মেঘলা আকাশের নীচেও লালের পাশে জ্বলজ্বল করছে সোনা রং। গাড়ি থেকে নেমে যিনি ইন্ডোর স্টেডিয়ামের ভিতর চলে গেলেন, তাঁকে চিনিয়ে দেবে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সমর্থক-সদস্যদের স্লোগান। স্টেডিয়ামের ভিতরে অবশ্য শুরুতে গ্যালারির দর্শকরা খেয়াল করেননি। মঞ্চে তখনও যন্ত্রীরা সারছেন শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। মঞ্চের পিছন দিয়ে গেস্ট রুমে যাওয়ার সময় হঠাৎ চোখ পড়ল লাল-হলুদ জনতার। আরও একবার সমবেত কোরাস, ‘মজিদ-মজিদ’। আশির বাদশা ভক্তদের সেই ভালবাসা গ্রহণ করলেন। জানালেন, ইস্টবেঙ্গল তাঁর হৃদয়ে। আর এভাবেই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকল স্পোর্টস ডে-তে ইস্টবেঙ্গলের শতবার্ষিকী উদযাপন।
১৯৭০ সালে ইডেনে আইএফএ শিল্ড ফাইনালে ইরানের পাস ক্লাবের বিরুদ্ধে সেই ঐতিহাসিক গোল। ইস্ট বেঙ্গল জনতার একদা ‘হার্টথ্রব’ পরিমল দে শারীরিক অসুস্থতায় অনেকটাই ন্যুব্জ। মঙ্গলবার নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে ক্রীড়া দিবসের মঞ্চে ছয়ের দশকে লাল-হলুদের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবলারের গালে চুম্বন এঁকে দিলেন আশির বেতাজ বাদশা মজিদ বাসকার। কারণ, তখন পাস ক্লাব ছিল ইরানের অন্যতম সেরা ক্লাব। নিঃসন্দেহে এদিনের গোটা অনুষ্ঠানের সেরা দৃশ্য এটি। দু’জনের আলিঙ্গন একেবারেই হার্দিক।
বন্ধু জামশিদ নাসিরিকে সংবর্ধনা দেওয়ার সময়ে মজিদ নিজেই আবেগতাড়িত। স্নেহের সঙ্গে কাছে টেনে নিলেন জামশিদকে। মঞ্চে উঠে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না অনেকে। ইস্টবেঙ্গলের স্পোর্টস ডে-তে সকাল থেকে সন্ধে ব্যস্ত থাকলেন মজিদ। এ বারের স্পোর্টস ডে ছিল সব অর্থেই ব্যতিক্রমী। কারণ শহরে উপস্থিত মজিদ। ক্লাবের রক্তদান শিবিরে সকালেই উপস্থিত হন ইরানি-তারকা। রক্তদাতাদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায় ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তন তারকাকে। সন্ধেয় আগাগোড়া মঞ্চে ছিলেন তিনি। তাঁর পরনে ছিল ১২ নম্বর জার্সি। এই জার্সি পরেই তো একদিন ভক্তদের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন মজিদ। আজ এত বছর পরে তিনি দেখলেন ভক্তদের কাছে তিনি বাদশা হিসেবেই রয়ে গিয়েছেন।
এদিন ইস্ট বেঙ্গলের শতবর্ষের স্মরণীয় ক্রীড়া দিবস অনুষ্ঠানে চাঁদের হাট বসেছিল। ছয় থেকে নয়ের দশক পার করে লাল-হলুদে খেলে যাওয়া ফুটবলাররা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলেন অনুষ্ঠান। ৩২ বছর পর দেখা হতেই ‘মজিদ-জামশিদ’ জুটির মঞ্চে সখ্যতা দেখে বোঝাই যাচ্ছিল খেলার মাঠে তাঁদের বোঝাপড়া কী ধরনের ছিল! মজিদের গলায় লাল-হলুদ উত্তরীয় পরিয়ে দেন জামশিদই।
শুরুতে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন তিন অতিথি- সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদার, নাট্য ব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত ও ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। মঞ্চে তখন উপস্থিত মজিদ বাসকার, আশিয়ান কাপ জয়ী দলের অধিনায়ক ঘানার সুলে মুসা। মঞ্চে উপবিষ্ট প্রত্যেক অতিথিকে আজীবন সদস্যপদ দিয়ে সম্মানিত করে ইস্ট বেঙ্গল ক্লাব। অরিজিৎ সিংহের গলায় গাওয়া ইস্টবেঙ্গলের থিম সং উদ্বোধন করেন ইস্টবেঙ্গলের প্রেসিডেন্ট প্রণব দাশগুপ্ত।
ছ’য়ের দশক থেকে শুরু হয় ইস্ট বেঙ্গল অধিনায়কদের সংবর্ধনা পর্ব। ছ’য়ের দশকের তিন ফুটবলার সুকুমার সমাজপতি, চন্দন ব্যানার্জি, পরিমল দে’কে দেখে আবেগে ভেসে যায় ইস্ট বেঙ্গল জনতা। তাঁরা হাত তুলে অভিবাদন গ্রহণ করেন সমর্থকদের। এরপর সাতের দশকের অধিনায়কদের বরণ করে নেওয়ার পালা। সুনীল ভট্টাচার্য, স্বপন সেনগুপ্ত, সমরেশ চৌধুরি, শ্যামল ঘোষ, শ্যাম থাপা, সুরজিৎ সেনগুপ্ত, প্রশান্ত ব্যানার্জি প্রমুখ। তবে ১৯৭৯ সালের অধিনায়ক প্রশান্ত ব্যানার্জি যখন বললেন, ‘ইস্ট বেঙ্গল জার্সি গায়ে মাঠে নামলে ৩০ শতাংশ সেরাটা দেওয়ার ক্ষমতা থাকলে সমর্থকদের চিৎকারে সেই ক্ষমতা বেড়ে ১০০ শতাংশ হয়ে যেত।’ সঞ্চালক মীরের অনুরোধে প্রশান্ত ব্যানার্জির বক্তব্যে গরম হয়ে ওঠে ইনডোরের গ্যালারি।