিরে গেলেন।
আর শিল্ড জয়ের পরের বছরই সুধীর চ্যাটার্জি অবসর নিলেন মোহনবাগান থেকে। রাজেন সেনের হাত ধরে সেই ফাঁকা জায়গাটায় ঢুকে গেলেন গোষ্ঠ পাল। তা মঞ্জুর করলেন খোদ কর্তা মিলিটারি মেজাজি মেজর শৈলেন বসু – ক্লাবের সর্বময় অধিকারী। প্রথমদিন মাঠে পা দিয়েই অগ্নিপরীক্ষা দিতে হলো গোষ্ঠ পালকে। সেদিন আসাদুল্লা কাপে মোহনবাগানের সঙ্গে খেলা কাস্টমস-র। সেই ম্যাচে নামলেন মালকোচা মারা ধুতি পরে গোষ্ঠ পাল। সেদিনের বৃষ্টি ভেজা মাঠে গোষ্ঠ পাল এজেবারেই সুবিধে করতে পারলেন না। দর্শকরা মন্তব্য ছুড়লেন – ‘র’ মেটিরিয়াল, মোহনবাগানে চলবে না।
এর জবাব দিলেন গোষ্ঠ পরের ম্যাচে। ব্ল্যাক ওয়াচের বিরুদ্ধে খেলায় খালি পায়ে বুট – পরা ইংরেজদের নাচিয়ে ছেড়ে দিলেন লেফ্ট ব্যাক ভূতি সুকুলের সঙ্গে খেলে। সাধে কি তখনকার মন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী কলকাতার কেন্দ্রস্থলে আকাশবাণীর কাছে কলকাতার একমাত্র ফুটবলার গোষ্ঠ পালের পূর্ণাবয়ব মূর্তিটি স্থাপনা করেছিলেন? গোষ্ঠ পালের আইডল ‘স্লিপারি’ শিবদাস ভাদুড়ি। আরও একজন স্যার দুখীরাম মজুমদার। যদিও তিনি এরিয়ানের প্রাণপুরুষ।
ঐ যে বলেছিলাম না, ব্ল্যাকওয়াচের ফুটবলারদের গোষ্ঠ পাল নাচিয়ে ছেড়েছিলেন। তারা তো গোল দিতে পারলেনই না, একেবারে মরমে মরে রইলেন। সেটা ১৯১৩ সালের কথা। এই খেলার ফলাফল কী হয়েছিল জানেন? গোষ্ঠ পাল মোহনবাগান ক্লাব থেকে যাওয়ার স্থায়ী আসনটি লাভ করে নিলেন। বয়স তখন মাত্র ১৭।
খেলা যদি হত ৫ – ৩ – ২ ছকে, তবে গোষ্ঠ পাল তাঁর সেরা ব্যাক। বলা তো হয়েই থাকে তখনকার সেরা ফুল ব্যাকের নাম গোষ্ঠ (বিহারী) পাল। লম্বা টানা কিক, নির্ভয় ট্যাকলিং, প্রতিপক্ষকে হিমশীতল মেজাজে তারা করা আর গোটা মাঠে বুদ্ধির আলো ছড়িয়ে গোষ্ঠ অনবদ্য, অনুপম, অপ্রতিম। সাধে কি ‘দ্য ইংলিশ ম্যান’ – এর এক দুঁদে সাংবাদিক রেড রোজ ছদ্মনামে লিখে বসেছিলেন সেই প্রবচনটি,
“Gostha Imapegnable as the Chinese Wall.”
সেই একটা প্রবাদের জনক হল – ‘চাইনিজ ওয়াল’।
বাঙালির সম্মানের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকল – গোষ্ঠ পাল – দ্য চাইনিজ ওয়াল। তাতেই তো গত শতকের আদিভাগের টানা ২৫ বছর একটা অবদমিত জাতির আশা – আকাঙ্ক্ষা – উদ্দীপনা আর প্রাপ্তি মোহনবাগানের মাঠ থেকেই সংগ্রহ করতে পেরেছিল। মোহনবাগান তখন বুঝি একতা আঞ্চলিক নাম নয়, সমগ্র ভারতবর্ষ। সেই ভারতবর্ষের গড়ের মাঠে লড়ে চলেছেন একটা নগ্নপদ মালকোঁচা মারা বাঙালি – গোষ্ঠ পাল।
তাঁর পাদুটো ছিলো গতিক থামের মতো। ষণ্ডামার্কা গোরা পল্টনগুলো ওর কাছে ঘেঁষতে ভয় পেত। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল – ‘গোড়াদের পায়ে ভারী বুট, আপনার ভয় করে না?’
