ছোঁয়া তত সহজ ছিল না। চোখে চোখ রাখাও! আড়চোখে চেয়ে থাকায় শুধু বয়ঃসন্ধির কাঙালকষ্ট। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম আর প্যান্টের পকেটে ভাঁজ করা রঙিন কাগজ, চিঠি। প্রেমপত্র। যা চোরাগোপ্তা পাচার হবে। কেউ জানবে না। শুধু লালচে আভা ক্ষণিকের জন্য হানা দেবে দু’জনের কানের ডগা। হাতবদল হয়ে যাবে শব্দরা। স্পর্শ, স্পর্শ, স্পর্শ করে নেবে ওর আঙুল।
আমরা সকলেই কখনও না কখনও প্রেম নামক এক সাংঘাতিক গুপ্তসমিতির সদস্য ছিলাম। সকলের প্রমাণপত্র এখন তোরঙ্গগর্ভে। থাক সেখানে। উন্মাদের মধুমাস রয়ে যাক নিরুদ্দেশে। শুধু স্বাক্ষী রয়েছে সেইসব শব্দেরা। এমন দারুণ কুটিরশিল্প কেউ রচনা করেছে আগে? এমন ‘টু দ্যা পয়েন্ট’ অ্যানসার কেউ লিখেছে পরীক্ষায়? যেমনটা, ঠিক যেমনটা কেউ লিখেছে প্রেমপত্রে! কে শেখাল এমন নিপুন সান্ধ্যভাষা, যা শুধু পড়তে পারে অপরজন! কে বলে দিল, ওই শব্দটা লিখে আলতো করে কেটে দিতে হয়। বাকিটা ও ঠিক পড়ে নেবে। ঠিক বুঝে নেবে বালিশ।
বিশেষ যত্নে রচিত হয় প্রেমপত্রের লিপি। কিনতে হয় ফুলেল প্যাড। তার প্রত্যেক পাতায় আবছা ফুলছাপ। ধূসর, ফিকে-রং মায়াগাছ নেপথ্যে। ওই বাগান দিয়ে হেঁটে যায় কলম। মুক্তোর মালার মতো গাঁথতে হয় হাতের লেখা। ছড়াতে হয় কস্তূরীগন্ধ।
ভোররাতে শেষ হওয়া চিঠির মার্জিনে লম্বালম্বি করে পুনশ্চ। সেখানে অবশ্য একটাই কথা একশো একুশবার। ইংলিশ কোচিংইয়ের সৌরভ কেন তোমায় বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলল গোছের অনুযোগ। মাসিমা বোধহয় বুঝতে পারার পর ব্যবহার বদলে ফেলেছেন-এর আশঙ্কা। আমি কিন্তু খুব খারাপ। খুব খারাপ ছেলে-এর কষ্টবিলাস। এইসব উতোরচাপান অন্তে মার্জিনে ছোট্ট করে, বুঝলে, তাছাড়া তোমায় অবশ্য…। যেন ওই কথাটুকু না লিখলেও দিব্যি চলত। ও কথা যেন লেখারই নয় একদম। তবু লিখে দেয় সুলেখা কলম। আসলে ওই বাক্যটার জন্যেই তো এত ধানাইপানাই। ওই বাক্যটার জন্যেই পাগলা জগাইয়ের পাগলাসানাই। মেয়েটির পুনশ্চ-য় অবশ্য অত কায়দা নেই। সোজাসুজি, স্ট্রেটকাট। মা বলেছে, রেজাল্ট যদি খারাপ হয় এসবের জন্য, বিয়ে দিয়ে দেবে। বাক্যের শলাকা ফুঁড়ে দেয় ছেলেটাকে। সে নতুন বাক্য সাজাতে থাকে। বিয়ে হোক না হোক, চিঠিটা হওয়া দরকার।
তাক থেকে নামানো মিলটন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, রবীন্দ্রনাথ-রা বিছিয়ে যায় পত্রের কোনে কোনে। অলংকারে সেজেগুজে ওঠে লেখা। যেন একটা উদ্ধৃতিও বাদ না যায়। যেন হয়ে থাকে শিক্ষিত প্রেমের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কোনোদিন ছাপা হলে যেন লোকে বলে, সেই লিখেছিলেন রোজেনবার্গ, আর এই লিখলেন বাংলার বাঘ। তো ছেলেটি লেখে, পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি…মেয়েটা ঠোঁট বেঁকায়, বলে, ‘আস্ত ঢ্যাঁড়শ একটা।’
‘শোনো, ঢ্যাঁড়শ নামে ডাকবে না আমায়, একটা ভালো নাম কী দিতে নেই? আমি তোমায় দিচ্ছি রাজকন্যার মতো সব নাম, সোনামনের মতো নরম, মানতাসার মতো নামের গয়না আর তুমি বলছ ইয়ে…।’ ‘আচ্ছা বাবা, দিচ্ছি।’ মেয়েটা কানের কাছে মুখ নিয়ে আসে। যেমন সবাই নিয়ে এসেছে আবহমানকাল। ছেলেটির কানের লতির কাছে ঈষৎ বিপন্ন মেয়েটির ঠোঁট। মেয়েটি খুব কাছে যখন তখন তার টিকালো নাক ছোঁয় কর্ণকুন্তল। সামান্য চকমকি যেন জ্বলে ওঠে প্রত্যেকবার। মেয়েটা সজোরে কু-উ-উ করে দেয় ছেলেটার কানে। ছেলেটা ভেতরে ভেতরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, বাইরে কপট রাগ। এই বুঝি নাম? এটা কী হল! মেয়েটা কেবল হাসে। হাসতে হাসতেই বলে, ‘কালকের চিঠিতে পাবে।’ পরদিনের চিঠিতে ছেলেটা পেল নতুন নাম। ক্যাবলা।
প্রতিটি ভালোবাসার চিঠির নতুন উপহার, আদরনাম। রোজ রোজ, সবদিন। ওই নামটা না থাকলে সব মিথ্যে। ওই নামে ডাকতে হয় ফিসফিস করে। তবেই জেগে ওঠে পদ্মকাঁটারা, বেজে ওঠে শুদ্ধরাগ। এমন প্রেমিক-পাষন্ড ধরাধামে কে আছে, যে তার আদুরীকে দেয়নি নতুন নাম। এমন হতভাগিনীইবা কে, যে ভালবেসে পেল না গোপন নাম। রাজপথে নয়, এসব নামেরা থাকে অন্তরালে, দু’জনের ছায়ায় ছায়ায়।
ভালোবাসার চিঠি শুধু ভালবেসেই লেখা যায়। ও জিনিস মকশো করে হয় না কখনও। এখন সেসবের ঠিকানা কোনও কাঠের বাক্স। চিঠিগুলোর ভাঁজে ভাঁজে রয়ে গেছে ক্যাডবেরির পুরনো রাংতা, একটা খুব লম্বা চুল আর ঈষৎ পুরনো একটা চুলকাঁটা। বহুদিন, বহুদিন তারা আছে ওখানে। একে অপরকে আঁকড়েপাকড়ে বুকে চেপে, এর কালি ওর অঙ্গে লেপ্টিয়ে, এর আঙুল ওর আঙুল ছুঁয়ে ঘুমিয়ে আছে অকাতরে।