‘প্রাণ ভরিয়ে, তৃষা হরিয়ে…’ গানটা শুনতে শুনতে বারবার ফিরে যেতে তিন দশক আগে। দেবব্রত বিশ্বাসের গলায় এই গানের সঙ্গে তুলনা হয় না কারোর। সেই প্রবাদপ্রতিম শিল্পীর মৃত্যু বার্ষিকী আজ। ১৯৮০ সালে এইদিনেই এই সুর সম্রাট আমাদের ছেড়ে চলে যান। দেবব্রত বিশ্বাস শুধু প্রবাদপ্রতিম শিল্পী ছিলেন না, শিক্ষক হিসাবেও তিনি ছিলেন অসাধারণ। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে তাঁর নাম ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, তিনি শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস, যিনি পরিচিত মহলে ‘জর্জদা’ নামেও বিশেষ পরিচিত ছিলেন।
১১এ-র নাসিরুদ্দিন রোডের ছোট ফ্ল্যাটটিতে নতুন থিয়েটারের অবিস্মরণীয় সব প্রযোজনার সৃষ্টি হয়েছিল। পঞ্চাশের দশকের একেবারে গোড়ায় তৈরি হয়েছিল নাটককার তুলসী লাহিড়ী মহাশয়ের নাটক ‘ছেঁড়া তার’। তাঁর বাড়িই ছিল নাটকের আঁতুর ঘর। ভবিষ্যতে তাঁর নতুন প্রজন্মের বহু নাট্যকারের কাছে তিনিই ছিলেন মূলধন। তাঁর গানের কলি ভেসে উঠেছে মঞ্চে। নাটকের মঞ্চেও তিনি দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। ‘চার অধ্যায়’ নাটকের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন, এ কথা তো জানাই। সে-নাটকের প্রযোজনা ‘ছেঁড়া তার’ নাটকের পরবর্তীতে। সেই নাটকের সঙ্গীতের আবহ তাঁর হাতে তৈরি।
এমন একটি তর্ক নানা সময় উঠে আসে যে, দেবব্রত বিশ্বাসকে কি গড় বাঙালি সে ভাবেই ভালবেসে ফেলল, যে ভাবে তারা ভালবেসেছে কর্ণকে? কর্ণের মহিমা কতটুকু বোধগম্য হয়েছে বলা কঠিন, কিন্তু তাঁর সেই নিয়তিনিহত পুরুষকারের সামনে বাঙালি একেবারেই নতজানু। দেবব্রতের জীবনকাহিনিটি নিছক মুখরোচক কিছু অ্যানেকডোটের বাইরে ইতিহাসের একটা বৃহত্তর শিক্ষার মতো দেখা দেয়। প্রতিটি মানুষকেই নিজস্ব জীবনে নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ‘পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা’ কথাটা যেমন জনসমষ্টির ক্ষেত্রে সত্য, তেমনই ব্যক্তিগত জীবনেও। সকলকে সে রকম একটা ওঠাপড়ার পথেই এগোতে হয়। সেই পথের কিছুটা হয়তো ছকে-বাঁধা, কিছুটা আবার ছকের বাইরে। সেই ছকবন্দি আর ছক-ভাঙার খেলা নিয়েই চিরকালের জীবনযাপন। এই জীবন যাপনই ছিল দেবব্রত বিশ্বাসের।
মৃত্যুর প্রায় তিনদশক পরেও তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত জগতের অন্যতম জনপ্রিয় শিল্পীরূপে পরিচিত। দেবব্রত বিশ্বাস প্রায় ৩০০ রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেন। রবীন্দ্রসংগীতই তাঁর প্রধান সংগীতক্ষেত্র ছিল। কিন্তু জীবনকালে বারবার রবীন্দ্র সঙ্গীত নিয়ে বিশ্বভারতীর সঙ্গে সংঘাত লেগেছে তাঁর। ১৯৬৪ সালে এই মতপার্থক্য শুরু হয়। এই মতভেদ এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে একসময় তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়াই বন্ধ করে দেন। ১৯৭১ সালের পর থেকে আর তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেননি। রবীন্দ্র সঙ্গীতের জগতে বহু মানুষ নিজেদের স্থান পাকা করে নিলেও আজও দেবব্রত বিশ্বাসের গান সঙ্গীত প্রেমীদের মনে গভীর দাগ ফেলে দেয়। আজও তিনি অমর হয়ে আছেন তাঁর সৃষ্টি গুলোর মধ্যে দিয়ে। নিভৃতে, নির্জনে তাঁর গান মানুষের মন উদ্বেলিত করে তোলে। ঝড় তোলে মানস মননে।