মুচকি হেসে নিজস্ব ভাসায় উত্তর এসেছিল, ‘ভয়? আমারেই ত ওরা ভয় পাইল চিরডা কাল, আমি আবার ভয় করলাম কারে? এরই নাম আত্মবিশ্বাস, অহঙ্কার নয়।”
মোহনবাগানে যোগ দিয়েছিলেন ১৯১৩ সালে , টানা ২৩ বছর খেলার পর অবসরগ্রহণ। ততদিনে তিনি আর নাম নন, কিংবদনতিতে পরিণত। তাকে নিয়ে কত প্রবচন রচিত হলো। কেউ লিখলেন, ‘বাঘের মত বিক্রম, সাপের মত তীব্র চেতনা, চিতার মত ক্ষিপ্র গতি, চিনের প্রাচিরের মত দুর্ভেদ্য’। সর্বজন শ্রদ্ধেয় স্যার দুখিরাম মজুমদার বলতেন – ‘ যেন মত্ত সিংহ ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে’। সেই রকম চলন, সেই রাজকীয় পদক্ষেপ! কে যে কবে তার পাস দিয়ে ড্রিবল কিরে যাওয়ার সাহস দেখিয়েছিলো – ফুটবলের ইতিহাসকাররা তা লিখবারই উপাদান পাননি। উল্টে গোষ্ঠর পায়ে বল জমা দিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলেছেন। কারা জমা দিয়েছিলেন – দু চারটে নাম শুনবেন? এলসন, পপল, গামারি, নাইট, হ্যারিসন, গ্রিডস, স্টিলের মতো দুর্ধর্ষ ফুটবলাররা। সামনে গোষ্ঠ পাল থাকায় গোলকিপার অনু ভট্টাচার্যরাও ছিলেন টেনশন মুক্ত। তাঁর পেছনে দাড়িয়ে থাকা ছাড়া বল ধরার কাজ কদাচিৎ কর্রে হতো তাদের। কী খেতেন গোষ্ঠ পাল? ‘যা পাই তাই খাই’। পাকস্থলীতে গেলেই হজম হয়ে রক্তে মিশে গিয়ে সেই খাদ্যের নাম হয়ে যেতো দম, স্ফূর্তি, আত্মনির্ভরতা। গোষ্ঠ পালকে মাঠের বাইরে ছকে যেতে বাধ্য করেছিলেন কারা, কতবার সে পরিসংখ্যান দিতে পারবে ? বোধ কিরী, এক বারের কথা কেউ কেউ বলতে পারতেন।
যখন ১৯২৯ সালে ডুরান্ড কাপের একটি ম্যাচে কোয়ার্টার স্যান্ডেমোণিয়াম মুসা একবার চরম ফাউল করে গোষ্ঠকে এমন চোট মারেন যে, গোষ্ঠ মাঠের বাইরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে সেই অপমান হজম করেননি তুলসী দাস। তিনি সারে ছ’ফুট লম্বা মুসাকে মাটিতে ফেলে তাঁর বুকে চেপে বসে চিৎকার করে বলেছিলেন – ‘ তুমনে গোষ্ঠ পাল কো মারা, ম্যায়নে উসি কা বদলা লিয়া’। তবুও সত্যি কথাটা বলাই ভালো গোষ্ঠ পালের সময় মোহনবাগান কোনো নামি টুর্নামেন্ট জয়ী হতে পারে নি। না ডুরান্ড, না রোভার্স কাপে। গোষ্ঠ পালের এতে প্রতিক্রিয়া শুনবেন?
