চিনের তিয়ানানমেন স্কয়ারে একলা একটা মানুষ সারিবদ্ধ আস্ত ট্যাংক এর সামনে পথ আটকে দাঁড়িয়েছিল। ট্যাংক মানে যুদ্ধে ব্যবহৃত হয় যে কামান। ট্যাংক মানে আস্ত বাড়ি উঁড়িয়ে দিতে পারে যে। ট্যাংক ম্যান একলা পথ আটকে দাঁড়িয়েছিল।
ওই যে সিরিয়া থেকে ৫০০০ মাইল দূরে কোন শহরের ক’টা ছাত্র কোন দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ দেখালো তাতে পুটিনের কিচ্ছু এসে গেল না, পরের দিন আরো ৫০০টা শিশুর লাশ পাওয়া গেল। কিন্তু শেষ অবধি লড়াইটা দিয়েছিল তো কেউ৷ কে জানে ভিয়েতনামের মতো জিতলে ও জিততে পারে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া উই দা পিপল।
অনুরাগ কশ্যপ সরতাজ সিং না। নিজে লড়াইটা শেষ অবধি লড়তে পারেনি৷ চেষ্টা করেনি টুইটার পৃথিবীর ওই বিশাল ট্রোল বাহিনী আর আইটি সেলের মিথ্যাকে আটকানোর। টুইটার থেকে রেগেমেগে বেরিয়ে গেল হাফটাইমেই। আমরা বুঝতে পারলাম সবাই সরতাজ সিং না। আমরা ইতিমধ্যে জেনে গেছি সরতাজ সিং এর বাবা দিলবাগ সিং সরতাজকে বলেছিল তার চরম পরাজয়ের আগে, কোন লজ্জা নেই পুত্তর। তুমি অন্তত চেষ্টা করেছিলে।
এই ১০০% চেষ্টা করে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ আটকাতে না পারার মধ্যে কোন গ্লানি নেই। ইতিহাস ওই চেষ্টাটাকেই মনে রাখবে। যেভাবে কেরালাতে পিনারাই বিজয়ন সরকারকে মনে রাখবে। সবরীমালা মন্দিরে শতাব্দী প্রাচীন এক রীতিকে রদ করে মহিলাদের সমানাধিকার আর প্রার্থনার স্বাধীনতা দেওয়ার চেষ্টা। ভোটে হেরে গেছে এরা আগামী পাঁচ বছর কিন্তু আসছে ৫০ বছর এই বিপ্লবের চেষ্টা মনে থাকবে কোথাও কোন খাতায়। ওটাই ইনস্পেকটর সরতাজ সিংদের প্রাপ্তি৷
আমরা যারা রোজ ট্রামে বাসে অফিস ফেসবুকে মেলামেশা করি, আয়নায় নিজের আপোশ করা ক্লিন শেভ মুখটা দেখি, পিটিয়ে মারা হয়েছিল যে পেহেলু খানকে সেই কেসে সব্বাই বেকসুর খালাস হয়েছে তা খবরে দেখি, অর্থনীতির ভয়াবহ অবস্থা জেনে ও মন্দির কবে হবে তার খোঁজ রাখি, তারাই আসলে গনেশ গায়তোন্ডে।
গনেশ গায়তোন্ডেরা মারা যায় না। ওরা সত্যিই ব্রহ্মা। আমরাই গনেশ গায়তোন্ডে হয়ে সব কিছু জেনে বুঝে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণে সাহায্য করি। আমরাই হাত ধরে তমসাকে নিয়ে আসি আমাদের রান্নাঘর অবধি। একদিন দেখি আমাদের বন্ধুত্বগুলো বদলে দিয়েছে তমসা। ছেলেবেলার খানচাচাকে জেহাদি মনে হতে থাকে। নিজেকে ক্রমাগত অসুরক্ষিত মনে হতে থাকে নিজেরই দেশে। চাকরি নেই, বৃদ্ধি নেই, পরিশ্রত পানীয় জল নেই, পেটে ভাত নেই, উন্নয়ন নেই- সবকিছুর জন্য সংখ্যালঘু আর রিফিউজিদের দোষ দিতে ইচ্ছে করে। আমাদের গুরুজীর প্রবচন টুইটার, ফেসবুক, হোয়াইটস্যাপ এ আমাদের নিদান দেয়। ধর্মের আফিম সমস্ত সমস্যা ভুলিয়ে রেখে দেয় আর রাগী হতে বলে। এসব যতক্ষণে বুঝেছি, অনেক দেরী হয়ে গেছে। যারা লড়াইটা দিতো তারা ও টিবিতে আক্রান্ত হয়ে কমিউনে শুয়ে।
