“আমাদের সূর্য মেরুন, নাড়ির যোগ সবুজ ঘাসে
আমাদের খুঁজলে পাবে, সোনায় লেখা ইতিহাসে”
আজ মোহনবাগান দিবস। এবারের মোহনবাগান রত্ন পেলেন কেশব দত্ত। রবিবার বিকেলে সন্তোষপুর সার্ভে পার্কে কেশব দত্তর বাড়িতে গিয়ে তাঁর হাতে মোহন বাগান রত্ন তুলে দিলেন মোহন বাগান সভাপতি গীতানাথ গাঙ্গুলি। গতকাল ময়দানের রঙ লাল-হলুদ থাকলেও বিকেল থেকে তা বদলে যায় সবুজ-মেরুনে। মোহনবাগান রত্নের পাশাপাশি মোহনবাগান দিবসেই গত মরশুমের সেরা খেলোয়াড়রা পুরস্কার পাবেন। ২০১৮-১৯ মরশুমে মোহনবাগানের সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হয়েছেন অরিজিত বাগুই। সেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হয়েছেন রাজকুমার পাল। সেরা অ্যাথলিটের পুরস্কার পেয়েছেন তাপস দে। সেরা যুব দলের শিরোপা পাচ্ছে মোহনবাগানের অনূর্ধ্ব-১৯ দল। বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের জন্য সম্মানিত করা হবে মহম্মদ শামিকেও। এছাড়া এ বছর মোহনবাগানের লাইফটাইম মেম্বারশিপ পাচ্ছেন চুনী গোস্বামী, ভাস পেজ, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রসেনজিত চট্টোপাধ্যায়, এবং দেবশংকর হালদার।
আজ গোষ্ঠ পালের মূর্তিতে মালা দিয়ে শুরু অনুষ্ঠান। বিকেল তিনটে থেকে ক্লাবের মাঠে হচ্ছে প্রাক্তন ফুটবলারদের মধ্যে একটি প্রদর্শনী ম্যাচ। সাড়ে ছ’টায় শুরু হবে মূল অনুষ্ঠান। উপস্থিত থাকবেন রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। সংবর্ধনা দেওয়া হবে আইএফএ-র নতুন সচিব জয়দীপ মুখোপাধ্যায়কেও। এরপর সম্মান জ্ঞাপন পর্ব। পি কান্নন স্মৃতি পুরস্কার পাবে মোহনবাগান জুনিয়র ফুটবল টিম। ভোলা মাহাতো স্মৃতি পুরস্কার পাবেন বর্ষসেরা অ্যাথলিট তাপস দে। ধীরেন দের স্মৃতি পুরস্কার পাবেন বর্ষসেরা ক্রিকেটার রাজকুমার পাল। করুণাশঙ্কর ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরস্কার পাবেন বর্ষসেরা ফুটবলার অরিজিৎ বাগুই। সেরা ক্রীড়াব্যক্তিত্বের পুরস্কার নিতে অবশ্য হাজির থাকতে পারছেন না জাতীয় ক্রিকেটার মহম্মদ সামি। তবে অসুস্থতা সত্ত্বেও জীবন কৃতি সম্মান নিতে থাকবেন অশোক চট্টোপাধ্যায়। আজীবন সদস্যের কার্ড নিতে মঞ্চে ওঠার কথা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, চুনী গোস্বামী, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, দেবশঙ্কর হালদারদের। এই তালিকায় ভেস পেজ থাকলেও তিনি আসতে পারছেন না।
ইতিহাস বলে, দেশের অন্যতম প্রাচীন ক্লাব মোহনবাগান সেই ১৯১১ সালে এ দিনেই গোরাদের হারিয়ে আইএফএ শিল্ড জিতেছিল। সে দিন খালি পায়ে ফুটবল খেলে ইস্ট ইয়র্কশায়ারকে ২-১ গোলে হারিয়ে প্রথম ভারতীয় ক্লাব হিসাবে আইএফএ শিল্ড জিতেছিল মোহনবাগান। ওই দিনের কথা স্মরণ করেই প্রতি বছর ২৯ জুলাই ‘মোহনবাগান দিবস’ পালিত হয়। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে খালি পায়ে খেলার দাপট যেভাবে দেখিয়েছিল মোহনবাগান খেলোয়াড়রা, সেই স্মৃতি আজও অমলিন।
উত্তর কলকাতার মোহনবাগান অঞ্চলের মিত্র ও সেন পরিবারের সাহায্যে ভূপেন্দ্রনাথ বসু ১৮৮৯ সালের ১৫ অগস্ট ‘মোহনবাগান স্পোর্টিং ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেন। কথিত আছে যে মোহনবাগান ভিলায় ইডেন হিন্দু হোস্টেলের বিরুদ্ধে এই দল প্রথম খেলেছিল। প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ঠিক আগে অধ্যাপক এফ. জে. রো জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, এই দল কোনও রাইফেল শ্যুটিং বা আংলিং বা এই জাতীয় খেলার সঙ্গে যুক্ত কিনা। মোহনবাগান এই জাতীয় খেলার সঙ্গে যুক্ত নয় জেনে তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন দলের নাম পালটে ‘মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাব’ রাখতে। ক্লাবের কর্মকর্তারা এই পরামর্শ মেনে নিয়ে ক্লাবের নাম পরিবর্তন করেন। ১৮৯১ সালে কলকাতার শ্যামপুকুর অঞ্চলে এই দল চলে আসে। পরে এই দল উঠে যায় শ্যাম স্কোয়ার অঞ্চলে।
১৮৯৩ সালে মোহনবাগান কোচবিহার কাপে অংশগ্রহণ করে। এটিই ছিল ক্লাবের প্রথম টুর্নামেন্ট। পরবর্তীকালে মোহনবাগান কোচবিহার কাপ ও ট্রেডস কাপ সহ বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু জয়লাভে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীকালে কলকাতা পৌরসংস্থা শ্যাম স্কোয়ার নামে একটি সরকারি স্কোয়ার উদ্বোধন করলে, এরিয়ান ও বাগবাজার ক্লাবের সঙ্গে মোহনবাগান এই স্কোয়ারে জায়গা পায়। ১৮৯৫ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত শ্যাম স্কোয়ার ছিল মোহনবাগানের তৃতীয় মাঠ।
১৯০৪ সালে কোচবিহার কাপে অংশ নিয়ে মোহনবাগান প্রথম ট্রফি জেতে। হেয়ার স্পোর্টিং ক্লাবের বিরুদ্ধে ১৫ই অগস্ট প্রথম দিনের ফাইনাল ০-০ ড্র হয়। কিন্তু রেফারির সঙ্গে অসঙ্গত আচরণের জন্য হেয়ার স্পোর্টিং ক্লাবকে আইএফএ এই টুর্নামেন্ট থেকে বহিষ্কার করে। তাই মোহনবাগান জয়ী ঘোষিত হয়। ১৯০৫ সালে তারা আবার এই ট্রফি জিতেছিল। ২রা অগস্ট মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাবের বিরুদ্ধে প্রথম দিনের ফাইনাল ১-১ ড্র হয়। ৫ই অগস্ট পুনরনুষ্ঠিত ফাইনালে মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাবকে ১-০ গোলে হারিয়ে পরপর ২ বার কোচবিহার কাপ জিতে নেয় মোহনবাগান। এরপরে ১৯০৭, ১৯১২, ১৯১৬, ১৯২১, ১৯২২, ১৯২৫, ১৯২৮, ১৯৩১, ১৯৩৫, ১৯৩৬, ১৯৪১, ১৯৪৪, ১৯৪৮, ১৯৪৯, ১৯৬২ এবং ১৯৭২ সালেও এই কাপ জিতে মোট ১৮ বার চ্যাম্পিয়ন হয় মোহনবাগান। এই ১৯০৫য়েই চুঁচুড়ায় আয়োজিত গ্ল্যাডস্টোন কাপের ফাইনালে মোহনবাগান তৎকালীন আইএফএ শিল্ড জয়ী ডালহৌসিকে ৫-০ গোলে পরাজিত করে তাদের ৩য় ট্রফি জেতে। ১৯০৬ সালেও গ্ল্যাডস্টোন কাপ জিতে নেয় মোহনবাগানই। এর পরে ১৯০৮ এবং ১৯১১ সালেও গ্ল্যাডস্টোন কাপ জিতে নিয়েছিল মোহনবাগানই। সবসমেত ৪ বার।
১৯০৬ সালে মোহনবাগান ট্রেডস কাপ ও গ্ল্যাডস্টোন কাপ এক সঙ্গে জয় করে। ১৯০৭ সালে মোহনবাগান আবার ট্রেডস কাপ জেতে। ১৯০৮ সালেও এই কাপ জিতে পরপর তিন বছর এই কাপ জয়ের রেকর্ড সৃষ্টি করে মোহনবাগান। ১৯০৬ আর ১৯০৮, দু’বারই ফ্রি স্কুলকে ফাইনালে হারিয়েছিল মোহনবাগান, ২ বারই ১-০ গোলের ব্যবধানে। তার পরেও আরও ৮ বার (১৯৩৮, ১৯৩৯, ১৯৪৩, ১৯৪৪, ১৯৪৫, ১৯৪৯, ১৯৫০ এবং ১৯৬৫ সালে), অর্থাৎ মোট ১১ বার ট্রেডস কাপ জেতে মোহনবাগান।
আজও মোহনবাগানের নামে উত্তাল হয়ে যায় বাঙালির আবেগ, বাঙালির উচ্ছ্বাস, বাঙালির ভালবাসা। বাঙালির দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে ওঠে মোহনবাগান। বাঙালির মানসিকতায় দারুণ প্রভাব ফেলে রোমাঞ্চকর এই খেলাটি। এভাবেই বাঙালির রোজকার ব্যস্ততায় একটুকরো ফুরফুরে বাতাস হয়ে থাকুক মোহনবাগান।