“ট্রফি পাওয়ার কথা যত না চিন্তা করসি, সাহেব গো হারামু কি কইরা সেই চিন্তাই তখন বেশী করসি। ট্রফি পাই নাই বইল্যা আমাগো কষ্ট হয় নাই।”
কেন যে তার নাম ‘আশুতোষ’ রাখা হয়নি, বলতে পারি না।
গোষ্ঠ পালের জার্সিটা কেমন ছিলো তা পাঠকরা বুঝতে পেরেছেন, মালকোঁচা মারা ধুতি। শুধু ফুটবলে নয়, ক্রিকেট খেলার সময় একই পোশাক। সাহেবরা খেলতে নেমে বলতেন – ‘ধুতি নট এলাউড’। গোষ্ঠ মানলেন না, খেলা বানচাল হয়ে গেল। পরে অবশ্য ক্যালকাটা ক্লাবের কর্তা ব্যাক্তিরা ‘সরি’ বলেন, “লেট আস ফরগেট দ্যাট ইনসিডেন্ট”।
এমনই খেয়ালই গোষ্ঠ পাল। তিনিই প্রথম একজন খেলোয়াড় , একজন ফুটবলার, যিনি “পদ্মশ্রী” উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল খেতাব নিতে দিল্লী গেলেন। খেতাব পেয়েছেন তারাশঙ্কর ব্যানার্জিও। গায়ে তার নির্দিষ্ট পোশাক – গলাবন্ধ কোট। গোষ্ঠবাবুর ওসব বালাই নেই। তারাশঙ্কর বললেন, গলাবন্ধ কোট পরেননি। এটা না পরকে খেতাব নেওয়া যাবে না। গোষ্ঠবাবু বললেন, ধুতি – পাঞ্জাবিতে যদি খেতাব না পাওয়া যায়, নেব না, ফিরে যাব। সব শুনলেন রাজেন্দ্রপ্রসাদ। স্বয়ং রাষ্ট্রপতি বললেন, উনি একজন ফুটবলার, যে পোশাকেই আসুন, আমার আপত্তি নেই। এরই নাম গোষ্ঠ পাল। বিরল ব্যাতিক্রমি বাঙালি।
এবারে যদি বলি গোষ্ঠ পাল শুধুমাত্র মোহনবাগানের নন, তিনি ইস্টবেঙ্গলেরও!! অনেক মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল সমর্থক এই লাইনটা পড়লেই ‘রে রে’ করে তেড়ে আসতে পারেন। কিন্তু তাতে কিন্তু ইতিহাস বদলে যাবে না। সত্যিটা হচ্ছে যে লাল-হলুদ জার্সি গায়েও মাঠে নেমেছিলেন গোষ্ঠ পাল। ১৯২০ সালে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব প্রথম যে দল গড়ে তাতে ছিলেন কিংবদন্তী ফুটবলার গোষ্ঠ পাল। ১৯২০ সালে ইস্টবেঙ্গল একটাই টুর্নামেন্ট হারকিউলিস কাপে খেলতে মোহনবাগান থেকে তাঁকে হায়ারে নেওয়া হয়েছিল এবং চ্যাম্পিয়নও হয় লাল-হলুদ।
কিন্তু হয়েছিল কি?
নতুন ক্লাব তৈরি হয়ে গেছে ১ আগস্ট। কিন্তু সেই ক্লাবকে পরিচিতি পেতে গেলে তো কোনো একটা প্রতিযোগিতায় খেলতেই হবে। এদিকে আগস্ট মাসে কলকাতার ফুটবল মরশুম অনেকটাই এগিয়ে গেছে। ময়দানে চলছে লিগের খেলা। সেখানে মাঝপথে সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনাই নেই। অন্যান্য ছোট প্রতিযোগিতাও শেষ হওয়ার মুখে। এদিকে নতুন তৈরি হওয়া দল এক বছর বসে থাকবে, সে হয় নাকি!
হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র ছিলেন না ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সুরেশ চৌধুরী। তিনি আর রায়বাহাদুর তড়িৎভূষণ রায় ক্লাবের যুগ্ম-সম্পাদক। নতুন ক্লাবে তাঁরা জড়ো করেছেন কলকাতার বিভিন্ন দলে খেলা পূর্ববঙ্গের নামি খেলোয়ারদের। কলকাতার নানা ক্লাবে পূর্ববঙ্গের খেলোয়াররা প্রকৃত সম্মান পান না বলেই তো নতুন ক্লাব গড়ার সিদ্ধান্ত। কেবল পূর্ববঙ্গের মানুষ বলেই নাকি জোড়াবাগান ক্লাব মোহনবাগানের সঙ্গে খেলায় বসিয়ে দিয়েছিল শৈলেশ বসুর মতো দক্ষ খেলোয়ারকে। ময়মনসিংহ জেলার নাগপুর গ্রামের জমিদার সুরেশ চৌধুরী এরই প্রতিবাদে ছেড়ে দিয়েছিলেন জোড়াবাগান ক্লাবের সহ-সভাপতির পদ। ঠিক করেছিলেন নতুন দল গড়বেন। তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন অনেক নামকরা, অর্থবান মানুষও। নতুন ক্লাবের নাম হল ‘ইস্টবেঙ্গল’। সেই নামের সঙ্গে মিশে থাকা ভূখণ্ডের আবেগটাও কোথাও কাজ করে গেছিল।
কিন্তু সদ্য জন্ম নেওয়া সেই ক্লাবকে তো কোনো প্রতিযোগিতায় খেলার সুযোগ করে দিতে হবে। খোঁজ শুরু হল। এমন সময় তড়িৎবাবু খবর পেলেন, শ্যাম পার্কে হারকিউলিস কাপের খেলা হচ্ছে। একটাই সমস্যা, এই প্রতিযোগিতায় এগারো জনের গোটা দল নামানো যাবে না। কারণ, এটা ছ’জনের দলের টুর্নামেন্ট। প্রতি দলে মাত্র ছ’জন করে খেলোয়ার থাকবে। তখন আর বাছাবাছির সুযোগ নেই। তড়িৎবাবু এই টুর্নামেন্টেই ইস্টবেঙ্গলের নাম দিয়ে দিলেন। দল মাঠে তো নামুক। তাছাড়া, অনেকগুলো নামকরা দল আর ফৌজি দলও অংশ নিয়েছিল হারকিউলিস কাপে। গোটা দলের সবাই যাতে কম-বেশি খেলতে পারে, তাই ইস্টবেঙ্গলের দুটি টিম নাম দিল টুর্নামেন্টে—‘এ’ আর ‘বি’ টিম।
ক্লাব টুর্নামেন্টে নামছে, এদিকে টিমের জার্সিই ঠিক হয়নি। সুরেশবাবু জার্সির খোঁজে এক দোকান থেকে অন্য দোকানে ঘুরছেন হন্যে হয়ে। চৌরঙ্গীতে সাহেবদের একাধিক দোকান। কোনো জার্সিই পছন্দ হয় না। সব কেমন ম্যাড়ম্যাড়ে। সুরেশবাবু চাইছিলেন এমন এক জার্সি, যা চোখ ধাঁধিয়ে দেবে। যে অপমান, অবহেলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে তাঁদের নতুন ক্লাবের জন্ম, সেই প্রতিবাদের তেজটা যেন জার্সিতে থাকে। এমন এক জার্সি যা দেখে সকলের ভালোও লাগবে। যাতে প্রাণ আছে।
শেষ পর্যন্ত, এমন এক সেট জার্সির খোঁজ মিলল হোয়াইটওয়ে লেইডলে-র রাজকীয় বিপণীতে। লাল আর হলুদ রঙের উজ্জ্বল জার্সি। এই জার্সি পরে নামলে অনেক দূর থেকেও চেনা যাবে ইস্টবেঙ্গলের খেলোয়ারদের। তাছাড়া, জার্সিটায় যেন আগুন আছে। সুরেশবাবুর পছন্দ হল খুব। সুযোগ বুঝে দোকানিও চড়া দাম হাঁকল। ৮০ টাকা! সেই যুগে এর অর্ধেকের কম দামেই এক সেট বিলিতি জার্সি হয়ে যেত। তাতে কী! সুরেশবাবুর জমিদারি রক্ত। টাকা নিয়ে মাথা ঘামানোর রুচি তাঁর নেই। তাছাড়া, তার প্রাণের নতুন ক্লাবের জার্সি। সামান্য ক’টা টাকার জন্য এই জার্সি নিয়ে দরদাম করে আবেগটা মাটি করতে চান না তিনি। টাকা ফেলে দিয়ে নতুন জার্সি নিয়ে তিনি ফিরলেন ক্লাবে।