ধর্ম কোকেনের চেয়ে ভয়ানক নেশা। একবার অভ্যেস হয়ে গেলে আর ছাড়া দায়৷ আমাদের দেশে যেখানে রাজনৈতিক নেতারা টাকা কামাতে ব্যস্ত, বিজনেসম্যান পাব্লিকের পেছন মেরে ধান্দা করতে আর আদালত তারিখ পে তারিখ দিতে, সেখানে একটা ভগবান বা খোদার দরকার হয় যে ম্যাজিক জানে। যে ভরসা জোগায় নতুন সকালের, যে দাঙ্গাকে ধর্মযুদ্ধ বলতে পারে। কিংবা দৃঢ়তার সাথে মিত্র।
আমরা যারা গনেশ গায়তোন্ডে হয়ে রোজ প্রতিদিন এক পা এক পা করে এই বদলে যাওয়া দেশটাকে মেনে নিচ্ছি, স্টকহোম সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হয়ে পরছি, গোডসে ও হয়তো কোন মহৎ কারণে গান্ধীকে মেরেছিল তার একটা আলোচনা শুরু করছি, আসলে তারা গুরুজীদের হাত শক্ত করছি পারমাণবিক বোমা আমার শহরে, আমার পাড়ায়, চেনা গলিতে, ফ্রিজের তাকে, ঠাকুরের আসনের পাশে, শোয়ার ঘরে ঢোকাতে। যখন বুঝতে পারবো ‘লোচা’, নিউক্লিয়ার বোমের টাইমার অন হয়ে গেছে।
যে একটা কন্ঠ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধা দেখিয়েছিল বলে জেলে পচে মরছে, উন্নাও এর সেই মেয়েটি যে ধর্ষিতা হওয়ার পরে ও ক্ষমতাশালী বিধায়ককে জেলে পুরবে বলে শেষ দিন অবধি লড়াইটা দিল, ঘৃণার বিরুদ্ধে ভালোবাসার ডোজ দেবে বলে যে পাপ্পু চেষ্টা করেছিল বিশাল প্রতিপক্ষকে টক্কর দেওয়ার, ৭% ভোট আর শূন্য আসন হয়ে যাওয়ার পরে ও যে ছেলেমেয়েগুলো ভাবে আবার লড়াইটা লড়তে হবে, কিছু সহনাগরিক সাত পাঁচ না ভেবে যখন পিটিয়ে মারার ঘটনাগুলির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপের দাবি জানায়, বুঝতে হবে সরতাজ সিং একা ঢাল তলোয়ার হীন নিধিরাম সরদার হয়ে লড়াইটা লড়ছে না। তাই এতে কোন গ্লানি নেই। কোন লজ্জা নেই।
লজ্জাটা আমাদের ও না যারা মেরুদন্ডটি শুকোতে দিয়েছি। কারণ শেষ মেশ সরতাজ বা গায়তোন্ডে না, বাঁচবো আমরাই যারা পিঠ বাঁচিয়ে চলি।
পুনশ্চঃ সেক্রেড গেমস এর শিল্প বা সিনেমা জগতে এর পজিশন ইত্যাদি নিয়ে সমালোচনা করার প্রচুর লোক আছে। আমার মনে হয়েছে সেক্রেড গেমস একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলিল এসময়ের।
আমার এটা ও মনে হয়েছে যে কিছু মানুষ ট্যাঁ টুঁ করবে কারণ এক হিন্দু গুরুজীকে দেখানো হয়েছে পুরাণ, সংস্কৃত শ্লোক ইত্যাদি বলে যাবতীয় সন্ত্রাস, যৌনতা, নেশার কারবার চালাচ্ছে গোটা পৃথিবীতে। এতে অনেকের মনে হতেই পারে হিন্দুদের অপমান করা হয়েছে। আবার অনেকের মনে হতেই পারে, দেখতাম কোন মুসলমান গাজি বা খোদার বান্দাকে এই ভূমিকায় দেখালে কী হতো। ওরা অধম হইলে আমরা উত্তর হইবো না কেন? লড়াইটা তো হিন্দুদের পশ্চাৎপদে যাওয়ার না। বরং তমসাচ্ছন্ন গোঁড়ামির থেকে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে হাত ধরে উপরে তুলে আনার।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত