“মাম্পি আর কার্টুন নয়, এবার অফ করো”
“মা আর একটু ডোরেমন দেখি প্লিজ”
হ্যাঁ৷ আমাদের শৈশব জুড়ে যে সমস্ত রঙীন অধ্যায়েরা আছে, তাদের মধ্যে কার্টুন কিন্তু অন্যতম৷ আর কার্টুন বলতেই ডোরেমন, শিনচ্যান, নোবিতাদের নাম প্রথমে আসে৷ তবে অনেকেরই একটু পছন্দ ডোরেমনকে৷ ডোরেমন যেন একটু বেশিই আদরের, ভালোবাসার৷ আচ্ছা, কোথা থেকে কীভাবে সৃষ্টি হল এই ভালোবাসার চরিত্রটি?
আসলে ডোরেমন হলো টোকিওর নোবি পরিবারের ছেলে নোবিতা নোবির বন্ধু, যে কিনা নোবি পরিবারেরই আরেক সদস্যের মতো। মা-বাবার একমাত্র সন্তান নোবিতা পড়াশোনায়ও যেমন মহা ফাঁকিবাজ, আর বাকি সব ক্ষেত্রেও অকর্মণ্য। তার কাছের তিন বন্ধু হলো বিশালবপু জিয়ান, ধনীর দুলাল সুনিও ও মিষ্টি বালিকা শিজুকা। এই কয়জনের বন্ধুত্ব, ঝগড়া, ভালোবাসার সাথে তাদের পারিবারিক জীবন, স্কুল জীবনের নানা টক-ঝাল-মিষ্টি অভিজ্ঞতা নিয়েই মূল গল্প।আর ডোরেমনের কাজ হলো সবসময় নোবিতার ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকা ও নানা গ্যাজেট দিয়ে নোবিতাকে সাহায্য করা।
কোথা থেকে এল আদরের ডোরেমন? ডোরেমন সর্বপ্রথম বাজারে এসেছিলো ম্যাঙ্গা (জাপানী কমিক) সিরিজ হিসেবে, যার জনক ছিলেন ফুজিকো এফ ফুজিও। ফুজিওর প্রকৃত নাম অবশ্য ছিলো হিরোশি ফুজিমতো। হিতোৎসুবাশি গ্রুপের শোগাকুকান প্রকাশনীর ৬টি শিশুতোষ ম্যাগাজিনে ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ডোরেমন ম্যাঙ্গা ছাপা হয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় লেখা হয়েছিলো ১,৩৪৪টি গল্প, ‘৯৬ পর্যন্ত যা ৪৫টি খণ্ডে ছাপা হয়েছে।
তবে ডোরেমন ম্যাঙ্গা বা অ্যানিমের প্রারম্ভে এটি বলা হয় না যে, ডোরেমনের জন্ম ও ভবিষ্যৎ থেকে নোবি পরিবারে আগমন কীভাবে। ১৯৯৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘২১১২: ডোরেমন’স বার্থ‘ চলচ্চিত্রটিতে এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়, কেননা সেটি ছিলো অনেকটা গোটা সিরিজের প্রিক্যুয়েলের মতো। ২১১২ সালে মাৎসুশিবা রোবট ফ্যাক্টরিতে ডোরেমনের জন্ম। নোবিতার উত্তরসুরী সিবাশির সাথে তার পরিচয় কীভাবে এবং ডোরেমন ইঁদুর রোবটের কামড়ে তার কান কীভাবে হারায়, কান হারাবার পর ডোরেমনের গার্লফ্রেন্ড কীভাবে তাকে ছেড়ে চলে যায়, সবই দেখানো হয় তাতে। হলুদরঙা ডোরেমন বিষণ্ণতায় ‘স্যাডনেস’ নামক সুধা পান করে ফেলে। তার অনর্গল অশ্রুতে ভিজে দেহের হলুদ রঙ ধুয়ে গিয়ে নীল হয়ে যায়।
তবে শুধু ডোরেমনকে নিয়ে কথা বললে ওর বন্ধুরা রাগ করবে৷ তাই এবার ছোট্ট করে বাকিদেরও পরিচয় জেনে নেওয়া যাক৷ গল্পের অন্যতম প্রধান চরিত্র নোবিতা হলো টোকিওর নেরিমা ওয়ার্ডের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। ইয়া বড় এক গোল চশমা ছাড়া সে চোখে ভালো দেখে না। এক দুষ্টুর যতরকম ত্রুটি থাকতে পারে, তার সবটাই আছে নোবিতার। অলস, অগোছালো, অপ্রত্যুৎপন্নমতী, রোগা-পলকা, খেলায় অপটু। নোবিতার ভাগ্যটাও কেন যেন সহায় হয় না তার কোনো সময়েই। রোজ দেরি করে ক্লাসে যাওয়া, ক্লাস টেস্টে শূন্য পাওয়া, শিক্ষকের ধমক খাওয়া আর হোমওয়ার্ক নিয়ে মায়ের সাথে তর্ক করা তার প্রাত্যহিক রুটিন।
নোবিতার জীবনে সবচেয়ে বড় ভোগান্তির নাম দুই বন্ধু জিয়ান ও সুনিও। কুকুরের তাড়া আর জিয়ান-সুনিওর মার খাওয়া ছাড়া নোবিতার দিন-গুজরান দুর্লভ! মোটা জিয়ান সবসময় গায়ের জোর খাটিয়ে নিজেকে মারামারি ও খেলার মাঠে নেতা প্রমাণে ব্যস্ত এবং তার সবচেয়ে বড় তোয়াজকারী হলো সুনিও, যার রয়েছে টাকার গরম! হেঁড়ে গলায় গান গাইতে জিয়ানের জুড়ি মেলা ভার! জিয়ানের নয়নমণি ছোটবোন জাইকোর সাথে নোবিতার বিয়ে হওয়ার কথা থাকলেও ডোরেমন তার ভবিষ্যৎ পাল্টে দেয় শিজুকার মাধ্যমে।
শিজুকা মিনামোতো হলো নোবিতার হেরো-শ্রান্ত জীবনে এক চিলতে প্রশান্তির। মিষ্টি এই মেয়ে নোবিতা, জিয়ান, সুনিওরই সহপাঠী ও প্রতিবেশী। নোবিতার ঠিক উল্টো হলো শিজুকা, যতটা সম্ভব ‘নিখুঁত’ লক্ষ্মী একটা মেয়ে সে। নোবিতা তাকে অনেক পছন্দ করে, এই শিজুকার কাছে ভালো সাজতে গিয়ে হতভাগা নোবিতা প্রায়শ বিদঘুটে পরিস্থিতির জন্ম দেয়। কিন্তু তারপরও সহজ-সরল পরোপকারী নোবিতার জন্য একটা জায়গা শিজুকার মনেও রয়েছে, যদিও তা নোবিতার মতো প্রবল নয়। আর আছে নোবিতার আনমনা বাবা ও চিন্তিত মা, সুনিওর গয়না ও আত্মপ্রেমী মা, জিয়ানের মুদি দোকানদার মা, গানারি নামক অন্তঃপ্রাণ স্কুলশিক্ষক, আজন্ম ‘ফার্স্টবয়’ ডেগিজুকি প্রমুখ।
আচ্ছা ডোরেমন কেন এত জনপ্রিয় জানেন? কল্পনাপ্রবণ শিশুদের হাঁপিয়ে ওঠা স্কুলজীবনে গ্যাজেটের থলিওয়ালা ডোরেমন প্রশান্তিই দিয়েছিলো। মন চাইলো তো মাথায় ব্যাম্বো কপ্টার লাগিয়ে উড়ে গেলাম, মন চাইলো তো টাইম মেশিনে করে দেখে এলাম ডাইনোসরের যুগ, মন চাইলো তো এনিহোয়্যার ডোরে ডুব দিয়ে চলে গেলাম মাউন্ট ফুজির দৃষ্টিনন্দন প্রান্তরে কিংবা অন্য কোথাও! শুধু শিশু কেন, এমনটি কল্পনা করতে কে না ভালোবাসবে? ভালোবাসার এই দুর্বলতম স্থানটিতে…