এরপর, সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত। প্রথমবারের জন্য মাঠে নামল ইস্টবেঙ্গল দল। সেমিফাইনালে তাদের ‘এ’ আর ‘বি’ টিম মুখোমুখি হল। ‘বি’ টিম সরে দাঁড়ানোয় ‘এ’ টিম উঠল ফাইনালে। তারপর, ১৯২০ সালের ১৩ আগস্ট অমৃতবাজার পত্রিকায় খবর বেরোল—“হারকিউলিস কাপে ইস্টবেঙ্গলের জয়লাভ”। বিদ্যাসাগর কলেজকে ৪-০ গোলে হারিয়ে দিয়ে প্রথম টুর্নামেন্টই জিতে নিল ইস্টবেঙ্গল। সেই দলে খেলেছিলেন নগেন কালী, নসা সেন (অধিনায়ক), ভোলা সেন, প্রশান্ত বর্ধন, শৈলেন বসু এবং চারু বসু। কিন্তু একজনের নামের উল্লেখ অমৃতবাজার পত্রিকায় ছিল না। এমন একজন, যাঁকে বলা হয় ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম প্রথম কিংবদন্তি। যাঁর খালি পায়ের পাথুরে ট্যাকেলে মাথা পর্যন্ত ঝনঝন করে উঠত গোরা খেলোয়ারদেরও। যাঁকে ভারতের সর্বকালের সেরা ব্যাক বলা হয় আজো। ভারতের জাতীয় দলের অধিনায়কত্বও করেছেন মানুষটি। তাছাড়া, মোহনবাগানের রত্ন হিসেবেই তাঁকে মনে রেখেছেন বাংলার ফুটবলপ্রেমীরা। অথচ, সেই মানুষটি যুক্ত ছিলেন ইস্টবেঙ্গলের প্রথম দলের সঙ্গেও। মানুষটির নাম গোষ্ঠ পাল।
গোষ্ঠ পাল মোহনবাগানে খেলতেন রাইট ব্যাক পজিশনে। তখনকার দিনে তাঁর মতো ময়দান কাঁপানো ব্যাক আর কেউ ছিলেন না। সুরেশবাবু খুবই পছন্দ করতেন তাঁকে। একদিন তাঁকে প্রস্তাব দিলেন ইস্টবেঙ্গলে খেলার। শুধু খেলোয়ার হিসবে নয়, তাঁকে তিনি অধিনায়ক হিসেবেই বরণ করে নিতে চান টিমে। সেই প্রস্তাবে না করতে পারেননি গোষ্ঠ পাল। ইস্টবেঙ্গলের প্রথম অধিনায়ক ছিলেন তিনিই।
কিন্তু, ইস্টবেঙ্গলের প্রথম ট্রফি-জয়ের যে খবর বেরিয়েছিল অমৃতবাজার পত্রিকায়, কোনো এক আশ্চর্য কারণে সেখানে নাম ছিল না গোষ্ঠ পালের। পরের বছর ফের মোহনবাগানে ফিরে গেলেন তিনি। ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে তাঁর খেলোয়ার জীবনের সম্পর্ক বড়োই সংক্ষিপ্ত, অথচ ঐতিহাসিক।
তখনো ইস্টবেঙ্গল বড়ো ক্লাব হয়নি। মোহনবাগান ক্লাবের নাম ও মর্যাদা তো ধরাছোঁয়ার বাইরে। অনেকে বলেন, হারকিউলাস কাপের জন্যই নাকি গোষ্ঠ পালকে মোহনবাগান থেকে ধার করে এনেছিলেন সুরেশবাবু। হয়তো তাই সত্যি। নাহলে, এটাই হয়তো হত এই দুই ক্লাবের ভিতরে প্রথম হাই ভোল্টেজ দলবদল।
ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের মতোই গোষ্ঠপালের সেই ‘দলবদল’-ও কিন্তু সম্প্রতি একশো বছরে পা দিয়েছে।
১৯৭৫ সালের ৮ই এপ্রিল পৃথিবীর মায়া কাটান ‘চীনের প্রাচীর’ গোষ্ঠ পাল।
এক সম্বর্ধনা সভায় তিনি বলেছিলেন,
“মোহনবাগানের জার্সির জন্যই লোকে আমাকে চেনে, এই জার্সিই আমাকে খেলা শিখিয়েছে, এটা আমার প্রিয়, আমি একে আমার মায়ের মতো স্রদ্বা করি, আমি ছেলেকে বলেছি আমার মৃত্যুর পরে যেনো আমার চিতায় এই সবুজ মেরুন জার্সিটা বিছিয়ে দেয়, এটাই আমার শেষ ইচ্ছা।”
ক্লাবের প্রতি ভালবাসা, আনুগত্য, শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ক’জন দেখাতে পারেন? ফুটবলার অনেক হয়, কিন্তু গোষ্ঠ পাল এই কারনেই অনন্য।
১৯৮৪ সালে কলকাতায় স্থাপিত হয় তাঁর ভাস্কর্য। খালি পায়ে ফুটবল খেলার ঔদ্ধত্যটাই বোঝানো হয়েছে এই ভাস্কর্যে। সেই ভাস্কর্যের নিচে লেখা আছে,
“ভারতীয় ফুটবলে সর্বকালের সেরা ব্যাক। সে যুগে বুটপরা ইউরোপীয় ফুটবলারদের বিরুদ্ধে খালি পায়ে খেলে দুর্ভেদ্য চীনের প্রাচীর নামে খ্যাত। খেলার মাঠে স্বজাতির সম্মান প্রতিষ্ঠায় ও জাতীয়তাবাদের উন্মেষে অন্যতম সৈনিক।”
ইডেন গার্ডেন্স ও মোহনবাগান মাঠের সামনে দিয়ে যাওয়া কলকাতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাটির গোষ্ঠ পাল সরণি।
তাঁর স্বরণে ডাকটিকিটও প্রকাশিত হয়েছে।
মোহনবাগান ক্লাব ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে মরনোত্তর মোহনবাগান রত্ন উপাধিতে ভূষিত করে।
মোহনবাগান ক্লাবের ভিতরে তাঁর নামে একটি সংগ্রহশালা গোষ্ঠ পাল সংগ্রহশালা তৈরি হয়েছে।
সেন্ট্রাল কলকাতায় রয়েছে গোষ্ঠ পাল মেমোরিয়াল স্পোর্টিং ক্লাব ও চালু হয়েছে গোষ্ঠ পাল চাম্পিয়ান্স বেবি লিগ।
(তথ্যসূত্র:
১- “People forgetting Gostha Paul: Son”, The Times of India. Retrieved 22 January 2016.
২- “India’s greatest footballer”, SportsStar, The Hindu, 15 April 2006.
৩- উইকিপিডিয়া।
৪- ‘ক্লাবের নাম ইস্টবেঙ্গল’, শান্তিপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়।
৫- http://www.thexplorateur.in/2019/02/Gosto-paul-bengal-footballer-untold-story.html?m=1
৬- https://www.bongodorshon.com/home/story_detail/goshtho-pal-was-the-first-captain-of-east-bengal
৭- https://m.risingbd.com/feature/news/237224/%E0%A6%9C%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%AE-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%96%E0%A7%87%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%9B%E0%A7%87%E0%A6%A8-%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%89%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A7%E0%A6%BF-%E0%A6%9A%E0%A7%80%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A7%80%E0%A6%B0)