যুবক বয়সে দেখতাম দেশের বুদ্ধিজীবীরা প্রবল শক্তিধর শাসকদের বিরুদ্ধে এক হয়ে প্রতিবাদ করছেন। জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়, গৌরকিশোর ঘোষ, অম্লান দত্তদের মত মানুষ। এনকাউন্টারের নামে নির্বিচারে পুলিশের নকশাল নিধনের বিরুদ্ধেও একত্রে সরব হয়েছিলেন বাংলার বুদ্ধিজীবীরা। সমাজ সচেতন এগিয়ে থাকা মানুষের নির্ভয় সামাজিক দায়িত্ব পালনের উদাহরণ মানুষ মনে রেখেছেন। কিন্তু এখন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বুদ্ধিজীবীদের সেই ঐক্য আর দেখিনা। এখন তারা লাভ-ক্ষতি, প্রাপ্তিযোগ, সময়, নিরাপত্তা এসব হিসেব করে প্রতিবাদ করেন অথবা বিরোধী অবস্থান নেন। সম্প্রতি ৪৯ বনাম ৬২-র লড়াইয়ে এই সত্যটা আবার সামনে এল।
৪৯ মানে বিজেপির ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের প্রতিবাদ করা আদুর গোপালকৃষ্ণন, অপর্ণা সেন, শ্যাম বেনেগাল ও মনিরত্নম সহ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা। এর পাল্টা দিয়েছেন প্রসূন যোশী, স্বপন দাশগুপ্ত, মধুর ভান্ডারকার সহ ৬২ জন বুদ্ধিজীবী। অবশ্য বুদ্ধিজীবী কে নন সেটা ঠিক করা এখন বেশ মুশকিল। কারণ ৬২ জনের তালিকায় পার্ণো মিত্র, কল্যাণ চৌবে সহ এমন কয়েকজনের নাম দেখলাম তারা কবে বুদ্ধিজীবী হলেন তা আমার জানা ছিলনা!
সঠিক বেঠিক বা সত্য মিথ্যা নয়, এখন রাজনৈতিক অবস্থান ঠিক করে দিচ্ছে আমি কার পক্ষে সরব হবো আর ক্ষেত্রে থাকবো নীরব। রাজনীতি অনুযায়ী লাল, সবুজ, গেরুয়া নানা রঙে ভাগ হয়ে গেছেন আজকের বুদ্ধিজীবীরা। নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ ও রাজনৈতিক সুবিধা দেখাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। যার জন্যই রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের আমলের বুদ্ধিজীবীদের মত তারা সমাজের কোন ন্যায়সঙ্গত ইস্যুতে একমত হন না। দলিত মানুষদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে, ভারভারা রাওদের মত বুদ্ধিজীবীদের জেলে বিনা বিচারে আটক করা হচ্ছে, আদিবাসীদের জল, জমি, জঙ্গল লুঠ হচ্ছে এসব প্রশ্নে কিন্তু তারা নীরব! তাদের উৎসাহ শুধু একটু ক্ষমতা, খানিকটা সুবিধা, অনেকটা উপার্জন বাড়ানোর রাজনৈতিক অঙ্কে।
এমন বুদ্ধিজীবীদের আমাদের দরকার নেই। এদের কোন বিবৃতিতে বা মন্তব্যে আমার কোন উৎসাহ নেই কারণ, এরা যা বলেন তা বিশ্বাস করেন না, আর যা বিশ্বাস করেন তা বলেন না। সত্যি বলতে কী এদের কেউই আমাদের আগের বুদ্ধিজীবীদের মত সত্যদ্রষ্টা নন। এদের কারোরই ব্যক্তিগত লাভ ক্ষতির ভয় না করে শাসকদের মুখের ওপর সত্যি কথা বলার সাহস নেই। এদের দক্ষতা শুধু ব্যক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধির জন্য শাসকদের তৈলমর্দনে।
কৃষক, শ্রমিক, ডাক্তার, খেলোয়াড়, বিনোদন কর্মী প্রত্যেকেরই একটা নির্দিষ্ট সামাজিক ভূমিকা রয়েছে। এরা সবাই একটা নির্দিষ্ট সামাজিক দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু আজকের বুদ্ধিজীবীরা কী করেন? আমি জানি একথা বলা মাত্র অনেকেই আমাকে তেড়ে মারতে আসবেন। তারা বলবেন, কেন এরা আমাদের ভাল মন্দের বোধ গড়ে দেন, চিন্তা ভাবনাকে সমৃদ্ধ করেন, পথ দেখান, সাহস যোগান, নিজেরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। আমি বলবো করেন নয়, একদা করতেন। এখন এরা নিজেদের কোলে ঝোল টানা ছাড়া আর কিছুই করেন না। এমন বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে সঙ্গত কারণেই মানুষের কোন উৎসাহ নেই। তা তারা ৪৯ বা ৬২ যে দলেই থাকুন না কেন।
এদের ব্যাপারে আমরা একটাই কাজ করতে পারি তা হল এদের একেবারে পাত্তা না দেওয়া। আমি বরাবর একটু বেশি রকম তরুণদের সমর্থক। তারা কিন্তু এসব বুদ্ধিজীবী নামধারী মানুষদের মোটেই পাত্তা দেন না, এমনকি আশেপাশে ঘেঁষেনও না। বুদ্ধিজীবীরাও এদের ব্যাপারে দলমত নির্বিশেষে হিংস্র। তাদের মতে, এরা নাচ-গান-সাহিত্য-শিল্প-ছবি-রাজনীতি কিছুই বোঝে না, এরা স্বার্থপর। তরুণদের তাতে কিছুই যায় আসে না। কারণ তারা জানে নিজেদের প্রয়োজনে এরা যে কোন সময়ে তাদের পায়ে পড়তে পারেন।
আজ লাল, কাল সবুজ, পরশু গেরুয়া এমন গিরগিটির মত রঙ পাল্টানো মেকি বুদ্ধিজীবীদের আমাদের দরকার নেই, আমাদের এখন সবচাইতে বেশি দরকার শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, ডাক্তারদের মত সমাজ সচেতন পেশাদার মানুষ। এরাই দেশ গড়েন, তৈরি করেন মানুষ। টিভির সামনে সন্ধ্যা নামলেই রঙ মেখে বসে পড়া বাকসর্বস্ব ও নিষ্কর্মা বুদ্ধিজীবীদের আমাদের কোন দরকার নেই।
আসুন, আমরা এই হাস্যকর ‘বুদ্ধিজীবী’ বাতিক থেকে মুক্ত হই।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত