এমন একটা সময় ছিল, যখন সমাজে নারীকে দেবী হিসেবে পূজো করা হতো, পাশাপাশি সতীদাহও করা হতো। তেমনই এক সময়ে, ১৭৯৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর কলকাতা থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে হালিশহরের কাছাকাছি কোনা নামক এক গ্রামে এক দরিদ্র শুদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লোকমাতা রানি রাসমণি। তাঁর মা রামপ্রিয়া দাস এবং বাবা হরেকৃষ্ণ দাস ছিলেন গরীব কৃষক দম্পতি। আর দশটা কৃষিজীবী পরিবারের মেয়ের মতোই রাসমণির দিন কেটেছিল ঘর গেরস্থালির কাজ করে আর বাবার জন্য মাঠে খাবার নিয়ে গিয়ে।
তবে হরেকৃষ্ণ দাস গরীব হলেও লেখাপড়া জানতেন এবং মনমানসিকতার দিক থেকেও আর দশটা মানুষের চেয়ে অনেক উন্নত ছিলেন। আর তাই বাবার হাতেই রাসমণির প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয়, বাবা তাকে অনেক গল্প শোনাতেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় গ্রামের লোকেরা হরেকৃষ্ণ দাসের বাড়িতে জমায়েত হতো মহাভারত, গীতা, পুরান পাঠ শোনার জন্য। ছোট্ট রাসমণি হারিয়ে যেতেন সেসব গল্পের মাঝে। এবং এর ফলে ধীরে ধীরে তার অন্তরে ধর্মের প্রতি ভালবাসার বীজ রোপিত হয়।
১৮০৪ সাল। কলকাতার জানবাজারের অভিজাত জমিদার পুত্র বাবু রাজচন্দ্র দাস স্ত্রী বিয়োগের শোক কাটাতে গঙ্গায় বজরা ভাসিয়েছেন। তখন জমিদারপুত্রের বয়স মাত্র ২১ বছর। ঘাটের দিকে চোখ ফেরাতে হঠাৎ অপরূপ রূপবতী ১১ বছর বয়সী রাসমণিকে দেখলেন। তার সৌন্দর্যে রাজচন্দ্র মুগ্ধ হলেও, পর পর দুই স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি আর কোনো সম্পর্কে জড়াতে চাননি। কিন্তু জমিদার পুত্র বলে কথা। আর তাই পরিবারের সদস্যরা তাকে আবার বিয়ে করাতে উঠে পড়ে লাগে গেল।
এদিকে আবার রাসমণি নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে এবং সবচেয়ে বড় কথা, জাতে শুদ্র। তবে তাতে কী? প্রগতিশীল রাজচন্দ্র জাত, শ্রেণীভেদ এবং তৎকালীন সমাজের অন্যতম বিষফোঁড়া যৌতুক- সবকিছুকে গুঁড়িয়ে দিয়ে রাসমণিকে বিয়ে করে জানবাজারের প্রাসাদে স্থান দেন। আর গ্রাম্য কিশোরী রাসমণিও খুব সহজেই এই অভিজাত পরিবারের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেন। রাজচন্দ্রের পিতা প্রীতরাম ছিলেন ব্রিটিশদের বিভিন্ন পণ্য সরবরাহকারী। ১৮১৭ সালে প্রীতরামের মৃত্যু হলে রাজচন্দ্র তৎকালীন ৬ লক্ষ ৫০ হাজার রুপি নগদ অর্থ এবং বিশাল সম্পত্তির মালিক হন।
তবে রাজচন্দ্র কিন্তু বাবা প্রীতরামের মতো শুধুমাত্র বৈষয়িক এবং হিসেবী জমিদার ছিলেন না। সামাজিক নানা দাতব্য কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। আর পর্দার অন্তরাল থেকে সাহস যোগাতেন রাসমণি। শুধু তাই নয়, সেই সমাজে অভিজাত নারীদের পর পুরুষের সামনে বের হওয়া নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু রাসমণি প্রায়ই পর্দার অবগুন্ঠন ভেদ করে বের হয়ে আসতেন এবং স্বামীর সাথে সাথে নিজের মূল্যবান মতামতও ব্যক্ত করতেন। আর এভাবেই ধীরে ধীরে তিনি জানবাজারের জমিদার প্রাসাদের রানি হয়ে ওঠেন।
রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদ করেছেন, তা সকলেই জানেন। তবে অনেকেই জানেন না, তাঁকে সর্বাত্মক সহায়তা করেছিলেন রাজা রাজচন্দ্র এবং রানি রাসমণি। আসলে রাসমণি ছোটবেলা থেকে মেয়েদের দুঃখ দুর্দশা দেখে বড় হয়েছেন। তাই তিনি মনে প্রাণে চাইতেন নারীরা দাসত্ব এবং ধর্মের নামে এঁটে দেয়া দুর্দশা থেকে মুক্তি পাক। এছাড়া রাজচন্দ্র অনেক মানবসেবামূলক কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। কলকাতায় দুটি স্নান ঘাট, নিমতলায় একটি বৃদ্ধাশ্রম এবং বন্যাপীড়িতদের জন্য খাদ্য ও নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করেছিলেন।
১৮২৩ সালের বন্যায় জানবাজারের প্রাসাদ থেকে গঙ্গার ঘাট পর্যন্ত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলে রাসমণি তাঁর স্বামীকে সরকারি অনুমোদন নিয়ে বাবু রোড (বর্তমান রানী রাসমণি রোড) এবং বাবু ঘাট তৈরির অনুরোধ করেন। আবার ১৮২৯ সালে কলকাতার সর্বপ্রথম ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠিত হয় রাজচন্দ্রের হাত ধরেই। এছাড়া রাসমণির পরামর্শে হিন্দু কলেজের ছাত্রদের অবৈতনিক পড়াশোনার দায়িত্ব নেন তিনি। কলকাতায় লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করতেও এই দম্পতি ১০ হাজার রুপি অনুদান দেন।
এভাবে সমাজসংস্কার এবং দাতব্য কাজের মধ্য দিয়ে এই প্রগতিশীল দম্পতির জীবন কাটছিল। এদিকে তাদের সংসারে চার কন্যা পদ্মমণি, কুমারী, করুণাময়ী এবং জগদম্বার জন্ম হয়। কিন্তু ৪৯ বছর বয়সে রাজচন্দ্রের আকস্মিক মৃত্যুতে রানি দিশেহারা হয়ে পড়েন। একদিকে ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে উদ্ভ্রান্ত রানি, অন্যদিকে জমিদারী কেড়ে নেবার পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র। এই পরিস্থিতিতে কোম্পানি এবং রানির পরিবারের বেশ কিছু সদস্য ভেবেছিল একা বিধবা নারী আর কী-ই বা করতে পারবে।
তবে যখনই তারা রানির অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে কীভাবে এই বিশাল সাম্রাজ্য হাতিয়ে নেওয়া যায় সেই প্যাঁচ কষছিল, তখনই রানি শোক ভুলে জমিদারীর হিসেবের খাতা হাতে তুলে নেন। এবং এ কাজে তিনি পাশে পান তাঁর বিশ্বস্ত সঙ্গী জামাতা মাথুরমোহন বিশ্বাস ওরফে মাথুর বাবু। প্রথমে মাথুরমোহনের সাথে করুণাময়ীর বিয়ে হয়। বিয়ের ২ বছরের মাথায় করুণাময়ী মৃত্যুবরণ করলে পুত্রসম মাথুরমোহনের সঙ্গে তাঁর সর্বকনিষ্ঠ কন্যা জগদম্বার সঙ্গে বিয়ে দেন রানি।
প্রসঙ্গত, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বিশাল জমিদারীর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবার পর ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে একজন স্বভাব নেত্রী এবং বিচক্ষণ ব্যবসায়ী হিসেবে তুলে ধরেন রানি। তবে এর পাশাপাশি তিনি এক সাহসী মহিলাও ছিলেন। যার প্রমাণ মেলে একাধিক ঘটনায়। ১৮৫৯ সালের কথা। তখন চাষিদের জোরপূর্বক নীল চাষ করাচ্ছিল নীলকরেরা। সাহেবদের অত্যাচারে বাংলার গ্রামে গ্রামে শুধুই সাধারণ মানুষের হাহাকার। এমনই এক সময়ে রানি জানতে পারলেন তার মাকিমপুর পরগণার চাষিদের ওপরও এমন নির্যাতন চালাচ্ছেন ইংরেজ নীলকর ডোনাল্ড।
ব্যাস, আর যায় কোথা। প্রজাদের বাঁচাতে এবং অত্যাচারী ডোনাল্ডের সৈন্যদের শায়েস্তা করতে ৫০ জনের একটি নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী পাঠান রানি। লাঠিয়ালরা মাকিমপুর পরগণায় পৌঁছানোর পর তাঁরা সংখ্যায় হয়ে গেলেন শ’খানেক। কারণ তাঁদের সঙ্গে তখন যোগ দিয়েছেন নির্যাতিত কৃষক জনতা। শেষে সকলে মিলে ডোনাল্ড এবং তার পেয়াদাদের পরগণা ছাড়া করেন তাঁরা। এভাবে সারা দেশজুড়ে শুরু হয় নীল বিদ্রোহ।
শুধু তাই নয়। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরফে মাছ ধরার ওপর কর আরোপ করা হলে, জেলেরা যখন সেই কর দিতে আপত্তি জানায় এবং এর ফলে পেয়াদা পাঠিয়ে তাঁদের ওপর নির্যাতন শুরু হয়, তখন রানী তাঁদের সান্ত্বনা দিয়ে ব্যাপারটা দেখছেন বলে আশ্বস্ত করেন। রানি জানতেন, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ করে জেতা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তাই এক্ষেত্রে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। সেটা হলো ব্যবসায়িক চাল কিংবা বুদ্ধির মারপ্যাঁচ।
এরপরই রানি কোম্পানির কাছ থেকে গঙ্গা থেকে ঘুসুড়ি হয়ে মেটিয়াবুরুজ পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার এলাকা ১০ হাজার রুপির বিনিময়ে ইজারা নেন। যেইমাত্র ইজারার দলিলাদি এবং কাগজপত্র রানির হাতে এসে পৌঁছালো, সেইমাত্র তিনি জেলেদের এক অভিনব হুকুম দেন। রানির হুকুমে রাতারাতি লোহার মোটা মোটা শিকল দিয়ে ইজারা নেওয়া অংশটুকু ঘিরে ফেলে জেলেদের শুধুমাত্র ওই ঘেরাওকৃত স্থানে মাছ ধরতে বলা হয়। এর ফলে পুরো এলাকার ঘাটগুলোতে সব ধরনের নৌ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আর কোম্পানির বড় বড় পণ্যবাহী জাহাজগুলোও আটকে যায়।
কলকাতার এক রানী কিনা ব্রিটিশরাজের সাথে টক্কর দিচ্ছে! এ খবর বারুদের বেগে ছড়িয়ে পড়ে গোটা শহরে। এহেন কাণ্ড এর আগে কলকাতাবাসী দেখেনি কখনো। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও ছুটে এলেন অভিনব সেই দৃশ্য অবলোকন করার জন্য। কিছু জেলে নৌকা মাছ ধরছিল আর কিছু নৌকা সেই বেষ্টনী পাহারা দিচ্ছিল। প্রতিশোধপ্রবণ ক্ষিপ্ত সেই জেলেরা আবার লোহার শিকলের সাথে নিজেদের দড়িও জুড়ে দিয়েছিল।
যথারীতি রানীকে সর্বোচ্চ আদালতে তলব করা হয় এবং সেইসাথে লোহার শিকলের বাঁধ অবিলম্বে খুলে দিতে আদেশ করা হয়। কিন্তু রানি তা করতে অসম্মতি জানিয়ে বলেন, তিনি ব্রিটিশরাজ থেকে ওই এলাকাটুকু ইজারা নিয়েছেন। নিজের ব্যবসায়িক ও প্রজা স্বার্থে তিনি যা ইচ্ছা তা করতে পারেন। তাছাড়া এমন কাজ করতে কোম্পানিই তাঁকে বাধ্য করেছে। এই বাঁধ তিনি তখনই উঠাবেন যখন তার প্রজাদের ওপর আরোপ করা কর উঠিয়ে নেওয়া হবে।
এরপরই রানির বুদ্ধিমত্তা এবং যুক্তির কাছে কোম্পানি মাথানত করতে বাধ্য হয়। এবং অবশেষে জেলেদের ওপর সকলপ্রকার কর উঠিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি রানিকে ইজারা বাবদ ১০ হাজার রুপি ফেরতও দেওয়া হয়। এমন দক্ষ হাতে জমিদারি সামলানোর পাশাপাশি রানি সমাজ সংস্কারক হিসেবেও অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। তখনকার যুগে বয়সের অনেক বেশি পার্থক্য রেখে বিয়ে দেওয়া হত। হামেশাই দেখা যেত, ৮-৯ বছর বয়সী শিশুর সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে মাঝবয়সী বিপত্নীক পুরুষ অথবা বৃদ্ধের।
এর ফলে স্বভাবতই অকাল বৈধব্য বরণ করতে হতো সেসব অভাগিনী মেয়েদের। রানী সিদ্ধান্ত নেন, এ ধরনের কুপ্রথা তিনি সমাজ থেকে দূর করেই ছাড়বেন। এরপরই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে রানি তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা পদ্মমণিকে তার চেয়ে ২ বছরের বড় এক কিশোরের সঙ্গে বিয়ে দেন। এছাড়া রাজা রামমোহন রায়ের সাথে সতীদাহ প্রথা রদে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বিধবা বিবাহ প্রচলনে আর্থিক সাহায্যও প্রদান করেছিলেন তিনি।
রানি প্রাত্যহিক গঙ্গা স্নানের সুবিধার্থে আহিরিটোলা ঘাট, বাবু ঘাট (স্বামী বাবু রাজচন্দ্র দাসের স্মরণার্থে), নিমতলা ঘাট নির্মাণ করেছিলেন। শবদাহ করার জন্য নিমতলা ঘাটে একটি বড় ছাউনি গড়ে দেন তিনি। তবে রানি সবচেয়ে বড় যে সমাজ সংস্কারটি করেছেন তা হিন্দুদের মধ্যে বিদ্যমান ধর্মীয় বৈষম্য দূরীকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কলকাতা থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণেশ্বরে এক জাঁকজমকপূর্ণ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি, যা আজও এই শহর তথা রাজ্যের অন্যতম পীঠস্থান।
রানি রাসমণি আদতে অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ছিলেন। তখনকার দিনে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা উপাসনালয় স্থাপনের নিয়ম ছিল না। সেখানে একজন নিম্নবর্ণের নারি, তিনি যতই ধর্মপ্রাণ হোন না কেন, তাঁর মন্দির নির্মাণ হিন্দু সমাজে রীতিমতো আন্দোলন বটে। কিংবা বলা যায়, উঁচু শ্রেণীর মানুষ অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের একধরনের যুদ্ধও বলা যায়। এই কালী মন্দির তৈরির পেছনে একটি গল্প রয়েছে।
রানি একবার বেনারসের এক তীর্থে যাবেন বলে স্থির করেন। কয়েকজন নিকটাত্মীয় এবং চলার পথের রসদ-সহ সকল প্রস্তুতি শেষ। কিন্তু যাত্রার আগের রাতেই মা কালী তাঁকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেন, ‘রানি কাশী যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই তুই এই গঙ্গা নদীর তীরে আমার মন্দির তৈরি করে পূজা কর আমি এখানে পূজা গ্ৰহন করব।’ এরপরই রানি তাঁর স্বপ্নের কথা সকলকে জানালেন এবং বিশ্বস্ত লোকদের মন্দির স্থাপনের জমি খুঁজতে বললেন। বিশেষত মাথুর বাবুকে।
অবশেষে, অনেক খোঁজাখুঁজির পর ১৮৪৭ সালে দক্ষিণেশ্বরে জেমস হেস্টির ২০ একরের জমিটি পাওয়া যায়। রানি তা আনুমানিক ৪২ হাজার ৫০০ রুপি অথবা ৫০ হাজার রুপি দিয়ে কেনেন। জমিটির ইতিহাস অসাম্প্রদায়িকতার এক অনন্য নিদর্শন। জমিটির এক অংশ পূর্বে এক ইউরোপিয়ানের খ্রিস্ট ধর্মালম্বীর ছিল, আরেক অংশে ছিল মুসলিম গোরস্থান। আর এখন বর্তমানে তা কালী মন্দির।
৮ বছর ধরে নির্মাণকাজ চলে মন্দিরটির। মূল মন্দরটি মা কালীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। উত্তরে রয়েছে রাধাকৃষ্ণ মন্দির আর দক্ষিণে নাটমন্দির এবং ১২টি ছোট মন্দিরের সমন্বয়ে দ্বাদশ শিবমন্দির। পুরো মন্দির কমপ্লেক্সটি তৈরি করতে তখনকার দিনে প্রায় ৯ লক্ষ ২৫ হাজার রুপি খরচ হয়েছিল। ১৮৫৫ সালের ৩১ মে মন্দির কমপ্লেক্সের নির্মাণকাজ শেষ হয়। মন্দির নির্মাণ শেষ কিন্তু পুরোহিত হবেন কে? আসলে একজন শূদ্র নারীর মন্দিরে কোনও ব্রাহ্মণই তখন পুরোহিত হতে রাজি হচ্ছিলেন না। কিন্তু রানি রাসমণিও দমে যাওয়ার পাত্রী নন।
তিনি তৎকালীন নামজাদা অনেক পণ্ডিতকে চিঠি লিখতে শুরু করেন। প্রায় সবার কাছ থেকে যখন হতাশাজনক উত্তর পাচ্ছিলেন তখন রামকুমার চট্টোপাধ্যায় নামক এক ব্রাহ্মণ রানিকে আশার আলো দেখালেন। রামকুমার নিদান দেব, রানির মন্দিরে উপাসনা করা তখনই সম্ভব যখন তিনি মন্দিরটি কোনও ব্রাহ্মণকে উপহার হিসেবে দেবেন এবং মন্দির পরিচালনার জন্য একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ ধার্য করে তা পুরোহিতের হাতে তুলে দেবেন।
রানি আর দেরি না করে মন্দিরের পুরোহিতের দায়িত্ব রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দেন। আর দিনাজপুরের জমিদারি থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ধার্য করেন। তারপরই রামকুমার তার ছোট ভাই গদাধর বা গদাইকে নিয়ে দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দিরে এসে উপস্থিত হন। রামকুমার প্রধান পুরোহিত আর গদাধরকে মা কালীর সাজসজ্জা ও মন্দির সংক্রান্ত ছোটখাটো কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
রানি লক্ষ্য করেন, গদাই ছেলেটি সর্বদাই অন্য এক জগতে বিচরণ করেন। সবসময় মা কালীর চিন্তায় ডুবে থাকেন। যার ফলে লোকে তাকে পাগল বলে। কিন্তু রাসমণির ধার্মিক হৃদয় বুঝতে পেরেছিল, গদাই মোটেই আর পাঁচটা ছেলের মতো সাধারণ নন। রামকুমারের মৃত্যুর পর তাই মাতৃভক্ত গদাইকেই রানি মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের দায়িত্ব দেন এবং তাঁকে নিজের ইচ্ছামতো মা কালীর সেবা ও প্রার্থনা করার অনুমতি দেন।
তারপর থেকে গদাই তাঁর জীবনের ৩০ বছর কাটান এই মন্দিরে। এবং হয়ে উঠেন হিন্দু ধর্মের অন্যতম ধর্মাবতার ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব। আবার এই মন্দিরেউ রামকৃষ্ণের হাত ধরে স্বামী বিবেকানন্দ সন্ন্যাস লাভ করেন। বলা হয়ে থাকে, নিম্নবর্ণের শূদ্র সেই রানী যদি দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দির তৈরি না করতেন, তাহলে গদাই কখনও শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস হতে পারতেন না, আর ভারতবর্ষও স্বামী বিবেকানন্দকেও পেত না।
মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত রানি রাসমণি সর্বদাই মা ভবতারিণীর পুজো এবং ভজন সাধন করে দিন কাটাতেন। অবশেষে ১৮৬১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তাঁর কালীঘাটের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুর পরে তাঁর মৃতদেহ কেওড়াতলা মহাশ্মশানে, চন্দনকাঠে দাহ করা হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। জীবিতকালে অত্যন্ত প্রজাবৎসল হওয়ার কারণে এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষের প্রতি তাঁর দয়া-মায়ার জন্য আজও তিনি সকলের কাছে ‘লোকমাতা’ নামে পরিচিত।